আকাশের রঙ ফ্যাকাশে
আকাশের রঙ ফ্যাকাশে
অষ্টাশীতিতম অধ্যায়
ধর্মতলা থেকে বর্ধমান মাত্র দু'ঘন্টার পথ । শক্তিগড় ছাড়া কোথাও স্টপেজ নেই । শক্তিগড়েই দেখলাম টিভিতে নিউজ চ্যানেলগুলো ব্রেকিং নিউজ দিচ্ছে । শিয়ালদা বিধিনসভার প্রার্থী খুন । সঙ্গে আরও তিনজনকে মৃত অবস্থায় পুলিশ উদ্ধার করে দেহ ময়না তদন্তের জন্য পাঠিয়েছে।
ইলেকশন কমিশন শিয়ালদা বিধিনসভার নির্বাচন বাতিল করেছে ।
আমরা ভেবে পেলাম না রাজপথে ঐ নিয়ে মিটিং মিছিল হল না কেন ? বড়দা বললেন - জম্পেশ আইডিয়াটা বের করেছিলি ভাই ! দুষ্কৃতীর হাতে মারা গেছে বলে কেউ তেমন প্রতিক্রিয়া দিতে পারছে না । এমনকি রাজনৈতিক মহলও একটু বেশীই যেন চুপচাপ ।
বাড়ীতে সুনেত্রাকে নিয়ে আর কোন অশান্তি হচ্ছে না । সকলে চুপ করে গেছে । এমনকি গোপা ও রূপাও যেন স্বস্তি পেয়েছে ।
বুকুন এসে আমার কানে কানে বলল - আইডিয়াটা যেমন দুর্দান্ত ; একশনও অনুরূপ চমৎকার । তবে দু দুটো গুণ্ডার একজন হয়তো অন্য গূণ্ডা মারল কিন্তু ওকে কে মারল ?
আপনি না জেঠুমণি ?
আমি যেন কিছু শুনতে পাইনি । বললাম - গুণ্ডাদের কথা গুণ্ডারাই জানে , আমি কি বলব। !
- আমার কেমন সন্দেহ হচ্ছে । আপনারা গতকাল কলকাতা গেলেন ; আজ ফিরেও এলেন - মাঝের সময়টা লাইফ সার্টিফিকেট জমা দিতে চলে গেল ! তবে কি জেঠুমণি?
আমি ওকে ' পরে বলব ' বলে তখনকার মত নিরস্ত করলাম। কারণ রূপা ও গোপা জল শরবৎ চা দেবার নামে ঘনঘন যাতায়াত করছে ।
বড়দা বললেন - বুকুন ! তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে ; একবার এদিকে এস তো !
আমাকে ছেড়ে বুকুন গেল বড়দার কাছে । নিশ্চয় সুনেত্রাকে নিয়ে কিছু বলবেন । বুকুন বড়দাকে বলল - কোন চিন্তা নেই জেঠুমণি! এখানে সব ঠিক আছে । সুনেত্রা ইজ নরমাল নাউ ।
- যাক বাবা । ভালো লাগল।
রাতে ডিনার টেবিলে বসে রূপা বলল - অপঘাতে মৃত্যু হলে কি তিনদিনে অশৌচ শেষ হয় ?
বড়দা এবং আমি পরস্পরের দিকে চাইলাম । বড়দা বললেন - চক্রবর্তীকাকাকে কাল ডেকে পাঠাব । দেখি কি বিধান দেন !
গোপা বলল - আমি ওসব কালাশৌচ নিয়ে ভাবছিই না । আমি ভাবছি ...
আবার আমাদের চোখাচোখি করতে হল ।
বড়দা বললেন - বল বউমা ! কি ভাবছ ?
আমার এবং বড়দার দুজনের আশঙ্কাকে অমূলক প্রতিপন্ন করে গোপা বলল - ত্রিলোকেশ্বর রক্ষিত যে যমের অরুচি আবার তা প্রমাণ হয়ে গেল ।
বড়দা এবং আমি দুজনেই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম । এবারও রক্ষকের ভূমিকায় বড়দা অবতীর্ণ হয়ে বললেন - মিঃ রক্ষিত মরেননি - তাই তো ?
গোপা বলল - নিউজে তো তাই বলছে । প্রথমে হসপিটালে নিয়ে গিয়ে চেক করতে গিয়ে ডাক্তারবাবু নাকি বলেছেন - হি ইজ স্টিল এলিভ ।
বড়দা ভাবিত না হলেও আমি ভয়ে এবং আশঙ্কায় অস্থির হয়ে উঠলাম । কি হবে এবার ? তিনি যদি বেঁচে যান তাহলে আমাদের সব কীর্তি ফাঁস করে দেবেন । তাও মেনে নেওয়া যায় ; কিন্তু পরিবারের কাছে আমরা যে খুব ছোট হয়ে যাব - এই চিন্তায় খাওয়াদাওয়া মাথায় উঠল ।
আমি বললাম - আমার গা-টা কেমন গুলোচ্ছে। খাওয়াতে রুচি হচ্ছে না ।
গোপা বলল - বুঝতে পেরেছি - 'কেন '! ঠিক আছে হাত মুখ ধুয়ে শুয়ে পড় । আমি লেবুজল এনে দিচ্ছি , খেলে উপকার পাবে ।
পেটে ক্ষিধে নিয়েও উঠে যেতে হল । বড়দা কিন্তু দিব্যি খেয়ে গেলেন । বুকুন শুধু আধ-খাওয়া করে আমার পিছু পিছু উপরে উঠে এল । বলল - আপনার শরীর কি খুবই খারাপ লাগছে ?
বললাম - তুমি আবার খাওয়া ছেড়ে উঠে এলে কেন ? গোপা লেবুর জল আনছে এখনই ঠিক হয়ে যাবে ।
- না তা বলছি না । ডাক্তার ডেকে দেব কি ?
- একদম না । তুমি অত ব্যস্ত হয়ো না তো !
বড়দা এসে নাড়ী টিপে দেখলেন । আমি হেসে ফেললাম।
- গোয়েন্দাগিরি ছেড়ে এবার কি ডাক্তারি করবেন ?
বড়দা গম্ভীর মুখে বললেন - নাড়ী না টিপেও ডাক্তার কিন্তু ছোট রক্ষিতকে জীবিত ঘোষণা করে দিয়েছেন, বুঝলি ।
আমি তাঁর উৎকন্ঠার কথা অনুধাবন করলাম । সাধারণত পাল্স বা হার্টের ক্রিয়া বন্ধ হবার পরও মানুষের ব্রেণডেথ হতে কমপক্ষে দশ মিনিট সময় লাগে । ওই দশটা মিনিট মানে নরক যন্ত্রণা । রোগী স্মৃতির জগতে বিচরণ করে । এ জন্যই বলে স্বর্গ বা নরক সবই এখানে । যাই হোক ছোট রক্ষিতের ব্রেণ ডেথ চার পাঁচ ঘন্টার পরও হয়নি যখন তখন তিনি জীবিতই আছেন বলা যায় । তবে তা' একরকম অম্ভব । সেলিম তো ওর কপালে গুলি করেছে তাহলে কি ভাবে তাঁর বেঁচে যাওয়া সম্ভব !
বড়দা বললেন - গুলি কপালে নয় ; লেগেছে গর্দানে । তাই হয়তো তিনি কোমায় চলে গেছেন । এখন তো শুনছি ভেন্টিলেশনে আছেন ।
রূপা বলল - তাহলে তো কালাশৌচের প্রশ্ন নেই, জামাইবু ।
বড়দা বললেন - কোনদিন সে প্রশ্ন উঠবে না ।
গোপা বলল - মানে ? আপনি কি বলতে চান , বড়দা ?
- আগে ভাইকে কিছু খেতে দাও । খেয়েদেয়ে সুস্থ হোক । তারপর সবাইকে নিয়ে বসব সেই কারণ খুঁজতে ।
এবার রূপা এক বাটি পায়েস আর দু'টো রাজভোগ এনে মুখের সামনে ধরল ।
- এই মাত্র লেবু দেওয়া জল খেয়েছি । এখন পায়েস খেলে তো কেটে যাবে !
একটু মশকরা করে বললাম ।
- এত বড় কাজ করে এলেন । সারাদিন তো খাওয়া দাওয়া জোটেনি নিশ্চয় ! ওই জন্যই তো গা' গুলোচ্ছিল । নিন এবার এটুকু খেয়ে সুস্থ হোন ।
রূপার কথায় ধমকের সুর । আমার বুকে যেন হাতুড়ি পিটতে লাগল । বুদ্ধিমতি মহিলা - গোপা এবং রূপা - দু'জনই ।
বললাম - বড়দাকে শুধিয়ে নাও কি কি খেয়েছি সারাদিন । আমার কথা তো বিশ্বাস করবে না !
গোপা বলল - থাক, আর সাফাই দিতে হবে না । ও সুনেত্রা, তোর মেসোমশাইকে এক গ্লাস ঠাণ্ডা জল এনে দে তো !
সুনেত্রা জল এনে উপস্থিত । তখন আমার ভীষণ টয়লেট পেয়েছে । জল খাব কি, বের করতে বাথরুমে দৌড়ালাম । তা' দেখে সবাই হাসাহাসি করতে লাগল ।
বড়দা বললেন - বউমা! রূপা মা ! তোমাদের যে কথা বলব বলেছিলাম , তা' হল ...
বুকুন নড়েচড়ে বসল , সুনেত্রা বড়দার পায়ের তলায় এবং গোপা ও রূপা আমার শয্যা দখল করে বসে পড়ল । আমি টয়লেট থেকে ফিরে দাঁড়িয়ে রইলাম । বড়দা বললেন - কি রে ভাই ! আমি বলব না তুই ?
আমি বললাম - আপনিই বলুন । আমি বললে তো বলবে সব বানিয়ে বানিয়ে বলছে ।
আসলে আমাদের উদ্দেশ্য ছিল ওদের মনে কৌতূহল জাগানো ; এমন ভাবে সত্য ঘটনাকে প্রকাশ করা যাতে ওদের মনে যুগপৎ বিস্ময় ,ভয়, ভাবনা , এবং ত্রিলোকেশ্বরের প্রতি ঘৃণা জন্মায় ।
বড়দা শুরু করলেন । ত্রৈম্বকেশ্বর রক্ষিত - মানে বউমা ! রূপা মা ! তিনি তোমাদের ঠাকুরদা উপার্জন তেমন করতে পারেননি ।
রূপা বলল - জানি দাদা । তখন ওঁরা খুব গরীব ছিলেন । বাড়ীটা ছিল অতি সস্তার এক কামরার বাড়ী ।
- সে তো তারও আগের কথা বলছ রূপা মা ! আমি অতদূরে যাচ্ছি না । কারণ তখন ত্রৈম্বকেশ্বর রক্ষিত ছিলেন সদাচারী ব্রাহ্মণ । রাণীমার পূজারীদের মধ্যে একজন ।
গোপা বলল - এই রূপা ! কথার মাঝে কথা বলবি না ।
সুনেত্রা বলল - ঠিকই তো ! গল্প শুনতে আমার আর তর সইছে না । আপনি বলুন বড় মেসোমশাই ।
( চলবে )