পছন্দ
পছন্দ
"যদি তারে নাই চিনি গো, সে কি...সে কি আমায় নেবে চিনে, এই নব ফাল্গুনের দিনে..."
রবি ঠাকুরের সব গানই অভিনব, বর্ণনাতীত, শ্রূতিমধুর কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু তাই বলে আশ্বিনের এই প্যাচপ্যাচে গরমে ভিড়ে ধাক্কা খেতে খেতে, এবড়োখেবড়ো রাস্তায় হোঁচট খেতে খেতে, জোরালো আলোয় চোখের দৃষ্টি প্রায় খুইয়ে, মাইকের এই গগনভেদী আওয়াজে ফাল্গুনের কথা তো মাথায় আসছেইনা, গানটাকেও অত্যাচার মনে হচ্ছে|
আর সেই কারণেই কাবলু খেপে লাল| এমনিতেই সেকেলে গান খুব একটা ভালো লাগেনা ওর, তার ওপর ভিড়ের মধ্যে ঘামচুপচুপ নতুন জামা, আশপাশ থেকে পায়ে পাড়া দিয়ে জুতোর বারোটা বাজানো - উফফ! কেন যে ও বেরোলো!
এদিকে ওর বাবা অমরেশ কিনতু গানের সাথে সাথে গুনগুন শুরু করেছে| বাবাকে নিয়ে পারা গেলনা, বাড়িতে, গাড়িতে, ট্রেনে, সিগনালে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গলায় রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনলেই ঘাড় দোলানো শুরু করে দেবে|
টুবলুও বেশ চিন্তায় পরে গিয়েছে| ওর হাতের আইসক্রিমটা প্রায় গলে গিয়ে শেষের দিকে, হাত গড়িয়ে চকোলেট গড়াচ্ছে| ঘাড় উঠিয়ে তাই মায়ের দিকে তাকালো, টিসু লাগবে|
একমাত্র অপর্ণা নির্বিকার| মুখের মধ্যে একটা খুশি খুশি ভাব নিয়ে ছেলের হাত ধরে ভিড় ঠেলে মণ্ডপের দিকে এগিয়ে চলেছে| এর পরের বার দড়ি উঠলেই ওরা মণ্ডপে ঢুকে যাবে|
সপ্তমীর সন্ধ্যা|
দক্ষিণ কলকাতার মুদিয়ালীতে ভিড় উপচে পড়েছে| তার মধ্যেই চারজনের এই ছোট পরিবারটি প্রায় আধঘন্টা লাইনে অপেক্ষা করার পর ঢুকে পড়লো চোখধাঁধানো মণ্ডপটির ভেতর|
ভেতরে ঢুকেই মোবাইলে ফটো তোলা, 'উহু-আহা-অসাম-ফ্যাবুলাস' এসবে ভরে গেল চারদিক| সবাই মন্দিরের কারুকার্যের সামনে নিজের সঙ্গীর সাথে সেলফি তুলতে ব্যস্ত|
'বাবা, এই জন্য বলেছিলাম আসবোনা, এতক্ষন কান ফাটিয়ে দিলো!' বাবার ওপর ক্ষোভ উগরে দিলো কাবলু|
অমরেশ কিনতু একইরকম, 'বলিস কি? হেমন্তবাবুর গলায় রবীন্দ্রসংগীত বিদেশিরাও শোনে রে, যেমন গান, তেমন গলার গাম্ভীর্য, পারফেক্ট কম্বিনেশন, এ পারফেক্ট জেম!'
এর মধ্যে একটু ফাঁক পেয়ে অপর্ণা ব্যাগ থেকে টিসু বার করে টুবলুর হাত মুখ মুছিয়ে দিলো| জলের বোতলটা বার করে অমরেশ আর কাবলুকে জল খাইয়ে নিজেও একটু খেলো| তারপর ব্যাগের ভেতর
বোতল ঢুকিয়ে প্রতিমার দিকে এগোতেই বাধা এলো , 'দর্শনার্থীরা দয়া করে সহযোগিতা করুন| মণ্ডপের ভেতর ভিড় করবেননা, বাঁ দিকের প্রস্থানপথের দিকে এগিয়ে চলুন|
হাঁটতে হাঁটতে ঘাড় ঘুরিয়েও প্রতিমা দর্শন হলোনা অপর্ণার, কয়েক ঝাঁক মানুষের মাথায় মায়ের মুখ ঢেকে গিয়েছে | ইশ, এই সব কাজগুলো মণ্ডপের বাইরে বেরিয়ে করলেই পারতো, অপর্ণা চুক চুক করে আফসোস সূচক শব্দ করলো জিভ দিয়ে|
মায়েদের আর ঠাকুর দেখা হয়না।
ঠিক তখনি, ভিড়ে ঠাসা মণ্ডপের ভেতর সবার অলক্ষ্যে, দড়ির অপর পাড়ে পাটাতনের ওপর ফুলমালার ধুপকাঠির ধোঁয়ার আড়ালে মুচকি হাসলেন দেবী |
"মোর ভাবনারে কি হাওয়ায় মাতালো, দোলে মন দোলে অকারণ হরষে.."
হেডফোন খুলে ফেলেছে কাবলু| মুদিয়ালী হয়ে শিবমন্দিরের পুজোর সামনে এসে আবার লাইনে দাঁড়ানো ওরা|
অপর্ণা অমরেশের দিকে এগোলো, 'বেরোনোর সময় ঠাকুরঘরের আলোটা জ্বালিয়েছিলে? আমি বলে দিয়েছিলাম কিন্তু বারবার করে?'
অমরেশের মুখ দেখেই বোঝা গেল কেস গড়বড়| 'আমি তো কাবলুকে বলেছিলাম, এই কাবলু..কিরে জ্বালিয়েছিলি তো?'
ডেইরিমিল্কের এডগুলোতে এক কামড় ক্যাডবেরি খাবার পর ছেলে-মেয়েগুলো যেমন মুখটা করে, ওরকম মুখ করে কাবলু এখন গানটা গিলছে| ওর ভারী পছন্দ এই রিমিক্স রবীন্দ্রসংগীতগুলো| এমনিতে খারাপ না হলেও মাঝে মাঝে মাত্রাতিরিক্ত যান্ত্রিক বাজনা ঢুকিয়ে দেয় বলে রেমিক্সগুলো আজকাল অনেকেই অপছন্দ করে|
যেমন অমরেশ| মানতেই হবে, যেই লোক সত্তর দশকের হিন্দি গান শোনে, হেমন্ত-চিন্ময়-দেবব্রত ছাড়া রবিঠাকুর শোনেনা, তার এরকম গান ভালো কেন লাগবে| ঝ্যাং ঝ্যাং করে গিটার, ড্রিম ড্রিম করে ড্রাম বাজছে, তার সাথে রবীন্দ্রনাথ?
ব্যাস, মণ্ডপে ঢুকেই তাই তুলকালাম লেগে গেল|
'বাবা ডাকছে, আর উনি হাত তুলে ইশারা করছেন| যদি বাবার হার্টফেল হতো আর তখন বাবা ডাকতো, তখনও কি তোমার গানটাই আগে শুনতে হতো? এতবার করে বলে এলাম আলোটা জ্বেলে আসিস, ক্লাস এইটের ছেলে মনটা কোথায় থাকে যে ভুলে গেছিস?'
অপর্ণাকেই ঢুকতে হলো ওদের মাঝখানে| সত্যিই তো, পুজোর দিন ওরা সবাই মিলে ঘুরতে বেরিয়েছে, এত সুন্দর করে সাজানো চারদিক, এই সময় ঝগড়াঝাটি বকাঝকার কোনো মানে হয়?
অবশ্য কথাটা 'ঠাকুর দেখা' হলেও আজকাল ঠাকুর আর দেখে কজন? মণ্ডপের উচ্চতা, চাকচিক্ক্যই এখন ইউ.এস.পি| সবাই চায়, এমন কিছু একটা করবে যেটা বাকিদের থেকে আলাদা হয়ে বিপুল এই জনসমুদ্রকে তাক লাগিয়ে দেবে| পুজোটা তো এখন প্রতিযোগিতা, ব্যবসা, নির্ভেজাল আনন্দের চেয়ে বেশি টেবিলের ওপর ট্রফি সাজানো, রাস্তার ধার দিয়ে বিজ্ঞাপনী প্রচার আটকানোর প্রথা |
আর পুজো কমিটিরও বলিহারি| এত কষ্টে এতক্ষন লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে মণ্ডপে ঢুকতে না ঢুকতেই এদের তাড়া লাগানো শুরু হয়ে যায়| কারুর যদি মন থেকে প্রতিমা দর্শনের সত্যিকারের ইচ্ছা থেকেও থাকে, সেই সুযোগটাও পাওয়া যায়না|
অপর্ণা একটু এগোনোর চেষ্টা করেছিল, হঠাৎ স্বেচ্ছাসেবক ছেলেটা এগিয়ে এলো, 'ম্যাডাম ভি.আই.পি পাস আছে? এই লাল ফিতের সামনে থেকে দেখতে হলে পাস লাগবে|'
অদ্ভুত তো! যাকগে, কি আর করা যাবে, দূর থেকেই ঠাকুরের দিকে চোখ রাখলো অপর্ণা|
'মা, আমি দেখতে পাচ্ছিনা আমাকে দেখাওনা|'
বেচারা পাঁচ বছরের টুবলু এখনো অতটা লম্বা হয়নি| অগত্যা কোলে তুলে নিতে হলো ওকে| অপর্ণা জানে এবার টুবলুর প্রশ্ন শুরু হবে, আর হলোও তাই| আর এই প্রশ্নোত্তর, কার্তিক-লক্ষ্মী, লায়ন-পিককের মধ্যেই ভিড়ের ধাক্কায় ধীরে ধীরে ওরা মণ্ডপের বাইরে|
'টুবলু, দেখলি আমাকে ঠাকুর দেখতেই দিলোনা| তুই যদি বেশি বেশি খেয়ে শক্তিশালী হয়ে যেতি তাহলে ওকে মেরে দিতি', ঠোঁট ফুলিয়ে মিথ্যে আহ্লাদ করলো অপর্ণা|
মায়েদের আর ঠাকুর দেখা হয়না।
এখানেও হাজার হাজার উৎসাহী চোখের দৃষ্টি এড়িয়ে, মণ্ডপের ভিড়ের মধ্যে হালকা চোখ ঘুরিয়ে মুচকি হাসলেন দেবী|
"হারে রে রে রে রে, আমায় ছেড়ে দে রে দে রে..."
রান্নাঘরে ছুটতে ছুটতে এলো টুবলু, "মা আমার ফেভারিট গানটা চালিয়েছে মাইকে, শুনছো?"
শুরু হয়ে গেল টুবলুর নাচতে নাচতে গাওয়া| খেয়েদেয়ে উঠে এভাবে নাচানাচি করলে বমি হয়ে যাবে না? নিজের ভাতের থালা রেখে ছেলেকে আগে ধরে-বেঁধে বসাতে গেল অপর্ণা| বাবার সাথে বড় ছেলে টিভির ঘরে ক্রিকেট দেখতে দেখতে খাচ্ছে, ওদেরকে এখন ওখান থেকে নড়ানো যাবেনা|
থাক গিয়ে, এইতো পুজোর কয়েকটা দিন সবাই বাড়িতে থাকে| দশমী ফুরালেই আবার অমরেশের অফিস, টুবলু-কাবলুর স্ক্যুল আর অপর্ণার কলেজ| পুজোর কয়েকটা দিন সব বাঙালিই উৎসবের মেজাজে থাকে| রাস্তাঘাটে কোথাও ঝগড়াঝাটি নেই, কথা কাটাকাটি হলেও 'থাক না দাদা পুজোর দিন' বলে রণে ভঙ্গ দেওয়া, সবসময় একটা পুজো পুজো গন্ধ, চারদিক রমরমা, ঝলমলে| হাজারো বাণিজ্যিক উপাদান থাকলেও কোথাও না কোথাও মনের ভেতর উৎসবমুখর বাঙালীয়ানাটা লোকে ভোলেনি|
মাংসের শুধু ঝোল-মশলা দিয়ে তাড়াতাড়ি ভাত মেখে খেয়ে নিলো অপর্ণা| অমরেশ দেখতে পেলেই এখুনি ছুটে এসে নিজের পাত থেকে মাংস তুলে দেবে| আসলে বাইরে এগরোল খাবার পর নিজের খিদেটা কম ছিল বলে রান্নার আন্দাজটা অপর্ণা করতে পারেনি আজ, সপ্তমীর চিকেন কষাটা একটু কমই পড়েছে|
রাত যখন প্রায় বারোটা বাজে, যখন পাড়ার ছোট্ট ফাঁকা মণ্ডপটায় ঝাড়বাতির আলোটা ঢিমে করে দিয়ে ঢাকিরা ঢুলছিলো, ঠিক তখনই মা দূর্গা বুঝলেন যে এই ফাঁকে তাঁকে একটু বিশ্রাম নিয়ে নিতে হবে| আরো পাঁচটা দিন টানতে হবে তো, আজকাল তো দ্বাদশীর আগে কেউ ভাসান দেয়না|
ভাগ্যিস ছেলেমেয়েগুলোকে খাইয়ে দিয়েছিলেন আগেই| গনেশ, লক্ষ্মী আর কার্তিক ঘুমিয়ে কাদা| অসুরটাও কোথাও গিয়েছে হয়তো, আশেপাশে দেখা তো যাচ্ছেনা| এই এক জ্বালা, লোকটা মদের নেশাটা কিছুতেই ছাড়তে পারছেনা| এখন মণ্ডপে কেউ এসে গেলে কি হবে|
স্বরস্বতীর হাত থেকেও গল্পের বইটা প্রায় পড়ে যায় যায়, চোখ আধবোজা| আলতো করে বইটা নামিয়ে রাখলেন দেবী|
লোকে ঠাকুরের মূর্তি দেখে, কিনতু সারাদিনে ওনাদের যে ধকলটা যায় সেটা কেউ বোঝেনা| ভোররাতে তৈরী হয়ে বস, সারাদিন গুচ্ছ গুচ্ছ লোক কেউ পুজো করছে, কেউ ফুল ছেটাচ্ছে, কেউ ক্যামেরায় টপাটপ ফটো তুলছে, বলিহারি বাবা, কতই যে রঙ্গ দেখা যায় দুনিয়ায়| আজকাল তো আবার পুজোয় প্রায় চব্বিশ ঘন্টা দর্শন দিতে হয়| পাড়ার এই ছোট পুজোগুলোতেই রাতে যা একটু চোখ লাগানোর সুযোগ থাকে|
শশুরবাড়ি থেকে আনা গান শোনার যন্ত্রটা বার করলেন দেবী, গান শুনতে শুনতে একটু ঝিমিয়ে নিলে শরীরের ক্লান্তিটা চলে যাবে| হেডফোন কানে লাগিয়ে একটুখানি এদিক ওদিক করে দেবী দূর্গা ওনার পছন্দের গানটা চালিয়ে দিলেন|
'আমার বেলা যে যায় সাঁঝবেলাতে...'
এসিটা একটু বাড়িয়ে ঘুমন্ত অমরেশের গায়ের ওপর চাদরটা টেনে দিয়ে অন্যপাশ ফিরে শুলো অপর্ণা| সারাদিনের নিত্যকর্মের ক্লান্তিটা তাকে গ্রাস করেছে এবার।
মোবাইলের হেডফোনটা কানে গুঁজে চোখ বন্ধ করে নিজের প্রিয় গানটা চালিয়ে দিলো|
'...তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে, আমার বেলা যে যায়..|”