STORYMIRROR

Manab Mondal

Abstract Fantasy Inspirational

4  

Manab Mondal

Abstract Fantasy Inspirational

বাঘা যতীন

বাঘা যতীন

4 mins
341

কুষ্টিয়ার এক গ্রামে বাঘের উৎপাতে সবাই দিশেহারা। গ্রামেরই বাসিন্দা ফণিবাবু ঠিক করলেন, বাঘটিকে তিনি মারবেন। তাঁর পিসতুতো ভাই যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় বা যতীন একটা ভোজালি সঙ্গে নিয়ে বাঘ মারা দেখতে গেলেন। জঙ্গলের পাশে মাঠে সবাই বাঘের জন্য অপেক্ষা করছে, ফণিবাবুর হাতে বন্দুক। এদিকে বাঘ এসে পড়ল যতীনের পিছনে। ফণিবাবু গুলি ছুড়লে তা বাঘের মাথা ঘেঁষে চলে যায়। উত্তেজিত বাঘটি যতীনকেই আক্রমণ করে বসে। ভোজালি দিয়ে যতীন তাকে প্রতিহত করার চেষ্টা করেন। শুরু হল বাঘে মানুষে তুমুল লড়াই। শেষে বাঘটির মৃত্যু হল, আর যতীন হলেন গুরুতর আহত। তাঁর শরীরের প্রায় ৩০০টা জায়গায় ক্ষত হয়েছিল। অনেক সেবা-যত্ন-চিকিৎসার পর তিনি সেরে উঠলেন। ডাক্তার সুরেশপ্রসাদ, যিনি এতদিন যতীনের চিকিৎসা করছিলেন, তিনি বাঘ মারার স্বীকৃতি হিসেবে যতীনের নাম দিলেন, ‘বাঘাযতীন’।

 

ছোটোবেলা থেকেই দেশকে প্রবল ভালোবাসতেন বাঘাযতীন। মানুষের সেবায় ছিল তাঁর ঐকান্তিক নিষ্ঠা। শরীরচর্চা এবং কুস্তিতে ছিলেন দক্ষ। স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য তিনি টাইপরাইটিং ও শুর্টহ্যান্ড নেওয়া শিখেছিলেন। কলকাতায় কিছুদিন কাজ করার পর মুজফফরপুরে ব্যারিস্টার কেনেডির স্টেনোগ্রাফার হিসেবে কাজ নেন। ওই সময়ে ফুজফফরপুরে ফুটবল ও শরীরচর্চা কেন্দ্র গড়ে তুলেছিলেন যতীন। পরে আবার কলকাতা এসে বাংলার গভর্নরের ব্যক্তিগত সচিবের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। পাশাপাশি বিপ্লবের তোড়জোড়ও চলত। কলকাতাতেই যতীন এসেছিলেন অরবিন্দ ঘোষের সান্নিধ্যে। তাঁরই আদর্শে বিপ্লবী কর্মকাণ্ড চলত। যতীন সেখানে নেতা হয়ে ওঠেন নিজের গুণে। ১৯০৮ সালে তাঁদের বোমা তৈরির কারখানায় পুলিশ আসে। 


তারপরেও গোপনে বাঘাযতীন বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছিলেন। আলিপুর বোমার মামলায় অভিযুক্তদের সাহায্য করছিলেন গোপনে। এরই মধ্যে তিনি গ্রেপ্তার হন, এবং প্রমাণের অভাবে বছরখানেক পর তাঁকে ছেড়েও দেয় পুলিশ। তিনি স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ঝিনাইদহে চলে যান এবং ব্যবসা শুরু করেন। ব্যবসার আড়ালেই স্বাধীনতা সংগ্রামের কাজকর্ম চলত। দেশের নানা প্রান্তের বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে এই সময়ে সন্ন্যাসীর বেশে ঘুরে বেরিয়েছেন সারা ভারত। বিপ্লবের প্রয়োজনে স্বদেশি ডাকাতি চালাতেন। দুর্বিনীত ইংরেজদের পেটানোর জন্য বিখ্যাত ছিলেন তিনি। কোনো উদ্ধত ইংরেজ ভারতীয়দের অপমান করছে দেখলে তিনি সহ্য করতে পারতেন না। সোজা হাত তুলতেন। 


১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। জার্মানি তখন ইংরেজদের প্রধান শত্রু। জার্মানি থেকে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রচারকার্য চালানোর জন্য ‘বার্লিন কমিটি’ তৈরি করলেন সেখানে বসবাসকারী ভারতীয় ছাত্ররা। এদের সঙ্গে যোগাযোগ করে যতীন্দ্রনাথ ১৯১৫ সালে অবনী মুখার্জিকে জাপানে পাঠিয়ে দিলেন রাসবিহারী বসুর কাছে। এদিকে ‘আত্মোন্নতি সমিতির’ প্রতিষ্ঠাতা বিপিন বিহারী গাঙ্গুলির সাহায্যে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের ২৬ আগস্ট কলকাতার ধর্মতলায় ‘রডা অ্যান্ড কোম্পানি’-র দোকান থেকে বিপ্লবীরা ৫০টি মাউজার পিস্তল ও ৪৬০০ রাউন্ড কার্তুজ লুঠ করেন। নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বাঘাযতীন। তারপর বাঘা যতীন ও তাঁর সঙ্গীরা ওড়িশার বালেশ্বরে গিয়ে লুকিয়ে থাকেন। 


বাঘাযতীন চেষ্টা করছিলেন জার্মানির কাছ থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করতে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, এক বিপ্লবী যোগাযোগ করেন জার্মান সরকারের সঙ্গে। জার্মান প্রশাসন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করতে রাজি হয়েছিল। বাঘাযতীনের সহযোদ্ধা নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ভারতীয় বিপ্লবীদের জন্য বিদেশ থেকে অস্ত্র আনতে সিআর মার্টিন নাম নিয়ে বাটাভিয়া যান। সেখানে জার্মান দূতাবাসের মাধ্যমে যোগাযোগ করেন জার্মানির প্রশাসনের সঙ্গে। তাঁকে জার্মান সরকার জানায়, অস্ত্র বোঝাই ৩টে জাহাজ ভারতের উপকূলে পাঠাবে তারা । সেই অনুযায়ী, ম্যাভেরিক, অ্যানি লার্সেন ও হেনরি-এস নামে তিনটে জাহাজ রওনা দেয়। কিন্তু ইংরেজদের কাছে সেই খবর ফাঁস হয়ে গিয়েছিল। তিনটি জাহাজের একটি হাতিয়ায়, একটি সুন্দরবনের রায়মঙ্গলে এবং একটি ওড়িশার বালেশ্বর উপকূলের পৌঁছনোর কথা ছিল । ইংরেজ সরকার আটক করে তিনটে জাহাজকেই। বালেশ্বরে বাঘা যতীনের গোপন আস্তানাতেও হানা দেয় পুলিশ।

 পুলিশবাহিনী নিয়ে বাঘাযতীন ও তার সঙ্গী বিপ্লবীদের পিছু নিয়েছিলেন। বিপ্লবীরা অনাহারে-অর্ধাহারে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পালিয়ে যেতে লাগলেন। বাঘাযতীন ভীরু কাপুরুষ ছিলেন না। পাল্টা আক্রমণের জন্যেও প্রস্তুত হচ্ছিলেন তিনি। এদিকে ব্রিটিশ পুলিশরা বাঘাযতীনদের দলবলকে ডাকাত বলে গ্রামে গ্রামে প্রচার করেছিল। তাই স্থানীয় মানুষদের কেউ কেউ ভয় পেয়ে এবং ডাকাত ধরানোর পুরস্কারের লোভে বাঘাযতীনের গতিবিধির খবর জানিয়ে দিচ্ছিল পুলিশকে। 


একদিন বঙ্গোপসাগরের উপকূলে বুড়িবালাম নদীর তীরে দোকানে চার সঙ্গীদের নিয়ে খেতে বসেছিলেন বাঘাযতীন। সেই খবর পুলিশে কাছে পৌঁছয়। তখনই পুলিশবাহিনী নিয়ে বালেশ্বরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কিলবি ও মিলিটারি লেফটেন্যান্ট রাদারফোর্ড চলে যান সেখানে। বাঘাযতীনও বিপদ আঁচ করে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হলেন। আশ্রয় নিলেন পরিখার আড়ালে। পুলিশের সঙ্গে তাঁদের গুলির যুদ্ধ শুরু হল। ১৯১৫ সালের ৯ সেপ্টেম্বর স্বাধীনতা সংগ্রামের এক পবিত্র রণক্ষেত্রে পরিণত হল বুড়িবালামের তীর। গুলির যুদ্ধে সেখানে চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরী শহিদ হলেন। গুরুতর আহত হলেন বাকি তিন জন। তাঁদের গুলির সব ফুলিয়ে গিয়েছিল। এই অবস্থায় ব্রিটিশ পুলিশ তাঁদের বাগে পেল। 


পরের দিন বালেশ্বর সরকারি হাসপাতালে মারা গেলেন বাঘাযতীন। বিচারে তাঁর সঙ্গী জ্যোতিষ পালের ১৪ বছর সশ্রম কারাদণ্ড হল, মনোরঞ্জন সেনগুপ্ত ও নীরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের হল ফাঁসি। বুড়িবালামের তীরে ব্রিটিশ শাসকের বিরুদ্ধে যে ৪ বাঙালি বিপ্লবী মরণপন লড়াই করেছিলেন, তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখলেন: 

“বাঙালির রণ দেখে যা তোরা

রাজপুত, শিখ, মারাঠী জাত

বালাশোর, বুড়ি বালামের তীর

নবভারতের হলদিঘাট”।

বাঘাযতীন | এই মানুষটির বিপ্লবী কর্মকান্ডকে ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে | সেই সময় কলকাতার সব বিপ্লবী কার্যকলাপের সঙ্গেই যুক্ত ছিলেন বাঘাযতীন | গার্ডেনরিচের ডাকাতির ঘটনা,রডা কোম্পানির অস্ত্র দখল, বার্ড কোম্পানির ডাকাতি থেকে শুরু করে ইন্সপেক্টর সুরেশ মুখার্জী হত্যা, শামসুল আলম হত্যা.....সবকিছুর পিছনেই ছিলেন বাঘাযতীন | 

#freedomfighter #revolution #revolutionary #বাঘাযতীন #bangla #indianfreedomstruggle


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract