Souradipta Sen

Drama Tragedy

4.5  

Souradipta Sen

Drama Tragedy

মহালয়া

মহালয়া

1 min
385


আজ সকালবেলায় বেশ তাড়াহুড়ো পরে গেল অবনীর| 

সকালে একবার ঘুম ভাঙার পরেও ছটা নাগাদ আবার শোয়াটাই সর্বনাশটা ডেকে আনলো| অপর্ণার ডাক শুনে পরেরবার চোখ মেলতেই দেখে ঘড়িতে সাড়ে আট| অফিস তো আর এখানে নয়, সুদূর ধর্মতলা| পুজোর আগে বাসের যা অবস্থা, অনেকগুলো বাস ছেড়ে দিলেও সেই বাদুড়ঝোলা হয়েই যেতে হবে| তাই সব মিলে মেজাজটা খিটখিটে হয়ে আছে অবনীর|


শার্টের হাতা গুটিয়ে অবনী যখন ডালটা ভাতে ঢাললো তখন ছোট্ট দেবী পায়ে পায়ে এগিয়ে এলো| 

'বাবা, আমার ঘোড়াটা ঠিক করোনি?' 

এহে! একদম ভুল হয়ে গাছে| কাঠের একটা ঘোড়া, অপর্ণার কোন এক বন্ধু কাশ্মীর থেকে নিয়ে এসেছে দেবীর জন্য, পায়ের জায়গায় চাকা লাগানো| সেই ঘোড়াটার একটা চাকা খুলে গিয়ে বাবাজি এখন পঙ্গু, আর তাই অবনীর ওপর এই দায়িত্ব|

'আজ এসে করে দেব|'

'তুমি বলেছিলে আজ সকালে করে দেবে| আজ বিকেলে তিতুন, ছোড়দা, বিল্লু সবাই আসবে| আমার ঘোড়াটা এখুনি ঠিক করে দাও|'

অবনী সত্যিই ভেবেছিলো আজ সকালে রেডিও শুনতে শুনতে ঠিক করে দেবে| অসময়ে ঘুমিয়ে না পড়লে হয়তো দেবী এই অভিযোগটা করার সুযোগই পেতো না। কিনতু এখন নটার সময় তো আর এসব খেলনা ঠিক করার সময় নেই হাতে |

'বিকেলে ওরা আসার আগেই আমি এসে ঠিক করে দেব| আজ তাড়াতাড়ি আসবো, তুই বিকেলে ঘুম থেকে উঠেই দেখবি আমি এসে গেছি|'

'না! আমি জানি তুমি দেরিতে আসবে| আমাকে এখুনি ঠিক করে দাও!' দেবীর মুখ লাল, ঠোঁট ফোলা,চোখ ছলছল|

একটু একটু করে অবনীর মাথা গরম হচ্ছিলো| তবুও ধৈর্য ধরে আরেকবার মেয়েকে বোঝাতে গেল| দেবীও হয়তো মেজাজটা অবনীর মতোই পেয়েছে, অবনী কিছু একটা বলার জন্য মুখ খুলতেই হাতের পুতুল দিয়ে দেবীর আক্রমণ, ফলস্বরূপ মাছের বাটি উল্টে অবনীর সাদা শার্টে তেল-হলুদের বন্যা|

ব্যাস, আগুনে ঘি! বাড়ি মাথায় করে অবনীর চিৎকার, দেবীর কান্না, অপর্ণার বেরিয়ে এসে অবস্থা সামাল দেওয়া আর সব শেষে কোনো রকমে কাপড় বদলে আধপেটা খেয়ে অবনীর অফিস বেরিয়ে যাওয়া|


সারাদিনের কাজের মধ্যে অবনীর মাথা থেকে ঘটনাটা বেরিয়ে গেছিলো, বিকেলে রজনীবাবুর সাথে পুজোর কেনাকাটা নিয়ে কথা হওয়ার সময়ে দেবীর কান্নাভেজা মুখটা আবার মনে পড়লো| 

মনটা খারাপ হয়ে গেল অবনীর| বাবার কাছে মেয়ে একটা আবদার করেছে, বাবা সেই সামান্য আব্দারটুকু রাখতে না পারলে মেয়ে অভিমান করতেই পারে| ছয় বছরের মেয়েকে তাই বলে পুজোর সময় অতটা বকাঝকা করা মোটেই ঠিক হয়নি ওর| 

সাড়ে পাঁচটায় অফিস থেকে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়লো অবনী| নিউ মার্কেট থেকে প্লাষ্টিক হাতে বেরিয়ে বাসস্টপে দাঁড়ালো একটু পরে|


দরজা খুলতেই অপর্ণাকে দেবীর কথা জিগেস করলো অবনী| 

'ওপরে সাজগোজ করে বসে আছে| তুমি এত দেরি করলে কেন?'

জুতো ছেড়ে ওপরে উঠে পা টিপে টিপে দেবীর পেছনে দাঁড়ালো অবনী| সাজগোজ করে দেবী টেবিলের ওপর বসে ছবির বই দেখছে নিজের মনে, অবনীর আগমন লক্ষ্য করেনি |

অবনী কাগজের মোড়কটা খুলে চাকা লাগানো একটা নতুন চকচকে কাঠের ঘোড়া আস্তে করে বিছানার ওপর রাখলো| প্লাস্টিকের ভেতর থেকে একটা ফ্রক বার করে ইচ্ছা করে গলা তুললো অবনী, 'অপর্ণা, দেবীকে এই ফ্রকটা পরিয়ে দেখে নাওতো মাপ ঠিক আছে কিনা? ততক্ষনে আমি পা ভাঙা ঘোড়াবাবুকে দেখি| নতুন বন্ধু পেয়ে, পুরানো ঘোড়াবাবুকেও তো ওর সাথে আনন্দ করে ছুটতে হবে নাকি!'


নাহ, মেয়ের মুখের এই ফোকলা দাঁতের হাসিটার কোনো বিকল্প নেই| অবনী কি আগে কোনোদিন দেবীকে এতো আনন্দ পেতে দেখেছে? হয়তো দেখেছে, তবে ছোট্ট মুখের প্রানভোলানো এই হাসিটা প্রত্যেকবারই যেন একটু একটু করে বেশি মিষ্টি হয়ে ওঠে|

সারাদিনের মান-অভিমানের পর্ব এক নিমেষে উধাও, স্নিগ্ধ একটা খুশির হাওয়া বইছে চারদিকে। সস্নেহে অবনীর কোমর জড়িয়ে দেবী খিলখিল করে হেসে উঠলো |


আকাশবাণীতে পুজোর গান দিয়েছে| 

আজ মহালয়া, রাত ঘুরলেই দেবীপক্ষের সূচনা| 

সবার অলক্ষ্যে চোখের কোনাটা মুছে নিলো অবনী|


কয়েক দশক পরে....


বাথরুমের দরজার আওয়াজ পেয়ে ঘুরে তাকালো প্রতীক| দেবিকার স্নান হয়ে গিয়েছে|

'তোমার জন্যই বসে আছি| আজকে ভিসাটা কালেক্ট করবো দেবী, অথোরাইজেশন লেটারে তোমার একটা সই লাগবে করে দাও|'

'আমাদের টিকেট কবে যেন?'

'শনিবার, পঞ্চমীর দিন| রাত একটায় কলকাতা থেকে ডাইরেক্ট ব্যাংককের সুবর্ণভূমি এয়ারপোর্ট|'

একটু চিন্তিত দেখালো দেবিকাকে|

'শোনো, দশটার মধ্যে বেরোবো| তুমি অফিস ঢোকার আগে ঢাকুরিয়াতে নামবে, আমি তোমাকে ড্রপ করে ভিসা অফিস চলে যাবো | কাগজ-কলমের কাজ, পেমেন্ট সব সেরে নিতে হবে আজকেই|'

'হ্যাঁ', একটা বড়  নিশ্বাস ফেললো দেবিকা| 


ডাইনিংয়ের জানালাটার সামনে এই সময় অবনীবাবু বসে থাকেন, মোটা কাঁচের চশমা দিয়ে দশতলা উচ্চতা থেকে সব কিছু স্পষ্ট না দেখতে পেলেও, আকাশটা দেখতে পান|

বছরদেড়েক আগে অপর্ণা মারা যাওয়ার পর থেকে তিনি তাঁর মেয়ের কাছেই থাকেন| রাজারহাটের এই রাজকীয় ফ্ল্যাটটা প্রতীকের অনেকদিনের জমানো ব্যাঙ্ক ব্যালান্সের স্থাপত্য| প্রতীক, দেবিকা আর ওদের ছেলে রনির সাথে তিনিও এখন এই ফ্ল্যাটের বাসিন্দা।


দেবিকা এসে দেখলো অবনীবাবু চোখ কুঁচকে পেপারটা পড়ার চেষ্টা করছেন| দেবিকাকে দেখেই চশমাটা খুলে হাতে নিলেন তিনি|

'তোদেরকে কতবার বলতে হবে আমার চশমাটা পাল্টানো দরকার? তোর মা চলে যাওয়ারও আগের চশমা এটা, দুতিনটে জায়গায় কাঁচ এত ঘষে গেছে যে হাত দিলে হাতে লাগে| তবু তোরা শুনবিনা?'

দেবিকা বোঝানোর চেষ্টা করলো, 'ডাক্তারের সাথে এপয়েন্টমেন্ট করা আছে পুজোর পরে| তুমি তো জানো এই সময় ডাক্তার পাওয়া সোজা নয়|'

ঝাঁঝিয়ে উঠলেন অবনীবাবু, 'সহজ কি করে হবে? তোমাদের পার্টি করার সময় থাকলেও নিজের বাবার জন্য সময় থাকেনা| ফেলে রেখে দিয়েছো একজন আয়ার হাতে, কখনো জানতেও চাওনা বাবা কেমন আছে, বাবার কি লাগবে| যাও তোমরা বন্ধুবান্ধব নিয়েই থাকো|'

দেবিকার মাথায় অজস্র পিনফোটানোর মতো একটা অনুভূতির সাথে কান দুটো গরম হয়ে উঠলো | ধৈর্য ধরার একটা সীমা আছে, গলা তুললো দেবীকাও| ঝাড়া তিন মিনিট ধরে ছাত্রপড়ানোর মতো ওর সারাদিনের কি রুটিন, অবনীবাবুর পেছনে মাসে সব মিলে কত খরচ হচ্ছে, তাঁর জন্য ওদের কত ঝক্কি পোয়াতে হচ্ছে, কত ইচ্ছা জলাঞ্জলি দিতে হয় - সব কিছুর একটা লিস্ট শুনিয়ে দিলো|

এক নিঃশ্বাসে বলা শেষ করে, অবনীবাবুর দিকে না তাকিয়ে, আওয়াজ করে দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে লিফটের বোতাম টিপলো দেবিকা| ঘরের মধ্যে তখন দামি দেয়াল ঘড়ির টিকটিক শব্দ ছাড়া আর কোনো আওয়াজ নেই|


শরতের এইসময়টা বিকেলবেলায় খুব সুন্দর একটা ফুলের গন্ধ বেরোয়| এইদিকটা এখনো বেশ ফাঁকা ফাঁকা, কংক্রিটের জঙ্গল এখনো এই অঞ্চলটায় দাপট বিস্তার করেনি। দশতলার বারান্দা থেকে অবশ্য কোনো গন্ধ পাওয়া যায়না, কিনতু দূরে সবুজ গাছগাছালি ঘেরা ফাঁকা জমিগুলো দেখা যায়|

অবনীবাবুর মনটা আজ ভালো নেই| দেবিকার কথাগুলোর জন্য নয়, নিজের ওপর বিরক্তিতে| সত্যিই তো, তিন জনের সাজানো সংসারে বহিরাগত চতুর্থ ব্যক্তি হয়ে এসে উনিই তো নিজের সমস্ত আবদার টেবিলে সাজিয়ে রেখেছেন| প্রতীক-দেবী যথাসাধ্য করছে, তারপরেও এরকম করার কোনো মানে হয়? কারণ-অকারণেই আজকাল তার মেজাজটা বড্ড খিটখিটে হয়ে থাকে, কেজানে কেন? 

আজকে আসুক ওরা উনি খোলাখুলি ক্ষমা চেয়ে নেবেন| ওরা নিজের ছেলে-মেয়ে, ওদের কাছে আবার লজ্জা কিসের?

অবনীবাবুর মনে পড়লো বহুবছর আগের এক মহালয়ার সন্ধ্যার কথা| আজও হয়তো মেয়ের রাগ বাবাকেই ভাঙাতে হবে|


সন্ধ্যে নাগাদ দেবিকা আস্তে আস্তে ঘরে ঢুকলো| অবনীবাবু বসে বসে একটা বই পড়ার চেষ্টা করছিলেন| চুপচাপ পাশে এসে দাঁড়ালো দেবিকা|

'বাবা, এটা একটু দেখে নাও|'

ঘুরে তাকালেন অবনীবাবু, দেবিকার হাতে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ - কোনো একটা চশমার দোকানের নাম লেখা তাতে|

ঠোঁটের ফাঁকে একটা হাসি এসে গেল অবনীবাবুর| বহুবছর আগের কথাটা পুনরায় তার মনে পড়লো | তিনি ভুলে গিয়েছিলেন যে সময় অনেকটাই বয়ে গিয়েছে | আজ তিনি রক্তের সম্পর্কে দেবিকার বাবা হলেও, সবরকম ভাবে দেবিকাই তাঁর অভিভাবক | মেয়েই যে বাবার রাগ ভাঙাবে তাতে আর আশ্চর্যের কি। দেবীর শরীরেও তো অবনীবাবুরই বংশাণু আছে, তাই হয়তো বহুবছর আগের নিঃশর্ত ভালোবাসার একটা ছোট্ট নিদর্শনের আজ পুনরাবৃত্তি হবে। আজ শুধু জায়গার অদলবদল হয়েছে, সম্পর্কের প্রাচীরে তো আর ফাটল ধরেনি।

'পুরানো পাওয়ারেরই নতুন একটা সেট আছে এতে, তোমার সুবিধে হবে| পুজোর পরে নাহয় ডাক্তারের কাছে চেকাপ করিয়ে নতুন একটা নিয়ে নেবো। আর..' একটু ইতস্তত করে দেবিকা ওর ডান হাতটাও এগিয়ে দিলো সাথে, কিছু কাগজপত্র মনে হচ্ছে, ’এটাও নাও বাবা ‘| 

'এটা কি রে দেবী?'

‘ঢাকুরিয়ায় একটা ভালো ব্যবস্থা করেছি| এখানে আমরা সারাদিন থাকিনা, তুমিও ঘুরতে বেরোতে পারোনা| ওখানে তোমার মতো অনেকেই আছেন, আর চব্বিশ ঘন্টা ডাক্তার, নার্স সবাই থাকে| খুব ভালো ব্যবস্থা, প্রতীকের বন্ধুর দাদা হলো মালিক, তোমার কোনোরকম অসুবিধে হবেনা|'

চোখ নামালো দেবিকা, 'আর আমরা পুজোয় বাইরে যাচ্ছি কদিনের জন্য ঘুরতে, তারপরে হয়তো কালীপুজোর পরে বছর দুয়েকের জন্য প্রতীকের সাথে আমেরিকা যেতে হবে| তাই আগে থেকেই সব ব্যবস্থা করে রাখতে হচ্ছে| এখানে কিছু কাগজপত্র আর ছবি আছে| ওখানকার সমস্ত ডিটেলস আর তোমাকে কি কি নিতে হবে সব লেখা আছে| আমি শিউলিকে বলে দেব যেন গুছিয়ে দেয়'|

অবনীবাবুর চোখটা ঝাপসা হয়ে এলো, এটা বোধহয় চশমার ঘষা কাঁচের জন্য নয়| বাবার দিকে এক ঝলক তাকিয়ে দেবিকা ফোনটা কানে তুলে ঘরের দরজা দিয়ে ধীর পায় বেরিয়ে গেলো | 


রনির কম্পিউটারে পুজোর গান চলছে| 

আজ মহালয়া, রাত ঘুরলেই পিতৃপক্ষের সমাপ্তি| 

সবার অলক্ষ্যে চোখের কোনাটা মুছে নিলেন অবনীবাবু|

 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama