Souradipta Sen

Drama

4.5  

Souradipta Sen

Drama

নীলাংশু দত্তর ঘটনা

নীলাংশু দত্তর ঘটনা

8 mins
28


জুন ২৮..


প্ল্যানমাফিক যা কেনাকাটা করার ছিল তা প্রায় শেষের দিকে, গোছগাছও করাই আছে মোটামুটি| দীর্ঘ আড়াই বছর পরে, মেঘের আস্তরণ ছিঁড়ে ধোঁয়াশা ঘেরা মহানগরটাকে ওপর থেকে দেখার কথা ভেবে মাঝেমাঝেই রোমাঞ্চিত হয়ে উঠছে নীলাংশু| তারপর প্লেন যখন ঝাঁকুনি দিয়ে দমদমের মাটি ছোঁবে, তখন স্পিকার থেকে ভেসে আসবে পরিচিত সেই ঘোষণা, বাংলায়! আর তর সইছেনা ওর!


ভ্যাকসিন, লকডাউন, সংক্রমণের হার - এসব করে গত দুটো বছর কেটে গেল| কেউ জানেনা আরো কতদিন এভাবে কাটাতে হবে| বাড়ির লোককে ঝুঁকিতে ফেলার ভয়,যাতায়াতের ওপর নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদি বাড়ি ফিরতে দেয়নি নীলাংশুকে| আল্ফ়া,ডেল্টা, ওমিক্রন- অনেকেই এলো, ভোগালো, নিজের পরিচিত পরিমণ্ডলের অনেককেই কেড়ে নিলো, আবার চলেও গেল| ডাক্তার-রুগীদের পাশাপাশি চরম দুর্দশায় পড়লো অর্থনীতি, শিক্ষাব্যাবস্থা, গরিব দেশের দিন-আনি-দিন-খাই মানুষগুলো|


মোবাইলে আঙ্গুল চালাতে চালাতে চোখদুটো বুঁজে আসছিলো নীলাংশুর| হঠাৎ পাশের ঘরের দরজা খোলার আওয়াজে ঝিমুনিটা কেটে গেল| এত রাতে নতুন লোক এলো নাকি?

ওদের এই সার্ভিস এপার্টমেন্টে চারখানা ঘর| প্রত্যেক ঘরে নিজস্ব বাথরুম থাকলেও, রান্নাবান্নার ব্যবস্থা নেই| নীলাংশু নিজের ফ্ল্যাটটা ছেড়ে দিয়েছে দুমাস আগেই| লিজ শেষ হয়ে গিয়েছিলো, দুমাসের জন্য বাড়িওয়ালা আর বাড়ায়নি|


কান পাতলো নীলাংশু| হ্যাঁ, ট্রলি টানার আওয়াজ পাচ্ছে সে, নতুন লোক|


কিন্তু এখন! বাইরে ঠান্ডা, তাছাড়া ভাইরাসের নতুন ভেরিয়েন্ট শহরে আবার প্রবলভাবে আঘাত হানায় চারদিকে নাইট-কার্ফু চলছে|


'খুক-খুক!'


গভীর রাতের নির্জনতায়, পাশের ঘর থেকে এক মহিলার কাশির আওয়াজ পেলো নীলাংশু|



পয়লা জুলাই..


'মর্নিং নীল, স্টিভেনসন বলছি| তোমার ডকুমেন্টগুলো কি হল?'


'মর্নিং স্যার, আর আধঘন্টা সময় দিন|'


'তুমি পাঠাবে তারপর আমি দেখবো, তারপর যদি আবার কিছু...তোমার শরীর ঠিক আছে তো? এত সময় তো লাগার কথা নয়?'


'আসলে দেশে ফেরার জন্য ওই ইমিগ্রেশনের কাজকর্মে একটু জড়িয়ে গেছিলাম|'


'এগারোটার মধ্যে তোমার ইমেইলের প্রত্যাশা করছি|'


অফিসের ফোন নামিয়ে একটা বড় শ্বাস ফেললো নীলাংশু| ওর কম্পিউটারে খোলা ইন্টারনেটের বিভিন্ন পেজগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলো ও| পরিবর্তনশীল এই ভাইরাসের নতুন রূপ সম্পর্কে বিভিন্ন দেশের নামিদামি গবেষক-চিকিৎসকেরা মোটামুটি একই জিনিস বলে চলেছেন| তবুও খুঁজছিলো নীলাংশু, ইতিবাচক কিছু যদি পাওয়া যায়| ওর মনে একটা অস্বস্থি থেকে-থেকে ফিরে আসছে| জুলাইয়ের শেষে দিদির বিয়ের জন্য দেশে ফেরাটা না থাকলে হয়তো এই হাঁসফাঁসটা লাগতো না| 


কাশি-সর্দি-জ্বর-গা ব্যাথার মতো উপসর্গ দিয়ে শুরু হবে, তারপর ফুসফুস ছাড়াও নাকি পাচনতন্ত্রের ইন্দ্রিয়গুলোকে আক্রমণ করবে প্রবল সংক্রামক এই নতুন রূপটি| এছাড়া এটি নাকি হাওয়ায় ছড়ায়, এর মারণ ক্ষমতা আগের চেয়ে অনেক বেশি|


এবং নীলাংশুর নতুন প্রতিবেশীর ঘর থেকে ঘনঘন কাশির আওয়াজ ও সমানে পেয়ে গিয়েছে গত দুইরাত!



জুলাই ৩..


নীলাংশুদের শহরে আবার লকডাউন চালু হয়ে গিয়েছে| এতদিন সপ্তাহে দুদিন করে অফিস যেতে হচ্ছিলো, এবার সেটাও বন্ধ| শহরে গোষ্ঠী সংক্রমণ শুরু হয়ে গিয়েছে, হাসপাতালগুলো ভরে উঠছে, মৃত্যুসংখ্যাও উর্দ্ধগামী|


নীলাংশু নিজেও ভালো নেই|

না, কোনো উপসর্গ দেখা দেয়নি বটে, কিন্তু মানসিক চাপ এবং এক অজানা আশংকায় দিন কাটাচ্ছে ও |


ইদানিং বাড়িতে থাকতে হচ্ছে বলেই নীলাংশু বুঝতে পেরেছে যে ওর প্রতিবেশিনীর কাশিটা ক্রনিক কোনো ব্যারাম নয়| গতকাল দুপুরে পাশের ঘরে কথাবার্তার আওয়াজ পেয়ে দেয়ালে কান ঠেকিয়েছিলো ও| স্পষ্ট শুনতে পেয়েছে নাক টানার শব্দ, ঘড়ঘরে ভাঙা গলার আওয়াজ| ভাষাটা অবোধ্য ঠেকলেও ওঘরের আগন্তুককে কয়েকবার 'সিভিয়ার হেডেক' বলতেও শুনেছে ও|


ভেতরে জমতে থাকা অস্বস্তিটা আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে তখন থেকেই|



জুলাই ৫..


আজ শনিবার, নীলাংশুদের অফিস ছুটি| 


অন্য যেকোনো স্বাভাবিক শনিবার হলে আজ নীলাংশু পিঠে ব্যাগ নিয়ে সাইকেলটাকে সঙ্গী করে বেরিয়ে পড়তো| কখনো পাহাড় ঘেঁষা রাস্তা ধরে, আবার কখনো সমুদ্রকে সাথী করে মাইলের পর মাইল চষে ফেলতো| কখনো হয়তো চলে যেত কোনো টিলার পাদদেশে, সাইকেল রেখে হাঁটা লাগাতো চরাই-উৎরাই ধরে|


কিন্তু এখন নীলাংশু বেরোতে ভয় পায়| 


অত্যাবশ্যকীয় কারণে বেরোনোর নিষেধাজ্ঞা না থাকলেও সকালবিকেল খাবারের ব্যবস্থাটুকু করতে বাইরে যেতে বুক কাঁপে ওর| বেরোতে গেলেই পাশের ঘরের বন্ধ দরজাটা যখন ওর চোখে পড়ে, ওর মনে হয় লক্ষ-কোটি ভাইরাস যেন কিলবিল করে ঘুরে বেড়াচ্ছে দরজার হাতলে, ফটোফ্রেমে, ফুলদানিতে| বসারঘর, সিঁড়ি, সদরের দরজা তো সকলেই ব্যবহার করে, কোন ভরসায় সেখান দিয়ে চলাফেরা করবে ও? 

একবার পজিটিভ এসে গেলে দিদির বিয়ে, দেশে ফেরা, বন্ধুদের সাথে সমস্ত পরিকল্পনা জলাঞ্জলি দিয়ে সখেরবাজারের দুতলা বাড়িটার চেয়ে কয়েকহাজার মাইল দূরে এই দেশে পড়ে থাকতে হবে একটা মুড়ির টিনের কৌটাকারের হাসপাতালের ঘরে..কমকরে অন্তত এক মাস| তারপরেও ছাড় নেই, এদেশের কড়া নিয়মকানুন অনুযায়ী হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলেও পুনঃসংক্রমণ রুখতে সরকারি নিভৃতবাসে থাকতে হবে আরো চোদ্দদিন|


প্রায় দুমাস আগে থেকে দেশে ফেরার জন্য উদগ্রীব হয়ে দিনগোনা এবং সমস্ত প্রস্তুতি অগ্রিম সেরে ফেলা নীলাংশুকে যদি দুমাসের জন্য আটকে পড়তে হয়, তবে ও নিজের মানসিক ভারসাম্য হয়তো বজায় রাখতে পারবেনা |



জুলাই ৮..


স্নান সেরে বেরোনোর পরেও নীলাংশু ঘরে সানিটাইজারের তীব্র গন্ধটা পেল| জানালা খুলতে দ্বিধাবোধ করলো ও, পাশের ঘরের জানালার পাল্লা খোলা|


আজ বেরিয়েছিল নীলাংশু| তিনদিনের মতো খাবার কিনে ফ্রিজে ঢুকিয়ে দিয়েছে| সাথে নিয়ে এসেছে প্রচুর পরিমানে শুকনো খাবার, ইনস্ট্যান্ট-নুড্ল, বিস্কুট-কেক-ফল ইত্যাদি| পনেরো তারিখ টেস্ট হওয়া অবধি টেনেটুনে চালাতে হবে, ঘরের বাইরে কোনোমতেই বেরোনো যাবেনা| এছাড়া আর কোনো উপায় নেই ওর, জলে-কুমির-ডাঙায়-বাঘের অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে ও| ওর প্রতিবেশী খুকখুকে কাশি আর ঘড়ঘরে সর্দি নিয়ে দিব্ব্যি সকালবিকেল বাইরে বেরিয়ে চারপাশ বিষাক্ত করে চলেছে, আর আমরা কিনা আমাদের দেশের লোকেদের সচেতনতা নিয়ে নালিশ করি!


নীলাংশু অবশ্য বেপরোয়াদের দলে পড়ে না| ও ফিরেই বাইরে থেকে আনা খাবারদাবারের প্যাকেট সানিটাইজারে চুবিয়ে দিয়েছে প্রায়, চৌকাঠহীন দরজার নিচের ফাঁক কৌশল করে চেপেচুপে বন্ধ করেছে, তারপর সাবান ঘষে গরমজলে পনেরো মিনিটের স্নান...আজকাল দিনে দুবার করে নুনজলে গার্গেলও শুরু করে দিয়েছে ও| উপসর্গের জন্য অপেক্ষা নয়, ভাইরাস বনাম নীলাংশুর লড়াইটা শুরু হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই|


গরমজলের ভাপ নেওয়ার মাঝেই কলিংবেলটা হঠাৎ বেজে উঠলো| কারুর তো আসার কথা ছিলোনা!


জোড়া মাস্কে নাকমুখ ঢেকে দরজা ফাঁক করলো নীলাংশু|


'স্যার, আপনার অর্ডারের থার্মোমিটার|'


'আমার? আমি তো কিছু অর্ডার দিইনি!'


'আটের তিন আপনার রুমটাই তো?'


পরপর কয়েকটা হৃদস্পন্দন বোধহয় বাদ পড়ে গেল নীলাংশুর| আঙ্গুল তুলে পাশের ঘরের দিকে দেখিয়ে দিলো ও|



জুলাই ১২...


'তুই শুধুশুধুই চিন্তা করছিস, কাশি তো অনেক কারণেই মানুষের হতে পারে?'


'আর তার সাথে বাকি ব্যাপারগুলো? তুই জানিস শেষ কয়েকদিন মালটা বাইরেও বেরোচ্ছেনা? সকালে বেরিয়ে সারাদিনের খাবার নিয়ে চলে আসে, ব্যাস!


'সে তো ভালো কথা, সচেতন বলতে হবে|'


'সেটা বাকি বিশ্বের জন্য, আমার তো লাগোয়া ঘর! তাছাড়া কাশতে-কাশতে যায়, কাশতে-কাশতে ফেরে, আদৌ মাস্ক পড়ে নাকি পড়েনা কিংবা পড়লেও নাকের নিচে...|'


'তোর চোখের নিচে কালি, গলার স্বরে ক্লান্তি...মানসিক স্থিতি মানুষের শরীরে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে, জানিস? আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে দিনের পর দিন কাটালে নানান রোগ এমনিতেই দানা বাঁধে, তখন করোনার পক্ষে ব্যাপারটা কি আরো সহজ হয়ে যাবেনা? সাবধানতা অবলম্বন কর কিন্তু বৃথা দুশ্চিন্তা না করে মন সতেজ আর পরিমান মতো খাওয়াদাওয়া...তুই খাবারের কি করছিস?'


"রেডি-টু-ইট" খাবারের প্যাকেটগুলোর দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচালো নীলাংশু, 'যথেষ্ট খাচ্ছি! তুই বললি কাল মা-কে নিয়ে দোকানে যাবি, ওদিকেও তো ছড়াচ্ছে?'


'কি করবো, গয়না তো হোম-ডেলিভারি নেবোনা| তাছাড়া নিজের গাড়িতে…আচ্ছা, তুই প্রতিবেশীনিকে টেস্ট করে নিতে বলতে পারিসনা? কিংবা কোনো হেল্পলাইনে ফোন-টোন করে ঘটনাটা বল যখন এত ভয় পাচ্ছিস?'


বিরক্ত হলো নীলাংশু, 'আমি বললে ও শুনবে কেন? তাছাড়া যদি পজিটিভ বেরিয়ে যায়, এখানকার নিয়ম অনুযায়ী আমাকেও একুশদিনের আইসোলেশনে ঢুকিয়ে দেবে | ব্যাপারটা একই দাঁড়াচ্ছে না?'



আরো কিছুক্ষন পরে ফোন রেখে আলো বন্ধ করলো নীলাংশু| ওর কলকাতার বাড়িতে এখন সাজসাজ রব, বিয়ের প্রস্তুতির হৈহুল্লোড়| কদিন আগে হলে ও-ও এসব নিয়েই মেতে থাকতো| একে তাকে ফোন করা, দিদির বিয়ের কেনাকাটা, বাড়িভাড়া নিয়ে আলাপ-আলোচনা ইত্যাদি| তবে এখন উৎসাহটা থাকলেও ওর ভয় লাগে, হৃদকম্প বেড়ে যায়| খালি মনে হয়, দেশে ফেরার ওপর কোনো বাধা না ঘনিয়ে আসে!


গত কয়েকদিন ধরে ক্রমাগত চলছে এসিটা| সারাদিন ঘরটা বন্ধ থাকায় স্যাঁতস্যাঁতে ভাব কাটানোর আর কোনো উপায় নেই| পাতলা চাদরটা গায়ে টেনে নিলো ও| জানলা দিয়ে বাইরে থেকে আসা আলো, অন্ধকার ঘরটায় একটা আলোআঁধারীর মায়াজাল সৃষ্টি করে| আকাশপাতাল ভাবতে ভাবতে চোখ বুঁজে এলো নীলাংশুর|



একটা শব্দে নীলাংশুর ঘুমটা ভেঙে গেল| পাশের ঘর থেকেই শব্দটা আসছে| শব্দটা একবার হয়েই থামলোনা, শেষরাতে চললো বেশ কয়েকবার| 


কাশির নয়, বমি করার শব্দ|



জুলাই ১৫..


নিজের শরীরটাকে টেনেহিঁচড়ে তুললো নীলাংশু, সাড়ে এগারোটায় টেস্ট করতে যেতে হবে|


বাথরুমে আসতেই আবার গা গুলিয়ে উঠলো ওর| হাঁটু গেড়ে বসে, দুহাতে কমোডের কোনাদুটো ধরে মুখ নামিয়ে শরীরটা ছেড়ে দিলো ও|


সেইরাতে পাশের ঘরের আওয়াজের পরেই ও টের পেয়েছিলো কপালের দুদিকের শিরায় যন্ত্রণার রেশটা| আলজিভের কাছটায় ভারী হয়ে এসে কাঁপুনি দিয়ে জ্বরটাও এলো তারপরেই, একটা গোটা দিনের জন্য শুইয়ে দিলো বিছানায়| আর তারপর গতরাত থেকে এই ঘটনা|


মুখ ধুয়ে প্যারাসিটামল খেল নীলাংশু| সর্বাঙ্গে একটা জড়তা, আর শরীরের প্রতিটা কোষে যেন রিনরিনে একটা ব্যাথা অনুভব করছে ও, তার সাথে কাঁপুনি দিয়ে শীত করছে| ও বাড়িতে এখনো কিছু জানায়নি| বিয়েবাড়ির বাতাবরণ মেঘাচ্ছন্ন করে তুলতে মন চাইছেনা ওর| আগে টেস্ট হোক, রিপোর্ট আসুক, তারপর দেখা যাবে|


ভিনদেশে, সম্পূর্ণ অপরিচিত একটা মানুষ ওর জীবনের একটা অধ্যায় হয়ে থেকে যাবে ও ভাবতেও পারেনি। যাকে সে দেখেনি, যার সাথে কথা বলেনি, যার ইতিবৃত্তান্ত ওর জানা নেই, অন্যসময় হলে যার কথা সে হয়তো সপ্তাহে পাঁচ মিনিটেরও বেশি ভাবতো না সেই মানুষটাই আজ এক চরম সংক্রামক মারণরোগ নিয়ে ওর সাজানো পরিকল্পনাফিক দিনগুলোকে কেমন ওলোটপালট করে দিতে চলেছে সেটা ভাবলে কেন জানে না নীলাংশুর রাগের চেয়ে ডাক ছেড়ে কান্না আসছে বেশি!


দরজা আটকে বেরিয়ে গেল সে|


দরজা আটকে বেরিয়ে গেল সে|


***


ছটা বেজে গিয়েছে|

ঘুম ভাঙতেই খিদেটা টের পেলো নীলাংশু| উঠতে হবে, সকালবেলায় টেস্ট করে আসায় আজ আর বাইরে খাবার কিনতে যাওয়ায় বাধা নেই| বরং হাসপাতাল ভ্রমণের আগে শেষবারের মতো পছন্দমতো খাবার কিনে আনার সুযোগ ও আজকের রাতেই পাবে|


কিছুক্ষন বিছানায় বসে রইলো ও| পেটের মাংশপেশীগুলোতে এখনো ব্যাথা| সর্দিতে মাথাটা ভারী হয়ে থাকলেও জ্বরটা আর নেই| 

আর মনটাও এখন পরিষ্কার| এতদিনের এত অপেক্ষা, আয়োজন, পরিকল্পনা, গোছগাছের পরিণতিটা এরকম নিমর্ম হতে চলেছে বটে, কিন্তু নীলাংশুর ভেতরটা এখন পাথরের মতো শক্ত| আসন্ন পসিটিভ রিপোর্টের হাত ধরে ভাগ্যের পরিহাস মেনে নিয়েই ও নিজেকে বুঝিয়েছে যে দেশ, পরিবার, আলুপোস্ত,ঘি-ভাতের থেকে দূরে একাকিত্ব যুঝে আরো দুমাস টিকতে হলে কাঠিন্য ছাড়া গতি নেই|

 

ফোনের ভলিউমটা বাড়িয়ে লিফটের দিকে এগোলো নীলাংশু| যেকোনো মুহূর্তেই মেসেজটা আসবে|



'হ্যালো!'


আনমনা নীলাংশু একটু চমকে গিয়েছিলো, সামলে নিয়ে পাশে তাকালো| ওদের রিসেপশনিস্ট|


'আপনি কাল চেকআউট করছেন না?'


গলার কাছটা দলা পাকিয়ে ব্যাথা করে উঠলো নীলাংশুর, কালকের দিনটা নিয়ে কত স্বপ্নই না ছিল| 

'সেরকমই ইচ্ছা আছে|'


'সিওর! আশা করি আপনার অভিজ্ঞতা শান্তিপূর্ণ হয়েছে|'


মনে মনে হাসলো নীলাংশু, বেচারি জানেনা মেয়েটির আজকে ওর সাথে কাটানো মুহূর্তগুলোর জন্য কালকে স্বাস্থদপ্তরের লোক এসে ওকেও কোয়ারান্টাইনে পাঠাবে|


'আপনার প্রতিবেশী, মিসেস জুলিয়া, তিনিও কালকে চেকআউট করছেন|'


জুলিয়া? তার এতবড়ো সর্বনাশটা যে করলো, এই তাহলে তার নাম? মনের ভেতরের সুপ্ত রাগটা যেন হঠাৎ বেরোতে চাইছে নীলাংশুর| কিন্তু বড়োই ক্লান্ত সে| 

'আচ্ছা? জানতাম না |'


‘প্রত্যেক তিনমাসে একবার করে আসেন উনি,' রিসেপশনিস্টের চোখে করুনা, 'যীশু ওনার মঙ্গল করুন| ফুসফুসে ক্যান্সার আছে ওনার, শহরের হাসপাতালেই দুসপ্তাহ ধরে কেমোথেরাপি করান, তারপর আবার নিজের গ্রামে ফিরে যান| স্বামী মারা যান আগের বছর| নিঃস্বন্তান বিধবা মানুষটা বড্ড অসহায়, প্রায় প্রতিদিনই কোভিড টেস্ট করাতে হয় ওনাকে, আমাদের ওপর বিশেষ নির্দেশিকা থাকে ওনাকে নিরাপদ রাখার। '


গভীর ভ্রুকুটি আর হাঁ হয়ে যাওয়া মুখ নিয়ে নীলাংশু উত্তর দেওয়ার আগেই ঝটকা মেরে লিফ্টটা একতলায় এসে দাঁড়ালো| 



আর ঠিক সেই সময়ই ট্রিং-ট্রিং আওয়াজ করে ওর ফোনে এসে ঢুকলো স্বাস্থদপ্তর থেকে পাঠানো টেস্ট রিপোর্টের মেসেজটা!


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama