সাহিত্যের অনুপ্রেরণা - আমার মা
সাহিত্যের অনুপ্রেরণা - আমার মা


প্রাইমারী স্কুলে পড়ি তখন, আমাম্র প্রিয় পাখি লিখতে বলেছে দিদিমণি। গরমের ছুটির একটা হোম ওয়ার্ক ছিল। শুনে মা জিজ্ঞেস করেছিল, কি পাখি নিয়ে লিখবে, সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিয়েছিলাম, ‘কেন ময়ূর, ওটাই তো আমাদের দেশের সবচেয়ে সুন্দর পাখি’। মা বললে ‘বেশ’। মনে আছে পরদিন বিকেলবেলা, রোদ টা একটু পড়েছে। বারান্দায় আমি মার সাথে বসে, প্রতিদিনের মত উঠোনে জলের কুয়া তলার কাছে শালিখ পাখি গুলো কিচিরমিচির। আমি তখন দু জোড়া শালিখ দেখে খুব আনন্দে প্রণাম করে চলেছি। মা কাছে ডেকে বললেন, ‘তুমি লক্ষ্য করেছ শালিখ পাখি র চোখগুলো?’ ‘হ্যাঁ, মা, কি সুন্দর ওদের টানা টানা চোখ, কাজল দেওয়া যেন। গায়ের রংটাও আমার খুব ভালো লাগে। মা আবার ও বললে, ‘তুমি কখন দেখতে পাও এই পাখি?’ আমি বললাম, ‘প্রতিদিন আমি ওদের দেখি সকালে আসে উঠোনে, কিন্তু কাক এলে ই পালিয়ে যায়। আর এই দুপুর বেলা শালিখ আর চড়ুই কি সুন্দর অনেকক্ষণ থাকে কুয়া তলায় যদি না কেউ তাড়া দেয়। আর জানো স্কুলে যাবার সময় এক শালিখ দেখলে আমি তো চোখ বন্ধ করে থাকি, যেই আর একটা আসে তখন তাড়াতাড়ি চোখ খুলে প্রণাম করে নি।‘ সেই শুনে মার কি হাসি! মার কাছে শুনেছিলাম শালিখ পাখি নাকি কথা ও নকল করতে পারে। সেবার আমার লেখা প্রিয় পাখি দিদিমণি সবাইকে পড়ে শুনিয়েছিল, সবচেয়ে ভালো হয়েছে বলে। ক্লাসে মোটামুটি সবাই লিখেছিল ময়ূর নিয়ে, আমি লিখেছিলাম সেই শালিখ পাখি নিয়ে যাকে আমি প্রতিদিন দেখি।
এই রকম আরো কিছু গল্প আছে, একবার আমার সবচেয়ে ভালো লাগা ফুল লিখেছিলাম স্কুলে পরীক্ষায়, মা একবার গল্প করেছিলো গ্ল্যান্ডি ফ্লাওয়ারের, সেই ফুলের ঘন সবুজ পাতা, সাদা বড় পাপড়ির ফুল, অপূর্ব গন্ধ। তখন মেখলিগঞ্জে বাবার চাকরী, আমাদের শোয়ার ঘরটার কাছেই ছিল বেশ লম্বা গাছ টা। আমি খুব ছোট ছিলাম, মায়ের গল্পে গ্লান্ডি ফুল চিনেছিলাম, ভালবেসেছিলাম, আর পরে লিখেছিলাম মন ভরে। মা ই আমাকে প্রথম ডায়েরী এনে দেয়, দিনের ডায়েরী, যা নিজের সাথে নিজের কথা বলা লিখে রাখা যায়, সময়ের হাত ধরে তা বুঝেছিলাম আরও পরে।
আমার লেখা সে কবিতা হোক, গল্প হোক বা কোন নতুন জায়গা দেখা হোক লেখা আমার মনের কথা বলা নিজস্ব ছন্দে, নিজের অনুভবে। সেই লেখার যে কল্পনা, যে চিন্তার বিন্যাস, আশেপাশে মানুষ বা জিনিসের সাথে মন জড়িয়ে ফেলা, সে আমার মায়ের থেকে পাওয়া। অনেক সময় মনে মেঘ জমেছে, জীবনের ব্যস্ততাতে লেখার দাড়ি যে পরেনি তা নয়, সেই আবার নিজেকে খোঁজা, আর মা মাঝে মাঝে যখন বলত ‘তুই লেখ মা, তোর কলমে অনেক জোর’। সেই কথাগুলো আমাকে ভাবিয়েছে, শক্তি দিয়েছে আবার কলম ধরবার।
মা এখন ভারী অসুস্থ, অনেকদিনের পারকিনসন্স রোগ, যা তাকে প্রায় অচল করে দিয়েছে, স্মৃতি ধীরে ধীরে সঙ্গ দেয় না তবু এখন ও অপেক্ষায় থাকি মা আমার লেখা শুনে কি বলল, ভাই মাঝে মাঝে ফোনে রেকর্ড করে পাঠায় মা কি বলল আমার লেখা শুনে, আর তাতেই বুঝি লেখাটা আমার সার্থক।