Nandita Pal

Horror Tragedy

3  

Nandita Pal

Horror Tragedy

মিতালী

মিতালী

5 mins
367


রঞ্জিত, বয়স পঁচিশ, কলকাতার বেহালার পর্ণশ্রীতে থাকে, কলকাতায়ই পড়াশুনো আর তারপর তথ্য প্রযুক্তিতে চাকরী। রঞ্জিতের গান লেখা তাতে সুর দেওয়া একটা নেশা প্রায়, মাঝে মাঝেই ভাবে চাকরী কিছুদিন করে গান নিয়েই থাকবে। তখন ত্রিবান্দমে ট্রেনিং পিরিয়ডে, রবিবারে বিকেলের দিকে, একটা গানের সুর কিছুতেই রঞ্জিতের মনঃপুত হচ্ছিল না, হঠাৎ বাঁশির আওয়াজ ভেসে এল একটা, দারুণ পল্লীগীতি। সুরের উৎস খুঁজতে খুঁজতে গিয়ে দ্যাখে ওদের ব্যাচের সবচেয়ে শান্ত ছেলেটা ছাদের কার্নিশে বসে বাজাচ্ছে মন উদাস করা বাঁশির সুর। সেই আলাপ হয় রঞ্জিতের অলোকের সাথে, ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব। অলোক দুর্গাপুর কলেজ থেকে পড়ে আসা, বাড়ী বোলপুর। অলোক যখন বাঁশি বাজাতো মনে হত ও যেন অন্য জগতে। দুজনে গান কথা সুর নিয়ে খুব ভালো বন্ধুত্ব হল দুজনের।

 ট্রেনিং শেষে দুজনেই কলকাতা পোস্টিং পায়, সেটা একটা ভাগ্য ই বলতে হবে। কলকাতায় দূর সম্পর্কের এক দাদার কাছে ক’দিন থাকে অলোক, তারপরে অফিসের কাছেই একটা একটা ভাড়া বাড়ীতে থাকতে শুরু করে। কাজের চাপে সারাদিন দেখা না হলেও বিশাল অফিস ক্যাম্পাস এ রঞ্জিত আর অলোক মাঝে মাঝে হাঁটতে যেত, তার সাথে চলত বিভিন্ন রকমের গল্প। অলোক জেম্নি শান্ত, রঞ্জিতের বিপরীত প্রায়, কিন্তু দুজনের কোথাও একটা খুব ভালো সম্পর্ক তৈরী হয়। এক দুবার রঞ্জিত অলোকের ফ্লাটেও থেকেছে, আর প্রায় শনিবার রাতে রঞ্জিতের বাড়ীতে অলোক আসত, সেই আসর বসত রঞ্জিতের গান আর অলোকের বাঁশিতে, রঞ্জিতের আরও দু একজন বন্ধুরা ও আসত।

সেবার রঞ্জিতের ছোটো মাসীর মেয়ে মিতালী শিলিগুড়ি থেকে এসেছে।ও গ্রাজুয়েশন এ শান্তিনিকেতনে ভর্তি হবে বলে। মিতালী যেমনি পড়াশুনায় তেমনি নাচে, এক দুবার এমনও হয়েছে দু দাদার বাঁশি আর গানে, মিতালী ওর নাচ দেখিয়েছে। অলোক এত কম কথা বলত লাজুক, মিতালী মজা করে বলত বোবাদাদা। এরপর মিতালীর শান্তিনিকেতনে যাওয়া, ওখানে হস্টেল পাওয়া, অলোক বেশ সাহায্য করেছিল মিতালীকে।

গত কয়েকমাস ব্যাঙ্কের প্রজেক্ট এ অলোক কাজ করছে। মার্চে বছর শেষের সময় সামনে, ভীষণ চাপ, অলোককে শনি রবি বার ও অপিস যেতে হচ্ছে। প্রায়ই দেখা হচ্ছে না আর রঞ্জিতের সাথে। হলেও বা কয়েক মিনিট লিফটের কাছে। রঞ্জিতের ও কাজের সাথে বেশ কিছু রেকর্ডিং থাকায় সব মিলিয়ে দেখা হচ্ছে না কিছুদিন।

মিতালী শান্তিনিকেতনে, ক্লাস চলছে পুরোদমে। কোন কোন শনিবার ফাঁকা থাকলে চলে আসে রঞ্জিতদের বাড়ীতে। একদিন এসে অলোকের খোঁজ করছিল রঞ্জিতের কাছে, একটু খেপাতে গেল রঞ্জিত, ‘আমার বন্ধুকে নিয়ে টানাটানি কেন?’ শুনে মিতালী যেন একটু গম্ভীর হয়ে গেল । কেন যেন রঞ্জিতের মনে হল সেদিন, অলোক আর মিতালীর কোনো সম্পর্ক তৈরী হচ্ছে কি? প্রশ্নটা মিতালীকে করতে গিয়ে করল না। সেই সপ্তাহেই অলোকের সাথে যেই কয়েক মিনিটের জন্য দেখা, হাল্কা করে জিগ্যেস ও করলাম ‘কী খবর বাছা ? আমার বোন তোমার খোঁজ করছে কেন!’ লাজুক হেসে অলোক বলল, ‘তোকে পরে বলব’।

ব্যাস, কে জানত সেই শেষ দেখা অলোকের সাথে। লক্‌ডাউন শুরু হল। অলোক বোলপুর গেল না এত অফিসের কাজ ভেবে। ওর সাথে যারা ছিল সবাই বাড়ী চলে গেল। মেসো এসে মিতালীকে নিয়ে গেল শিলিগুড়ি। অনেক করে রঞ্জিত বলল অলোককে বেহালায় ওদের বাড়ীতে এসে থাকতে, কিছুতেই এল না। অফিস তো কিছুদিনেই খুলে যাবে, আর খুললেই যেতে হবে এই দোহাই দিয়ে অলোক রইল ভাড়া বাড়ীতেই।

এদিকে রঞ্জিতের বাড়ীতে ওর ঠাকুমা অসুস্থ হয়ে পড়ে। স্ট্রোকের পর বাড়ী হাসপাতাল কদিন, কিন্তু ঠাকুমাকে আর বাঁচানো গেল না। প্রায় দশ-বারোদিন ঝড়ের মধ্যে দিয়ে যায়, অলোক এক দুবার ফোন করে সে সময়, আসতে ও চায় হারপাতালে। করোনার আতঙ্ক, রঞ্জিতের বাবা বারণ করেছিলেন হাস্পাতালে আসতে। এরিমধ্যে রঞ্জিতের পা ভেঙ্গে যায়। এরপর ঠাকুমার শ্রাদ্ধে রঞ্জিত ফোন করে অলোক কে কিন্তু পায় না। ফোনে মেসেজ, হোয়াটস আপ করে রাখে রঞ্জিত, কোনো উত্তর পায় নি।অফিসের এ এক-দুজন বন্ধুদের জিজ্ঞাসা করে এটুকু শোনে যে অলোকের শরীর মাঝে খারাপ ছিল, ব্যাস, এই পর্যন্তই। অফিসেও আসছে না, ওরা ও যোগাযোগ করতে পারছে না। সেই শুনে রঞ্জিতের বেশ চিন্তা হল, যেভাবে হোক খবর আনতেই হবে। বাবা রাজী হল ওকে অলোকের ভাড়া বাড়ীতে নিয়ে যাবার জন্য। সেই দিন ই অলোকের সেই দাদার ফোন পেল রঞ্জিত। অলোকের দাদা জানায় অলোককে কোয়ারেনটাইনে নিয়ে গেছে আজ দিন সাতেক পার্ক সার্কাসের কাছে। গায়ে জ্বর নিয়ে ঘরে পড়েছিল। বাড়ীওয়ালা খবর দেয়, ওর দাদা গিয়ে তক্ষুনি ভর্তি করায়। করোনা টেস্ট এর নমুনা নিয়ে গিয়েছে। মনটা এত খারাপ হয়ে গেল রঞ্জিতের। এ কদিনেই অলোক এত ভালো বন্ধু, বাড়ীর সবার কাছেই ও আপন। মিতালী ও প্রায় দিন ই ফোন করে জানতে চেয়েছিল ওর কথা । ওকেও জানালাম। কিছু ভালো লাগছে না। দুদিন পর দাদার কাছেই জানতে পারি, অলোকের করোনা পজিটিভ এসেছে। হাসপাতালে ভর্তি – যোগাযোগের তেমন ব্যবস্থা নেই, ওরাই সময় মতো খবর দেয়।

অলোকের মা-বাবা নেই, কাকার কাছে মানুষ। মিতালীকে খবরটা দিলাম, বুঝলাম নদীর বাঁধ ভাঙ্গার মতো কান্না মিতালীর। এরপরে কদিন সেই উর্দ্ধশ্বাস অপেক্ষা ফোনের। আমার মা প্রতিদিন দেখি ঠাকুরকে বলছে ভগবান তুমি ছেলেটাকে সুস্থ করে দাও। বড় ভালো ছেলে অলোক।

সব শেষ হয়ে যাবার সেই খবর ওর দাদা ই দিল। শেষের দিকে ও কিছু বলতে চেয়েছিল কিন্তু পারেনি । বাড়ীর লোক কাউকে যেতে দেয়নি। ফোনে অনুমতি নিয়ে হাসপাতাল থেকেই দাহ করে অলোককে।

এরপরে দীর্ঘ মাস তিন চারেক কেটে গিয়েছে। রঞ্জিতের পা ঠিক হবার পর ধীরে ধীরে অফিস যাওয়া- সপ্তাহে একদিন, বা দুদিন, এমন কোনোদিন হয়নি অলোকের কথা মনে হয়নি রঞ্জিতের। কিছুদিন ধরে মা ফ্লাইওভার ধরে আসার সময় ‘আদর্শ হাসপাতাল’, যেখানে অলোক কোয়ারেনটাইনে ছিল, যখনই রঞ্জিত পাশ দিয়ে যায়, একটা অদ্ভুৎ অনুভূতি হয়। প্রতিদিনই ওর মনে হয় একটু দাঁড়াই। মনে হয় অলোকের যেন বাঁশি শুনতে পায়। এমনও হয়েছে রঞ্জিত ফ্লাইওভার ধরে নেমে আবার ফিরেছে ঐখানে। হ্যাঁ সেই বাঁশিতে অলোকের পল্লীগীতি যেন। মন ছুয়ে যাওয়া। রঞ্জিত বাড়ীতে একদিন মা কে বলে একথা। মা বলে ওটা তোর মনের ভুল, খুব ভালবাসতি তো বন্ধুকে তাই।

বেশ কিছুদিন পড়ে একদিন রাতে কাউকে না বলে রঞ্জিত চলে যায় মা ফ্লাইওভারের ওপর সেই যায়গাটায়।ধীরে বাইকটা চালিয়ে যেই কাছে যায় রঞ্জিত, যেন স্পষ্ট স্বরটা অলোকের বাঁশির। লকডাউন বলে খুব কম গাড়ী, কিছুক্ষণ পরে ফ্লাইওভার বন্ধ ও হয়ে যাবে। কেন মনে হয় অলোক কিছু বলতে চায়। ধীরে ধীরে এসে রঞ্জিত দাঁড়ায় রেলিংটার কাছে, শীতের রাত। ঠাণ্ডা হাওয়া। যেখান থেকে আদর্শ হাসপাতালের আলো দেখা যায়। দেখে রেলিঙের কাছে সাদা জমাট ছায়ার মত কিছু একটা, সেই বাঁশিটা কাছে এসে থেমে গেল। ভয়, আনন্দ, সব মিলিয়ে রঞ্জিত দাঁড়িয়ে পড়ল। বাইকটা রেখে নেমে পড়ল রাস্তায়। ‘অলোক তুই ভালো আছিস তো ? তোকে খুব মিস করি অলোক’ রঞ্জিত নিজেই বিড়বিড় করে বলছে আর চোখ বেয়ে জল। ‘খুব কষ্ট হয়েছে তোর, ভেন্টিলেটরে... তাই না ?’ রঞ্জিত বলে চলেছে।

‘আমিও তোকে একটা কথা বলতে চাই’। স্পষ্ট নয়, ভাঙ্গা ভাঙ্গা ধীর আওয়াজ’ অলোকের গলাই, কিন্তু ভাঙা কর্কশ। রঞ্জিত যেন শুনতে পেল স্পষ্ট। ‘হ্যাঁ বল অলোক’ রঞ্জিত বলল। ‘আমি মিতালীকে ভালোবেসেছিলাম’, অলোকের গলা।

যেদিন অলোক এর মৃত্যু সংবাদ পাঠায় রঞ্জিত, মিতালী বিশাল একটা মেসেজ রাতে করেছিল রঞ্জিতকে, তাতে ও সব লিখেছিল। অলোক আর মিতালির ভালো লাগা, কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারছিল না। মিতালীই অলোককে একটা চিঠি দেয়, অলোক দেখা করে তার উত্তর জানাবে বলেছিল এক রবিবার। ব্যাস, তারপর সব ওলটপালট হয়ে যায়।


রঞ্জিতকে সেদিন অজ্ঞান অবস্থায় টাফিক পুলিশ বাড়ী পৌঁছে দেয়। যখন জ্ঞান ফেরে তখন খালি অলোকের কথা ই বলছিল।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror