বিলেতি সাহেবের বাইজী
বিলেতি সাহেবের বাইজী
পাশেই শিবতলা শ্মশানঘাট থাকার কারণে এমনিতেই এদিকটা বেশি ভিড় ভাট্টা হয় না। লোকের মুখে শোনা কথা ইংরেজ আমলের কিছু বিদেহী অতৃপ্ত আত্মারা আজও রাতবিরেতে এখানে ঘুরে বেড়ায়। তাই সন্ধ্যে বাড়ার সাথে সাথে এমনিতেই এলাকায় লোকজন কমে যায়। অবশ্য জয়ন্তরা এত বছর এখানে আছে, কোনোদিনও কিছু শোনেনি বা দেখেনি। আজ রবিবার। তার উপর ঠান্ডাটাও বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে। এমনিতেই সন্ধ্যের পর লোকজন কম থাকে, তার উপর আজ এই বীভৎস ঠান্ডায় যে দু একজন চায়ের দোকানে ভিড় জমাত, তারাও আসেনি। আটটা নাগাদ ভূবন চায়ের দোকানটা বন্ধ করে দেবার পর চারিদিক শুনশান, নিঃঝুম। জয়ন্তর ডাইনিং রুমের বেসিনটা থেকে টপটপ করে শুধু জল পড়ার শব্দ ভেসে আসছে।
কলটা ভালো করে বন্ধ করে এসে ডাইনিং টেবিলের পাশের চেয়ারে পায়ের উপর পা তুলে বসে জয়ন্ত সুখটান দেবার জন্য একটা সিগারেট বার করল। পকেট থেকে লাইটারটা বের করে জ্বালানোর সাথে সাথে হঠাৎ করেই চারিদিক ঘুটঘুটে অন্ধকারে নিমজ্জিত হল। লাইটারের অগ্নিস্ফুলিঙ্গর লালচে আভা জয়ন্তর মুখে পড়েছে। অন্ধকার ভেদ করে শ্মশানের দিক থেকে কুকুর শেয়ালের ডাক ভেসে আসছে। কোন এক দমকা হওয়ায় লাইটারের আলোটাও নিভে গেল হঠাৎ। প্রচন্ড ঠান্ডায়ও জয়ন্তর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের ফোটা যেন কোন এক অচেনা ভয়ের পূর্বাভাস। হৃদস্পন্দন হঠাৎ করেই যেন বেড়ে গেল জয়ন্তর। চোখের পলক না ফেলে অন্ধকারের মধ্যেই স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ও।
“ভয় পাচ্ছিস! ভূত বলে কিছু হয় না। ওসব বাজে কথা। আজগুবি গল্প সব। বি স্টেডি জয়ন্ত”। নিজের মনে কাঁপা কাঁপা গলায় কথাগুলো বলে নিজেই নিজেকে সাহস জোগানোর চেষ্টা করল জয়ন্ত। হাত-পায়ের লোমগুলো খাড়া হয়ে গেছে, বুঝতে পারছে ও। “জয়ন্ত বি স্টেডি, লোডশেডিং হয়েছে”। এ যেন নিজের যৌক্তিক সত্ত্বার সাথে নিজেরই অযৌক্তিক সত্ত্বার দ্বন্দ্ব। হাতড়িয়ে মোমবাতি জোগাড় করে লাইটার দিয়ে মোমবাতি জ্বালায় জয়ন্ত। মোমবাতির লাল আভা ঠিক যেন কোন এক অন্ধকার নির্জনপুরীর অন্দরমহলে মায়াবী আলো। বেসিনের কলে আবারও টপটপ জল পড়ার শব্দ। ঠিক যেন কোন বিলেতি সাহেব সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে বুট পরে খট খট শব্দে পায়চারি করছে। পেছন ফিরল জয়ন্ত। একি! দেওয়ালে কার ছায়া! গলার স্বর রুদ্ধ হয়ে আসছে। জল তেষ্টা পাচ্ছে। নিজের অজান্তেই হাত জোড়া জড়ো করে চোখ বন্ধ করল জয়ন্ত।
- “জয়ন্ত,এটা তোর নিজের শ্যাডো জয়ন্ত। জয়ন্ত, প্লিস আন্ডারস্ট্যান্ড!”
- “ওকে! বেসিনের কল খুলছে কেন বারবার?”
- “ইউ নো জয়ন্ত! বেসিনের কলটা খারাপ আছে। আগামীকাল মিস্ত্রি আসার কথা। ভূত বলে কিছু নেই, কিচ্ছু নেই”।
নিজের সাথে নিজের কথাবার্তা চলে। ক্ষনিকের ভীতি কাটিয়ে সাহস জোগাড় করে জয়ন্ত। কিন্তু ওটা কিসের শব্দ! ঝুম ঝুম করে বেজে চলেছে। শব্দটা এগিয়ে আসছে তো! ঠিক যেন এই মায়াবী পুরীর অন্দরমহলে কোন এক বাইজি এসে নৃত্য পরিবেশন করবে এক্ষুণি। হাতে মোমবাতিটা নিয়ে ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো জয়ন্ত। ভেবেছিল আরো একবার অযৌক্তিকতা কে হারিয়ে দিয়ে যৌক্তিক সত্ত্বা খুঁজে পাবে অযাচিত ঝুম ঝুম শব্দের কারণ। বেশ দ্রুতগতিতে কিছু একটা ছুটে আসছে তো! ঘুটঘুটে অন্ধকারে শুধু এটুকুই বোঝা যাচ্ছে মানুষের মতোই শারীরিক গঠন তার। কিন্তু মুখমণ্ডলে চোখ নাক মুখ কিছুর অস্তিত্ব নেই। খানিকটা সিনেমার পর্দায় চাক্ষুষ করা এলিয়েনদের মতো মুখমণ্ডলের গঠন। সে দৌড়াচ্ছে আর ঝুম ঝুম শব্দ হচ্ছে তার দৌড়ের সাথে তাল মিলিয়ে। দৌড়ে অন্যদিকে চলে গেল সে। আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল ঝুমঝুম শব্দটা।
ব্যালকনির দরজাটা ছিটকিনি দিয়ে ভালো করে বন্ধ করে দিল জয়ন্ত। ফ্রিজে রুটি মাংস রাখা আছে ডিনারের জন্য। দুটো বিয়ার ক্যানও ছিল। নাহ, আজ আর ওসবে গিয়ে কাজ নেই। খিদে পেলে কারেন্ট এলে পরে দেখা যাবে ক্ষণ। বিছানায় কম্বলের তলায় দেরি না করে ঢুকে গেল জয়ন্ত। ঘুম আর আসে কই! মিনিট পাঁচেকের মধ্যে ফ্ল্যাটের মেইন দরজায় টোকা মারার শব্দ। কান খাড়া করে শুনল জয়ন্ত। সত্যিই তো কেউ নক করছে। ভয়ে দমবন্ধ হয়ে আসছে।
- জয়ন্ত, দরজা খোলো! আমি বিমলদা।
ও, বিমলদা। পাশের ফ্ল্যাটে থাকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলল জয়ন্ত। খানিকটা শ্বাস নিয়ে উত্তর দিল
- খুলছি।
বেডরুম থেকে দরজা অবধি যেতেও তখন ভয় লাগছে। সাহস করে উঠে দরজা খুলল জয়ন্ত। বিমলদা হাতে টর্চ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, সাথে সৌরভদাও রয়েছে।
- কিগো! মোম ঠোম জ্বালাও নি ঘরে।
- এসো গো বিমলদা। জ্বালাচ্ছি। এমার্জেন্সি লাইটটায় চার্জ দেওয়া নেই। মোম জ্বালাচ্ছি।
ঘরে ঢুকে বিমলদাই দরজাটা তাড়াতাড়ি বন্ধ করে দিল। মোমবাতি জ্বালালো জয়ন্ত। ফিসফিস করে বিমলদা জয়ন্তকে জিজ্ঞেস করল
- কিছু শুনলে?
- কি বলো তো?
- কোনো শব্দ।
- হুমম বিমলদা। দেখেওছি। তোমরাও…
- হুমম। আমি শুনেছি, আর সৌরভ ব্যালকনি থেকে দেখেছে।
- মুখটা..
সৌরভদা আমার কথাটা কেড়ে নিয়ে বলল
- মুখটা কিরকম! চোখমুখ নেই! অদ্ভুত না?
- হুমম সৌরভদা। বড্ড অদ্ভুত।
- বিমলদা একটা ঘটনা শুনেছিল। বলো বিমলদা।
একটা জ্বলন্ত মোমবাতিকে মাঝখানে ঘিরে তিনজন গোল হয়ে বসে আছে তখন। ঠিক যেন প্ল্যানচেট চলছে। ঢোক গিলে বিমলদা বলতে শুরু করল
- তখন এ পাড়ায় নতুন এসছি বুঝলে। বিকাশবাবু বলে এক ভদ্রলোক থাকতেন। উনি একটা গল্প বলেছিলেন। আমি তো হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলাম।
- কি গল্প?
- বলছি তো সেটাই। এখানে নাকি আগে এক সাহেব থাকতেন। প্রতি শুক্রবার করে তার বাড়িতে বাইজী নাচের আসর বসত। একবার সেরকম এক বাইজীকে সাহেবের খুব পছন্দ হয়ে গেছিল। সাহেব সরাসরি তাকে একসাথে রাত্রিযাপন, এমনকি বিবাহের প্রস্তাব অবধি দিয়েছিল। সেই বাইজী সব প্রস্তাব নাকচ করে দেওয়াতে নাকি রাগে অপমানে সেই সাহেব বাইজীর একেবারে মুন্ডু বিচ্ছেদ করে দিয়েছিল।
কথাগুলো এক নাগাড়ে বলে থামল বিমল দা। কারোর মুখে কোনো শব্দ নেই। গোল করে একে অপরের হাত শক্ত করে ধরে বসে আছে তখন। জয়ন্ত নীরবতা ভাঙল
- যদি কিছু মনে না করো আজ থেকে যাবে গো তোমরা আমার সাথে?
মাথা নাড়িয়ে সায় দিল বিমলদা আর সৌরভদা।
পরদিন সকালে যখন সূর্য উঠল, তখন এই গা ছমছমে ভাবটা আর নেই। পাখিদের কলতানের মিষ্টি ভোরে তখন আর কে বুঝবে যে আগের রাতটা কতটা ভয়ঙ্কর ছিল। সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ ভূবনের চায়ের দোকানে এল জয়ন্তরা। সেখানেও গতকালের রাতের ওই অদ্ভুত ঘটনা নিয়ে চর্চা হচ্ছে। পলাশ ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে। ও বলছে এটা নাকি ভূত নয়, ও কিসব রিসার্চ করে বার করেছে যে বাইরের কোনো গ্রহ থেকে আসা এলিয়েনদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যর সাথে কালকের চরিত্রটার মিল আছে। যদিও বাকিরা সেই তত্ত্ব খারিজ করে কালকের ঘটনাকে সম্পূর্ণ ভৌতিক আখ্যাই দিচ্ছে। তবে সবার মুখই থমথমে, চোখেমুখে আশঙ্কার ছাপ। কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছে সবাই।
ভূবনদার চায়ের দোকানে আসতে ভালো লাগে না রাতুলের। রাতুলের হাবভাব, চালচলন একটু মেয়েলী বলে সবাই ওকে “মেয়েছেলে”, “লেডিস” বলে ক্ষেপায়। কতবার মাকে বলেছে “মা, ভূবনদার কাছ থেকে পাউরুটি আনতে হলে দুপুরবেলা বলো, নিয়ে আসবো”। তখন কেউ তেমন থাকে না আসলে। কিন্তু উপায় কি! প্রতিদিন সেই ব্রেকফাস্টের টাইমেই পাউরুটি শেষ হয়।
- ভূবনদা, একটা পাউরুটি দাও।
ঘাড় ঘুরিয়ে চারিদিক দেখে অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করল রাতুল। কি ব্যাপার! সবাই চুপচাপ! থমথমে পরিবেশ! যাদের জন্য রাতুল ভয় পেয়ে থাকে, আজ তারাই ভয় পেয়ে আছে মনে হচ্ছে। যাকগে! হাঁপ ছেড়ে যেন বাঁচলো রাতুল। একটা দিন অন্তত ওদের টিটকারি, লেগপুলিং থেকে রক্ষা পাওয়া গেল।
সনাতন কাকু বাজার সেরে আসছেন। রাতুলকে খুব স্নেহ করেন, রাতুলদের পাশের বাড়িতেই থাকেন। রাতুলকে দেখতে পেয়ে ডাকলেন
- এই যে রাতুল, শোনো
- হুমম গো কাকু
- কাল ওটা তুমি ছিলে না রাত্রিবেলা? দৌড়ে ঘরে ঢুকলে
- হ্যাঁ কাকু। আমার একটু ক্ল্যাসিক্যাল ডান্স এর প্রতি ইন্টারেস্ট জন্মেছে হঠাৎ। তাই একটা নাচের স্কুলে ভর্তি হলাম।
- বাহ, খুব ভালো কথা তো। কিন্তু ওরম দৌড়াচ্ছিলে কেন?
- কাল হঠাৎ মা ফোন করে বলল টিভির রিমোট খুঁজে পাচ্ছে না। আমি যখন বেরোচ্ছিলাম কোন খেয়ালে পোশাক আশাক ঢোকাতে গিয়ে টিভির রিমোটটাও ব্যাগে ভরে ক্লাসে চলে গিয়েছিলাম। তারপর ঘুঙুর ঠুঙুর না খুলেই দৌড়ে দৌড়ে ফিরে এলাম বটে মায়ের ফোন পেয়ে, ততক্ষনে তো আবার লোডশেডিং হয়ে গেছে। আর বোলো না কাকু। কাল সিরিয়াল দেখা হয়নি। মা হেব্বি রেগে আছে।
হো হো করে হেসে উঠলেন সনাতন কাকু।
- অন্ধকারে ঠিক বুঝলাম না, পায়ে ঘুঙুর ছিল, তা নিয়েই দৌড়াচ্ছিলে বুঝেছি। মাথায় ওটা কি পড়েছিলে বাবা?
- আরে দাদা আমায় বাইকে বড় রাস্তার মোড়ে ছেড়ে কি একটা কাজে গেল। কাল রাতে যা ঠান্ডা ছিল , খুব ঠান্ডা লাগছিল। তাই হেলমেটটা পরেই দৌড়ে দৌড়ে চলে এলাম।
সনাতন কাকু হাসি আর থামাতে পারছেন না। হাসতে হাসতেই রাতুলের কাঁধে হাত রেখে বললেন
- বুঝলে রাতুল, ভূবনের দোকানের ছেলেপুলেরা কাল ওভাবে অন্ধকারে তোমাকে দেখে কেউ ভূত ভেবেছে, কেউ এলিয়েন ভেবেছে। তাই এরম থম মেরে বসে আছে আজ। আর তুমি! উফফ! পারোও বটে। তবে তুমিও যে ওদের ভয়ের কারণ হয়ে উঠলে সেটা দেখে কিন্তু আমি খুশিই হয়েছি।
রাতুল হাসে, কিন্তু ওর মনে একটা ভয় কাজ করে যদি সত্যিটা জানার পর ওরা ওকে আরো বেশি মানসিক অত্যাচার করে। সনাতন কাকু মিষ্টি হেসে বললেন
- চিন্তা কোরো না রাতুল। হিসেব নিকেশের খাতার পাতা উল্টিয়েই অন্তর্যামী জীবনের সব স্ক্রিপ্ট লেখেন।