পিতৃত্বের প্রতিদান
পিতৃত্বের প্রতিদান
হাঁটু জলে দাঁড়িয়ে ডেকেছিলে আমায়,
বলেছিলে, জলে না নামলে সাঁতার শিখবি কি করে?
আয়, আর আমি তো আছি, ভয় কিসের?
হ্যাঁ, ওই শেষ কথাটা শুনেই নিজেকে ছেড়ে দিয়েছিলাম অনাবিল ভরসায়।
তুমি তো আছো, নিজে তলিয়ে গেলেও, আমায় ভাসিয়ে রাখবে, কোন ক্ষতি হতে দেবে না।
তুমি তো বাবা, বাবারা সবসময় সন্তানকে এভাবেই তুলে ধরে, নিজেকে আড়াল করে, তুমিও নও ব্যতিক্রম।
তোমার কাছেই হাতে খড়ি, তারপর ভর্তি করলে শহরের নামকরা সুইমিং ক্লাবে।
লেখাপড়া, আঁকা, সাঁতার, আনুষাঙ্গিক অনেক কিছু চলতে থাকলো একসঙ্গে।
দামি পরিবারের দামি ছেলেমেয়েদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলতে শেখালে,
বন্ধ করে অফিস ক্যান্টিনে তোমার অবাঞ্ছিত টিফিন।
এক কাপ চা আর বিস্কুটেই পেলে, ঘন্টার পর ঘন্টা কাজ করার রসদ,
চোখে এঁকে ভবিষ্যতের উজ্জ্বল স্বপ্ন।
সুইমিং ক্লাস শেষে, দামি দামি গাড়ির সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটতো তোমার, নানা জায়গায় রঙচটা পুরনো স্কুটিটা। তোমার রং জ্বলা ঘর্মাক্ত সোঁদা গন্ধযুক্ত শার্ট, আঁকড়ে বসে থাকতাম, ভীরু সৈনিকের মত,
দক্ষ সেনাপতির পিছনে নিজেকে আড়াল করে।
নামি দামি গাড়ি নিয়ে বাকি বাবারাও আসতো।
কিন্তু তারা কেউ বাবা ছিল না।
কেউ ছিল ড্যাডি, কেউ বা বাপি।
শুধুমাত্র তুমি, হ্যাঁ, তুমিই ছিলে একমাত্র বাবা।
কারণ এই বিশেষ শব্দটাই বারবার আমার অসংলগ্ন বুলি আওড়ানো দুই ঠোঁটে, এঁকে দিয়েছিল আমার মা।
তোমাদের শরীরের বিন্দু বিন্দু রক্ত আর নোনা জল শুষে, আমি শহরের সর্বশ্রেষ্ঠ সাঁতারু হওয়ার দৌড়ে, এগিয়ে যেতে লাগলাম।
তারপর কেটে গেল অনেকগুলো বছর, হ্যাঁ, অনেকগুলো।
আমি হলাম প্রতিষ্ঠিত, হলাম পরিবারের কর্তা।
আর তুমি, বাবা, তুমি হলে নেহাতই অবাঞ্ছিত কেউ,
তোমায় রেখে আসলাম, ওল্ড এজ হোমে।
মা বাড়িতেই থাকলো, তোমার বৌমা ফ্যাশন ডিজাইনার, ভীষণ ব্যস্ত।
ছেলের দেখাশোনার জন্য, পয়সা খরচ করে ঝি রাখা নেহাতই বাহুল্য।
তাই মাকেই বহাল করা হলো, দুবেলা দুমুঠো ভাতের বিনিময়ে।
আমি আরও প্রতিষ্ঠিত হলাম, রাষ্ট্রপতির হাত থেকে নিলাম পুরস্কার।
টিভিতে দেখানো হলো।
জানিনা বাবা, বৃদ্ধাশ্রমের ওই ছোট্ট ঘরে টিভি আছে কিনা?
থাকলে হয়তো তুমিও দেখে থাকবে।
তোমার দুচোখ নিশ্চয়ই ভরে উঠেছিল আনন্দাশ্রুতে,
অথবা শূন্যে মুষ্টি আস্ফালন করে বলতে চেয়েছিলে,
"আমি জিতে গেছি।
আমার ছেলে আজ প্রতিষ্ঠিত, রাষ্ট্রপতির দ্বারা পুরস্কৃত, শহরের সবকটা নামি সুইমিং একাডেমির কর্ণধার।"
কিন্তু বলতে পারোনি, ছিল অদৃশ্য চোখ রাঙ্গানি, লজ্জা মাখা নিষেধাজ্ঞার।
জানো বাবা, আজ এক চরম সত্য উপলব্ধি করতে পারলাম।
আমার সাত বছরের ছেলেটি বলল,
"আমি খুব বড় ক্রিকেটার হব, ভারতের হয়ে খেলব,
আমায় টিভিতে দেখাবে, রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে পুরস্কার নেব।
কিন্তু তুমি কিভাবে দেখবে বাপি?
তুমি তো বুড়ো হয়ে যাবে, দাদুর মত।
তুমি তো হোমে থাকবে, বুড়োরা তো হোমেই থাকে।
আমি বরং যে হোমে টিভি আছে, সেখানে তোমায় রেখে আসবো। "
কষ্ট হয়নি জানো বাবা,
নিজের কর্মকাণ্ডের উপযুক্ত জবাব পেলাম,
হৃদয় অভ্যন্তরে সপাটে চাবুকাঘাতের দ্বারা।
চোখ দুটো ঈষৎ ভিজলো, মনটা মুচড়ে উঠলো,
তবে হলো না কোন অভিমান।
ভাবলাম, এভাবেই বুঝি বাবারা পেয়ে থাকে বংশানুক্রমে,
পিতৃত্বের প্রকৃত প্রতিদান।