Abanti Pal

Abstract Inspirational

4.0  

Abanti Pal

Abstract Inspirational

আবাহন

আবাহন

5 mins
155




ঝিলমিল সমুদ্রপাড় বরাবর ছোট্ট পায়ে এগিয়ে চলেছে। অস্তগামী সূর্যের লাল আলোর আভরণে, রুক্ষ এলোচুলে, মলিন বসনে, হাতে একগুচ্ছ মুক্তর মালা আর চোখে অনাবিল সরলতা নিয়ে ঝিলমিল এগিয়ে চলেছে নিজের রুজিরুটির সন্ধানে। আজীবন সমুদ্রকে ঘিরেই তার শ্বাস-প্রশ্বাস আর বেঁচে থাকার আশ্বাস পেয়ে এসেছে সে। কিন্তু তার ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক দিয়ে বন্ধনহীন সমুদ্রের বিপুলতা আর অপরিসীম আকাশের ব্যাপ্তি কিছুটা অনুধাবন করতে পারলেও, ঝিলমিল নিজের মনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছে তার একান্ত নিজস্ব জাগতিক পরিসর। বহির্জগতের রোশনাই সেই গণ্ডি টপকে তার অন্তরাত্মাকে বিশেষ নাড়াতে পারেনি। ঝিলমিল আপন খেয়ালে বেশ খুশি। 


আট বছরের মেয়েটার কোনোদিন হয়তো ভালো বিক্রি হয়, কোনোদিন মন্দা যায়। তার একার পেট চলে যায়, আর কি চাই? আপন বলতে তো আর কেউই বেঁচে নেই। সবই ওই সমুদ্র নিয়েছে একদিন। যে দেয়, সে নেয়ও বৈকি। এ যেন প্রকৃতির নিষ্ঠুর পরিহাস। এই কথাটা ওকে মধেমধ্যে বিচলিত করলেও, ঝিলমিল বোঝে এই বুঝি প্রকৃতির নিরলঙ্ঘিত নিয়ম।


আজ সমুদ্রতট অন্যান্য দিনের তুলনায় আপেক্ষিকভাবে ফাঁকা। ঝিলমিল শুনেছে একটা বড় রকমের সাইক্লোন আসছে। তাই বলে সে কি মালা বেচবে না? নরম বালির স্পর্ষণে আর শীতল ঢেউয়ের নিরন্তর ভাঙ্গা-গড়ার খেলায় নিজের শ্রান্তি ধুয়ে ফেলবে না? হোক না নুলিয়ারা কেউ নেই, হোক না কোনো নৌকো নেই, তবু আছে তো অনাদিকাল থেকে গুঞ্জে যাওয়া সমুদ্রের সস্নেহ কল্লোল। এই কি যথেষ্ট নয় তার দিনযাপনের জন্য?


ওই তো একজনকে দেখা যাচ্ছে দূরে। ঝোড়ো হাওয়ার তোয়াক্কা না করে সে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে। নিশ্চয়ই সে পর্যটক। তাকে গম্ভীর চিন্তামগ্ন অবস্থায় দেখলেও, ঝিলমিল ভাবলো, জিজ্ঞাসা করতে ক্ষতি কি? 


'ও দিদিভাই, মালা কিনবে, মুক্তর মালা?' মস্ত ক্যামেরা গলায় ঝোলানো, বড়ো ব্যাগ পিঠে ত্রিশোর্ধ্ব মহিলাটির সামনে এসে অনুরোধ রাখলো ঝিলমিল। কেউ কেউ শখে কেনে, কেউ সহানুভূতিতে, বিরল কেউ হয়তো তাকে স্নেহ করে। এই দিদি কি কিনবে তার সামগ্রী?


ছোট্ট মেয়েটার গলার আওয়াজে নিয়ন্তার চিন্তার জাল কেটে গেল। আজ সকালে এখানে এসে থেকেই সে চিন্তিত ছিল। এই আবহাওয়ায় তার কাজ সম্পন্ন হবে কিভাবে? সমুদ্রতট প্রায় শূন্য। কোনো পছন্দসই সাবজেক্ট তো চাই তার ছবির। এদিকে দিনের আলো ফুরিয়ে আসছে দ্রুত। আজ শূন্য হাতে বুঝি ফিরে যেতে হবে শহরে। হঠাৎ মেয়েটাকে দেখে অবাক হয়ে গেল। কেউ কোথাও নেই, তবু এইটুকু মেয়ে তো বেশ সাহসী বলতে হবে! আসন্ন ঝড় তোয়াক্কা না করে নিজের কাজ করে চলেছে।


নিয়ন্তা মেয়েটার সাথে আলাপ জমালো। বেশ মিশুকে মিষ্টি মেয়েটা। কত ব্যবধান তাদের দুজনের তথাকথিত সামাজিক স্তরে, তবু মেয়েটি তার মতনই তো বেরিয়েছে নিজের স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার সংগ্রামে। নিয়ন্তা নিজেও এসেছে অন্তরের চিত্রশিল্প সত্ত্বাকে জাগ্রত করতে, সব্বার থেকে আলাদা কিছু করে কোনো চমৎকার ঘটাতে, সাড়া ফেলে দিতে মানুষের মনে। ভিন্ন ভাবে হলেও, দুজনের সংগ্রাম কোথাও যেন এক - উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতন বেঁচে থাকার।


কি মনে করে নিয়ন্তা বলল,

'ছবি তুলবি? আমি তোর ছবি তুলে ফটোগ্রাফি কনটেস্টে দেব। কত মানুষ দেখতে পাবে তোর মুখ। আজ তোর কেউ নেই, সেদিন দেখবি কত লোক তোকে আপন করে নিয়েছে, ভালোবাসছে। কে জানে, হয়তো তাদের মধ্যে কেউ তোকে ঘরের মেয়ে করে ঘরে তুলে নেবে!'


ঝিলমিল অত বোঝে না, অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা করার বুদ্ধি তাকে ঈশ্বর এখনো দেয়নি। কিন্তু মানুষের বাড়তি স্নেহ পাওয়ার লোভ বুঝি ওকে পেয়ে বসলো। জলের ওপর হঠাৎ এসে পড়া সূর্যকিরণ যেমন ক্ষুদ্র তরঙ্গকে ঝিলিমিলিয়ে তোলে, তেমনই ছবি তোলার নামে তার ছোট্ট মনটা শিহরিত হয়ে উঠলো। লাজুক হেসে সম্মতি জানালো তক্ষনই। 



আজ নিয়ন্তার তোলা ছবি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। বছরের সেরা চিত্রশিল্পকারের খ্যাতি এখন তার মুকুটে স্বমহিমায় জাজ্বল্যমান। ছবিটার শিরোনাম 'আবাহন'। দিগন্তে সূর্যোদয়ের বর্নবলয়ে, দারিদ্র্য ছেড়ে উঠে আসছে একটা বাচ্চা মেয়ে সমুদ্রমন্থন সেরে। মুক্তমালায় শোভিত মেয়েটার থেকে বুঝি দ্যুতি ঠিকরে বেরোচ্ছে, যেন সাক্ষাৎ দেবী। চিত্রচরিত্রে ঝিলমিল।


ছবিটার জনপ্রিয়তা সেটাকে বহু জায়গায় স্থান দিয়েছে। কিছু বড়ো বিজ্ঞাপন সংস্থা এগিয়ে এসেছিল ঝিলমিলের সাথে কাজ করার প্রস্তাব নিয়ে। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে, বেশ কয়েকটা খ্যাতনামা পূজামণ্ডপে সেই ছবির স্থান হয়েছে এবছর। বড়ো বড়ো পুজোয় ঝিলমিলের মুখের আদলে তৈরি হয়েছে দেবীপ্রতিমায়ের আরাধ্য মুখশ্রী।


নিয়ন্তা ভোলে নি। প্রতিশ্রুতিমত, ছুটে গিয়ে ঝিলমিলকে নিজের কাছে নিয়ে এসেছে, নিজের রোশনাইয়ের ভাগ দিতে। স্বপ্নের মতন কেটেছে পুজোর দিনগুলো। যে ঝিলমিল কোনোদিন সমুদ্র-দিগন্তের বাইরে কিছু দেখেনি, আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে সে দেখেছে মানব সমুদ্রের লহরী। কত বিচিত্র তাদের ব্যবহারের রঙ-রূপ, কত অতল তাদের মনের অন্ধকার গহ্বর, হদিস পাওয়া বেজায় মুস্কিল। ক্রমে জটিল থেকে জটিলতর লাগে তাদের। তাদের হাসি, কলরব, উচ্ছাসের মধ্যে থেকেও একসময় খুব একলা বোধ করে ঝিলমিল।



আজব আদব-কায়দা মানুষের। ঝিলমিলকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিল যারা, তারাই কেন যে আজ চূড়ান্ত অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখছে ওকে? যে ক্যামেরার ঝলসানি তাকে দিয়েছিল এত কিছু, সেই ক্যামেরা আজ অন্যত্র ব্যস্ত। শুধু একটা ক্ষুদ্র মুখ নিয়ে পড়ে থাকলে হয় না কি? সমাজসমুদ্রের যে অফুরন্ত কাজ। সে দেয়, আবার চোরাস্রোতের টানে সব অবজ্ঞা করে বেরিয়ে যায়। তাকে ধরে রাখে, কার সাধ্যি? মনের গহীনে এই নিয়ম অবশ্য ঝিলমিল জানে।


প্রয়োজন ফুরিয়েছে তার, বুঝেছিল ঝিলমিল সেইটুকু। তবুও একটা খচখচানি কিছুতেই যাচ্ছিল না মন থেকে... সমুদ্র চিরবহমান হলেও, সে কিছুই ভোলে না, সমস্ত সযত্নে লালন করে, আগলে রাখে তার আপন করে। যারা তার অন্তঃস্থলে লালিত, ত্যাজ্য করে না তাদের। কিন্তু মানবসমাজ? তেমন নয় কি? বারংবার ঝিলমিল সমুদ্রের সাথে গুলিয়ে ফেলে এই সমাজ-স্রোত।


দশমীর সন্ধ্যায়, দেবীকে বিদায়লগ্নের মুহূর্তে পায়ে পায়ে গঙ্গার ধারে এসে নিয়ন্তার হাতটা ধরলো ঝিলমিল। বিসর্জনের সুর উঠেছে ঢাকিদের কাঠিতে। নৌকায় নৌকায় চাপানো হচ্ছে দেবীমূর্তি। গঙ্গা অপেক্ষমান। আরাধনা শেষে, মানবসমাজের দেবীকে আপন করে সে ফিরিয়ে নেবে নিজের কাছে। হয়তো বা ক্ষুদ্র একতাল মাটি নিজের একসময়ের মানবপ্রদত্ত ঈশ্বরের রূপ ভুলে মিশে যাবে গঙ্গার স্রোতে, ফিরে যাবে সমুদ্রে, তারপর মহাসমুদ্রে। তবুও, ঝিলমিল কেন যে বুঝে উঠতে পারে না মানব হৃদয়ের ওঠাপড়া। একটুখানি স্নেহের যে বড়ো বেশি কাঙাল হয়ে পড়েছিল সে! নিজেকে এদের সন্তান ভেবে কি বড্ড ভ্রম হয়ে গেল তার?


নিয়ন্তা ঝিলমিলের মাথায় হাত বুলিয়ে ম্লান হাসে। ইচ্ছে থাকলেও, পরিবারের অমতে গিয়ে এই মেয়েটিকে নিজের কাছে রেখে যত্ন করার উপায় তার নেই। প্রকৃতির কোল ঘেঁষে বড়ো হওয়া এই মেয়েটির যথার্থ স্থান যে ওই সমুদ্রপাড়, সেটা তারা বারবার বুঝিয়ে দেয় নিয়ন্তাকে। তাই হোক। কিন্তু পড়াশোনা করে বড় হোক। সসম্মানের সাথে বাঁচুক। সেসবের ব্যবস্থা নিয়ন্তা করবে। তবু সকলের মধ্যে থাকতে পাবে না, তাদের স্নেহের পরশ থেকে বঞ্চিত হবে শৈশবকালে। এখানেই নিয়ন্তা'র আফসোস।


ঝিলমিল দেখে, নিজের মুখবয়বের প্রতিফলনে গড়া দেবী তখন ভাসানের জলে। বিস্ফারিত চোখে ওর আকুল জিজ্ঞাস্য নিয়ন্তাকে

'যেই মা'কে আবাহন করে পুজো করো, তাকে কেন বিসর্জন দাও গো তোমরা?'


বাকরোহিত হয় নিয়ন্তা। পরক্ষনেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলে

'শক্তির কখনও বিসর্জন হয় না ঝিলমিল। ঈশ্বর সাময়িকভাবে মৃত্তিকা রূপে ধরা দিয়েছিলেন আমাদের মধ্যে। পুজো শেষে নিজের শুভশক্তি সবার মধ্যে বিলীন করে গেলেন, পরের আবাহনে আরও কাছের, আরও শক্তিশালী হয়ে আসবেন বলে!'


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract