Debdutta Banerjee

Classics Inspirational

3  

Debdutta Banerjee

Classics Inspirational

তুষার দেশের অতিথি...

তুষার দেশের অতিথি...

5 mins
644


ঢং ঢং ঢং ঢং..... ঘন্টার আওয়াজে খয়েরী হলুদ কাপড় পরা শিশুর দল ছুটে বেরিয়ে আসে খোলা আকাশের নিচের চাতালটায়, সবার হাতে বড় একটা করে মগ আর বাটি। এখন ওদের জলখাবারের সময়। এরপর লামা চিপার ক্লাস। খুব সুন্দর কথা বলেন লামা চিপা। সব সময় বলেন -''তোমরা ঈশ্বরের সন্তান। এই পৃথিবীর বুকে তোমরা ক্ষণিকের অতিথি। অল্প সময়ের জন‍্য তোমরা এখানে এসেছো। ভালো কাজ করো। সবাইকে সাহায‍্য কর। ঈশ্বর তোমাদের সহাযআবার ঝাপসা হয়ে আসে সব কিছু। কেমন ছেড়া ছেড়া ছবি গুলো হারিয়ে যায়। চারদিকে পেজা তুলোর মত বরফ, বরফ আর বরফ। বাচ্চা ছেলেটা ছুটছে বরফের ভেতর, খেলছে, লাফাচ্ছে। ঐ তো পাপা, একটা বড় বরফের পাহাড়ে দড়ি বাঁধছে। পাসাং দাজুও আছে। পেম্বার পাপা শেরপা, দাজুও শিখেছে পাহাড়কে জয় করতে। আজ থেকে পেম্বার ট্রেনিং শুরু। পাপা বুঝিয়ে দিচ্ছে সব। কি করে দড়ির ওপর শরীরের ভার রেখে উপরে উঠতে হবে। একটা ছোট্ট টেন্ট নিয়ে ও দাজু আর পাপা এসেছে এই বরফের দেশে। ওরা এখন হিমা 

আবার সব ধুয়া ধুয়া, অন্ধকার। না, না, ঐ তো আলো দেখা যাচ্ছে। ঐ তো পাসাং দাজু ঐ তো ওপরে, ফাটলটার মুখে। ওকে বলছে ধীরে ধীরে দড়িটা ধরে খাঁজে পা রেখে ওপরে উঠতে। ক্রিভাস তো দাজুই চিনিয়েছিল ওকে। ক্রিভাস থেকে বাঁচার উপায় শিখিয়েছিল। বরফের রাজত্বে যাদের নিত‍্য আনাগোনা এই হীম শীতল মৃত‍্যু গহ্বরকে তাদের চিনে নিতেই হবে। মোকাবিলা করতে হবে পদে পদে এই শীতল মৃত‍্যু ফাঁদের স 

ভীষণ ঘুম পাচ্ছে পেম্বার, কিন্তু ঘুমালে চলবে না। একবার ঘুমিয়ে গেলেই সব শেষ। ওকে জেগে থাকতেই হবে। দাজু যখন ওপরে রয়েছে ওকে ঠিক বার করবে ওর দাজু। পাহাড়ের মাঝে বিছিয়ে রয়েছে ক্রিভাস, মরণ ফাঁদ। পর্যটকরা ওদের অতিথি। তাদের নির্বিঘ্নে এ পথ পার করে দেওয়াই শেরপাদের কাজ। পাংসা পেম্বা ওরা এ কাজ করে আসছে বহুদিন ধরে। আটবার এভারেষ্টে উঠেছে পেম্বা। এর আগেও দুবার ক্রিভাসের কবলে পড়তে পড়তে বেঁচেছে। তবে এবার কি  কারাকোরাম রেঞ্জের ৭৪১৫ মিটার উঁচু সাসের কাংরি শৃঙ্গ ছুঁয়ে নামছিল দলটা।ওদের নেতৃত্ব দিচ্ছিল পেম্ব। সবাই ছিল খুব ক্লান্ত বিধ্বস্ত।কৃৃষ্ণনগরের দলটাকে গুছিয়ে নিয়ে ফিরছিল ওরা। পাসাং দাজু ছিল সবার পেছনে। বেঙ্গলের ঘুম থেকে এসেছিল ওরা, হিমালয়ের বরপুত্র এই শেরপা দুই ভাই কারাকোরামের অতিথি। সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে আজ ওদের লে শহরে পৌঁছে যাওয়ার কথা ছিল। ছোট একটা হিমবাহ পার করছিল ওরা, মাত্র পাঁচশো মিটার পথ বাকি ছিসবার প্রথমেই ছিল পেম্বা, দড়ি, আইস এক্স, আর যাবতিয় সরঞ্জানিয়ে হাঁটছিল একাই। একটু বেশি ওয়েট বইছিল হয়তো।বহুবার পাহাড় ভেঙ্গে ভেঙ্গে ওর আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেছিল। ভুলে গেছিল পাপার শেখানো কথা গুলো। পাহাড়ের বরফ কে বিশ্বাস করতে নেই। দেখতে যতই মনোরম হোক এ হল হুর পরীদের দেশ। ছলনা পদে একটু বেখেয়াল হয়েছিল কি পেম্বা!! তিনদিন পর লে ফিরবে, আর এক সপ্তাহ পর বাড়ি ফিরেই দেখা হবে পরিবারের সাথে। এসব কথা ভেবেই কি ও পথ হাঁটছিল চুলের মত সরু ফাটলটা যদি চোখ পড়ত!! দাজুরা বেশ কিছুটা পিছিয়ে গেছিল। ছোটছোট বিন্দুর মত লাগছিল ওদের। শর্টকাট নিতে গেছিল পেম্বা যা পাহাড়ে একদম বারণক্রিভাসটা টের পেতে পেতে ও কয়েকশো ফুট ভেতরে তলিয়ে গেছিল। সোজা নয় এঁঁকেবেঁঁকে নেমেছে গর্তটা। ভীষন সরু। এ সব অভিযানে একটা ভুল সব শেষ করে দিতে পারে পেম্বা জানে।আপাতত একটা খাঁজে নিজেকে আটকাতে পেরেছিল পেম্বা, ওর চিৎকার কি দাজু শুনতে পেয়েছিল ? কে জানে। ঘড়ির কাঁঁটা বলছে ৫৮ ঘন্টা পার হয়ে গেছে। সাথের জল টুকু শেষ হয়েছিল আগেই। শেষ বিস্কুটটাও শেষ। বরফ গুরো করে খেতে হচ্ছে যা খুব বিপদজনক। এই ৫৮ ঘন্টাকে মনে হচ্ছে কয়েক শ বছর। তবুও আশা ছাড়েনি পেম্বা। পাপা বলত মরার আগেই মরতে না। মৃত‍্যুতো আসবেই একদিন। তাই মৃত‍্যুকে ভয় পেয়ে কেন বেঁচে থাকা? বাঁচবে বাঁচার জন‍্য। পেম্বা ঐ কথা গুলোই মনে করে দাঁতে দাঁত চেপে। পড়ে যাওয়ার সময় বেশ কিছু সরঞ্জাম নিচে পড়ে গেছিল। আইস এক্সটা থাকলে তবু চেষ্টা করা যেত একবার। আর খাঁজটাও এতটাই ছোট যে ঠিক মত বসাও যায় না। একটা ছোট বরফের চাঙ্গর নিচে ছুড়ে দেখেছিল পেম্বা। প্রায় চল্লিশ সেকেন্ড পর জলে পড়ার শব্দ হয়েছে। ঐ জল সাক্ষাত মৃত‍্যু। একবার পড়লে আর রক্ষা নেই। বেশি নড়াচড়া করলে তারও ঐ গতিই হবে। কিন্তু আর এভাবে বসে থাকা যাচ্ছে না। মনে জোড় আনতে প্রেমার কথা ভাবে পেম্বা । আবার বোধহয় তুষার ঝড় শুরু হল!! কুচো কুচো বরফ গড়িয়ে আসছে উপর থেকে। যদি গর্তের মুখটা বুজে যায়.....!! অক্সিজেন শেষ হয়ে যাবে বাতাস চলাচল বন্ধ হলেই। আর ভাবতে পারে না পেম্বা। সাহায‍্য নিশ্চই আসবে। মনে জোড় আনে। আটান্ন ঘন্টা না ঘুমিয়ে একটা কেমন ঘোরের মধ‍্যে চলে যায় ও। মনে পড়ে সিয়াচেনের হনুমান থাপার কথা। সাতটা দিন ক্রিভাসের মধ‍্যে আটকা পড়েও বেঁচে ছিল সে। পরে অবশ‍্য শরীরের কলকব্জা জবাব দিয়েছিল। তবুও সাতটা দিন শ্বাস নিয়েছিল সে বরফের কবরে। মোটে আড়াই দিনেই ভেঙ্গে পড়লে চলবে না। সে যে শেরপা, শেরপাদের প্রাণ এত সহজে যায় না। পাসাং দাজু তো রয়েছে ওপঅবসন্ন হয়ে আসে শরীর। বরফের গুহায় বন্দী পেম্বার হঠাৎ মনে হয় উপর থেকে একটা হাল্কা আলো আসছে ভেতরে। নিজের হেডটর্চের ব‍্যাটারি চব্বিশ ঘন্টা আগেই দেহ রেখেছে। ব‍্যাগে একটা টর্চ ছিল। সেটা জ্বালিয়ে সিগন‍্যাল দেওয়ার চেষ্টা করে পেম্বা। চিৎকার করে বলে -''আমি এখানে, বাঁচাউত্তর আসে না, আসে না কোনো আলো। টর্চটা নেবালেই আবার সব অন্ধকার। 

 

অবসন্ন দেহে চোখের সামনে ভেসে ওঠে কত চেনা ছবি। হ্যালুসিনেশন !! ঐ তো তার মা, ঝর্ণায় জল নিচ্ছে, স্কুল থেকে ছুটে আসছে খয়েরী কাপড় পরা নেড়ামাথা ছোট্ট ছোট্ট লামার দল। ছাগল আর ভেড়ার পাল নিয়ে যাচ্ছে প্রেমা আর তার আব্বা। দাজু আর পাপা যাচ্ছে নতুন দল নিয়ে সগরমাথা (এভারেষ্ট) অভিযানে। ছোট্ট পেম্বাও যেতে চপ্রেমার আব্বা বলেছিল সগরমাথায় চড়তে পারলেই শাদি হবে ওদের। জেদ করেই সতেরো বছরের ছেলেটা পাপার দলে ঢুকে পরেছিল। প্রথম দুবার শেষ বেস ক‍্যাম্প অবধি কুলির কাজ করিয়েছিল পাপা। তৃতীয়বার ও উঠতে পেরেছিল চোমোলাংমায়। যাকে পৃথিবী চেনে এভারেষ্ট নামে। এরপর পর পর আটবার , কেমন যেন নেশা ধরে গেছঘুম মনেষ্ট্রি ঝাপসা হয়ে আসছে, ঢং ঢং ঢং, ছুটির ঘন্টা বাজছে। ঘুম নেমে আসছে চোখের পাতা জুড়ে। কানে বাজছে লামাচিপার কথা-''তোমরা সবাই ক্ষণিকের অতিথি''তবে কি সময় ফুরোলো!!ঐ তো শোনা যাচ্ছে হেলিকপ্টারের আওয়াজ!! ইন্দোটিবেট বর্ডারের থেকে কি রেসকিউ টিম আসছে? ঘড়ি বলছে চৌষট্টি ঘন্টা পার হয়েছে!!

চপারে রেসকিউ টিম আসতে তো এত সময় লাগার কথা নয়!! আর কতক্ষণ এভাবে বরফের কুয়ায় থাকতে হবে? হাইপোথার্মিয়া শুরু হয়ে যাবে এর পর। বেসক‍্যাম্প থেকে কি খবর যায় নি লে তে? এমনটা তো হওয়ার কথা নয়। আশা মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। এই বরফের দেশে আত্মাদের বাস পেম্বা জানে। আশা হারালেই টেনে নেবে ওরা। হোলি ফ্ল্যাগ তো আর সব জায়গায় থাকে না। মহান আত্মারা ডাকছে তাকে। ঐ তো!! ওদের ডাক শুনতে পাচ্ছে পেম্বা। তবে কি সময় ফুরোলো? কালঘুম নেমে আসে চোখের পাতা জুড়ে। কিন্তু জোড় করে জেগে থাকতে চায় পেম্বা, সে যে শেরপা, সে যে হারতে শেখেনি। 


Rate this content
Log in