নতুন জীবন
নতুন জীবন
ঠোঁটে গাঢ়ভাবে লিপস্টিক টা লাগালো শিউলি। শরীরে সস্তা দামের পাতলা শিফনটা জড়িয়ে নিল এমনভাবে, যা পেট, বুক, পিঠ উন্মুক্ত রেখে শরীরের যৌন আবেদন ফুটিয়ে তুলল। চোখে সরু করে কাজল লাগালো, চুলে বেলি ফুলের মালা, তারপর চপলা হরিণের মতো ঘুরে ফিরে নিজেকে আয়নায় দেখে নিল। এরপর সে এগিয়ে গেল বড় রাস্তার ল্যাম্প পোস্টের নীচে, যেখানে রোজ দাঁড়িয়ে তার পেট চলে, যেখানে দাঁড়িয়ে সে নিজের জীবন চালায়।
গত দুদিন ধরে শিউলি উপোসী আছে, নাহ্ শিউলির পেট উপোসী নয়, তার শরীর উপোসী। তবে আজও যদি কোন খদ্দের না জোটে তবে কাল থেকে সে উপোস করতে বাধ্য হবে। কারণ ঘরে জমানো টাকা যা ছিল দুদিন খেয়ে আর ঘর ভাড়া দিয়ে শেষ। মধ্য তিরিশের শিউলি বোঝে যে এই লাইনে তার কদর ফুরিয়ে আসছে। কারণ এখানে এই বয়েসের মেয়েদের আর দাম নেই। তাদের না থাকে আর রূপের ছটা, না থাকে পুরুষ শরীরে জ্বালা ধরানো যৌন আবেদন। তখন এদের বাঁধা কটা পুরোনো খদ্দের নিয়ে থাকতে হয়।
শিউলির ও এখন সেই অবস্থা, যখন যৌবন ছিল তখন শিউলির দরজায় ছিল বাবুদের ভিড়, আর এখন তাকে দাঁড়াতে হয় রাস্তার ধারে। আজও অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল সে, না কেউ দেখলে না তাকিয়ে। তাদের পাড়ায় যে নতুন দু তিন টে কুড়ি বাইশ বছরের মেয়ে এসেছে, এখন তাদের কদর খুব। পুরোনো মুখ চেনা খদ্দেররা ও কেউ এলেও না হয় শিউলি সস্তায় নিজেকে বিকিয়ে দিত। ক্রমশঃ রাত গভীর হচ্ছে। ওদের পাড়ার সব ঘর গুলোই এখন ক্লান্ত হয়ে নিশ্চুপ হয়ে গেছে। সন্ধ্যে রাত থেকে যে খদ্দেররা ঘরে ঘরে ভিড় জমিয়ে ছিল, তারাও আদরের খেলায় এখন ক্লান্ত। এমনকি পাড়ার খোঁড়া মেয়ে কুকুর টা, যে দুদিন আগে বে পাড়ার কুকুর দ্বারা ধর্ষিত হয়ে, নাকি স্বেচ্ছায় সহবাস করে একসাথে চারটি কুকুরের মা হয়েছে, সেও ক্লান্ত হয়ে আজ ঘুমিয়ে গেছে।
এবার শিউলি ফিরে যাবে, আর কেউ আসবে না, তাছাড়া আর থাকাটাও নিরাপদ নয়। এবার যারা আসবে তারা জোর করে শরীরটাকে ভোগ করতে চাইবে। বিনিময় প্রথা তাদের অভিধানে নেই। আর তার এই মুহূর্তে সত্যি কিছু টাকার দরকার, মুদির দোকানে ধার বাকি, ঘর ভাড়াও সবটুকু দেওয়া হয়নি, এমনকি ঘরে রাতের খাবারটুকু মজুত থাকলেও সকালের জন্য জল ছাড়া কিছু নেই। সব মিলিয়ে সে আজ সত্যি খুব অসহায়। আজ আর তার কোন দাম নেই। শুধু আজ কেন? কোনদিনই কি তার কোন দাম ছিল? সে তো ছিল শিউলি ফুলের মতোই, যে রাতে সৃষ্টি হয়ে ভোরে ঝরে যায়। সারা রাত সে গন্ধ ছড়ায়, তারপর যখন ঝরে যায় আর সেভাবে তার সুঘ্রাণ থাকে না। রক্ত মাংসের শিউলির ও এক অবস্থা, দিনে সে কুঁড়ি, আর রাতে প্রস্ফুটিত ফুলের মতই ফুটে উঠে, যার সুঘ্রাণ ছড়িয়ে উঠত কামার্ত পুরুষদের কাছে, অথচ সকাল হলেই সে ও ঝরে থাকা ফুলের মতো ই হয়ে থাকত। এইসব ভাবতে ভাবতেই সে ঘরের দিকে এগিয়ে যায়, আর তখনই সে দূরের পার্কের গেটের কাছে একজন পুরুষ কে দেখতে পায়। এই সময় এই পাড়ায় পুরুষ মানে, শিউলি আশার আলো দেখল। পার্কের দিকে এগিয়ে গেল সে, তারপর তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল, "লাগবে নাকি? "
ছেলেটি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকিয়ে রইল।
"কমে হয়ে যাবে" শিউলি আবারও বলল।
এবার ও ছেলেটি কোনো উত্তর করলে না।
শিউলি তখন শেষ চেষ্টা করল, "দেখ দু ঘন্টার টাকা দিয়ে সারা রাত থাকবে। "
ছেলেটি এবার মুখ খুলল, "আমায় থাকতে দেবে তুমি? আমার কাছে পয়সা নেই, থাকার জায়গাও নেই, দুদিন কিছু খাইনি, দেবে থাকতে? "
এবার শিউলি ঝাঁঝিয়ে উঠল, "আ মোলো যা, মরণ দশা, আমি কি ফিরি তে সেবা কেন্দ্র খুলেচি নাকি রে? দূর হ, দূর হ।" শিউলি গজগজ করতে করতে এগিয়ে গেল।
"এই যে শুনছো, শোনোনা গো, রাত টুকু থাকতে দেবে? আমার না খুব ভয় করে একা রাতে, দাও না গো থাকতে।" ছেলেটি শিশু র মতো বলে উঠল।
শিউলি থমকে দাঁড়িয়ে গেল, কি করুণ স্বর, কি অসহায়তা, কি ভীষণ আকুতি, এগুলো কি করে সে এড়িয়ে যায়? এগিয়ে গেল ছেলেটি র কাছে, " কে তুমি? বাড়ি কোথায়? কি নাম তোমার? "
"গনু, কখনও বা আদর করে বলত গনশা, আবার কখনও গনেশ। মা বেঁচে থাকতে বলত, আমি মরে গেলে তোর কি হবে গনু? সত্যি আমার কি হবে? আমি যে খুব বোকা, বাড়ি আমার অনেক দূর , কোথায় কি নাম অতো বলতে পারি না, বোকা তো তাই জানি না। আমার বড়ো দাদা খুব ভালো ছিল, কিন্তু বৌদি টা নয়। মা বেঁচে থাকতেই খুব মুখ করত, মা মারা যেতে একদিন আমায় বলল মার শান্তির জন্য পূজো দিতে নিয়ে যাবে, বলে ট্রেনে তুলে বসিয়ে দিয়ে নিজে কোথায় হারিয়ে গেল। আমি ট্রেন থেকে নেমে ঘুরতে ঘুরতে এখানে চলে এসেছি। " এবার ছেলেটি কেঁদে ফেলল।
শিউলি জোরে চেঁচিয়ে উঠল, " চুপ , একদম চুপ, পুরুষ মানুষ কাঁদতে লজ্জা করে না? "
"তবে যে বৌদি বলত আমি পুরুষ নয়, নপুংসক। কতদিন তো বৌদি আমায় নিয়ে কত অসভ্যতামি করত। আমি চিৎকার করে মাকে ডাকতাম, বৌদি তাতে খুব মজা পেত। মাকে বলত আমি নপুংসক। মাকে এর মানে জিজ্ঞেস করলে মা বলত আমি পুরুষ নয়। " ছেলেটি করুণ ভাবে কথা গুলো বলল।
শিউলি ভালো করে ছেলেটির দিকে দেখল, বয়সে তার থেকে একটু ছোট হবে। কিন্তু বুদ্ধি তে একেবারে শিশু, দেখে তার মায়া হল। সে বলল, " আচ্ছা চলো আমার সাথে, তবে আমিও খুব গরীব, খেতে দিতে সেভাবে পারবনা, কিন্তু রাতটুকু আশ্রয় দিতে পারব। "
ছেলেটি কে নিয়ে শিউলি ঘরে গেল এবং সকালের রান্না হওয়া ভাত জল দিয়ে রাখা ছিল, সেটাই নুন লঙ্কা দিয়ে যত্ন করে খেতে দিল। যে খাদ্যে কোন আভিজাত্য ছিল না, ছিল একরাশ যত্ন আর সহানুভূতি। গনু অভুক্ত পেটে খাবারটা পেয়ে সবটুকু তৃপ্তি করে খেয়ে ফেলল। তারপর শিউলির বিছানায় যেখানে কোন ভদ্রলোক শুতে ঘৃণায় কুঁকড়ে যাবে, সেখানে পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে গেল। আর অভুক্ত শিউলি জল খেয়ে সে রাতের মত খিদের নিবৃত্তি ঘটিয়ে , ঐ বিছানায় যেখানে অন্য পুরুষ নিয়ে উঠলে তার পেট ভরে, সেখানে অন্য এক পুরুষের সাথে একদম অন্যরকম ভাবে রাত কাটাল, যে রাতে কোন চাহিদা ছিল না, কোন কামনা ছিলনা, ছিল শুধু পরদিন খাবারের চিন্তা।
শিউলি মাতৃত্ব কি জানেনা, তার বিয়েও কোন দিন হয়নি, গরীব বাপ মার ঘরে অনেক ভাই বোনের সাথে মানুষ হচ্ছিল, না মানুষ হচ্ছিলনা শুধু বড়ো হচ্ছিল। এমনি করেই একদিন বিক্রি হয়ে গেল। আর সেটা যে বাপ মায়ের সহমতেই তাতে কোন সন্দেহ নেই। তারপরের কাহিনী ছিল আরও করুণ, এ হাত সে হাত বদল হয়ে এসে পৌঁছাল এই শহরের এই নিষিদ্ধ পল্লীতে, কমলা মাসির তত্ত্বাবধানে তার জীবন শুরু হয়েছিল।
অনেক পুরুষ তাকে অনেকবার, অনেক রকম করে ছুঁয়েছে, কিন্তু ঐ পর্যন্তই, কেউ তাকে নিয়ে সংসার করেনি, ওদের সংসার হয়না, ওদের সংসারের স্বপ্ন দেখতে নেই। এইসব অতীতের কথা মনে জাগলে কষ্ট হয়। কত বোকা ছিল তখন, শুধুমাত্র ভালবাসার গল্প শুনিয়ে, সংসার করার লোভ দেখিয়ে কত পুরুষ তাকে ভোগ করেছে দিনের পর দিন, আর সে বোকার মত এখান থেকে মুক্তির আশায়, একটা সংসারের স্বপ্ন দেখে বিশ্বাস করে গেছে সেই মুখোশধারী মানুষগুলোকে। তাই হয়ত তার জীবন থেকে স্নেহ, মমতা, ভালবাসা সবকিছুই হারিয়ে গিয়েছিল। আজ এই নিতান্তই সরল, নিষ্পাপ ছেলেটির সংস্পর্শে এসে, তার জীবনে এক অন্যরকম অনুভূতি জেগেছে। গনু শিউলিকে আশ্রয় করে, শিউলির বুকের কাছে পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে। কিন্তু শিউলির বিনিদ্র রজনী কাটছে অতীতের স্মৃতি হাতরে, আর এক অজানা ভবিষ্যতের লোভে। সে চিন্তা করল সকালে কমলা মাসিকে বলে ছেলেটিকে তার কাছে রেখে দেবে, ছেলেটি বড় অসহায়, দরকার হলে একটা কাজও যোগার করে দেবে, একটা দ্বীর্ঘশ্বাস ছেড়ে স্বগতোক্তি বেরিয়ে এল নাই বা থাকল শরীরের সম্পর্ক, মনটাই না হয় সম্পর্ক রাখুক। মনটাই তো সব, শরীর তো নিমিত্ত মাত্র। এই ভাবনাতেই কেটেছিল সেই রাত। সকাল হতে কমলা মাসির কাছে অপরাধীর মতো কথাটা বলেছিল সে, শুনে মাসির ঝাঁঝিয়ে উঠেছিল, "তুই কি এখনও সংসারের স্বপ্ন দেখিস? দূর করে দে ওটাকে। "
শিউলি কেঁদে বলেছিল, "না মাসির ও কাল সারারাতেও আমায় স্পর্শ করেনি। শুধু এই বুকে একটু আশ্রয় খুঁজে ছিল। আমি সংসার নয়, একজন অসহায়ের আশ্রয়দাত্রী হতে চাই। "
কিন্তু বাঁধ সাধলো গনু নিজেই, সে কোন কাজ জানেনা। কাজ শেখানোর দ্বায়িত্ব নিল নিষিদ্ধ পল্লীর দালাল লক্ষণ, যে শিউলিকে গুন্ডা বদমাশ দের থেকে আগলে রাখত। সে গনুকে একটা মুদির দোকানে কাজ শিখতে দিল। আর সেই সময় শিউলির নিজের পেশায় সময় দিত। কারণ সে গনুকে জানাতে চায়না কিছু। এ দিকে দুটো পেট ও তো চালাতে হবে।
একদিন দুপুরে গনুর জ্বর এল, সে ঘরে ফিরে এল। শিউলির ঘর তখন বন্ধ, লক্ষণ তাকে বাইরে অপেক্ষা করতে বলল, কারণ একে তো শিউলির এই লাইনে কদর কম, তার ওপর এই অসময়ে, খদ্দের ভাঙানো ঠিক নয়। বাইরে অপেক্ষারত গনু এক সময় ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে দেখল এক পুরুষকে। সে দৌড়ে ঘরে গিয়ে দেখল, আলুথালু বিবস্ত্র শিউলি যন্ত্রনায় কাতর, বিছানার এক কোনে রয়েছে শিউলির শরীরের দাম। গনুর কিছু বুঝতে বাকি থাকল না। সেই মুহূর্তে সে শিউলিকে অপমান করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। নাহ্ শিউলি বোধহয় এবারও পারল না তার স্বপ্নের সংসারটাকে ধরে রাখতে। গনুর হাতটা ধরে বলল, " আমি শুধু দুটো পেট চালাতে চেয়েছিলাম, আমার কোন শরীরের চাহিদা নেই বিশ্বাস কর, তোমায় কথা দিচ্ছি না খেয়ে মরলেও আর এ কাজ করবনা। "
গনু বলল, "তুমি নোংরা, আমি তোমার কাছেথাকবনা।" কথাগুলো বলে সে বেরিয়ে গেল। "
শিউলি শুধু কেঁদে গেল, আটকাতে পারলনা। সেদিন ভোর রাতেই সে স্বপ্ন দেখল গনু তাকে ডাকছে, খুঁজছে, বলছে, "তুমি কোথায়, আমার ভয় করছে। "
নাহ শিউলি সে ডাককে উপেক্ষা করতে পারলনা, গনুর খোঁজে বের হল। একটু এগিয়ে দেখল সেই পার্কের গেটের কাছে জ্বরে বেহুশ হয়ে পড়ে আছে। শিউলি দৌড়ে গিয়ে নিজের কোলে তার মাথাটা তুলে নিল। তারপর আদরে আবেগে গনুর কপালে নিজের ঠোঁট ছোঁয়ায়। গনু চোখ মেলে তাকালে সে বলল, " ফিরে চল, আমি তোমাকে কিছুতেই একা ছাড়ব না। তুমি যা বলবে আমি মেনে নেবে। কথা দিলাম আর ওখানে থাকবনা। ও কাজ আর করবনা। " তারপর সে নিজের অভিশপ্ত জীবনের কথা বলল। গনু কি বুঝল, সে দুহাত দিয়ে শিউলিকে আঁকড়ে ধরে বলল, " তবে চল আমরা এখান থেকে চলে যাই, অন্য কোথাও। "
শিউলির ঘর, শিউলির ব্যবসা, তার দীর্ঘ উনিশ বছরের ঐ কদর্য জীবন সব পিছনে ফেলে সে এগিয়ে গেল, শুধু গনুর হাতটা ধরে।
গনুও পরম নিশ্চিন্তে শিউলিকে আঁকড়ে ধরে চলল কোন এক নতুন সংসারের পথে। শুরু হয়েছিল এক নতুন দাম্পত্যের কাহিনী।