Nandita Pal

Romance Inspirational Others

3  

Nandita Pal

Romance Inspirational Others

অপরাজিতা

অপরাজিতা

4 mins
396


‘ঠাম্মি, কেমন লাগলো বল তোমার আজকে? এতো লোক তোমায় আজ কি রকম মন দিয়ে শুনল বল!’- তাপসীর উজ্জ্বল মুখটার দিকে তাকিয়ে বছর আশির ইন্দ্রাবতি দেবী একগাল হেসে বললেন, ‘জীবন সার্থক হল মনে হল আজ, আর সব হল তোর জন্য’। নারী দিবসে আজ বিশাল আয়োজন ছিল, যেখানে তাপসী, যে এখন সমাজের একজন চেনামুখ যে পরিত্যক্ত নারীদের অন্ধকার, উৎকণ্ঠা আর বিপদের থেকে বাঁচবার জন্য শক্ত খুঁটি হয়ে উঠেছে, সে তার প্রধান অতিথি হিসেবে তার ঠাকুমা ইন্দ্রাবতি দেবিকে আমন্ত্রণ করেছিলেন। ইন্দ্রাবতি দেবী তাপসীর কাজের সঙ্গী, ভাবনার শরিক আর অবশ্যই একরাশ অনুপ্রেরণা। আজ যখন ইন্দ্রাবতি দেবি বলতে শুরু করলেন, কিভাবে শিক্ষা আর কাজের মধ্য দিয়ে নিজেকে খোঁজা যায়, সত্যকে আঁকড়ে ধরে থাকা যায় এবং কাজের মধ্য দিয়েই ভগবানকে পাওয়া যায়। বলতে বলতে নিজের চোখে দেখা তাপসীর সেই ছোট থেকে রাস্তার ফুটপাথে বাচ্চদের সাথে বন্ধুত্ব করা, তাদের কে লুকিয়ে খাবার দেওয়া, বই দেওয়া আর পড়ানো, এভাবে কখন তাপসী ওই বাচ্চাগুলোর জীবনের সাথে জড়িয়ে গিয়েছিল- সব বললেন। বলতে বলতে তার গর্ব হচ্ছিল খুব নাতনির জন্য, আর সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনছিল ইন্দ্রাবতি দেবিকে। 


বিশাল ব্যবসায়ী বাড়ির কর্ণধারের স্ত্রী ইন্দ্রাবতি দেবী, বৈভব আর প্রাচুর্যে টইটম্বুর সবসময় তার জীবন। স্বামী প্রয়াত, ছেলে মেয়েরা সব আজ প্রতিষ্ঠিত। যখন যেভাবে তিনি যা চেয়েছেন সংসারে, সেই ভাবেই তা হয়েছে। ইন্দ্রাবতি দেবীর কথা কেউ অমান্য করে এমন সাধারণত হয়নি। বড় ছেলে রসরাজের মেয়ে তাপসী, ছোট থেকে খুব কাছের ইন্দ্রাবতির। কিন্তু অদ্ভুত এই মেয়ে একটু একটু করে বড় হয়েছে আর ওর চিন্তা ভাবনা কাজ সব যেন একটু আলাদা। কখন ও মনে হয় ও ওর মায়ের মত। গোপা খুব সপ্রতিভ ও খুব ভালো স্টুডেন্ট ছিল, নিজের পায়ে দাঁড়ানোর একটা স্বপ্ন ছিল ওর। খুব ভাল চাকরী পেয়ে ও করতে পারেনি। নিজে কিছু করতে চেয়েও পারেনি, এ বাড়ির বেড়াজাল ভেঙ্গে, একদিন নিজেই নীরবে ছেড়ে দেয় এ সংসার। রসরাজ বাবু জানতেন মায়ের শক্ত শাসন, কিন্তু সেদিন চিৎকার অশান্তি করেনি, কিন্তু নীরব বিদ্রোহ করে চলেছেন হয়ত আর কোন সম্পর্কে না জড়িয়ে। গোপা আর কোনদিন এ বাড়িতে আসেনি, বছরে একবার বাইরে দেখা করে তাপসীর সাথে। ইন্দ্রাবতি দেবী আরো দুই ছেলে মেয়েদের নাতি নাতনি থাকলেও তাপসীর ওপর যেন একটু বেশি টান, এই মেয়েটা যেন ওঁর মনের অনেক কঠিন বাঁধন আলগা করে দিতে পারে, তাপসীর সাথে থাকলে পৃথিবীটা দেখতে আরও সুন্দর লাগে।


সামনে তাপসীর বিয়ে, রনজয়ের সাথে, একদম সাধারণ ঘরের ছেলে। ইন্দ্রাবতি দেবীর শরীর খুব একটা ভালো যাচ্ছে না, নাতনির বিয়ের আয়োজনে যেন ত্রুটি না থাকে সে দিকেও খেয়াল সবসময়। তাপসী লক্ষ্য করেছে ঠাম্মি সেদিনের বক্তৃতার পর থেকে আনন্দের সাথে সাথে কিছু একটা নিয়ে নিয়ে চিন্তা করেই চলেছে। কিন্তু জিজ্ঞাসা করলে সদুত্তর পায়নি। একদিন লক্ষ্য করেছে অনেক রাতে ঠাম্মির ঘরের আলো জ্বলছে, আস্তে করে গিয়ে দ্যাখে ঠাম্মি মশারি থেকে বেড়িয়ে টেবিলের ওপর বসে কিছু একটা লিখছে। খুব অবাক হয়ে ডাকতে গিয়েও আর ডাকেনি। গতকাল বলেছিল আজ তাপসী যখন ওর মায়ের সাথে দেখা করতে যাবে একবার যেন ইন্দ্রাবতির ঘরে দেখা করে যায়। গেলো তাপসী ঠাম্মির ঘরে, ওকে একটা মুখবন্ধ খাম দিয়ে ঠাম্মি বললেন, ‘মায়ের হাতে দিস’। চমকে গেলো তাপসী, যে ঠাম্মি কোনদিন মায়ের নাম নেয় না, কিছু জিজ্ঞেস করে না মাকে নিয়ে, সে কিনা মাকে চিঠি দিচ্ছে! ঠাম্মি বুঝল কিনা জানে না, তাপসীর মাথায় হাত দিয়ে বলল, ‘আমার এই কাজটা অনেকদিন ধরে পড়ে আছে, যাবার আগে করে যেতে চাই’।


সেদিন তাপসীর বিয়ে, সানাই, বাজনা, আর তাপসী রণজয়ের কাজের জায়গার সবাই এসেছে, পরিবারের লোকেরা, একই অনুষ্ঠানে মেয়েপক্ষ আর ছেলেপক্ষ একসাথে একেবারে। ইন্দ্রাবতি দেবীর শরীর আরও খারাপ হওয়ায় একটি ঘরে নার্স তাঁকে দেখভাল করছে। বর চলে এসেছে, উলুধ্বনিতে বাড়ি মাতোয়ারা। ইন্দ্রাবতি দেবী সন্ধের পর কয়েকবার নার্স কে জিজ্ঞেস করছে কেউ এসেছে কিনা ওর সাথে দেখা করতে। তাপসী বিয়ের পিঁড়িতে যাওয়ার আগে আশীর্বাদ নিয়ে যায় ঠাম্মির, রসরাজ বাবু ও এসেছিলেন দেখা করতে, মেয়েকে সম্প্রদান করবেন উনি। বিয়ে শুরু হয়ে যায়, মন্ত্রে তখন গমগম, ইন্দ্রাবতি দেবী পাশ ফিরে শুয়ে পরলেন, চোখ বেয়ে জল। কিসের কান্না, তাপসী চলে যাবে বলে না গোপাকে লেখা সেই আর্তি, গোপাকে ওর সংসার ফিরিয়ে দেবার। একদিন যে ইন্দ্রাবতির অহংকার অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল সেই মেয়েটার স্বপ্নের, তার ই মেয়ের ভালোবাসায় সেই অন্ধ বিশ্বাস একটু একটু করে ভেঙেছে, সেই সব কথা একের পর এক লিখেছিল চিঠিতে। এও লিখেছিল ইন্দ্রাবতি দেবী যে সে বুঝেছে গোপা বাড়ি থেকে চলে গেলেও কারো মন থেকে চলে যায় নি ও, ওকে আরও সজিব করে রেখেছে তাপসী। কিন্তু এত বছরের জমা বরফ যে একটা চিঠিতে কিছুই হল না তা বুঝল ইন্দ্রাবতি দেবী। এর মধ্যে রসরাজ একবার এসে বলে গিয়েছে বিয়ে সম্পূর্ণ হয়েছে ঠিকমত।


‘আসব মা?’, চমকে উঠল কথাটা শুনে ইন্দ্রাবতি দেবী কিন্তু পাশ ফিরল না, আবার কথাটা ভেসে এলো একটু কাছ থেকে যেন। অনেক কষ্টে পাশ ফিরলেন, দুহাত বাড়িয়ে বললেন ‘আয় মা’। গোপা ধীরে কাছে এলো, পিছনে রসরাজ বাবু। ইন্দ্রাবতি দেবি জড়িয়ে ধরলেন গোপাকে বুকের মধ্যে, বরফ গলা জলে তখন সমুদ্দুর। তার মধ্যে ইন্দ্রাবতি দেবী বললেন, ‘যাও রস আর তুমি একসাথে মেয়ে জামাইকে বরণ করে ঘরে তোল’।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance