আকাশের রঙ ফ্যাকাশে
আকাশের রঙ ফ্যাকাশে
নবতিতম অধ্যায়
পুলিশ মহলে আলোড়ন পড়ে গেছে । ত্রিলোকেশ্বর রক্ষিত গুলি খেয়েও মরেননি । কোমায় চলে গেছেন ঠিকই, একদিন কোমা থেকে জেগে উঠলে যে বিস্ফোরণ হবে তা এই ধরণী নিতে পারবে তো !
কমিশনার থেকে এস ডি পি ও বারাসত সকলে ভীষণ চিন্তিত । একটি বেসরকারি হাসপাতালে তাঁর চিকিৎসা চলছে । কেন্দ্রীয় বাহিনী হাসপাতালে মোতায়েন রয়েছে। পুলিশের সেখানে নো এন্ট্রি ।
ডক্টর এস কে ভরদ্বাজের নেতৃত্বে দশ সদস্যের একটি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে কেন্দ্র সরকারের নির্দেশে। তাদের প্রার্থীর এই খুন হয়ে যাওয়া সরকার মেনে নিতে পারছে না । অবস্থার কিছু উন্নতি হলে তাঁকে এইমসে স্থানান্তর করা যায় কি না সে নিয়েও চিন্তা ভাবনা চলছে ।
রাজ্যের প্রাক্তন শাসকদল ত্রিলোকেশ্বরের চৌদ্দ গুষ্টির শ্রাদ্ধ করে চলেছে । বিরুদ্ধ পক্ষ কি না ! এক্জিট পোলের হিসাব অনুযায়ী তাঁর নাকি জেতার সম্ভাবনা প্রবল ছিল । যাই হোক যুযুধান দলগুলো নিজ নিজ প্রার্থীর সমর্থনে চিল-চিৎকার জুড়ে দিয়েছে ।
এই পরিস্থিতিতে লালবাজারে ঘন ঘন বৈঠক হচ্ছে । কেন্দ্রের শাসকদল ঘনঘন পূজাপাঠ, হোম ইত্যাদি নিত্যনৈমিত্তিক রূপে করে যাচ্ছে ।
উৎসব রায়চৌধুরীও মিঃ মুখার্জীকে বললেন - আমিও ওই ধরণের হোমের আয়োজন করতে চাই । দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে ওরা করছে করুক ; আমরা কালীঘাট মন্দিরে এই হোম করব ।
মিঃ মুখার্জী বললেন - আপনার মাথা ঘুরে গেছে মনে হচ্ছে । আপনি এখন কিছুদিন বিশ্রাম নিন স্যার ।
- আমার মাথা ঘুরায়নি মিঃ মুখার্জী! মাথা তো ঘুরছে পুলিশের । আপনারা অহেতুক ভয় পাচ্ছেন । একটা আম-অপরাধী সে মরল না বাঁচল তা' নিয়ে আপনারাও কম জল ঘোলা করছেন না । সেইজন্যই আমি ঠিক করেছি কালীঘাট মন্দিরে হোম যজ্ঞ করে আপনাদের মাথার ব্যামো সারিয়ে তুলি । কারণ পুলিশের মাথাব্যথা মাইই দূর করতে পারেন । আপনারা সবাই আসবেন কিন্তু মায়ের মন্দিরে প্রসাদ নিতে ।
একনাগাড়ে কথাগুলো বলে ক্ষান্ত হলেন বড়দা । ভয় তো আমারও হচ্ছে : তা' বলে সেঁধিয়ে যেতে হবে !
মিঃ মুখার্জী বললেন - আসল কথাটা বলুন তো সাহেব ।
ওঁকে নিয়ে কি ভাবছেন ?
- কিচ্ছু না । চিকিৎসা চলছে চলুক । দেখুন কি রেজাল্ট আসে । মরার আগেই মরবেন কেন ?
এবার কমিশনার সাহেব বললেন - আমাদের তো হাসপাতালে যেতে দিচ্ছে না !
- এ কেমন কথা স্যার যে দিচ্ছে না বললেই হবে ? কাউকে দিয়ে আদালত থেকে অনুমতি নিয়ে আসুন । পুলিশ তো অপরাধী নয় যে সেখানে গেলে অক্সিজেন নাক থেকে খুলে দেবে !
- এটা তো ভাবিনি । ভেবেছিলাম পুলিশের গতি রোধ করতে পারবে না । কিন্তু ফল হল উল্টো । জোয়ানরা রে রে করে তেড়ে আসছে ।
বড়দা বললেন - সত্যচরণ ঘোষালের কেসটা কি রি-ওপেন করা যাবে ?
- দ্যাট কেস ইজ স্টিল ইন প্রসেস ।
- এই তো স্যার আপনাদের কাজের নমুনা। একজন ব্যারিস্টারকে দিনে দুপুরে প্রকাশ্যে খুন করা হল ; পুলিশ হাত গুটিয়ে বসে রইল ?
- কি করা যায় বলুন ! ত্রিলোকেশ্বরকে তো এরেস্ট করা সম্ভব হয়নি !
- তো এখন করুন ।
- এখন ? হা হা হা ! মিঃ রায়চৌধুরী! মুখুজ্যে ঠিকই বলেছে আপনার মাথাটা গেছে । এই অবস্থায় এরেস্ট করা যায় নাকি ?
- শুনুন স্যার, ঘোষালের কেস নিয়ে নতুন করে চার্জশীট ইস্যু করুন । একমাত্র দায়ী করুন ত্রিলোকেশ্বরকে । আদালতে কেস ফাইল করে তাঁর রিমাণ্ড চান ।
- চাইলেই কি আদালত তা মঞ্জুর করবে ?
- করেই দেখুন না । কিছু তো পথ দেখিয়ে দেবে । সেই সুযোগ নিয়ে হাসপাতালে ঢুকে চিকিৎসকদের বোঝান; প্রয়োজন পড়লে ভয় দেখান । হাসপাতাল যেহেতু এ রাজ্যে ব্যবসা করছে সেহেতু তাদেরও কিছু বাধ্যবাধকতা
আছে রাজ্যের কল্যাণের জন্য ।
- আপনি সাহেব একদিন আমার অফিসে আসুন দেখি । ভালো করে আলোচনা করি । ফোনে এত বলা যায় না ।
- সে না হয় যেতে পারি । তবে আমি বলব আরও কিছুদিন দেখুন। রোগীর অবস্থা কেমন আছে এখন ?
- শুনছি যাই যাই করছে । মেডিকেল বুলেটিন তো তাই বলছে ।
- আপনি স্যার ওই চিকিৎসক দলের নেতৃত্ব ডক্টর ভরদ্বাজের ফোন নং আমাকে জোগাড় করে দিন । দেখি আমি মিঃ রক্ষিতকে দেখে আসতে পারি কি না ।
কমিশনার বললেন - আমি আজই ব্যবস্থা করছি ।
আমি বললাম - বড়দা কি আবার কলকাতা যাবেন ?
বললেন - যেতেই হবে । বউমা, রূপা, বুকুন, সুনেত্রা এদেরও নিয়ে যাব ।
- আমি যাব না ?
- তুই বাড়ীতে থাকতে পারবি না ? আচ্ছা বেশ, তুইও যাবি।
বড়দা হঠাৎ সবাইকে কেন নিয়ে যাচ্ছেন বুঝলাম না । তবে এটা খুব ভালো জানি তিনি অকারণে কিছু সিদ্ধান্ত নেন না ।
বড়দা পেয়ে গেলেন ডক্টর ভরদ্বাজের ফোন নং। ফোন করে নিজের এবং আমাদের সকলের পরিচয় দিয়ে বললেন - ওঁর পরিবার ওঁকে চোখের দেখা দেখতে চাইছেন, আপনি কি অনুমতি দেবেন? দেখুন আমি 'র" এর প্রাক্তন গোয়েন্দা এবং ত্রিলোকেশ্বর রক্ষিত আমার ছোট ভাইয়ের শ্বশুর হন ।
ডক্টর ভরদ্বাজ বললেন - উনি এখন স্থিতিশীল । আপনারা আসতে পারেন । তবে একজন করে দেখে যাবেন । একসাথে সবাই মিলে নয় ।
বড়দা রাজী হলেন এবং আমাদের বিশেষ করে গোপা ও রূপাকে বুঝিয়ে বললেন এর চেয়ে বড় সুযোগ আর আসবে না । যদি মনে কর ওঁকে মেরে ফেলা ভালো হবে তবে সে ব্যবস্থাও করে দেব । আর যদি মায়া দয়া দেখিয়ে ছেড়ে দিতে চাও তবে আমাদের ভবিষ্যৎ বিপজ্জনক হয়ে পড়বে ।
গোপা ও রূপা দুজনই সম্মত হল ওর মত মানুষ না থাকাই ভালো , আর ওর সঙ্গে আমাদের যেহেতু কোন সম্পর্ক নেই আমরা আপাত্রে করুণা দেখাতে যাব কেন ?
আমি বললাম - তাহলে কালই যাওয়া যাক ।
বড়দা বললেন - ঠিক । সুনেত্রা এসে বলল - মা ! তাহলে শিউলিদির খবরটাও নিয়ে নেব ।
বলে শিউলিকে ফোন করতে কিছুটা আড়ালে সরে গেল ।
আমরা কলকাতা যাবার জন্য তৈয়ারী শুরু করে দিলাম ।
বড়দা কমিশনার সাহেবকে ফোন করে জানালেন যে কাল আমরা ত্রিলোকেশ্বরকে দেখতে হাসপাতালে যাচ্ছি । ব্যাপারটা সত্যি না মিথ্যে জানতে হবে তো !
- আমার শুভ কামনা রইল মিঃ রায়চৌধুরী। আশা করি আপনার সন্দেহ দূর হবে ।
বড়দা বললেন - আমার সন্দেহ শুধু একটি জায়গায় । জানেন স্যার আজকাল বাজারে যে মাছগুলো আমরা টাটকা মাছ ভেবে কিনে থাকি ; ওগুলোতে যথেষ্ট পরিমাণে ফর্মালিন দেওয়া থাকে, ফলে মাছ যেমনকার তেমনই থেকে যায় ।
- তার মানে আপনি বলতে চাইছেন মিঃ রক্ষিতের দেহেও তেমনই কোন রাসায়নিক প্রয়োগ করে ভেন্টিলেশনে রাখা হয়েছে ?
- ঠিক তেমনটা নাও হতে পারে , তবু একবার যাচাই করতে দোষ কোথায় ? রাজ্যের শাসক দল যেমন দুর্নীতিপরায়ণ , কেন্দ্রে যারা শাসনে আছেন তাঁরাও তো রাজনৈতিক ক্ষেত্রের লোক । পাল্টা চাল দিয়ে তেমন করতেই পারেন।
- কিন্তু ডাক্তারবাবুরা কি তা' মেনে নেবেন ?
- হয়তো তাই। বাধ্যবাধকতাও তো থাকতেই পারে । হাসপাতালটি বেসরকারি । সুতরাং কোন কিছুই অসম্ভব নয় ।
কমিশনার সাহেব ভাবতে লাগলেন। বললেন - ঠিক আছে , আসুন । আর আমার সঙ্গে অবশ্যই দেখা করে যাবেন ।
সেদিনই রাতের বেলায় একটি নিউজ চ্যানেলের অফিসে উড়োফোন এল । যে বেসরকারি হাসপাতালে ত্রিলোকেশ্বর রক্ষিতকে ভেন্টিলেশনে রাখা হয়েছে , তাঁর সেদিনই মৃত্যু হয়েছে । শুধু অসন্তোষ চাপা দিতে ছলনা করে দেহটি বেসরকারি হাসপাতালকে টাকা খাইয়ে ভেন্টিলেশনে রাখা হয়েছে ।
চ্যানেলটি উড়োফোনের কথা স্বীকার করে নিয়ে ব্রেকিং নিউজ ছড়িয়ে দিতেই হাসপাতালে সাংবাদিকদের ভীড় জমে গেল । কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন থাকলেও তারা ভীড় সামলাতে হিমসিম খেয়ে গেল । বাধ্য হয়ে বাহিনীর ভারপ্রাপ্ত অধিকর্তা পুলিশের শরণাপন্ন হল ।
( চলবে )