Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!
Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!

Rohit Patra

Abstract Tragedy Crime

4  

Rohit Patra

Abstract Tragedy Crime

দারোগা বাবু

দারোগা বাবু

12 mins
480


বলছি কি গান শোনেন তো? রোজই শোনেন, আচ্ছা মাঝে মধ্যে? তা কেমন লাগে শুনতে? ভালো বেশ, তাইনা? কত রকমভেদ আছে বলুন তো। পপ, জ্যাস, রক, ক্লাসিক্যাল ইত্যাদি ইত্যাদি। আপনার কি ভালো লাগে? রবীন্দ্র সংগীত না রক? আচ্ছা আচ্ছা বুঝেছি। ভাবছেন কম্বিনেশন টা ম্যাচ করছে না ঠিক? কোথায় রবীন্দ্রসংগীত আর কোথায়... আচ্ছা ছাড়ুন সেসব। কোনোদিন এরকম হয়েছে যে গান শুনে নিজের ওপর রাগ ধরেছে খুব? ঘেন্না করেছে? মনে হয়েছে এই মানুষের চামড়া টা টেনে ছিঁড়ে ফেলি? মনে হয়েছে যে গান নামক বস্তুটার অস্তিত্ব আছে কেন? মনে হয়নি? ধুর মশাই কি গান শুনেছেন তাহলে? ভাবছেন কোথাকার কে দিজ্ঞজ এলো জ্ঞান দিতে? তাহলে প্রথমেই বলা ভালো আমি সেসব কেউ না। পেটে বিদ্যাও আপনার চেয়ে ঢের কম। নেই বললেই চলে। কিন্তু আমি শুনেছি সেই গান। রোজই শুনতে পাই। জানেন এক সময় আমি গান পাগল ছিলাম। কি যেনো বলে ইংরিজি তে। ধুর ধুর মাথায় আসে না। তো হ্যাঁ যেটা বলছিলাম... একটা সময় লতা থেকে শুরু করে কিশোর কুমার, মান্না দে, হেমন্ত মুখার্জী কতজনের ই গান শুনেছি... আর এখন গান শুনলেই আর্তনাদ করে উঠি। অসহ্য লাগে আমার গান।


আরে মশাই চলে যাচ্ছেন? বিরক্তি লাগছে খুব? বিশ্বাস করুন আপনার সময় আমি নষ্ট করবো না। শুনে যান না একটু। আরে আরে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে? ছাড়ুন আমার হাত। ওকি আমার হাত বাঁধছেন কেনো?


" একেবারে বদ্ধ পাগল মালটা। সারাদিন পর একটু সময় পাই বসার। এখনও জুটে গেছে পাগল ছাগল সব।" নিজের মনেই আওড়ে চলেছে কথাগুলো থানার দারোগা প্রণয়। "আই খানকির ছেলে কথা বলবি না। বেতের লাঠিটা দেখেছিস? চাবকে ছাল তুলে দেব আর একটা কথা বললে। খুন করার সময় এসব কথা মনে ছিল না? এখন পাণ্ডিত্য দেখাচ্ছিস আমাকে? জ্ঞানের কথা তোর মাকে শোনাবি শুয়োরের বাচ্চা। ফিরিয়ে আনতে পারবি ওকে? কত পাপ করেছিস হিসেব রাখিস? তুই এসব বলে সমবেদনা পাবি আমার থেকে? তোর মত জানোয়ারদের কেটে ফেলা উচিত। উপায় থাকলে এখনই গলা টিপে মেরে দিতাম।" উঠে দাড়ায় প্রণয়। লাঠিটা নিয়ে দুঘা ধরিয়ে দেয় তার পিঠে। যন্ত্রণায় কাতরে ওঠে। গুনগুন করে কি একটা গানের সুর ভাঁজে আর পরমুহূর্তেই বলে " কি বাজে গানটা। তাইনা?" কপালের রগ ফুলে ওঠে প্রণয়ের। বেদম পেটাতে থাকে লোকটাকে। মারতে মারতে নাক মুখ থেকে রক্ত বেরিয়ে আসে। ঝুলে পড়ে চোয়াল টা। " মারুন বড়বাবু। যতখুশি মারুন। আমি এটার ই যোগ্য। কিন্তু আপনি শুনলে আপনিও বুঝবেন। ঠিক বুঝবেন।" পাগলের মত হাসতে থাকে সে। রাগের পারদ চড়তে থাকে। আর বেশিক্ষন এখানে থাকলে তার হাতে খুন হয়ে যাবে লোকটা।


ছোট থেকে বাড়িতে দেখে এসেছে সে বাবাকে। পুলিশে কাজ করতেন। জাদরেল অফিসার ছিলেন।খুব নাম ডাক ছিল চারিদিকে। কত দাগী আসামীকে তিনি ঘোল খাইয়ে ছেড়েছেন। নাম শুনলেই তটস্থ হয়ে থাকতো সবাই, সে চুনো পুটিই হোক বা রাঘব বোয়াল। সে বাবার মত হতে চেয়েছিল। খুব মনে পড়ে আজকে তার কথা। বছর কয়েক হলো তিনি চলে গেছেন অনেক দূরে যেখান থেকে পুলিশের থাবাও উদ্ধার করতে পারেনি কাউকে। একবার তিনি বলেছিলেন " প্রণয় খুব সম্মানের এই কাজটা। খুব সততা লাগে। কোনোদিন তুই পুলিশ হলে বিকিয়ে দিসনা নিজেকে। ওই যে টাকা গুলো দেখিস যেটার জন্য পৃথিবীটা ছুটে চলেছে, গিলে চলেছে রাহুর মত সবাইকে, ওটার দাস করবি না কখনও নিজেকে।" ছোট্ট প্রণয় তখন হা করে তাকিয়ে থাকতো। কথার মানে বোধগম্য হতো না তার। কিন্তু এখন সে বোঝে। যদিও বাবার মত হওয়া তার হয়নি। ক্যান্সার ছোঁয়াচে নয়। কিন্তু যে রোগ তাকে পেয়ে বসেছে সেটা ক্যান্সারের থেকেও ভয়ানক। কুরে কুড়ে খাচ্ছে তাকে রোজ। টাকা চাই আরও। মন ভরছে না কিছুতেই। মানুষের জন্য কাজ করেনা বলা যায় না। তবে আইনের ছিদ্র সেই প্রশস্ত করে আরো। কত আসামী ছাড়া পেয়েছে তার হাত থেকে, কত ঘুষ নিয়েছে সে এই হাত দিয়ে। অথচ দিনের শেষে তার অনুশোচনা হয় না বিন্দু মাত্র। কিন্তু আজকের এই লোকটার ওপর তার রোষ টা একটু বেশি। পারলে নিজেই খুন করতো তাকে। বেশ যন্ত্রণায় কাতরে কাতরে... থানা থেকে বেরিয়ে আসে। মনটা ভালো নেই আজ তার। বাড়িতে ঢুকতে ইচ্ছা করে না। আবার নীলিমা কাদবে তাকে দেখে। ঘরটা যে খুব ফাঁকা লাগে তার। তাদের একমাত্র মেয়ে মারা গেছে দিন কয়েক হলো। এখনও সে মানতে পারেনা কিছুতেই। এইতো সেদিন আকার ক্লাস থেকে ফিরে জড়িয়ে ধরে বাবাকে বলেছিল "আমাকে এনে দেবে নতুন রং পেন্সিল। তোমার ছবি আঁকবো।" বার বার ভেসে ওঠে কথাটা তার কানে। অসহ্য লাগে। গলার কাছটা দলা পাকিয়ে আছে। সেদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরতে দেরি দেখে সুরভীর খোঁজ পড়ে যায়। যতই হোক। পুলিশের মেয়ে বলে কথা। কিন্তু ওইটুকু সময়ে কোথায় হাওয়া হয়ে গেলো। কদিন পরে বস্তির এক ভাঙ্গা ঘর থেকে পায় সুরভীর লাশ। খুনিকে ধরতে বেশি সময় লাগেনি তার। হিংস্র বাঘের ন্যায় ধাওয়া করে সে আসামীকে ধরে ফেলে সন্ধের মধ্যেই। বলা যায় আসামী নিজেই তাকে ধরা দিয়েছে। কিন্তু তাকে ধরেও কি সে ফিরে পাবে সুরভীকে? যখনই তার মনে পড়ছে রক্তশূন্য সুরভীর দেহটা অসহায় হয়ে পড়ে ছিল ঘরের কোণে... আর ভাবতে পারে না। সস্তা দামী কোনো মদ ই তাকে ভোলাতে পারছে না। নীলিমা র কান্না আসেনা আর, সবকিছু সে ধূসর দেখে। মাঝে মাঝে গোয়িয়ে ওঠে আর তাতে নেশা কেটে যায় প্রণয়ের। প্রলাপ বকে। " ওফ্। থামবে এবার। ওই ওই যে দেখতে পাচ্ছো না সুরভীকে। ঐতো খেলা করছে সিড়িতে। মাথাটা গেলো নাকি?..." মদের গ্লাসটা তুলে নেয় আবার। বাকিটা ঢক ঢক করে গলায় ঢেলে গড়িয়ে পড়ে সোফা থেকে। রাত কেটে যায়। সারাদিন ধরে ঘ্যান ঘ্যানে গান চলে যায়। গানের কথা কিছুই মাথায় ঢোকে না। সারাদিন কেমন ঝিমিয়ে থাকে প্রণয়। মাসকয়েক কেটে যায়। রোজ রোজ সে থানায় যায় আর গায়ের ঝাল মেটাতে থাকে লোকটার ওপর।খুনের দায়ে সুপ্রিম কোর্ট তার ফাঁসির রায় দেয়। দেখতে দেখতে এগিয়ে আসে দিন।

"তোমারেই করিয়াছি জীবনেরও ধ্রুবতারা, এ সমুদ্রে আর কভু হবো নাকো পথহারা... হু হুম হুম।" নিজের মনে গুন গুন করে গান করতে থাকে জেলের ঘানি টানা আসামি টা।

"গান বন্ধ কর শুয়োরের বাচ্চা। জিভটা কেটে ফেলবো এখনই। বন্ধ কর বলছি!"

" আচ্ছা বড়বাবু এসেছেন? আমার তো আর নেই বেশিদিন। পরশুই তো... আমাকে শেষ বারের মত বলতে দেবেন না কথা গুলো? শুনবেন না সেই গান?"

সন্তান বিয়োগের দুঃখ আর ক্রোধ একসাথে মিশে আবার হিংস্র হয়ে ওঠে সে। পায়ের পাতায় লাঠি দিয়ে মারতে থাকে একের পর এক। যন্ত্রণায় ককিয়ে ওঠে লোকটা।

"শুনবেন না আমার কথা? একটিবারের জন্য?" কেঁদে ওঠে সে। ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদতে থাকে। কি মনে হতে একটু নরম হয় প্রণয়ের মন। যদিও মেয়ের কথা তার মাথায় ঘুরতে থাকে অনবরত।

"ঠিক আছে কি বলবি বল শুয়োরের বাচ্চা। এমনিও তো মরবি। কি তোর এত কথা শুনি আজকে। বল..."

হুংকার করে ওঠে প্রণয়।


"জানেন বড়বাবু? আমি মারতে চাইনি আপনার মেয়েকে। ও আমার নিজের মেয়ের মতোই। ওকে ধরে এনে ভেবেছিলাম টাকা আসবে কিছু। বিশ্বাস করুন আমি জানতাম না ও আপনার...। আমি ফিরিয়ে দিতাম ওকে কিছু টাকা পেলেই। কিন্তু মুখের দিকে চেয়ে আমার মরা মেয়েটার কথা মনে পড়ে গেলো। কিছু করতে পারলাম না। ভাবলাম ওকে আমার কাছেই রাখবো। যেতে দেবো না। কিন্তু ও থাকতে চাইলো না জানেন? বললো এখানে খুব নোংরা, ও হাফিয়ে উঠছে। আমরা নাকি বাজে লোক। কথাটা শুনে মাথাটা গেলো বিগড়ে। এ তো আমার লক্ষ্মী হতেই পারে না। ও কখনও বলেনি আমাকে এরকম। কোনোদিন খেতে না পেলে বলতো পেট খারাপ আজকে। খিদে নেই। জানেন ওকে দেখে কাদতাম। ওইটুকু মেয়ে আমার কথা ভেবে... আর আপনাদের বড়োলোকের ঘরে আপনারা ফেলে ছড়িয়ে খান। নষ্ট করেন খাবার। আপনারা কীকরে বুঝবেন হপটাখানেক না খাবার কষ্ট? রোখ চেপে গেল। খেতে দিলাম না ওকে দুদিন। বন্ধ করে রাখলাম ঘরটায়। ভেবেছিলাম বলবে " খেতে দাও আমাকে। খিদে পেয়েছে বাবা।" কিছু শুনতে পেলাম না। দুদিন কেটে গেলো। দরজা খুলে দেখি পড়ে আছে ও মাটিতে ।শরীরটা বেজায় ঠাণ্ডা। ভাবলাম ঘুমিয়ে পড়েছে। হাত পায়ে সেক দিলাম। তাও কথা বললো না। লক্ষী লক্ষী বললাম কবার। সাড়া দিলো না।"

বনের জন্তুর মত চোখ লাল হয়ে উঠেছে প্রণয়ের। পায়ে করে সজোরে দুটো লাথি মারে তাকে। মাথা দেয়ালে ঠুকে দেয়। সরু সুতোর মত রক্তের ধারা বেয়ে আসে তার গাল বেয়ে। ঠোঁটের কোণে একটু হাসি দেখা দিয়েই আবার মিলিয়ে আসে।

"ওকে কোলে তুলে ভালো করে দেখলাম মুখটা। লক্ষ্মীর মুখটা ভেসে উঠলো। ভাবলাম ওর মুখে খাবার তুলে দেব। সে ও বেচেঁ থাকুক বা না থাকুক। প্যান্ট টা ছিঁড়ে গেছিলো। এই দেখুন না। পকেটে টাকা রাখার উপায় নেই। আর কটাকা ই বা ছিল যে যত্ন করে তুলে রাখবো। লুকিয়ে রাখা টাকার ভাঁড় টা আছড়ে ভাংলাম। দু চার পয়সা যা পেলাম তাই দিয়েই কিনে আনলাম দুটো পাউরুটি। খিদেতে পেট এ রাহু ছুটছিল আমার। ও খেতে চাইলো না। মুখ খুললো না কিছুতেই। জোর করে এক টুকরো পাউরুটি গুঁজে দিলাম। নিজে খেলাম বাকিটা। একবার ট্রেন থেকে পকেট মেরে পেয়েছিলাম একটা গান শোনার মেশিন। কিসব বলেন আপনারা। জোরে জোরে গান চালালাম। "তুঝ সে নারাস নেহী জিন্দেগি হয়রান হূ ম্যায়, পারেশন হ্ন ম্যায়।" রাগ করেছিস লক্ষ্মী আমার ওপর? সোনা আমার। আর করবো না অমন। এবার খেয়ে নে। তোকে কাচের চুড়ি আর ফ্রক কিনে দেবো ।তুই বলেছিলিস না মেলা তে। সেবার এ তো কিনতে পারিনি। এবারে যাহোক করে তোকে কিনে দেবো মা।

তাও আমার সাথে কথা বললো না ও।" কাদতে থাকে আবার। শুকনো রক্ত আর চোখের জল মিশে রাতের থেকেও ঘোলাটে হয়ে ওঠে তার দৃষ্টি।


প্রণয়ের মনে হয় এখনই তার গলায় পা ঢুকিয়ে দিক। হৃৎপিন্ডটা খুলে আনবে সে তার। কিন্তু কিসের জন্য হাত কেপে যায়। আবার বলতে থাকে সে "কোলে তুলে নিলাম তাকে আবার। লক্ষী মা একবার কথা বল। আর তোকে খেতে না দিয়ে বন্ধ করে রাখবো না। তুই কেনো বললি অমন করে? কিরে, কথা বলবি না? তারপরেই আপনি এলেন দলবল নিয়ে আগের মতই। আগের মতই আমি বসে ছিলাম চুপ করে। আপনি কোমরে দড়ি বেধে ঘষতে ঘষতে নিয়ে এলেন। আমার লক্ষ্মীকে আমার থেকে দূরে নিয়ে চলে গেলেন।"


ও আমার মেয়ে ছিল। সুরভী। লক্ষী না। কোথাকার কোন রাস্তা থেকে তুলে এনেছিস তোর মেয়েকে! আমার মেয়ের সাথে তুলনা করিস না ওর। আর একবার আমার মেয়ের কথা মুখে আনলে... যন্ত্রণায় অসাড় শরীরটা কে টেনে তুলে লোকটা ঝাঁঝিয়ে ওঠে " হোক রাস্তার, ও আমার মেয়ে ছিল। মনে পড়ে না সেবার আপনারা দলবল সমেত ঢুকে পড়েছিলেন আমাদের ঘর ভেঙে। আমাকে মেরেছিলেন বেধড়ক। কেন? একটা রুপোর গয়না চুড়ি করেছিলাম বলে? মেয়েটা ভালো করে খায়নি সেবারেও। ভালো ছিল না ওর শরীরটা। খুব কাসছিল কদিন ধরে। ভেবেছিলাম ওটা বেচে যা আসবে তা দিয়ে খাবার কিনবো, ওষুধ কিনবো। পেট ভরে খাবো দুজনে। ছিনিয়ে নিতে পারতেন হারটা। দিয়ে দিতাম হাসি মুখে। মারতে পারতেন। আমার সামনে লক্ষ্মীকে ধাক্কা মারলেন, কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে এলেন থানায়। দুদিন পর জানেন কি হয়েছিল? আপনাদের থেকে ছাড়া পেয়ে দু চার টাকা যোগাড় করে রুটি ঘুগনি কিনে আনি। লক্ষী লক্ষ্মী আমি এসে গেছি মা। কোথায় তুই? আজকে খাবো ভালো করে। দেখ রুটি ঘুগনি এনেছি।

সাড়া মেলে না। ঘরে ঢুকে দেখি লক্ষ্মী পড়ে আছে একইভাবে। আবছা আলোতে ওর মুখটা ফ্যাকাসে হয়েছিল। ঠোঁটের কোণে সাদা ফেনা উঠেছিল। কতবার ডাকলাম সাড়া দিলো না। জানতাম আর সাড়া দেবে না। সেই গানের মেশিনটা তখনও বাজছিল জানেন। "লাগ যা গলে কি ফির ইএ হাসিন রাত হো না হো সায়েদ ফির্সে জনম মে মুলাকাত হো না হো।" ছুঁড়ে ফেললাম মেশিনটা কে। অসহ্য লাগলো গানটা। মনে হলো কি এসব! বাল্ ছাল গান সব। লক্ষ্মীর গলায় যে গান শুনেছি সেটার মত গান কেউ গাইতে পারবে না। আপনাদের অস্কার জয়ী এ আর রহমান ও না। ফিরিয়ে দিতে পারবেন আর লক্ষ্মীকে? পারবেন না। সেদিন আমাকে নিয়ে না গেলে যাহোক করে মেয়েটাকে বাঁচানোর চেষ্টা করতাম আমি। আর আপনি কি করলেন সেদিন? মোটা টাকার মাইনে পেয়ে দুটো গরিবকে লুটে রুটি মাংস খেলেন রাতে? আচ্ছা মাংসটা থেকে পচা একটা গন্ধ পেয়েছিলেন? গা গলায়নি আপনার? ও আপনারা তো বড় সর মানুষ। এসব তো খাবেন না আপনারা। তাইনা? সেদিন পেটে খাবার পড়েনি। খিদেটাও আর অনুভব করতে পারছিলাম না। চিৎকার টা ভেতর থেকে আসছিল। শক্তি ছিলনা। মনে হচ্ছিল এই মানুষের চামড়াটা কে টেনে খুলে ফেলি। বনের পশু রাও এর চেয়ে অনেক অনেক ভালো জানেন।"

প্রণয়ের দাঁত শক্ত হয়ে ওঠে। আসামীর সামনে বলে নাকি তার অনুশোচনা তাকে পুড়িয়ে মারছে ভেতর থেকে বলেই তার চোখ ছল ছল করে উঠলো।

" এতেই জল এসে গেল চোখে? আপনারা কাদেন? কি গান চালিয়ে যেরকম মদ খান সেভাবেই?" পাগলের মত হেসে ওঠে সে। " যাবেন আমার সাথে? একটা জায়গা দেখাবো। শেষবারের মতো। যাবেন আমার সাথে। হাতে হাতকড়া পরিয়ে দেবেন। কোথাও পালাবো না বিশ্বাস করুন। আপনাকে সেই গান শোনাবো। শুনবেন না?"

কোথায় যাবি? জাহান্নামে?

দেখবেন বাবু। আপনার ভালো লাগবে না। কিন্তু আপনি ঠিকই বুঝবেন। আমি জানি।

জিপে বসে দুজনে আসে এক বস্তিতে। দুজনের কাছেই চেনা সেটা। একজনের শিকার এর স্থান আর একজনের শিকার হবার। ঘিঞ্জি এলাকা। মাটির বাড়ি। কয়েকটার অবস্থা খুব শোচনীয়। খড়ের আর আদবেস্টাস এর ছাদটা কোনরকমে বাঁচার মিথ্যে আশা টাকে আকড়ে ধরে রেখেছে।

হাতে হাতকড়া পড়ে ঘাড় নাড়িয়ে লোকটা বলে

" আসুন আমার সাথে। গানটা শুনতে পাবেন। চালাকি করবো না। এমনিও মরবো। নাহয় আপনি বন্দুকের ঘোড়া চেপে আমার দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য করে দেবেন।"

ওই যে শুনতে পাচ্ছেন? একটা সুর ভেসে আসছে। বেহালার সুর না। ও অনেক দামী, বড়োলোকের আসর ঘরে বাজে। সৌখিনতা ওসব। এটা আমাদের সুর। ওই যে ঘরটা দেখছেন কান্না ভেসে আসছে যেখান থেকে হ্যাঁ হ্যাঁ ওটাই... ওদের ঘরে বাচ্চাটার মা গলায় দড়ি দিয়েছে। আর ওই যে ঘরটা দেখা যাচ্ছে ওর বাবাকে আপনাদের লোক পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। হার্ট এ্যাটাক বলে চালিয়ে দিয়েছেন তাইনা? আর হ্যাঁ ওই বাড়িটা... ধার নিয়ে শোধ করতে না পারায় গুলি খেয়ে মরেছে। সবাই কাদঁছে। অথচ সবার কান্না বোঝা যাচ্ছে। কত রকমের কান্না! কি অদ্ভুত। সবার কান্না মিশে কিরকম সুর তুলেছে। আর ওই কথা ওই গোঙানি গুলো মিশিয়ে দিন। পারফেক্ট গান। তাইনা? অথচ এরা অস্কার পায়না। রোজ এই কবরখানা য় শুয়ে শুয়ে এই গান ই শুনি আমি। বাকি সব গান কে ঘেন্না হয়। এটাই আসল...। আপনারা যেসব বড়োলোকের হয়ে চাকরি করেন যাদের টাকায় বসে খান তারা কোনোদিন শুনেছে এই গান? শোনেনি। কত অপরাধীকে ছেড়ে দেন? কত ঘুষ নেন? আর দিনের শেষে এসে আমাদের লুটে নিয়ে যান। আপনারা এত বড় মানুষ। দিনের শেষে শরীরের খিদে মেটাতে এসে হাত পাতেন আমাদের মেয়ে বউ দের কাছে। অন্ধকারে সব মিশে যায় তো। তাই নিজেদেরকে আর চিনতে পারেন না। দুটো টাকার জন্য সম্মান বেচে কতজন। ওই যে দেখতে পাচ্ছেন না? দাড়িয়ে ওখানে? ওর স্বামীকে তো আপনারাই ধরে নিয়ে গেলেন সেবার। কই আর ফিরে আসেনি সে। বড়োলোকের বাড়ি ডাকাতি করতে গেছিলো... এই পুলিশ শুনুন না পরশু আমার ফাঁসি তো। আর এই একঘেয়ে গান শুনতে ইচ্ছা করেনা আমার। মেয়েটা আমার জন্য অপেক্ষা করে বসে আছে। ও খেতে পেয়েছে ঠিক করে? ওর খবর নিতে পারিনা তো। আমাকে মেরে ফেলুন না দারোগা বাবু। আপনার বন্দুকটা একটু রক্তের স্বাদ পাবে। মেরে ফেলুন না আমাকে। পায়ে পড়ছি আপনার। কেউ জানতেও পারবে না।...দারোগা ও দারোগা" তাকে জিপে টেনে তোলে অন্য দুই কনস্টেবল।

প্রণয় তাদের এগিয়ে যেতে বলে। এই প্রথমবার তার মেয়ে হারানোর যন্ত্রণার থেকেও বেশি যন্ত্রণা অনুভব করে সে। বুকের কাছটা খুব ভারী লাগছে। শরীরের ভেতরটা জ্বলছে। অ্যাসিড ঢেলে দিয়েছে কেউ যেনো। একটা একটা করে অঙ্গ পুড়ে ভস্ম হয়ে যাচ্ছে। বসে পড়ে সে মাটিতে। নিজের হাতটা তার এত লাল লাগছে কেনো? একি এত রক্ত? রক্ত বন্ধ হচ্ছে না কেনো? প্যান্ট এ হাত চেপে ধরে। কোথায় রক্ত? কোথায় কি? এতদিনের পাপ তার শিরদাঁড়া বেয়ে নামতে থাকে। চূড়ান্ত ঘেন্নায় বন্দুকের দিকে তাকিয়ে দেখে সে। চোখ আর তার রক্তজবা। অসহ্য পাপের দায় কে সামলাবে? সেও তো খুন করেছে কত। কত মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। কিন্তু সে কীকরে?...


বাড়ি ফেরে না সেদিন। রাস্তায় রাস্তায় ঘরে। একটা করে ল্যাম্প পোস্ট গোনে আর তার আলোয় দেখে বস্তির প্রাণীগুলোকে। এক টুকরো খাবার কিরকম ছিঁড়ে খাচ্ছে। নিজের শরীর আর অনুভব করতে পারে না সে। রাতের পাগল করা হওয়াতে ও পোড়া চামড়ার গন্ধ পায়। কালকে ভোরে ফাঁসি হবে। ফাঁসি টা কার আসলে? ভাবতে ভাবতে রাত কেটে যায়। ভোরের আলো দেখা যায় না তখনও। সারা রাত এদিক ওদিক ঘুরে অনেক ভাবে সে। 4:30 এ থানায় ফিরে আসে। দেখে লোকটা হাসি মুখে গরাদ ধরে বসে। প্রণয় বাঁচাতে চায় তাকে। মনে হয় সে বলুক " অনেক দূরে চলে যাও তুমি। ফিরে এসনা আর কোনোদিন।" কিন্তু আইনের শিকলে সেও বাঁধা। তালা খুলে ভেতরে ঢুকে বসে। তখনও লোকটা কি একটা গানের সুর ভাঁজছে। প্রণয়কে দেখে মুখ তুলে মৃদু হাসে।

তুমি এখনও হাসছো? হাসি পাচ্ছে?

কি বলছেন দারোগা? হাসবো না? আনন্দ করবো না? লক্ষ্মীর সাথে দেখা করবো। গান শুনবেন একটা? গাইব?

গাও

লোকটা গান শুরু করলো। আজ আর রাগ ধরলো না প্রণয়ের। শুধু একটু হেসে তার প্রসংশা করলো।

সময় এলো। বের করা হলো তাকে গারদ থেকে। তারপর একে একে তোড়জোড় করে তার গলায় ফাঁস লাগানো হলো। প্রণয়ের দিকে তাকিয়ে ছিল লোকটা। মুখে তার মৃদু হাসি। প্রণয়ের মনে হলো সেই দড়ি টা নিজের গলাতে অনুভব করছে। তারপরেই হঠাৎ করে পৃথিবীটা অন্ধকার হয়ে এলো আস্তে আস্তে। দড়িটা কয়েকবার নড়ে উঠলো। তারপর থেমে গেলো সব। ধূসরতা আরও একটুখানি বাড়লো।


থানায় ফিরে আসে সে। কনস্টেবল দুজনকে বাইরে যেতে বলে। একবার মানিব্যাগ থেকে সুরভীর ছবি বের করে। একফোঁটা জল পড়ে তার ওপর। তারপর পকেট থেকে বন্দুক টা বের করে আনে। একটা কান ফাটানো শব্দ প্রতিধ্বনিত হয় আর ধূসর সুরকি ওঠা দেয়াল ভেজে লাল তরলে। 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract