সবুজ
সবুজ
সবুজ আজ বড় স্কুলে যাবে, ক্লাস ফাইভ।
সকাল থেকে নেই উদ্দীপনার অন্ত।
নতুন ব্যাগে নতুন বই গুছিয়ে, একটা ছোট প্লাস্টিক বক্সে কটা মুড়ি আর ছোলা ভাজা ভরে দেয় মায়া, সবুজের মা।
তার ব্যস্ততাও কিছু কম নয়, তবে সে আজ নয় একটুও ক্লান্ত।
তারও যে পড়াশোনার বড় সাধ ছিল, নানা করণে হয়ে উঠেনি।
না হয় না হোক, তবে ছেলেকে সে পড়াবে, যত দূর পড়তে চায় ততদূর, ওকে মানুষের মতো মানুষ তৈরি করবে।
তবেই তার নিজের অপূর্ণ ইচ্ছে গুলি পূর্ণতা পাবে।
ছেলের হাত ধরে দরজার কাছে আসতেই পাশের বাড়ির ডাক্তার গিন্নি মায়া কে বলে, কি রে মায়া, ছেলেকে সেই সরকারি ইস্কুলেই ভর্তি করলি।
শুনছিলাম তোর ছেলের পড়াশোনায় বেশ মাথা আছে,
তা সব তো এবার গোল্লায় যাবে।
সরকারি ইস্কুল মানেই তো, সকালে দলবেঁধে গোয়ালে ঢোকা,
দুপুরে খিচুড়ি ঘ্যাট খাওয়া,
আবার বিকেলে দলবেঁধে ধূলো উড়াতে উড়াতে ঘরে ফেরা।
না হয় লেখা, না হয় পড়া।
এইভাবে কোনো মতে ইস্কুলের গন্ডি টা হবে পার,
তারপর হয় চালাবে টোটো, নয় বেচবে পেপার।
আমার ছেলে পড়ছে প্রাইভেট ইস্কুলে, ওদের সব আলাদাই ব্যাপার।
ওখান থেকে একবার পাশ করে বেরোলে, হবেই হবে আগামীর ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার।
মায়ার মনের টুকরো টুকরো দুশ্চিন্তা গুলো জমাট বাঁধতে শুরু করে।
সরকারি স্কুলে পড়াশোনা হয় না, প্রাইভেট স্কুলে হয়।
এসব চিন্তা যে সে করেনি, তা নয়, কিন্তু কোথায় উপায়?
সবুজের বাবাকে সে পাঠিয়েছিল, বড় রাস্তার পাশে ঐ বড় প্রাইভেট স্কুলেতে, কথা বলতে।
যখন ওরা জানল, সবুজের বাবা কাজ করে পরের দোকানে, আট হাজার টাকা মাইনে।
বলল এখানে খরচ অনেক,পারবেন না, ছেলেকে সরকারি স্কুলে ভর্তি করুনগে,
কই দেখি, পরের জন কে আছেন লাইনে।
সেদিন সবুজের বাবা মাথা নিচু করে ফিরে এসেছিল বাড়িতে।
আর মায়া, সকল দ্বিধা দ্বন্দ্ব কাটিয়ে মাথা উঁচু করে বলেছিল তাদের ছেলেকে পড়াবেই সরকারি স্কুলেতে।
কিন্তু আজ হঠাৎ ডাক্তার গিন্নির কথা, মনটা দিয়েছিল একটু দুলিয়ে।
ছেলেকে সে করতে চায় মানুষের মতো মানুষ, দশজনের একজন।
তার কি আর চলে, ভাঙ্গলে এভাবে মন?
মায়া, ম্লান হেসে ডাক্তার গিন্নিকে বলে, কি করব দিদি, প্রাইভেট স্কুলে যে অনেক খরচ,
আমরা পারব না টানতে ।
আমাদের যে পান্তা ফুরোয়, গেলে নুন আনতে।
তোমার ছেলের বাবা ডাক্তার, ছেলেও ডাক্তার হবে।
আমার ছেলের বাবা শ্রমিক, ছেলেও না হয় কাজ করে মরবে।
তারপর কালের নিয়মে কেটে যায় অনেক সময়, কত শীত, গ্রীষ্ম, বসন্ত করে পারাপার।
মনে পড়ে, প্রাইভেট স্কুলে পড়া ডাক্তার গিন্নির ছেলেকে, আজও কিন্তু সে বেকার।
অথচ কি অদ্ভুত ব্যাপার দেখুন, সরকারি স্কুলে পড়া সবুজ, চিনতে পারছেন তো? ঐ মায়ার ছেলে সবুজ,
আমার, আপনার, আমাদের সবার সবুজ,
আজ কলকাতার মস্ত এক নাম করা ডাক্তার।