Nandita Pal

Classics

3.5  

Nandita Pal

Classics

শ্রাবনসন্ধ্যা

শ্রাবনসন্ধ্যা

5 mins
529


শ্রাবনের শেষ প্রায়, আকাশ কালো, কিন্তু বৃষ্টি নেই- তাই বেশ একটা গুমোট গরম। শ্রীরামপুরে বটতলায় আরোগ্য হাসপাতাল থেকে ডাক্তার সৌরভ বসু অনেক কষ্টে বেলা দুটো নাগাদ প্রায় জোর করেই বেরিয়ে পড়লেন: মনটা ভীষণ খুশি ড: বসুর, ছেলে বাড়িতে আছে আজ। ঋষভ ডাক্তারি পড়ছে কলকাতা মেডিক্যালে, MBBS করে ইন্টার্ন করছে কলকাতা মেডিক্যালে। কালই রেজাল্ট বেরিয়েছে MD এন্ট্রান্সের, যা rank করেছে তাতে হয়তো AIMS এ পেয়ে যাবে, ভীষণ খুশি, এতো চাপে ছিল কদিন।  


ঋষভ ছোটথেকেই অসামান্য প্রতিভা, বরাবর হাসিমুখ, শান্ত স্বভাবর সে: শ্রীরামপুর হাই স্কুলের রেকর্ড ভাঙা রেজাল্ট নিয়ে পাশ করে, শুধু নিজের স্কুল নয়, এলাকার গন্ডি ছাড়িয়ে দূর দূরান্তের শিক্ষকেরা এক ডাকে চিনতো ঋষভকে। আর নিজের স্কুলের জনপ্রিয়তা তো প্রশ্নাতীত, স্কুলের ছাত্রদের পড়াশুনায় সাহায্য করা আর ওর ব্যাবহারে শ্রীরামপুরের নয়নমনি ছিল সে। অধ্যাবসায়ের জোরে উত্তরোত্তর উন্নতির শিখরে ঋষভ। সেই সাথে বেশ লেখা লেখিও করে, ওর লেখা বিভিন্ন ম্যাগাজিনে বের ও হয়েছে। ড: বসুর মেয়ে ছোট, নাম তিয়া, ও এবার উচ্চমাধ্যমিক দেবে। মেয়ে একেবারে অন্যরকম,তার বকবকানিতে বাড়ি সরগরম। দাদা আর বোনের ভাব যেমনি, তেমন মাঝে মাঝে লেগেও যায়। মেয়ে যদি বাইরে পড়তে যায়, বাড়ি একদম খালি হয়ে যাবে, এই ভাবনা এখন ড:বসু মাঝে মাঝেই ভাবেন। মাহেশের রথের মেলা চলছে, ভালো ভিড় রাস্তায়, রাস্তার দুধারে খাবারের দোকান। বাড়িতে এলেন যখন, সবাই বসে আছে একসাথে খাবে বলে, রান্নাঘর থেকে দারুন গন্ধ আসছে। ড: বসুর স্ত্রী ভীষণ ব্যাস্ত রান্নাঘরে। সুনেত্রা ও এসেছে কিছুক্ষন আগে, ড: বসু হাত ধুয়ে বসে পড়লেন ডাইনিং এ, ঋষভের পাশে।


ড: বসু এলাকার নামকরা ডাক্তার, সেই সুবাদে বিজ্ঞানী সংকেত রায়ের সঙ্গে পরিচয়, বেশ কবছর হার্টের খুব সমস্যায় ভুগছেন সংকেত রায়, সাহা ইনস্টিটিউট থেকে রিটায়ার করেছেনা সবে। সুনেত্রা সংকেত রায়ের একমাত্র সুন্দরী কন্যা, ভারী মিষ্টি স্বভাবের মেয়ে, ঋষভের থেকে বছর তিনেকের ছোট, শ্ৰীৰামপুর কলেজ এ পড়ছে। সুনেত্রা ঋষভকে চিনতো খুব ভালো ছেলে হিসেবে, পারিবারিক সখ্যতায় এরপর দুজনের মধ্যে ঘনিষ্টতার সুযোগ ঘটে। বাবার অসুস্থতার জন্যে সুনেত্রা কখনোই দূরে পড়তে যেতে চায়নি। অপূর্ব গান গায় সুনেত্রা, সেই সূত্রে এখন 'দক্ষিণী' তে গান শিখতে যায় প্রতি সপ্তাহে কলকাতায়। ঋষভের জীবনে সুনেত্রার গভীরতা আরো বৃদ্ধি পায় ডাক্তারি পড়ার সময়। কলকাতা যাবার পর পথের দূরত্ব যেন ওদের মনকে আরো কাছে এনে দিয়েছে। মেডিক্যাল পড়তে গিয়ে ঋষভের প্রথম দিকে একদম ভালো লাগতো না, এক দুটো পেপারে ও পাশ করতেও পারেনি, সেই সময় সুনেত্রা ওকে সব সময় মনোবল দিয়েছে, উৎসাহ দিয়েছে। একবার কলেজ ফেস্টিভ্যালে একটা ঝামেলাতে ঋষভ জড়িয়ে পরে, পুলিশ কেস হয়েছিল তাতে। সুনেত্রা ওর পিসতুতো দাদা, যে এক বড় উকিল কলকাতা হাই কোর্টের , তাকে নিয়ে সব কিছু সামলেছিলো। দীর্ঘ পাঁচ-ছয় বছরের সম্পর্ক ওদের। প্রতিদিন সন্ধে সুনেত্রাকে দিনের সব কথা বলা ঋষভের, সুনেত্রার কাছে সব বললে মনটা ভারী শান্ত হয়ে যায়। ঋষভ এগিয়ে চলার অনুপ্রেরণা খুঁজে পাওয়ার যেন পরশমনি ও। দুই বাড়িতেও বুঝতে পারে এখন ওদের সম্পর্কটা। আর পেশেন্ট ও ডাক্তারের সম্পর্ক অবশেষে পারিবারিক বন্ধুতে পরিণত হয় ড: বসু আর সংকেত রায়ের। তবে কিছুদিন ধরে এম ডি এন্ট্রান্সের প্রস্তুতি, হাসপাতাল ডিউটি র চাপ, সব মিলে সুনেত্রার সাথে সেই অনেক্ষন ধরে গল্প করা, গান শোনা হয়ে উঠছিলো না ঋষভের। আজ বিকেলে সুনেত্রার সেই খোলা গলায় 'আমার হিয়ার মাঝ্যে লুকিয়ে আছ..', মনটা ভরিয়ে দিয়েছে ওর।


ঋষভের ঘরে বসে অনেক গল্প হলো ওদের। একটা দারুন কার্ড বানিয়েছে সুনেত্রা ঋষভের জন্যে, ওদের এতো বছরের বিভিন্ন সময়ের ছবি দিয়ে। সব ছবিগুলো নিয়ে অনেক গল্প, টুকরো স্মৃতি সব-ই নিয়ে চললো বেশ কিছুক্ষণ। এরমধ্যে ঋষভ ব্যাগ থেকে সব বের করেও সুনেত্রার জন্যে আনা স্কার্ফটা খুঁজেই পেলো না, মনটা বারো অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে, নিজেই ভাবলো। বাইরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, বৃষ্টি আসবে হয়তো, ঋষভ বাড়ির জানালাগুলো বন্ধ করতে গেলো। সুনেত্রার বাড়ি থেকে ফোন, বাবার সাথে কথা বলে উঠতে যাবে হটাৎ চোখে পড়লো ঋষভের বইয়ের মধ্যে একটা হলুদ খামের চিঠি। খামের ওপর লেখা 'আমার প্রিয় মানুষটার জন্যে'- 'তোমার প্রিয় বান্ধবী'। খুব সুন্দর হাতের লেখা, খুলবে কিনা ইতস্তত করে খুলেই ফেলে খামটা, স্বপ্নভঙ্গ হল যেন,কে এই ঐন্দ্রিলা? আবার একবার পড়ে চিঠিটা, দ্বিধান্বিত মনে সংশয়ের আকাশ ভেঙে পড়ে এতদিনের প্রেমের বন্ধনে। ঋষভের গলা পেয়ে তাড়াতাড়ি চিঠিটা রেখে দিয়ে সুনেত্রা উঠে বেরিয়ে আসে ঘর থেকে। ঋষভ কিছু বোঝার আগেই দেখে সুনেত্রা মাকে বলে গেটের দিকে হেটে যায়, দৌড়ে গেট এ যেতে গিয়ে দেখে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে দিয়েছে, 'আবার এস নেত্রা'- বলতে সুনেত্রা একবার তাকালো ওর দিকে, সুনেত্রার চোখে কি জল? .....


ঘরে ফিরে এসে চুপ করে বসে থাকে ঋষভ, বিছানায় পরে আছে ঐন্দ্রিলার চিঠিটা, বুঝতে পারে কেন সুনেত্রা অভিমানে চলে গেলো। 'সাহিত্যচর্চা' একটা গ্রূপের সাথে ঋষভের কিছুদিন আলাপ হয়েছে, সেখানে আলাপ ঐন্দ্রিলার সাথে। যাদবপুরে তুলনামূলক সাহিত্যের ছাত্রী, স্মার্ট ঝকঝকে একটি মেয়ে, একবার ওদের বাড়ি মানিকতলায়,গিয়েছিলো কারণ একটা আলোচনা সভা ওদের বাড়ির বিশাল লনে হয়েছিল। লেখে ভালো মেয়েটি, আর সেই সূত্রে প্রায় ই কথা হয় ঋষভের সাথে। কিছুদিন ধরে ঐন্দ্রিলার কথায়, তাকানো তে কোথায় যেন একটা কিছু বলতে চাওয়া লক্ষ্য করছে ঋষভ। শুনেছে ঐন্দ্রিলার জন্যে ওর বাড়ি থেকে নিউইয়র্ক বসবাসকারী বিজ্ঞানী সংলাপ সেনের বিয়ে প্রায় পাকা। সেদিন ঋষভ ভীষণ ব্যস্ত কলেজে, ঐন্দ্রিলা ফোন করেছিল সন্ধেবেলা নন্দনে আলোচনা সভায় যেন যায় ও। একটু দেরি হলেও ঋষভ সেদিন নন্দনে যায়, প্রোগ্রামের পর বেশ কিছুক্ষন বসে গল্প হয়, ঐন্দ্রিলা সারাক্ষন ই ঋষভের সাথে সাথেই ছিল। ফেরার সময় হঠাৎ ঋষভকে হলুদ খামের ওই চিঠিটা দেয়। গভীর ভালোবাসার ছোঁয়ায় দীর্ঘ এক প্রেমপত্র। অনেকবার পড়েছে চিঠিটা ঋষভ, একটা অদ্ভুত ভালোলাগা অনুভব করেছে। কিন্তু সুনেত্রাকে বলতে গিয়ে ও বলতে পারেনি ঐন্দ্রিলার কথা এতো দিন, আজ বুঝতে পেরেছে সুনেত্রাকে সব বলতেই হবে।


পরদিন কলকাতা ফেরার কথা বিকেলে, সকালে সুনেত্রার সাথে দেখা করতে যাই ঋষভ। থমথমে মুখ সুনেত্রার, জোর করে একটু হাসতে চাইলো। 'সাহিত্যচর্চা' র কথা সুনেত্রাকে আগে বলেছিলো ঋষভ, কিন্তু ঐন্দ্রিলার কথা আজ বললো সব। এই চিঠিটার পর ঐন্দ্রিলার সাথে আর কথা হয়েছে কিনা জানতে চাইলো সুনেত্রা। 'না সময় হয়নি আর',ঋষভ বললো। আর কিছু কথা বলে বেড়িয়ে এলো ঋষভ। বিকেলে কলকাতা যাবার পথে মনটা বেশ হালকা লাগছে মনে হলো ঋষভের, সুনেত্রাকে বলতে পেরে হয়তো। কিন্তু কাল থেকে ঐন্দ্রিলা র একটা কল ও ধরেনি, একটু খচখচ করছিলো, সেই সময় ঐন্দ্রিলার ফোন আসে, কাল সন্ধেতে মধুসূদন মঞ্চে একটা ভালো নাটক যাচ্ছে, একসাথে দেখতে চায়, ঋষভ না করতে পারলো না।


সুনেত্রা কদিন বেশ মনমরা রইলো, কিছুই যেন ভালো লাগছে না, যে গান ওর সব সুখ দুঃখের সাথী মনে হতো, আজ তাকেও বেশি ভালো লাগে না। ঋষভ প্রতিদিনই ফোন করে, কথা হয়..কিন্তু কোথাও কথা গুলো আর ভ্রমরের মতো কানে গুনগুন করে না সারাদিন। ঋষভ বাড়ি আসবে শুনে মননদীর কুল উপছে পড়ে না। কলকাতা গানের ক্লাসের পর বাইরে ঋষভকে দেখতে না পেলে দিনটা আর মাটি হয় না। 


ঋষভের সেদিন দিল্লী চলে যাবার কথা, AIMS এ মাস্টার্স এ হয়ে গিয়েছে ওর। সুনেত্রা এসেছে এয়ারপোর্টে সী অফ করবে বলে। ঋষভ মুখে কিছু না বললেও চোখ যেন কাউকে খুঁজে যাচ্ছে, সুনেত্রার বুঝতে অসুবিধে হলো না। এদিকে সংলাপ সেন আসছে আমেরিকা থেকে, বিয়ের আগে ঐন্দ্রিলার সাথে কিছু সময় কাটাতে চায়। ঐন্দ্রিলা আর থাকতে পারলো না, এয়ারপোর্টে ছুটে গেলো ঋষভের কাছে। প্রায় গেট এ ঢোকার মুখে ঋষভ, এই সময় ঐন্দ্রিলা পৌছালো। ঋষভকে একটু পাশে ডেকে নিয়ে সব বলে গেলো একনাগাড়ে, ঐন্দ্রিলা চায় না সংলাপের সাথে ওর বিয়ে হোক। ও ঋষভকেই চায় যাকে ও মন দিয়ে বুঝতে পারে ও সব বলতে পারে। আর সব কথা ঋষভকে বললে ওর ভীষণ শান্ত লাগে মনটা। সুনেত্রা শুনছিলো সব, বুঝতে পারে ঋষভ ওদের ব্যাপারে কিছুই বলেনি ঐন্দ্রিলাকে। সুনেত্রা এগিয়ে গেলো ঐন্দ্রিলার দিকে, বন্ধু বলে আলাপ করে, ও শান্ত ভাবে ঋষভকে বোঝায় যে এখন সময় ঐন্দ্রিলার বাড়ীতে কথা বলার, নাহলে ব্যাপারটা হাতের বাইরে চলে যাবে। ঐন্দ্রিলা আনন্দে সুনেত্রার হাত জড়িয়ে ধরে। ঋষভ সুনেত্রাকে কিছু বলতে চায়, কিন্তু ততক্ষনে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে, ভেতরে ঢুকতেই হবে ঋষভকে এয়ারপোর্টে। ঋষভ এগিয়ে যায়, পেছনে তাকিয়ে দেখে ঐন্দ্রিলা হাত নাড়ছে,দুচোখ খোঁজে নেত্রাকে,দেখে সুনেত্রা ধীরগতিতে চলে যাচ্ছে।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics