ঝরা ফুলের গন্ধ
ঝরা ফুলের গন্ধ
বাবা অফিসে বেরোচ্ছে এখন।
জুতো পড়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে টাই বাঁধছে। পিকলু জানে এরপর কি হবে, এখন শীতের ছুটি চলছে বলে ও রোজ বাবার অফিস যাওয়া দেখে।
আয়না দিয়ে পিকলুকে দেখে বাবা হাসলো, 'ক্যাপ্টেন, কি ব্যাপার? ব্রেকফাস্ট করবেনা?'
বাবা ক্যাপ্টেন বলে ডাকলে পিকলুর খুব ভালো লাগে। আসলে বাবার সাথে খুব একটা সময় ছুটির দিনগুলো ছাড়া ও কাটাতে পারেনা। এমনিতে ওর স্কুলের সময়টা খুব বাজে, সকাল ৭টায় ওকে বেরিয়ে যেতে হয় স্কুলবাসে করে। বাড়ি ফিরতে ফিরতে দুপুর ২টো। তখন তো আর বাবা থাকেনা। অফিস থেকে যখন বাবা ফেরে সেই রাতের বেলায়, তখন পিকলুর খাওয়াদাওয়া হয়ে যায়। ওর ঘরে গিয়ে ও কমিক্স বা ড্রয়িং বুক নিয়ে বিছানায় উঠে পড়ে।
বাবা অবশ্য অফিস থেকে ফিরেই ওর ঘরে আসে। মাঝেমাঝে এটা সেটা কিনে নিয়েও আসে। ঘরে ঢুকে পিকলুকে নিয়ে লোফালুফি চটকাচটকি করে বাবা। পেটের মধ্যে আঙ্গুল দিয়ে কাতুকুতু দিয়ে ওর আর বাবার একটা নিজস্ব খেলা আছে, সেটা খেলে। খুব আনন্দ পায় পিকলু, হৈহৈ করে হাসাহাসি করে ওরা।
বাবার এই সারাদিনের পর অফিস ফেরত একটা গন্ধ পিকলুর খুব ভালো লাগে। এই মুহূর্তগুলোই ওর সারাদিনের বাড়িতে একা থাকা, বাবার সাথে না কাটানো সময়গুলো পুষিয়ে দেয়।
এখন কয়েকদিন অবশ্য সকালে উঠে ও বাবাকে পাচ্ছে | কেউ জানেনা, ও কাউকে বলেনি, ছুটির মধ্যেও ও রোজ সকালে তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে চা খাবার সময় বারান্দায় বাবার সাথে বসবে বলে। ওর বাবা আটটার সময় বেরিয়ে যায়, তাই তার আগে এই সময়টা ও গিয়ে ওর বাবার কোলে বসে থাকে। কাগজগুলোতে চোখ বুলাতে বুলাতে ওর বাবা একটাই বিস্কুট থেকে নিজেও খায় ওকেও কামড় বসাতে বলে।
একদিন প্লেটে ঢেলে ওর বাবা ওকে একটু চা-ও দিয়েছিলো। পিকলুর খুব আনন্দ হয়েছিল সেদিন, নিজেকে অনেকটা বড়দের মতন মনে হচ্ছিলো। সোয়েটার আর টুপি পড়া থাকলেও, বাবার শালের ভেতর নিজেকে মুড়ে না নিলে ওর গা থেকে শীতটা যেন ঠিক যায়না।
'ক্যাপ্টেন, ছুটিতে একটু হোমওয়ার্ক করছো তো?'
ঘাড় নাড়লো পিকলু। ঠিক ও যেমনটা ভেবেছিলো, বাবা এবার আলমারিটা খুলে গায়ে সেন্ট মাখবে। তারপর চিরুনি দিয়ে চুলটা আঁচড়ে একবার আয়নায় নিজেকে দেখে নিয়ে কোটটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে যাবে। যাওয়ার সময় টেবিল থেকে ব্যাগটা তুলে নেবে। তারপর গাড়ির দরজা খুলে ব্যাগ আর কোটটা যত্ন করে পাশের সিটে রেখে নিজে বসে বেল্ট বেঁধে জানলা দিয়ে পিকলুকে হাত নেড়ে টাটা করবে।
পিকলু রোজ দাঁড়িয়ে থাকে এই সময় বারান্দার রেলিং আঁকড়ে। টাটা করে, যতক্ষণ না গাড়িটা বাঁক ঘুরে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে ।
পিকলুর খুব বাবার মতন হতে ইচ্ছা করে।
***
'বুবাই, এই সকালে বারান্দায় টুপি ছাড়া দাঁড়িয়ে কেন রে? ঠান্ডা লাগাবি নাকি?'
'মা'!
পিকলু ছুটলো, ওর মা উঠে গেছে ঘুম থেকে। দৌড়ে গিয়ে মায়ের ওপর ঝাঁপাতে যে কি আরাম লাগে। মায়ের গায়ে গায়ে লেগে থাকতে সবসময় ইচ্ছা করে পিকলুর। শীতকালে মায়ের গায়ে সুন্দর একটা উষ্ণতা জড়িয়ে থাকে যেন, যেটা আবার গরম কালে বদলে যায় একটা শীতল প্রশান্তিতে।
মা ওর চুল ঘেঁটে ওকে আদর করলো। পিকলু চোখ বুঁজে মাকে জড়িয়ে তাড়িয়ে তাড়িয়ে এই আদরটুকু নিলো। ও জানে এবার কি হবে, শীতকালের ছুটিটা বাড়িতে থেকে ও দেখেছে।
'ছাড় বুবাই, আমি রেডি হই? যা, হ্যাডক দাদু অনেক্ষন তোর খাবার সাজিয়ে অপেক্ষা করছে খেয়ে নে।'
দুর, হ্যাডক দাদু তো সারাদিন ওর সাথে থাকবেই। ওর বাবা মায়ের থেকেও অনেক বড়, সব চুল সাদা। ওকে ভীষণ ভীষণ ভালোবাসে, আর ওদের বাড়িতেই থাকে। কিন্তু এখন হ্যাডক দাদুর কাছে যেতে ইচ্ছা করছেনা। গল্প শোনার জন্য, খুনসুটি করার জন্য সারাদিন পড়ে আছে তো।
'তা বললে হয়? খাবার ঠান্ডা হয়ে যাবেনা? দাদু এতো কষ্ট করে বানিয়েছে তোর জন্য?'
'তুমি থাকবেনা আজ?'
'আমি আজকে তাড়াতাড়ি চলে আসবো প্রমিস। বিকেলে সমীর আঙ্কেল আসবে না?'
ব্যাজার মুখে খাবার টেবিলে গেলো পিকলু। ঠিক যেমনটা ও ভেবেছিলো তাই হবে। মা এখন বাথরুমে ঢুকবে। তারপর স্নান সেরে ব্যাগ গুছিয়ে কিছুক্ষন ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে সেজেগুজে কাজে বেরোবে।
ওর মায়ের ড্রেসিং টেবিলটা পিকলুর কাছে একটা কৌতূহলের জায়গা। কত জিনিস যে ওখানে আছে। ওর মা এটা সেটা নিয়ে মাখামাখি করে যখন, পিকলু তখন পর্দার পাশে দাঁড়িয়ে দেখে। ওর মাকে খুব সুন্দর দেখতে এমনিতেই, ঠিক স্নো-হোয়াইটের মতো। কিন্তু সাজগোজ করার পরে ওর মাকে যেন আরও অপূর্ব লাগে, ঠাকুরের মূর্তিগুলোর মতো ।
স্কুল থাকলে মায়ের সাথেও সকালে ঠিকমতো দেখা হয়না। হ্যাডক দাদুই সকালে উঠে সব ব্যবস্থা করে দেয়। রাতেও ওর মা ফেরে অনেক দেরিতে, টিভিতে স্পাইডারম্যান শেষ হয়ে যাওয়ার পরে, রাতে খেতে বসার সময়।
বাড়ি ঢুকে ব্যাগ রেখেই ঘড়ি খুলতে খুলতে বুবাইয়ের মাথাটা বুকে চেপে ধরে ওর মা। মাঝে মাঝে ওর হাতে টুক করে গুঁজে দেয় জেমস বা চকোলেটের প্যাকেট। মা যখন হ্যাডক দাদু বা অসীমা পিসির সাথে কথা বলে, তখন মায়ের শাড়ীর আঁচল বা সালোয়ারের ওড়নাটা নিয়ে মাথায় ঘোমটার মতো দেয় পিকলু। ওর মায়ের যেই হাতটা পিকলুর ছোট্ট শরীরটাকে জড়িয়ে ধরে সেই হাতটাকেও পেঁচিয়ে দেয় মাঝে মাঝে।
'বুবাই, বি গুড। হোমওয়ার্কগুলো করে নিও, পরেরবার কিন্তু ক্লাস ফোর, মনে আছে তো? টাটা।'
মা এবার গাড়িতে উঠবে, রাখালকাকু মাকে নিয়ে যায় গাড়ি চালিয়ে। গেট পেরোনোর মুখে মা একবার জানলা দিয়ে মুখে বাড়িয়ে ওকে টাটা করবেই। তখনি পিকলুর আরো বেশি করে যেন মনে আসবে মায়ের গোলাপি নেইলপলিশের লম্বা লম্বা নখগুলোর ওর মাথার চুলে আঁকিবুকি কাঁটার আরামটা।
পিকলুর কিন্তু মায়ের মতন হতেও খুবই ইচ্ছা করে।
***
'পিকলু বাবু, তুমি আজ পড়তে বসবেনা?'
উফফ! মা বাবা এই হ্যাডকদাদুর ওপর দায়িত্ব দিয়ে গেলেই দাদু প্রতি মিনিটে পিকলুকে মনে করায় পড়তে বসার কথা।
'আমি খেয়ে উঠে দুপুরে পড়বো।'
'দুপুরে তো ঘুমাতে হবে দাদুভাই, বিকেলে আঙ্কেল আসবে না?'
তখনি পিকলুর মনে পড়লো, মাও বলেছিলো বটে। আজ সমীর আঙ্কেল আসবে ওদের বাড়ি। ওর বাবা-মা দুজনেরই বন্ধু, সমীর আঙ্কেল । দারুন মজা হয় সমীর আঙ্কেল এলে। চকোলেট বা লজেন্স তো আনবেই, আর পিকলুকে দারুন মজার মজার সব গল্প শোনায় আঙ্কেল। কখনো অদ্ভুত সব ঘটনা, কখনো পশুপাখিদের মজার মজার অজানা কান্ডকারখানা ইত্যাদি। পিকলু তাই মুখিয়ে থাকে সমীর আঙ্কেলের সাক্ষাৎ পেতে|
স্নানে বা বাথরুমে বসে পিকলু নিজের সাথে কথা বলে। মাঝে মাঝেই ও নিজেকে বাবা কিংবা মা সাজায়। কল্পনার জগতে হেঁটে গিয়ে অনুমান করে নেয় ও ওর বাবার মতো কোট পরে ইংলিশে মিটিং করছে। কিংবা ওর মায়ের মতো বড়ো কোনো কম্পিউটারের সামনে দাঁড়িয়ে হাতে ছড়ি নিয়ে বক্তৃতা দিচ্ছে। গরম জলে স্নান করতে গেলেও যখন ওর শীত করে তখন ও মনে জোর আনে এই ভেবে যে এই ঠান্ডাতেও ওর বাবা-মা কত সকালে স্নান করে অফিস গেছে। সত্যি ওরা দুজনেই যেন ঠিক হিম্যান বা ওয়ান্ডার ওম্যান এর মতো শক্তিশালী।
অবশ্য পিক্লুও ওদের মতো বড়ো হয়ে যখন অফিস যাবে, তখন এরকম শক্তিশালী হয়ে যাবে। ওকেও সকালে তাড়াতাড়ি উঠে চা খেতে হবে, বাড়ির লোকজনকে কাজকর্মের নির্দেশ দিতে হবে, দাঁড়ি কেটে কোট পড়ে চুল আঁচড়িয়ে, হাতে মোবাইলে খুটখুট করতে করতে গাড়িতে উঠতে হবে।
অবশ্য ও বাবার অফিসে যাবে না মায়েরটায়, সেটা এখনো ঠিক করে হয়ে ওঠা হয়নি|
***
দুপুরবেলায় পিকলু বাবার ঘরে এলো।
পিকলু লক্ষ্য করেছে আজকাল সকালে উঠলেও ওর দুপুরে ঘুম আসেনা। হয়তো স্কুলে যাওয়ার ক্লান্তিটা নেই বলেই। কিংবা হয়তো রাতে ও কানে হাতচাপা দিয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে বলে।
হ্যাঁ, ইদানিং প্রায় প্রতি রাতেই ও জোর করে চোখ কুঁচকে পাশবালিশ আঁকড়ে চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুম আনে।
আসলে ও একটা উপায় বার করেছে, অনেকটা ওর ইংলিশ বইয়ের 'ওসমান দি অস্ট্রিচ'-এর মতো। হিনা মিস বলেছে অস্ট্রিচ বা উটপাখি যখনই ভয় পায় বা দুঃখ পেয়ে কিছু দেখতে না চায়, ও তখনই নিজের মাথাটা মাটির ভেতর ঢুকিয়ে দেয়। ও ভাবে, ও কাউকে দেখতে পাচ্ছেনা মানে ওকেও কেউ দেখতে পাচ্ছেনা। এই গল্পটা পড়ে স্কুলে খুব হেসেছিলো পিকলু। কিন্তু এখন ওর অবস্থা ওসমানের মতো। চাদর মুড়ি দিয়েও যতক্ষণ না ঘুম আসে, ও সব শুনতে পায়। কিন্তু ভালো না লাগলেও, দুঃখ পেলেও, ও জোর করে মনে আনে টিনটিন, ছোটা ভীম বা স্কুলের ঘটনাগুলো। ও মনের গভীরে ঢোকাতে চায়না কিচ্ছুটি। তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়তে চায়, যেন ঘুমালেই এই কঠিন বাস্তবটা থেকে কিছুক্ষনের জন্য হলেও রেহাই পাওয়া যাবে।
তারপর আস্তে আস্তে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে।
একদিন বাবা-মা বেরিয়ে যাওয়ার পর হ্যাডকদাদুকে ডেকেছিল পিকলু।
'দাদু, বাবা মা রোজ রাতে ঝগড়া কেন করে? দুজনে খুব বকে দুজনকেই, আমার ভালো লাগেনা, আমি চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি ।'
হ্যাডকদাদু প্রশ্নটা শুনেই পেছন ফিরে গিয়েছিলো। তারপর হেসেছিলো খুব জোরে জোরে, 'দুর বোকা। ঝগড়া কেন? ওদের অফিসের লোকগুলো কিছু কাজ পারেনা, ওদেরকে কিভাবে বকাবকি করেছে সেটা অ্যাক্টিং করে।'
'অ্যাক্টিং?'
'হ্যাঁ! এই এইভাবে-', দাদু নানা অঙ্গভঙ্গ করে হাসিয়েছিলো পিকলুকে। খিলখিলিয়ে উঠেছিল পিকলু সেদিন। কিন্তু তবুও পিকলুর ভালো লাগেনা, মা বাবা অন্যকিছুর অ্যাক্টিং করলেও তো পারে।
তবে কয়েকদিন ধরে ওরা আর চিৎকার করছেনা। এমনকি দুজনে দুজনের সাথে খুব একটা কথাও বলছেনা। আজকাল যেন বাড়িটা একটু বেশিই নিঝুম হয়ে গিয়েছে।
বাবার ঘর পেরিয়ে হাতে কিছু জিনিস নিয়ে মায়ের ঘরে ঢুকলো পিকলু।
বাবা আর মা এখন আলাদা ঘরে শোয়ে। এটা অবশ্য ভালোই হয়েছে। পিকলু অনেকদিন ধরেই ভাবতো, ও নিজে আলাদা ঘরে রাতে শুচ্ছে অথচ বাবা-মা ওর চেয়ে অনেক বড়ো হয়েও একসাথে কেন শোয়ে? এইটা হওয়াতে ওর একটু আনন্দ হয়, ওর বাবা বা মা কেউই তাহলে খুব একটা ভীতু নয়, ওর মতোই সাহসী।
মায়ের ঘরে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে নাড়াচাড়া করলো পিকলু জিনিসগুলো। বাবার শেভিং ব্যাগটা মাটিতে নামিয়ে রেখে মায়ের কয়েকটা কৌটো বের করে খুলে দেখলো। কয়েকটা থেকে কি সুন্দর গন্ধ, ঠিক মা স্নান করে ফেরার পর যেমনটা বেরোয়।
বাবা মা বাড়ি থেকে চলে গেলে পিকলু ওদের জিনিস ঘাঁটে। অগোছালো করেনা অবশ্য কিছুই, কিন্তু এটা সেটা নেড়েচেড়ে, খুলে, মেখে দেখে।
মায়ের আলনাতে একটা কালো ওড়না আছে, ঐটা হাতে নিয়ে ঘর ছাড়লো পিকলু। বারান্দায় এসে নিজের প্রিয় কোনটায় বসে পিকলু ওর হাতের জিনিসগুলো নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করলো। এটা একটা ওর দারুন মজার খেলা। ও কখনো বাবা সাজে, কখনো মা।
***
আজ খেলা শুরু করার একটু পরেই ও কয়েকটা গাড়ি ঢুকতে দেখলো বাড়ির সদর দরজা দিয়ে ।
শেষের গাড়িটা সমীর আঙ্কেলের না? হ্যাঁ ঐতো গাড়ির কাঁচে ওই অদ্ভুত স্টিকার মারা। অঞ্জলি আন্টি বলেছে যারা উকিল হয় তাদের গাড়িতে নাকি এরকম স্টিকার থাকে।
পিকলুর মনে আনন্দ হলো, সবাই কত তাড়াতাড়ি অফিস থেকে চলে এসেছে আজ, এখনো তো সন্ধ্যেই হয়নি। ঠিক যেন রবিবারের মতো। সাথে সমীর আঙ্কেলও আছে।
কিন্তু পিকলুর হাতে যে এতো জিনিসপত্র, বাবা মা দেখলে বকবেনা তো? এই যাহ, কি করবে এখন পিকলু?
তাড়াহুড়ো করে পিকলু যখন জিনিসগুলো গোছাতে ব্যস্ত তখন একটা চেনা গলা শুনলো পিকলু।
'একি পিকলু মাস্টার, তুমি এখানে করছো কি?'
যাহ, সমীর আঙ্কেল দেখে ফেললো যে। বাবা মাকে কিছু বলবেনা তো?
'ঘুমাওনি দুপুরে? তাহলে চকলেট পাবে কি করে?'
'বাবা-মা কোথায়? সরো, এগুলো রাখতে হবে তাড়াতাড়ি। ওরা দেখে ফেলার আগে।'
পিকলুর হাতের দিকে তাকালো সমীর আঙ্কেল। একটু চুপ করে গিয়ে তারপর পিকলুর হাত ধরে ওকে বারান্দার চেয়ারের সামনে দাঁড় করলো। হাত রাখলো পিকলুর কাঁধে।
'না সে ভয় নেই, বাবা-মাকে বলে এসেছি ওপরে আসবেনা। শুধু আমরা দুজনে গল্প করবো এখন।'
বাহ্! দারুন ব্যাপার, এবার নির্ঘাত টেরোডাক্টিল বা শিম্পাঞ্জি বা গুয়াতেমালার কোনো আগ্নেয়গিরি নিয়ে মজার গল্প চলবে ওদের মধ্যে।
কিন্তু…
'বাবা-মা নিচে একসাথে আছে?'
'হ্যাঁ, কেন রে?'
'জানো আঙ্কেল, ওরা অনেকদিন ধরে কথা বলছেনা। একসাথে দুজনে আমার ঘরে আসছেনা। বাবা অফিসে চলে গেলে মা ঘর থেকে বেরোচ্ছে, বাবা টেবিলে খাচ্ছেওনা রাতে।'
নালিশগুলো শুনে সমীর আংকেল আলতো করে জড়িয়ে ধরলো পিকলুকে।
'সেই জন্যই তোর কাছে আসা পিকলু। দেখ আমাদের বড়দের বুদ্ধি খুব কম, তাই সবাই বললো পিকলুর কাছে যাও, ও ছাড়া কেউ হেল্প করতে পারবেনা।'
'কিসের হেল্প?'
'তোর বাবা আর মায়ের একটা রোগ হয়েছে পিকলু। ডাক্তার বলেছে ওদের ভালো হতে একটু সময় লাগবে। ততদিন ওরা আলাদা বাড়িতে থাকবে। আর আমাকে দায়িত্ব দিয়েছে ওরা যেন সব নিয়ম মেনে চলে তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠে সেটার ওপর নজর রাখার।'
পিকলু ভুরু কুঁচকে শুনছিলো, কই দেখে তো বোঝা যায়না ওদের অসুখ হয়েছে? ওদের তো গা গরমও হয়নি, কাশিও হয়নি।
'পিকলু, ডাক্তার বলেছে তোকে যেকোনো একটা বাড়িতে থাকতে হবে। অবশ্য, প্রতি সপ্তাহে তুই অন্যবাড়িতে যেতে পারবি, যখনই তুই চাস।'
চোখ নামিয়ে পিকলুর হাতটা নিজের মুঠোয় নিলো সমীর আংকেল, 'এবার বুঝলি, আমরা তো বোকা, তাই ঠিক বুঝতে পারছিনা। তুই আমাদের হেল্প করে বলতে পারিস তুই কোন বাড়িতে কার সাথে থাকবি?'
আলতো করে ধরে থাকা সমীর আঙ্কেলের হাতটা ছাড়িয়ে পিকলু সরে এলো বারান্দার রেলিঙের দিকে। বাইরে তাকালো।
বিকেল হচ্ছে, ওদের বাড়ির সামনের ফাঁকা আকাশটায় কয়েকটা পাখি এদিক ওদিক ওড়াউড়ি করছে। পড়ন্ত বিকেলের রোদে ঠান্ডা ঠান্ডা একটা হাওয়ায় বেশ কিছুটা উঁচুতে একটা ঘুড়িও উড়তে দেখলো পিকলু।
স্কুলের হোমওয়ার্কের থেকেও শক্ত লাগলো ওর এই প্রশ্নটা | হাওয়ায় গোত্তা খাওয়া ঘুড়িটার দিকে তাকিয়ে ও থুঁতনিটা রাখলো বারান্দার রেলিঙে।
ওর ডান হাতে বাবার আফ্টারশেভের বোতলটা তখনও ধরা, গলায় পেঁচানো মায়ের কালো ওড়নাটা ।