পুরানো বইয়ের হলুদ পাতা
পুরানো বইয়ের হলুদ পাতা
আমি মানব মন্ডল। সাদামাটা চাহিদা হীন মানুষ বলেই পরিচিত সবার কাছে। একা জীবন কাটাচ্ছি শহরের শেষ আমার নিজস্ব একটা স্বপ্ন দুনীয়ায়। আজ আমার নিজস্ব একটা ঠিকানা আছে সেখানে। কিছুটা জমিতে ফুলের বাগান, সাথে সব্জী বাগান। একটা পুকুর। ছোটখাটো একটা বাগান বাড়ি বলতে পারেন। জীবনের সবটুকু আয়ের সঞ্চয় দিয়ে করা।
আমার বেশ দিন চলে যায়। মালি কাকার সাথে কাজ করি। বিকালে কিছু বিনে পয়সায় ছেলে মেয়েদের পড়াই। পেটের ভাত জোগাড়ে জন্য চিন্তা নেই। এই বাড়িতে বাগান আর পুকুর সব কিছুই পাওয়া যায়। চাল, ডাল, মসলা পাতি , ওষুধ পত্র অন্যান্য জিনিস পত্র কিনতে, শীতকালে বাড়িটা ভাড়া দিয়ে থাকি বনভোজনের জন্য। আর মাঝে মাঝে ফুল গাছ বিক্রি করে বেশ ভালো টাকাই আসে। আমার তো বেশি চাহিদা নেই তাই চলে যায়।
তবে নেশা নেই এমনটা নয়। নেশা আছে বই পড়ার।একা হলেও আমি কিন্তু আত্মীয়হীন না। আমি আমার পুরানো জীবনের সাথে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে থাকলেও। আমার ভাই বোন এবং তাদের ছেলে মেয়েরা আমার কাছেপুরানো বইয়েরআসে মাঝে মাঝেই। বছরের অন্য সময় না পারলেও। দূর্গা পূজার সময় ওরা আসবেই। আমার প্রাক্তন বিনে পয়সার ছাত্র ছাত্রীরাই গত তিন চার বছর ধরে এখানে দূর্গাপূজা করে।
আসলে বাঙালির প্রিয় উৎসব দূর্গাপূজা প্রতি আমার একটা দুর্বলতা আছে। দূর্গা পূজা ঠিক কিন্তু পূজা না। একটা মিলন উৎসব। এই দূর্গা উৎসব চারদিন একটা মায়াবী সময় কাটে । তবে দূর্গা পূজা ছাড়া আরো একটা বিষয় আমায় দুর্বলতা আছে।
সেটা হলো বই।
আমার এই বাড়িতে । আমার বলতে শুধু দুইটো ঘর আছে। বাদবাকি গুলো সব অতিথিদের । আমার ঘর খুঁজে বের করা সহজ উপায়, পুরানো বইয়ের তাক। আমাকে উপহার দেয় বই। বিশেষ করে আমি ভালোবাসি পুরাতন বই। হয়তো আমার মতো অনেকেই ভালোবাসে পুরোনো বই পড়তে। ওই যে হলুদ হয়ে যাওয়া পাতা, সামনের পাতায় লেখা ছোট্ট দুটো কবিতার লাইন বা আশীর্বাদ সূচক কথা, মাঝের পাতায় রাখা কোনো ভুলে যাওয়া চিঠি, বা শুকনো ফুল। ওগো আমার ভীষণ ভীষণ প্রিয় । জানেন এক একটা পুরোনো বই এক একটা সময়ের, স্মৃতির গল্প বলে। এদের যে কেন বিক্রি করে দেয়? মানুষেরা জানি না।
আজ সকাল থেকে মনটা ভালো ছিলো। আমার বাড়িতে একটা স্থায়ী দূর্গা দালানো করে নিয়েছি। স্থানীয় পটুয়া এসে এখানে এক মাস ধরে মায়ের মুর্তি বানায়। খড়ে ওপর মাটি দিয়ে দেবি মূর্তি রূপ দেওয়া রোজ একটুও করে দেখিছি। মহালয়ায় মায়ের মুর্তি গড়া পুরো হয়েছে চুক্ষু দানের মধ্যে দিয়ে। দুই দিন হলো মায়ের মুর্তি মধ্যে যেনো প্রান চলে এসেছে। যেনো জীবন্ত কেউ দাঁড়িয়ে আছেন। আলপনা দেওয়া সম্পূর্ণ। কাল ষষ্ঠী সবাই ব্যস্ত আমি ছাড়া। এখন আমার কাজ শুধু অপেক্ষা সবার জন্য। হয়তো এই একে একে ঢুকবে সবাই। তিন্নি, বাবাই, কেয়া, রঞ্জনরা। ওরা সবাই আমার ছেলে মেয়ের মতো। সবাই প্রতিষ্ঠা আজ । এটাই ভালো লাগে। একজন সাধারণ মাস্টার মশাইকে ওরা এতোটা ভালোবাসে সেটাই আমার কাছে বড়ো পাওয়া।
ওরা উপাহার হিসেবে নিশ্চিত আজ আবার বই আনবে । অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। পুরানো বইয়ের মধ্যে অনেক সংগ্রহ করে রাখার বই এসে যায়। আমার পুরানো বইয়ের তাকটা মূল্যবান হয়ে উঠবে সেগুলোতে। শুধুতো গল্প কবিতার বই না কতো গবেষণার বই চলে আসে এই পুরোনো বইএর ভিড়ে। আমার ছাত্রছাত্রীদের আমি নিজে কালিঘাট, গড়িয়াহাট গোলপার্ক, কলেজ স্টিট, ধর্মতলা ফুটপাত থেকে পুরাতন বই কেনা শিখিয়েছি। একটা বই খুজতে গিয়ে আমার আবিষ্কার করে ফিলে আরো কতো প্রয়োজনীয় বই ওই পুরাতন বইএর ভিতরে। তখন বইকেনার আনন্দটা দ্বিগুণ হয়ে যায়।
কাল রাতে মৌ আবার বলেছে আমার জন্য সারপ্রাইজ আছে। নিশ্চিত কোন রেয়ার বই খুঁজে পেয়েছে। তাই আরো মনটা উসখুস করছে। কখনো ওরা আসবে। সেই অপেক্ষায়। সকাল থেকে ভালো লাগলো ছিলো। সকালে শিশির গুলোও মিচকি মিচকি হাসছিলো। শালিক গুলোও টিসজ করছিলো আমাকে বোধহয়।
শেষ মেশ মৌ পোঁছাতে আমার অপেক্ষা শেষ হলো। খবরের কাগজ মোরা ছোট একটা বই। অথচ ও বলেছিলো সারপ্রাইজ। কাগজ মোড়া খুলতেই বুকের স্পন্দনটা বড়ে গেলো। বইয়ের নাম " কবিতায় ভালোবাসি "। খুব চেনা প্রচ্ছদ লেখকের নামের জায়গায় জ্বলজ্বল করে উঠলো আমার নামটা। অন্তত পঁচিশ বছরের পুরনো বই। এটা আমার প্রথম বই ষোড়শী বলে একটা লিটলম্যাগ থেকে বেরিয়েছিল। প্রকাশনা সংস্থাটা ছিলো আমার এক বন্ধুর। লেখা লেখিতে সফল হতে না পেরে এখন কাপড়ের দোকান খুলেছে। একশ কপি বোধহয় ছাপিয়ে ছিলো। ফলে সে বছরেই সব বিক্রি হয়ে গেছিলো। পুনঃ মুদ্রানের ভাবনা ছিলো কিন্তু আমি না করেছিলাম। কারণ ওগুলো সব বিক্রি হয়েছে আমার মুখ দেখে। বলতে পারেন পুস সেল। তাই ঝুঁকি নিতে চাই নি। কারণ আমি জানতাম ওগুলো কাঁচা হাতের লেখা। আসলে একটা লেখা যখন আপনি লেখেন তখন আপনার মনে হয় এটাই আমার সেরা লেখা। কিন্তু পরে মোহভঙ্গ হয় কিছুদিন গেলেই। সেটাই ঘটেছিল আমার সাথে। কিন্তু পরে আপনার লেখার বচন ভঙ্গী গঠনরিতী বদলাতে শুরু করে। তাই এই বইটা আমি অনেকদিন খুঁজেছিলাম। কারণ আমার উদাসীনতা ফলে আমার কাছে একটা লেখক কপি ছিলো না। প্রকাশক বন্ধুবান্ধব কারো কাছেই একটা কপি ছিলো না।
ভীষন উত্তেজিত হয়ে পাতা উল্টাতেই। বইটা উল্লটোতেই আমার হাত থেকে বইটা পড়ে গেলো আপনা থেকে।
আমি দেখলাম আমার চোখ ভরা জল দেখে ওদের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেলো। ওরাতো আমাকে কোনো দিন চোখের জল ফেলতে দেখেনি। তাই ওরা বুঝতে পারলো না ওরা কি করবে। আমি বইটা তুলে চুপচাপ ঘরের ঢুকে পড়ালাম। বললাম " তোরা পূজাটা সামলা আমাকে একটু একা থাকতে দে।"
বাইরে ঢাকের বাদ্যি আবার বেজে উঠলো। আমার পুরানো বইএর তাকে বইটা যত্ন করে রেখে দিলাম। বইএর প্রথম পাতায় লেখাটা আমার হাতে লেখা।
"তোমার চুলের গন্ধ নিয়ে, বাতাস আসবে আমার জানলায় প্রতি ভোরে। শুধু তুমি মনে রেখো আমারে।"
কবিতাটা আমি লিখেছিলাম নীলাঞ্জনার জন্যে। ওকে উপহার দিয়েছিলাম বইটা। প্রেম নিবেদন পরে বিয়েও হয়েছিল আমাদের। জীবন আমি ওর প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। ওর চোখে তাই আমি অসফল। আমাকে মনে রাখার প্রয়োজন করে না আর তাই বোধহয় বইটাও আজ ওর কাছে অপ্রয়োজনীয়।কেজি দরে বিক্রি হয়েছে হয়তো আমার সব অনুভূতি গুলো।
,,,,
