ট্যাক্সি নম্বর ৩০৩৫
ট্যাক্সি নম্বর ৩০৩৫
গত কয়েক সপ্তাহ প্রতি দিনই অফিস থেকে বেরোতে দেরি হয়ে যাচ্ছে। ডিসেম্বরের শেষ প্রায়: ভালোই জাঁকিয়ে ঠান্ডা পড়েছে এবার কোলকাতায়। আজ আবার একটু বৃষ্টি ও হয়েছে বিকেলে। রাজারহাটের শেষপ্রান্তে অফিস, রাতে অফিস ফেরার জন্যে এর স্পেশাল ক্যাব এর ব্যবস্থা থাকে। রাত নয়টার ক্যাব টা তাই আমার প্রায় বাঁধা।
ভীষণ কাজের চাপ ছিল আজ, ফাইনাল টেস্টিং চলছে সিস্টেম এর, তারমধ্যে রাত নয়টার ক্যাবটা মিস করেছি, নিজের উপর রাগ হচ্ছে, সোহিনীদি বেরোনোর সময় জিজ্ঞেস করেছিলেন, কিন্তু ওনাকে পুরো অন্যদিকে যেতে হয় তাই ওনাকে এগোতে বলে আমি বেড়িয়ে পড়েছি। ওলা উবের আপ খুলতে খুলতে হন হন করে মেইন গেট এর দিকে এগোলাম। দুপাশের পার্কিং স্পেস সব খালি, সিকিউরিটি গার্ডরা ঘুমটিগুলোতে বসে। রাস্তার পাশে চায়ের দোকানে টিমটিম আলো আর দূরে বহুতল বাড়ির থেকে মিস্ত্রী কাজের আওয়াজ আসছে।
একটা গাড়ি ও নেই ওলা উবের এ, চেষ্টা করে যাচ্ছি। গেট পেরিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম। অনেক কষ্টে একটা গাড়ি পাওয়া গিয়েছে উবের এ, দশ মিনিট ওয়েটিং টাইম দেখাচ্ছে। কুয়াশা আর অন্ধকারে চারপাশটা ঘোলা হয়ে আছে, বৃষ্টিও আসবে মনে হয়, প্রায় দশটা বাজে, বাড়িতে একটা ফোন করলাম। ঠিক এমনসময় একটা হলুদ ট্যাক্সি সামনে এসে দাঁড়ালো, গড়িয়া যাবো কিনা বলতেই ইশারায় উঠে বসতে বললো। তাড়াতাড়ি লাফ দিয়ে উঠেই প্রায় বসলাম, ব্যাগটা কোলে নিয়ে বসলাম। ডানদিকের জানালার কাঁচ টা পুরোটা বন্ধ হচ্ছে নাহ, অনেক চেষ্টায় কিছুটা ওঠালাম কাঁচ টা, হু হু হাওয়া, চাদর বের করে গায়ে মাথায় জড়িয়ে নিলাম। নিশ্চয়ই আজ বেশি পায়সা চাইবে ট্যাক্সি টা, এদিকে উবের র গাড়িটা ক্যানসেল করে দিয়েছে দেখলাম ড্রাইভার টা। মনে মনে ভীষণ রাগ হলো,একটা কমপ্লেইন করতে হবে উবেরে ভাবলাম।
ট্যাক্সি টা তখন টাটা ক্যান্সার হাসপাতাল ছাড়িয়ে রবীন্দ্রতীর্থ র সামনে সিগন্যাল এ দাঁড়িয়ে। গান চলছে 'চোখের আলোয় দেখে ছিলাম চোখের বাহিরে।..', যাই বলো, সিগন্যালে এই গান শোনানোর আইডিয়াটা কিন্তু দুর্ধর্ষ! ট্যাক্সি র নম্বর টা কত, ওঠার সময় ঠিক মতো দেখা হয় নি, বাবা কে একটা মেসেজ করে দিলাম বেড়িয়েছি বলে। ড্রাইভার এর দিকে তাকালাম, টুপি আর মাফলার পড়া। ভিউইং গ্লাস এ তাকিয়ে দেখি গ্লাস টা আধভাঙা, ড্রাইভার এর মুখটা ঠিক দেখতে পেলাম না। ক্লান্ত, তাই শরীরটা এলিয়ে দিলাম,হঠাৎ ড্রাইভার সীটের পিছনে ট্যাক্সি র নম্বর ৩০৩৫ দেখে চমকে উঠলাম,অরে এতো আমার রাত নয়টার অফিস ক্যাবের একদম এক নম্বরটা ! ও হবে কিছু একটা, কনকনে ঠান্ডায় আর ভাঙা জানালার হাওয়া তে আমার চোখ যেন বন্ধ হয়ে আসছে। গাড়ি তখন চিংড়িঘাটা হয়ে সাইন্স সিটি, স্পীডে চলছে ইস্টার্ন বাইপাস ধরে।
ঘুম ভাঙলো জোর ব্ৰেকে, ধড়ফড় করে উঠলাম। আরে এতো বাড়ির গেট এ পৌঁছে গেছি! আচ্ছা, আমি তো বাড়ির ঠিকানাটা বলিনি, কি করে সোজা এখানে এলো? বৃষ্টি পড়ছে আবার, তাড়াতাড়ি নেমে পড়লাম। ব্যাগ থেকে পয়সা দিতে যাবো, দেখি ট্যাক্সি টা ধীরে ধীরে চলতে শুরু করেছে, 'এই যে আপনার ভাড়াটা।..' আমি বললাম। শুনতে পেলাম ড্রাইভারটি বলছে 'ম্যাডাম, রাতে এতো দেরি করবেন না'...আর টাকাটা না নিয়েই ট্যাক্সি টা অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো।..আরে সেই নয়টার ক্যাবের ড্রাইভারের গলা একদম !
বাবা আওয়াজ পেয়ে দরজা খুলে দাঁড়িয়ে। ঘরে ঢুকে ঘটনাটা বাবাকে বলছি এরই মধ্যে সোহিনীদির ফোন, 'নীহারিকা তুমি পৌঁছে গেছো তো বাড়ি? তুমি ঠিক আছো?'..হ্যা, এই পৌঁছলাম গো, বলে আমার ট্যাক্সি র কথাটা বলতে যাবো, সোহিনীদি বললেন। ...'তুমি প্রায় যেই অফিস ক্যাবটায় যাও নয়টায়, সেটা আজ ভীষণ আকসিডেন্ট করেছে আর ড্রাইভার স্পটডেড।..এরপর আর কি বললো আমার কানে আর কিছু ঢুকলো না।