Jeet Guha Thakurta

Classics Fantasy Thriller

5.0  

Jeet Guha Thakurta

Classics Fantasy Thriller

আজগুবি

আজগুবি

6 mins
887


মাঝে মাঝেই এমন হয় যে আমি অনুভব করি কোনো অদৃশ্য ব্যক্তি যেন আমার সঙ্গে রয়েছে। আমার সঙ্গে কথা বলছে।

একদিন বাজারে আলু কিনছি। পটাপট আলু তুলছি ঝুড়িতে। হঠাৎ কেউ যেন পাশ থেকে সতর্ক করলো আমাকে, "ওই আলুটাতে দাগ আছে, খারাপ মনে হয়।" আমি হাতের আলুটা ঘুরিয়ে দেখি ঠিক তো, একটা জায়গায় কাটা আছে, কালো মতোন দাগ। আমি সেটা রেখে দিয়ে ঘুরে তাকিয়ে দেখি কেউ নেই। যাব্বাবা ! আমি দোকানদারের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, নিবিষ্টমনে তিনি কাগজে কী একটা হিসাব কষছেন।

আরেকদিন ওইরকম টীশার্ট কিনছি একটা মলে। একটা টীশার্ট পছন্দও হয়েছে। হঠাৎ পাশ থেকে কার গলা পেলাম, "দামটা কত দেখে নাও। খুব দামী না হয়।" আমি ট্যাগটা দেখে বললাম, "বেশি না, ৩০০ টাকা - ঠিকই আছে।" মুহূর্তেই সম্বিৎ ফিরে পেয়ে এদিক ওদিক তাকালাম। কে বললো কথাটা ? কেউ তো নেই আমার সামনে। যাইহোক, শার্টটা কাউন্টারে গিয়ে দিতেই সেলসম্যান চেক করে বললো যে ভুল করে অন্য শার্টের ট্যাগ এটার গায়ে লেগে গেছে, সরি স্যার, এটা সাড়ে আটশো টাকা। লে হালুয়া! আমি রেখে দিয়ে সোজা চলে এলাম।

আস্তে আস্তে এরকম হলো যে কোনো কাজ করার সময় অজান্তেই আমি যেন অপেক্ষা করি সেই কণ্ঠস্বরের। এই বুঝি কিছু বললো। কিছু সতর্ক করলো। লোকে বলে আমি নাকি অন্যমনস্ক থাকছি বড্ডো আজকাল। কিন্তু একথাটা কাউকে বুঝিয়ে বলি কীকরে! পাগল ভাববে তো সবাই।

দেখে দেখে একদিন ডাক্তারের কাছেও গেলাম। ভাবলাম যদি কোনো রোগব্যাধিই হয়ে থাকে। এমনি চেনা ডাক্তার। আমার কথা শুনে প্রেশার মাপতে মাপতে জিজ্ঞাসা করলেন, কেমন কণ্ঠ - পুরুষ না মহিলার ?

ভেবে বললাম, পুরুষই মনে হয়। কেমন ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলা। যান্ত্রিক যান্ত্রিক।

ডাক্তার আমাকে একটা ঘুমের ওষুধ দিলেন। আর কোনোকিছু নিয়ে বেশি টেনশান করতে বারণ করলেন। বললেন, আপনি মনে মনে যা কল্পনা করছেন, সেটাই বাস্তবে শুনছেন বলে আপনার মনে হচ্ছে।

খেয়েছিলাম সেই ওষুধ কয়েকদিন। কিন্তু তাতে এতো ঘুম পায়, সারাদিন ঘুম-ঘুম ভাব, কাজ করবো কীকরে ? তাছাড়া ওতে আমার ব্যামো কিছুই সারেনি। কীভাবে যেন গা-সওয়া হয়ে যাচ্ছিলো আমার সাথে সেই অদৃশ্য ব্যক্তির উপস্থিতি। ট্রেনে, বাসে, চলতে-ফিরতে, আমার শোওয়ার ঘরে মাঝেমধ্যেই কথা হয় আমাদের। একবার দু'বার লোকে রাস্তায় ঘুরেও তাকিয়েছে আমি ভূতের সঙ্গে কথা বলছি দেখে।

**************************************************

এইভাবেই চলছিলো। কিন্তু কিছুদিন হলো ব্যাপারটা অন্যরকম শুরু হয়েছে। সে আমাকে আগেভাগেই বলে দিচ্ছে কী ঘটবে। সেদিন যেমন আমি রাস্তা পার হচ্ছি যাদবপুর থানার কাছে। হঠাৎ সে কানের কাছে বললো, "দাঁড়াও - দুর্ঘটনা ঘটতে কতক্ষণ ? একটু দাঁড়িয়ে যাও।" আমি থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। ঠিক তখনি উল্টো দিক থেকে একটা বাইক এসে কোনাকুনিভাবে রাস্তাটা পার হতে গেলো আর চাকা স্কিড করে চলন্ত বাসের সাথে লাগলো ধাক্কা। বাসটাও তখন রাস্তা বাঁক নিচ্ছিলো বলে গতি বেশি ছিলো না। মারাত্মক জখম কেউ হয়নি। কিন্তু আমার কেমন যেন লাগলো ঘটনাটা।

আরেকদিনের কথা। আমাদের বাড়ির পরিচারিকা মহিলাটি সব কাজ সেরে চলে যাচ্ছে। সেই অদৃশ্য ব্যক্তি জানালো আমাকে, "পড়বে উল্টে সিঁড়ি থেকে।" আমি আনমনে বললাম, "কে ?" তার আর কোনো উত্তর নেই। দু-সেকেন্ড পরেই ধড়াম করে একটা আওয়াজ। ছুটে গিয়ে দেখি সদ্য সিঁড়ি মোছা হয়েছিলো। সেই ভিজে সিঁড়িতে পা ফস্কে পড়েছে ওই মহিলা। যন্ত্রনায় মুখ কুঁচকে গেছে তার। সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলাম।

কিন্তু আমার মনের খটকাটা গেলো না। এভাবে আগাম কীকরে বলে দিচ্ছে সে যে কী ঘটবে ? অদ্ভুত তো। আমি ঠিক করলাম লটারীর টিকিট কাটবো। দেখি এবার বলতে পারে কিনা।

আমার অফিসের সামনেই বেশ কয়েকটা লটারীর স্টল পরপর। একদিন ওগুলোরই একটাতে ঢুকলাম। এটা-ওটা বিভিন্ন লটারীর টিকিট দেখছি। দেখি কোনো নির্দেশ বা ভবিষ্যদ্বানী কিছু আসে কিনা কানের কাছে। মনে মনে বললাম, "কোথায় গেলে ভাই - বলো এবার কোন টিকিটে প্রাইজ উঠবে ?"

সে যেন শুনতে পেলো আমার কথা। অবিকল সেই ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় সে বললো, "এইসব দোকান আর কদিনই-বা থাকবে, উঠেই তো যাবে।"

এই খেয়েছে! দোকান উঠে যাবে ? এ কেমন ভবিষ্যৎবাণী ? আমি চট করে দোকানটা ছেড়ে বেরিয়ে এসে দেখলাম ভালো করে। ফুটপাথের ওপর খাসা পাকাপোক্ত গুমটি দোকান, পর পর অনেক দোকান এখানে। উঠে যাবে বললেই হলো ? লটারীর টিকিট নিয়ে কোনোকিছু সঠিকভাবে বলতেই পারবে না আসলে। সেটা স্বীকার না করে শুধু ভুলভাল সতর্কবার্তা দেওয়া। আমার আর লটারী কাটা হলো না। আন্দাজে কেটে কী হবে ?

**************************************************

দিন দুই পার হলো। তারপর একদিন অফিসে ঢুকতে গিয়ে দেখি সামনের ফুটপাথ পুরো খালি। চায়ের দোকান, তেলেভাজার দোকান, পান-সিগারেট, কিচ্ছু নেই। সেই লটারীর স্টলগুলোও নেই। পুরো জায়গাটা খালি করে মাটি লেভেল করছে কিছু শ্রমিক। খোঁজ নিয়ে জানলাম, নোটিস পড়েছে। এখান দিয়ে ফ্লাইওভার যাবে বলে প্রস্তাব এসেছে, তাই জায়গা খালি করে সার্ভে চলছে।

আমি বাড়িতে এসে সেদিন অনেক চিন্তা করলাম। ভেবে দেখলাম, এই অদৃশ্য ব্যক্তি, যে আমাকে সবসময় নানান ব্যাপারে সতর্ক করে দেয় - সে কিন্তু সবসময়ই কোনো না কোনো নেগেটিভ কথাই বলে। পজিটিভ কথা কিছু বলে না। কীসে কখন ক্ষতি হতে পারে, কখন কার অ্যাক্সিডেন্ট হতে পারে, কোনটা ভাঙবে বা নষ্ট হবে - এই ধরণেরই বক্তব্য তার। হয়তো সেটাও সাহায্যই করে ক্ষেত্রবিশেষে। কিন্তু গঠনমূলক বা অগ্রগতিমূলক ভাবনা নেই তার। সবসময়ই যেন কোনোকিছু থেকে আমাকে আটকানো। যেন একটা বন্ধনের মতো। সত্যিই কি তাহলে এর উৎপত্তি আমারই মনে ? আমার সদাসতর্ক ভীতু মানসিকতাই সেই অদৃশ্য কণ্ঠস্বরের আতুঁড়ঘর ? আমিই আসলে সে ? খুব বিরক্ত লাগলো এটা ভেবে যে এরকম একটা নেগেটিভিটিকে সবসময় সঙ্গে নিয়ে চলছি আমার সাথে।

বুদ্ধি খাটিয়ে এই নেগেটিভিটিকে দূর করবার একটা জবরদস্ত উপায় বের করলাম। পরদিনই আমাদের পাড়ার ইলেকট্রিক মিস্ত্রীকে ডেকে পাঠালাম।

ছেলেটা যথাসময়ে বাড়িতে এলো। বললো, "দাদা কী ঠিক করতে হবে ? কী সমস্যা হয়েছে ?"

আমি তাকে ডাইনিংরুমের স্যুইচবোর্ডের সামনে নিয়ে গেলাম। বললাম, "বোর্ডটা খোলো।" সে আমার উদ্দেশ্য বুঝতে না পেরে খুললো বোর্ডটা। আমি এবার বললাম, এখানে যে দুটো তার এসেছে, সেদুটো বোর্ড থেকে আলগা করো তো।

"কেন, কী করবেন ?"

"সে তোমাকে বুঝতে হবে না, খোলো তুমি তার দুটো।"

সে তার দুটো খুলে ঝুলিয়ে দিলো। একটা কালো, একটা লাল, বেশ মোটা তার। আমি বললাম, "বেশ - এবার আমাকে বলো দেখি এর মধ্যে কোনটা পজিটিভ কারেন্টের তার আর কোনটা নেগেটিভ ?"

ছেলেটা সেটাও দেখিয়ে দিলো। বললো, লালটাতে পজিটিভ। আমি এবার তার হাতে ১০০ টাকা দিয়ে বললাম, "ঠিক আছে, হয়ে গেছে। এবার তুমি যাও। কাল এসে আবার বোর্ডটা ঠিক করে দিয়ে যাবে। এখন যাও তুমি।"

"তার দুটো খোলা রইলো তো দাদা, কোনোভাবে টাচ লাগলে মারাত্মক শক মারবে কিন্তু।"

"আমি জানি। তুমি চিন্তা কোরো না।"

সে তো মাথামুন্ডু কিছুই না বুঝতে পেরে টাকাটা নিয়ে চলে গেলো অবাক হয়ে।

আমি তারপর স্লিপারটা খুলে রাখলাম পা থেকে। খালি মেঝেতে দু'পা পেতে দাঁড়িয়ে একহাতে চেপে ধরলাম পজিটিভ তারের খোলা মুখটা। ঝটিতে একটা মারাত্মক ধাক্কায় আমি ছিটকে পরে গেলাম মেঝের উপর। কোনো হুঁশই রইলো না কিছুক্ষণ।

**************************************************

আশ্চর্য হবার মতো ব্যাপার যেটা, সেটা হলো তারপর থেকে আমি এখন আর সেই অদৃশ্য কণ্ঠস্বর শুনতে পাই না। সেইসব নেগেটিভিটি সম্পূর্ণ গায়েব। আর কানের কাছে কেউ ভবিষ্যদ্বানী শোনায় না। পদে পদে কেউ আটকায় না। সব যেন জাদুমন্ত্রে একদম ঠিক হয়ে গেছে।

এর কিছুদিন পর। একবার মেট্রোয় উঠেছি। ছুটির দিন দুপুরবেলা। মেট্রো খালিই ছিলো। দেখি এক ভদ্রলোক এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন আর কার সঙ্গে যেন কথা বলছেন আপনমনে। মাঝে মাঝে মাথা নাড়ছেন। অদৃশ্য কারুর প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন, কথা বলছেন বাতাসের সাথে -

"হ্যাঁ, তারপর ওখানে না গেলে কী হবে ?... কেন, কোনটা করা চলবে না ?... আচ্ছা, কিন্তু কোনদিকে সেটা - কোথায় যাবো ?... "

আপনমনে বকেই যাচ্ছেন তিনি একা একা। আমি লক্ষণ দেখে ঠিক বুঝে গেলাম। এ জিনিষ তো আমার অতি পরিচিত। আমাকে ছেড়ে এখন একে এসে ধরেছে তাহলে। কিছু একটা করতেই হচ্ছে। এ যে কী পাগল করার মতো রোগ, তা আর বলার নয়। হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি আমি একসময়।

আমি এর ওষুধ বিলক্ষণ জানি। তাই ভদ্রলোককে উদ্দেশ্য করে বললাম, "আওয়াজ শুনতে পাচ্ছেন তো কারুর ?"

তিনি একবার আমাকে দেখে কিছুটা যেন উপেক্ষা করেই অদৃশ্য সেই ব্যক্তির সঙ্গে কথা চালাতে লাগলেন। তার মনের অবস্থা বুঝে আমি আবার জোর দিয়ে তাকে বললাম, "কোনো ফ্যাঁসফ্যাঁসে একটা কণ্ঠ তো ? সারাক্ষণ আপনাকে সাবধান করছে এটা ওটা নিয়ে, তাই তো ?"

ভদ্রলোক কাকে যেন বললেন, "এক মিনিট ধর তো।" তারপর কান থেকে তার ব্লুটুথ স্পীকারটা খুলে কিছুটা বিরক্তির সঙ্গে বললেন, "আমাকে কিছু বলছেন ?"

~ সমাপ্ত


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics