তুমি শ্রেষ্ঠ শিক্ষক , তুমি মা
তুমি শ্রেষ্ঠ শিক্ষক , তুমি মা
মা একটা ছোট্ট শব্দ যার মধ্যেই নিহিত রয়েছে জীবনের মূল বীজ মন্ত্র । মা থাকলে আমার অস্তিত্ব থাকত না । একজন লেখিকা হিসেবে আজ মায়েদের এই প্ল্যাটফর্মকে আমি বেছে নিলাম না বলা মনের কথা গুলো উজাড় করে দিতে । আমাদের ব্যক্তিত্ব , আমাদের পেশাগত পরিচয় সব কিছুর ভিতরে ও আমাদের মধ্যে বাস করে একটা স্বত্বা , যা কখনো কখনো সকলের কাছে অপ্রকাশিত থেকে যায় । কি জানি হাতে আর সময় পাবো কি না ? মহামারীর করাল গ্রাস থেকে বেরিয়ে আবার নতুন সূর্যোদয় দেখতে পাবো কি না ?
আজ আছি কাল নেই শব্দটা এখন এতই বাস্তব ও নগ্ন হয়ে উঠেছে যে মনের কথা গুলো বলে থুড়ি লিখে ফেলাই ভালো । হাম রহে না রহে ইয়ে লিখবট রহে যায়ে ... অমর হো জায়ে দস্তানে প্যারকি । অর্থাৎ কাল যদি না ফেরার দেশে চলে যাই তো আমার লেখাতেই অমর হয়ে থেকে যাবে আমার ভালোবাসার কাহিনী গুলি । না আমি প্রেমের সম্পর্ক বলতে এখানে নারী পুরুষের প্রেমের কথা বলতে চাইছি না । আজ একটা সহজ স্বীকারোক্তি করতে চাই মা ও সন্তানের ভালোবাসা নিয়ে । আমার মায়ের সঙ্গে আমার বয়সের পার্থক্য মাত্র আঠেরো বছরের যেখানে আমার ও আমার ছেলের বয়সের পার্থক্য পঁচিশ বছর ।
যখন ছোট ছিলাম ভাবতাম মা বড্ড বেশি নিষ্ঠুর । মা অল্প ব্যাথা পেলেও আহা আহা করে আমাকে প্যাম্পার করতেন না । অথচ কাকিমাদের দেখেছি ভাই বোনদের ব্যাথা লাগলে কেমন ছুটে বেড়াতেন । অথচ আমার মা আমাকে বলতেন শক্ত হতে হয় ... এত নরম হয়ে থাকলে চলে না । ওষুধ লাগিয়ে নাও ঠিক হয়ে যাবে । যখন ভাই বোনেদের মধ্যে মারপিট লাগত , যার যার মা এসে নিজ নিজ সন্তানকে সাপোর্ট করতেন আর অন্যের ছেলেদের দোষ খুঁজছেন । আর আমার মা সকলের সামনেই কান মূলে আমাকে দোষ দিতেন । সবাই পুজোতে পাঁচটা জামাকাপড় কিনলে আমার জন্য মা বরাদ্দ করতেন খুব বেশি হলে দুটো জামা । যুক্তিটা ছিল প্রয়োজনের বেশি কিছু করতে নেই । ঘুম থেকে উঠেই গানের রেওয়াজ , পড়াশোনা করা তারপর স্কুলের দিকে রওনা দেওয়া ।
বিকাল সাড়ে চারটে সময় বাড়ি ফিরেই জামাকাপড় পাল্টে কিছু খেয়েই একটু বিশ্রাম নিয়ে কাঁটায় কাঁটায় বিকাল ছটা বাজলেই পড়তে বসতে হত । সেই বিদ্যাভাস চলত রাত সাড়ে নয়টা পর্যন্ত । তখন ভাবতাম কবে মায়ের আঁচল ছেড়ে বেরিয়ে যেতে পারব । কারণ ওটা মায়ের আঁচল নয় শেকল মনে হত তখন । কিন্তু মায়ের মর্ম আজ বুঝতে পারছি । আমার জীবনে মা যে ঈশ্বরের দেওয়া কি বড় আশির্বাদ সেটা হয়ত আর বলার অপেক্ষা রাখে না । সেদিন যাকে ভিলেন মনে হত আজ তাকে দেবী মনে হয় কারণ সংসারের সারমর্ম আমি আজ বুঝে গেছি । আমি আজ যা কিছু হতে পেরেছি সবটাই মায়ের জন্য । মায়ের শক্ত হাতে আমার লোভ , লালসা , কুঁড়েমি , ফাঁকিবাজিকে দমন করার ফলে আজ একজন স্বশিক্ষিত মানুষ হতে পেরেছি ।
মায়ের কঠোর অনুশাসন আমাকে শিখিয়েছে পরিশ্রমী হতে , নিয়মে চলতে শিখতে । পরের ছেলেকে শাসন করার থেকে নিজের সন্তানকে সংযমী হতে শেখাতে হয় এইটাই মৌলিক শিক্ষা । সেদিন আমাকে কান মোলা দিয়ে মা কিছু ভুল করেনি । অতিরিক্ত চাহিদা পূরণ না করে যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু দিয়ে আমাদের লোভকে সংবরণ করতে শিখিয়েছে আমার মা । অল্প আঘাত পেয়ে বিছানা নিতে বাধা দিয়ে মা আমাকে শক্ত তৈরি করেছেন । ওই শিক্ষা আমাকে শিখিয়েছে যে সহজে ভেঙে পড়তে নেই । নিয়ম মেনে পড়তে বসতে বলা , স্কুল কামাই করতে না দেওয়া এগুলো করে আমাকে ডিসিপ্লিন কথাটার মানে বুঝিয়েছেন মা । আমি অপ্রয়োজনীয় গল্পের আসরে যেতে পেতাম না মায়ের কারণে । আজও যাই না কারণ আমাকে বাধা দেওয়ার জন্য মা আমার কাছে না থাকলেও আমার নিজেরই ভালো লাগে না সাংসারিক কূটচালিতে থাকতে ।
বরং মায়ের জন্য আমি বইপ্রেমী হয়ে গেছি শৈশবেই । আমার শিখতে অনেক হয়ত বাকি আছে তবুও মায়ের জন্যই আমার শেখার আগ্রহ তৈরি হয়েছে । সুযোগ খুঁজি আমি একটু সময় পেলেই বই পড়তে , হিজিবিজি লিখতে । লিখতেও তো শেখা আমার মায়ের অনুশাসনের জন্যই । কি জানি ছোটতে যে ভাবে চলতে চাইতাম মায়ের কাছে বাধা না পেলে আজ যাই হতাম অন্তত লিখতে শিখতাম না । আমার মনের বিকাশ তো হতেই পারত না যদি আমি মায়ের শেকলে বাঁধা না পড়তাম । মা আমাদের জন্ম দেন তার ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব নয় তাই কনকাঞ্জলি ও দিলাম না মাকে বিয়ের সময় । তবুও তাকে ধন্যবাদ জানানো তো যায় নিজের লেখা কালো অক্ষর গুলো দিয়ে।
মাগো সত্যি তোমার উপরে শিক্ষক আর কেউ নেই । আশ্চর্য্যর বিষয় হলো আমি নিজেও ছেলের সঙ্গে একই আচরণ করি যার বিরোধিতা শৈশবে আমি পদে পদে করে এসেছিলাম । অনেকেই এত শক্ত হবার জন্য আমাকে কথা শোনাতে পিছপা হননা যে আমি মা নামের কলঙ্ক । কোন মা ছেলের আঘাত লাগলে শান্ত হয়ে থাকে ? কোন পা পদে পদে ছেলের কাজের সমালোচনা করে ?কে করে জানিনা তবে আমি করি । আমাকে করতে হবেই । আমার মা তো কন্যা সন্তান জন্ম দিয়েছিলেন তাই অনেকটা সহজ ছিল পথটা । আমি পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়েছি । আমার দায়িত্ব অনেক বেশি যে ।
ওকে আমায় শেখাতে হবে প্রগতিশীল হতে কিন্তু তার সঙ্গে সংবেদনশীল হতেও । যেন আমার সন্তান কোনদিন কোন অন্যায় কাজ করার আগে পাঁচবার নিজের বিবেকের কাছে প্রশ্ন করে । ও ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হবে কি না জানা নেই কিন্তু এভাবেই ওকে আমি মানুষ করব যাতে ও কোনদিন ধর্ষকে পরিণত না হয় । কথা গুলো নির্মম , নগ্ন সত্য কিন্তু ওই যে বললাম সময় খুব কম তাই সকলকে এখন মনের কথাটা বলেই ফেলতে হবে ।
