চেনা বৃত্তের বাইরে
চেনা বৃত্তের বাইরে
মোবাইলের রিংটোনের শব্দে ঘুমটা ভাঙল তনুজার।
রাত্রি তিনটে পনেরোয় চৈতির ফোন! ঘুমচোখে রিসিভ করল, “কী রে! এত রাতে ফোন কেন?” বিপরীতে ভেসে আসা কথাগুলো শুনে মুহূর্তের জন্য ওর পায়ের তলার মাটিটা যেন সরে গেল!
বাথরুমে এসে চোখেমুখে জল দিতে একটু ভালো লাগলো ওর। পোশাক বদলে ব্যাগ পিঠে নিয়ে নিচে নেমে এলো ও। চেষ্টা করেও ও ওর ভ্রূকুটি দূর করতে পারছিলোনা।
জিপিএস চশমাটা গলিয়ে বাইরে এলো ও। চশমার ধারে বোতাম টিপে অটোকার্টকে বার্তা পাঠিয়ে সামনে তাকালো তনুজা। কন্ডোমিনিয়ামগুলো নিশ্চুপ, সমস্ত শহর ঘুমাচ্ছে। কেউ বুঝতে পারছেনা দীর্ঘ আট বছরের পরিশ্রমের ফল বিসর্জন যাওয়ার উদ্বেগে জর্জরিত তনুজার মনের মধ্যে এখন কি চলছে।
কার্টে উঠে একটু জল খেলো তনুজা। কাঁচের জানলা দিয়ে বাইরে তাকালো, কালো আকাশে অগুনতি ছোট-বড়ো জ্বলন্ত বিন্দু।
জ্বরা,ব্যাধি,হিংসা,যুদ্ধ - সব কিছুর সাথেই মানবপ্রজাতি সহাবস্থান করেছে আদি-অনন্তকাল ধরে। বিজ্ঞানের প্রগতি সময়ে সময়ে আটকেছে মানুষকে ধ্বংসলীলার গ্রাসে পরিণত হওয়ার থেকে। কিন্তু অতি বিচিত্র একটি প্রাণী এই মানুষ, শত সহস্র সাবধানবাণী এড়িয়ে, বিপদসংকেত অগ্রাহ্য করে ঔদ্ধত্ব দেখানোর ফলই হলো আজকের এই পরিস্থিতি।
পি-পি-পি।
আওয়াজে সৎবিৎ ফিরে পেলো তনুজা। একটি দৈত্যাকার অট্টালিকার সামনে তনুজাকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে চালকহীন কার্টটা অদৃশ্য হয়ে গেলো কুয়াশায়।
দুরুদুরু বুকে, মনে গভীর উৎকণ্ঠা ও কপালে ভাঁজ নিয়ে মহাকাশ বিজ্ঞানকেন্দ্রের কাঁচের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো তনুজা।
২৩তলায় ঢুকতেই এগিয়ে এলো চৈতি, উষ্কখুষ্ক চুল, না ঘুমানো লালচে চোখ।
'আঠাশ মিনিট হয়ে গেলো, এখনো নো রেস্পন্স'।
বড় স্ক্রিনে তাকালো তনুজা। ওরা ছাড়াও আরও জনাপঞ্চাশেক লোক ব্যস্তভাবে কাজ করে চলেছে, উৎকণ্ঠা নিয়ে তাকিয়ে আছে স্ক্রিনের দিকে।
ডিরেক্টর মিষ্টার কাতসুমি এগিয়ে এলেন, 'আমাদের স্যাটেলাইটের জ্বালানি কিন্তু কম পড়েনি। সাড়ে তিন বছরের খোরাকের সবে আড়াই বছর কাটিয়েছি আমরা। এখনো আমাদের অনেকটা পরীক্ষা করা বাকি আছে, এই অবস্থায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়আমরা পূর্ণাঙ্গ সাফল্যের দাবি করতে পারবো কি?'
কথাবার্তা ইংরেজিতেই হচ্ছিলো| তনুজা বললো, 'স্যার গ্রীন জোনে যেখানে প্রাণের সন্ধান পাওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি ছিল, সেখানে আমরা কিছু খুঁজে পাইনি। অন্তত এটুকু তো আমাদের প্রাপ্য হিসেবে আমরা-'।
'টিম, আমরা আবার সংকেত পাচ্ছি'!
মাইকের গমগমে গলায় চমকে উঠলো সবাই। তনুজা দৌড়ালো সামনে বসা ছেলেটির দিকে।
'স্ট্রেংথ?'
'বাড়ছে! আমরা আবার যোগাযোগ স্থাপন করতে পেরেছি! এসএফএল -১৩২ নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়নি, ইটস এলাইভ'!
বুকের পাথর নেমে যাওয়ার মতো একটা অনুভূতি হলো তনুজার। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো, সবার ঠোঁটেই হাসি, মুখে প্রশান্তি।
পেছন থেকে চৈতি এসে জড়িয়ে ধরলো, 'শুধু শুধু আসতে হলো তোকে'।
'টিম! আমাদের স্যাটেলাইট ছবি পাঠাচ্ছে। প্রজেকশন অন বিগ স্ক্রিন'! মাইকের ঘোষণা শুনে পঞ্চাশজোড়া কৌতূহলী চোখ এখন সামনের দিকে।
কিসের ছবি এটা?
অমসৃণ, ধূসর, জলশূন্য জমি চারদিকে। প্রাণহীন, তপ্ত বালির উঁচুনিচু ঢেউয়ের মাঝখানেই জিনিসটা দেখা যাচ্ছে।
স্যাটেলাইটের ল্যান্ডরোভারটা ধীরেধীরে এগিয়ে গেলো জিনিসটার দিকে। ছাইরঙা আকাশের মধ্যে দিয়ে সূর্যের যেটুকু আলো আসছে তাইতে চকচক করছে জিনিসটা।
স্বাস দ্রূত হচ্ছিলো তনুজার, 'ভ্যাকুয়াম পাম্প দিয়ে বালির স্তরটা নামাও।'
পনেরো মিনিটের মধ্যেই বালির স্তর নেমে গেলো কয়েকফুট। একটা শ্বেতশুভ্র গম্বুজের মতো জিনিস বেরিয়ে এসেছে বালির তলা থেকে। শত ঝড়ঝাপ্টাতেও যার জৌলুশ কমেনি, অন্তত দৃশ্যমান অংশটির ভেঙে বা খসে পড়েনি একটি টুকরোও।
চৈতি এসে দাঁড়ালো তনুজার পাশে, ওর চোখে বিস্ময়।
তনুজা জানে এটা কি, ইন্টারনেট এবং মিউজিয়ামে সংরক্ষিত শেষ কয়েকটি কাগজের তৈরী বইয়ে ও এটার ছবি দেখেছে।
স্যাটেলাইটের অবস্থানটি আরেকবার দেখে নিয়ে মাইকের বোতাম টিপলো তনুজা।
'রেকর্ডিং নম্বর ৬৫২, তারিখ ১৬ই জানুয়ারি ২৯৩৪ সাল। এসএফএল-১৩২ আজ ৮২১ দিন পর দাঁড়িয়ে আছে পূর্ব-পৃথিবীর একটি দেশে। মঙ্গলগ্রহে বাসস্থান গড়ে তোলার আগে আমার পূর্বপুরুষেরা এদেশেই থাকতেন। টিম, স্ক্রিনের ছবিটি আনুমানিক সতেরোশো ক্রিষ্টাব্দে তৈরী বিশ্বের অন্যতম সেরা কয়েকটি স্থাপত্যের একটির - যাকে বলা হতো তাজ মহল।'