STORYMIRROR

Shyamasree (শ্যামশ্রী)

Horror Thriller

3  

Shyamasree (শ্যামশ্রী)

Horror Thriller

ট্রেন যাত্রা ( প্রথম পর্ব)

ট্রেন যাত্রা ( প্রথম পর্ব)

11 mins
232

সেদিন ট্রেনে করে বাড়ি ফিরছি, স্লিপার টিকিট ভাগ্যে জুটেনি, A.C এর কথা না বলাই ভালো, তাই Chair Car যাচ্ছি। আমি যেই রুটের কথা বলছি, সেখানে সর্বসাকুল্য একটাই ট্রেন কলকাতার । তাই আমাদের কাছে ট্রেনের আরামদায়ক কামরায় শুয়ে ঘুমিয়ে যাত্রা অতিশয্য আশা ছাড়া কিছুই না। দিন পনেরোর আগে টিকিট কাটলে যদি মেলে স্লিপার, সেটাতেও নিজেকে ভাগ্যবতী মনে করতে হয়। আজ আমার জানালার পাশে পড়েছে,আমিও তাই চেয়েছিলেম টিকিট কাটবার সময়। Online এ টিকিট কাটার সময় ভাগ্যে জুটবে কি না ঠিক বুঝতে পারিনি।

ট্রেন ছুটে চলেছে, আমি ক্লান্ত ছিলাম, কানে Head Phone -এ গান শুনতে শুনতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি, ঠিক বুঝতে পারিনি। এমন সময় ট্রেনের ঝাকুনীকে ঘুম ভেঙে গেল। হঠাৎ করে ঘুম ভেঙে যাওয়াই প্রথমে ঠাওর করতে পারলাম না কোথায় আছি। তারপর মনে হলো ট্রেনের কামরাটি সম্পূর্ণ অন্ধকার। বড় অদ্ভুত লাগলো বিষয়টি, কারণ Sleeper এবং A.C -তে বেশী রাত হয়ে গেলে আলো নিভিয়ে দিলেও, Chair Car -এ তো আলো বন্ধ হয়ে যায়না। হঠাৎ আমার মনে হলো আঁধারটা বড় বেশিই গাঢ়, সাথে থাকা সহযাত্রীদের অবয়বটুকুও দেখা যাচ্ছেনা। আমি চুপ করে কিছুক্ষণ, তারপর আমার হঠাৎ মনে হলো বড় বেশি নিস্তব্ধতা, আলো নেই তবুও কোনো কোলাহল নেই।

মনে হচ্ছে একা আমি বসে সমস্ত ট্রেনে। আমি ভীতু নই, সাহসীর তালিকায় ফেলাই যায় আমাকে। তাছাড়া একা যাত্রা করা আমার স্বভাব। বাড়ি থেকে দূরে থাকি, তাই আমাকে নিয়মিত যাতায়াত করতে হয়। তাছাড়া অফিসের কাছে সমগ্র পশ্চিমবঙ্গেই আমি ঘুরে বেড়াই। তাই ট্রেনে যাতায়াত করাটা আমার কাছে আমার জীবনযাত্রার অংশ, বলতে গেলে বাড়ির চেয়ে বেশি আমি ট্রেন বাসেই কাটাই। তাই ট্রেনের এই বিষয়টি আমার চেনা চিরাচরিত যাত্রার সাথে এক্কেবারেই ভিন্ন। কি ভেবে আমি মোবাইল খুঁজতে শুরু করলাম, না মোবাইলটাও পেলাম না। ভাবলাম ঠিক চুরি হয়ে গিয়েছে। কিন্তু আমার জিন্সের পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে নিলো, আমি তা বুঝতে পারলাম না। এমন তো গভীর ঘুম আমার না। আমার কিছুই মাথায় ঢুকছিল না। বসে থাকবো, নাকি উঠে দেখবো এদিক ওদিকে তাও ঠিক করতে পারলাম না। মনটা অস্থির হয়েছিল, তাই আমি স্থির হয়ে বসে ভাবতে থাকলাম, এখন মনের মধ্যে কিছু কিছু প্রশ্ন উঠে এলো,

প্রথমেই মনে হলো আমি ঠিক ট্রেনে উঠেছি তো?

পরক্ষণেই মনে হলো, এটা তো শিয়ালদহ বা হাওড়া না যে ভুল হতে পারে, এটা তো কলকাতা স্টেশন, সর্বসাকল্যে বরাদ্দ কয়েকটি ট্রেন যাতায়াত করে, ভুল হওয়ার কোনো সুযোগই নেই।

তারপরেই মনে হলো,আচ্ছা আমি কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলাম? আচ্ছা ট্রেন কি শেষ গন্তব্যে পৌঁছে গিয়েছে?

এখানেও খটকা লাগলো, আমাদের ট্রেনের সময় সন্ধ্যার কিছু আগে, যদি ঘুমোই কত আর ঘুমোবো? আর এই ট্রেনের শেষ গন্তব্যে পৌঁছাতেও তো ১২ ঘন্টা লেগে যায়। মাঝে ঘুম ভাঙ্গলো না তা কি করে হয়? আর যদি পৌঁছেও যাই শেষ গন্তব্যে, কেউ আমাকে জাগিয়ে দেবেনা? আচ্ছা যাত্রীরা না জাগাক, যারা ট্রেন পরিস্কার করে, তারা কি জাগিয়ে দেবে না?

এখানেও ঠিক উত্তরটা পেলাম না। আরো কোনো প্রশ্ন মাথাও এলো না, আর তাছাড়া প্রশ্ন উত্তর পর্ব চালানোর মতো মানসিক স্থিতিও আমার ছিলনা সেই মূহুর্তে। তাই আমি কিছু ঠিক কি করব বুঝতে না পেরে আঁধার ঠেলে ঠেলে এগিয়ে যেতে শুরু করলাম, সামনে কিসে একটা হোঁচট খেতে দেখি কি একটা পড়ে আছে, ঠিক বুঝতে পারলাম না। ঠিক কি ছিল। হাতরে হাতরে বাইরে এসে দেখি কোন এক অজানা স্থানে এসে দাঁড়িয়েছে ট্রেনখানি।

চারিদিকে আঁধার। দূরে কিছু কিছু মানুষের ছোটাছুটি দেখে এগিয়ে গেলাম,আমি চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলাম "দাদা কি হয়েছে এখানে?"

আমার কথার কেউ উত্তর দিলো না।

আমি আরও একটু এগোতেই দেখলাম ট্রেন দূর্ঘটনা হয়েছে। আমি এবারে বেশ অবাক হলাম, এতো বড় ট্রেন দূর্ঘটনা হলো আমার ঘুম ভাঙ্গলো না কি করে? কেনই বা বুঝতে পারলাম।

শেষে আমার যুক্তিবাদী মন একটা যুক্তি খাড়া করেই নিলো, আমার কামরাটা প্রায় শেষের দিকে, তাই হট্টগোলের আওয়াজ তেমন করে আমার কানে পৌঁছায়নি।

যাইহোক, এসব ভেবে তো কাজ নেই। আমি ভাগ্যবলে জীবন পেয়েছি, মানুষ হিসেবে যা যা কর্তব্য তা তো আমায় করা উচিত। আমি একটু সামনে এগোতেই দেখলাম একটা মৃত দেহ পড়ে রয়েছে,বাইরের স্বল্প আলোয় মনে হলো বছর তিরিশের যুবক, ঘাড়টা পুরো ভেঙে গিয়েছে। আমি সেদিকে তাকিয়ে বুকটা ছ্যাত করে উঠলো, যতই সাহসী হই এমন একজন যুবকের এমন নির্ম্মম মৃত্যুতে কার না খারাপ লাগবে। আমি তাই সেদিন থেকে মুখ ফিরিয়ে এগিয়ে গেলাম, আমি চাইছি জীবিত কেউ থাকলে তাকে বাঁচাতে হবে, ঈশ্বর যখন আমাকে মারেনি,তখন আমারও কর্তব্য আরও কিছু প্রাণকে বাঁচানো।সামনে একটা কিসে পা লাগলো,তুলে দেখি সেটা একটা টর্চ, হয়তো হতভাগা যুবকটির। ভাগ্যবলে দেখলাম সেটা কাজ করছে। আলো ফেলতেই দেখলাম চারিদিকে রক্তের বন্যা আর আর্তনাদ। আমার সারা শরীরকে কাঁপিয়ে দিতে লাগলো। তবুও মনটাকে আমি শক্ত করে বিভিন্ন কামরায় উঁকি মারলাম। মনকে বারবার বোঝাতে লাগলাম, ভগবান যখন আমাকে প্রাণ দিয়েছে। তখন আমার উচিত যতজন সম্ভব মানুষের প্রাণ বাঁচানো। এতো কষ্টে মনকে শক্ত করে এগোলেও ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছি মানুষের মৃতদেহের স্তুপ দেখে। কারো কারো ঘাড় ভেঙে গিয়েছে, কারো কারো মাথা ফেঁটে গিয়েছে, কেউ কেউ সদ্য হাত বা পা হারিয়ে ছটফট করছে। সবচেয়ে কষ্টের লাগলো আমার কাছে একজন গর্ভবতী মায়ের মৃতদেহ দেখে, বয়েস বেশি হবে না, আমার চেয়েও কম হতে পারে, দেখেই বোঝা যাচ্ছে উল্টে পড়ে অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণে মৃত্যু হয়েছে উনার। আমার চোখ জলে ভরে এলো, আমার নিজের মায়ের কথা..... আর ভাবতে পারলাম না,চোখ দুখানি মুছে নিজেকে সংযত করলাম। কিছু কিছু স্থানীয় লোক এগিয়ে এসেছে সাহায্য করতে, আমিও যতটা পারলাম হাত লাগালাম।একটা কামরায় গিয়ে আলো ফেলতেই দেখি একটা বছর পাঁচেকের শিশু এককোনে দাঁড়িয়ে ভয়ে থরথর করে কাঁপছে, আমি আলো ফেলতেই মুখে হাত দিয়ে ঢেকে নিয়েছে। আমি টর্চখানি নিভিয়ে ধীর পায়ে তার কাছে এগিয়ে গিয়ে তাকে বুকে জড়িয়ে নিলাম। সেও আমাকে জড়িয়ে ধরলো পরম নির্ভরতায়,আমার মনে হলো সে কথা হারিয়ে ফেলেছে হঠাৎ আঘাতে। সে কিছুটা শান্ত হবার পরে আমাকে একহাতে জড়িয়ে অন্যহাত দিয়ে একদিকে ইঙ্গিত করছে।আমি সেদিকে আলো ফেলতেই সে ভয়ে আবার আমাকে জড়িয়ে ধরলো।

সেদিকে তাকাতেই দেখলাম ছয়জনের মৃতদেহ। বুঝলাম শিশুটি মা বাবা, ঠাকুমা, দাদু আর দাদার সাথে যাচ্ছিল। মাত্র ঘন্টা খানেক আগেই তার একটা সুখী পরিবার ছিল, সে ছিল সেই পরিবারের রাজকন্যা। আজ ভাগ্যের পরিহাসে সে আজ অনাথ। আমার হঠাৎ মনে একটা প্রশ্ন জাগলো, আচ্ছা বাচ্চা মেয়েটি মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছে, সে ভাগ্যবতী। নাকি দাদাটি, যে পরিবারের সাথেই চলে গেল। আমার বড় মায়া লাগলো, মেয়েটির দিকে তাকালাম, আমার কোলে এসে নিশ্চিন্তয়তায় কান্না থামিয়েছে,জড়িয়ে হয়তো ঘুমিয়েই পড়েছে। আমি শিশুটিকে কোলে নিয়ে বাইরে এলাম, একে নিয়ে কি করব ঠিক বুঝতে পারছিনা। বাচ্চাটাও আমাকে আঁকড়ে ধরে রয়েছে। আমি ভাবলাম এর আত্মীয়ের খোঁজ না পাওয়া পর্যন্ত আমি একে আমার কাছে রাখবো। বুঝতে পারলাম মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি ঘুম ভাঙ্গালাম না, কোলে নিয়ের এগিয়ে যেতে লাগলাম। মেয়েটার মুখখানা আঁধারে আমি ঠিক মতো দেখতেও পাইনি। চারিদিকে কত মানুষের ছোটাছুটি, স্থানীয় লোকেদের ছুটে আসা দেখে মনে হচ্ছে মানুষের মাঝে এখনো মনুষ্যত্ব সম্পূর্ণভাবে শেষ হয়ে যায়নি। আমিও এগোতে লাগলাম, যদি আরও কাউকে সাহায্য করতে পারি, হঠাৎ কান্না শুনে সেদিকে যেতেই দেখি বছর খানেকের শিশু কাঁদছে আর পাশে একজনের মৃতদেহ পড়ে। মানুষটাকে উল্টোতেই বুঝতে পারলাম বছর কুড়ির একজন মহিলা। দেখে আসামের অধিবাসী মনে হলো। উনার বাচ্চাটা কাঁদছে, আমি তাকেও কোলে তুলে নিলাম। কি করব এদের নিয়ে জানিনা, কিন্তু কেন জানিনা মনে হচ্ছে এরা আমার অচেনা না। আমি এখনো পর্যন্ত প্ল্যাটফর্মে পৌঁছাতে পারিনি,ছোট্ট বাচ্চাটা দেখলাম কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুলছে।আমি কোনো মতে প্ল্যাটফর্মে পৌঁছে একটা জায়গায় বাচ্চা দুটোকে বসিয়ে জলের খোঁজে গেলাম। আমি নিজেও বিহ্বল, কিছু বুঝতে পারছিনা কি কর্তব্য আমার? যাইহোক অতিকষ্টে একটা পাত্র খুঁজে জল নিয়ে বাচ্চাদের কাছে আসতে গিয়ে দেখি একজন মহিলা বাচ্চাদুটোকে মাই দিচ্ছে। আমি একদৃষ্টে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম। আমার পা দুটো আঁটকে গিয়েছে। কারণ মানুষটাকে আমি চিনি, সে আমার মা। হ্যাঁ তিনি আমাকে জন্ম দেননি, তবে কোনো দিনও বুঝতে দেননি তিনি আমার মা নন। কোনো দিনও কোনো অভাব বুঝতে দেননি। কিছুদিন আগে পর্যন্ত জানতাম না তিনি আমার মা ছিলেন না। এই বছর তিনি না ফেরার দেশে চলে গিয়েছেন, মৃত্যু শয্যায় বলেন আমাদের পাওয়ার গল্পটা। আমার সব গুলিয়ে যায়, হাত থেকে জলের পাত্রটা পড়ে যায়। মাকে তো আমি ভাই আর দাদা মিলে নিজে শ্মশানে... আমি তার দিকেই ছুটতে থাকি, কিন্তু কিছুতেই তাদের কাছে পৌঁছাতে পারিনা।শেষে আমি দিকবিদিকশুন্য হয়ে ছুটতে শুরু করি। মনে হয় সেখানে প্ল্যাটফর্মে নাম লেখা স্তম্ভটি, এতোক্ষণ এটা কোথায় ছিল কে জানে? পকেটে রাখা টর্চখানি যেখানে স্টেশনের নাম লেখা থাকে সেখানে ফেললাম। নামটা গাইসাল। কিন্তু আমি তো এই পথেই যাত্রী নই, তাহলে এখানে কি করে? ভেবেই আর্তচিৎকার করে উঠলাম, তারপর জানিনা। যখন চোখ খুললাম দেখি আমার মুখে একজন মহিলা জল ছিটাচ্ছেন। আমি তাকে দেখে ঠিক চিনতে পারিনা, আর বুঝতেও পারিনা কোথায় আছি।

" তুমি ঠিক আছো তো মা?"

" কি হয়েছে আমার? আমি কোথায়?"

" তুমি তোমার জায়গায় বসে রয়েছ, আমরা নৈহাটি থেকে ট্রেনে উঠি, তখন তুমি ঘুমোচ্ছিলে। জঙ্গীপুর স্টেশন পেরোনোর সময় কেমন অস্থির হয়ে উঠেছিলে। সবাই ঘুমোচ্ছিলো, কেউ তেমন লক্ষ্য করেনি। আমার তো ঘুম হয়না। তারপর হঠাৎ গোঁগোঁ করে উঠলে,আমি আর নিজেকে সামলাতে পারলাম না। বুঝতে পারলাম ভয়ের স্বপ্ন দেখছো, তাই মুখে জল ছিটিয়ে জাগানোর চেষ্টা করলাম।"

আমি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে উনাকে ধন্যবাদ জানাতেই উনি বললেন " আরে এসব বলছো কেন? তুমি আমার মেয়ের মতো। সাবধানে যেয়ো। আমি তো ফারাক্কায় নামবো।"

আমি তাকিয়ে থাকলাম উনার দিকে। আজ মনে হলো মা কতরূপে তার সামনে আসছে আজ।

তবে একটা বিষয় কিছুতেই আমার মাথায় ঢুকছিলো না, এমন স্বপ্নের মানে কি। এই ট্রেন তো গাইসলের উপর দিয়ে যাবে না। এটা তো অন্য পথ। আর মা মৃত্যুর সময় ওকে বলেছে ও আর ভাইকে উনি জন্ম দেননি। খুঁজে পেয়েছেন। কিন্তু কোথায় কিভাবে পেয়েছেন উনি বলেন নি। তাহলে এই স্বপ্নের মানে কি? আদেও এর বাস্তবতা রয়েছে।

আমি উঠে গিয়ে চোখে মুখে জল দিলাম, একটু বাথরুম থেকেও ঘুরে এলাম। বাইরে বাইরে ঘুরি,তাই আমি সাথে একটা অতিরিক্ত বোতল রাখি, বাইরে থেকে জল বাথরুম পরিস্কার করে, তারপর যাই। সবকিছু সেরে আমি যখন এসে বসলাম,তখন ভদ্রমহিলা বললেন "তুমি যখন উঠে গেলে,এই সোনার চেনটা পড়ে গিয়েছিল। আমি তুলে রেখেছি।" বলে একরকম আমার হাতে গুঁজে দিলেন উনি।

আমি কিছু বলার আগেই ট্রেনটি একটা স্টেশনে এসে থামলো।উনি বললেন " আসি মা আমার স্টেশন এসে গিয়েছে। " আমি আর কিছু বলার সুযোগই পেলাম না।

কাউকে যে জিজ্ঞেস করবো এই চেনটা কার, কিন্তু কাউকে দেখে মনে হলো না চেনটি তাদের। কারণ ভদ্রমহিলাটি সবার সামনে আমার হাতে দিয়েছেন। তাছাড়া চেনটির দিকে তাকিয়ে আমার কেন জানিনা অচেনা মনে হলোনা।চেনটি সযত্নে রেখে দিলাম চেনখানি আমার ব্যাগে।

আমার আর ঘুম হলোনা। ইচ্ছেও করলো না ঘুমাতে। আজকে আমার সাথে কি ঘটনা ঘটে চলেছে আমি বুঝতে পারছিনা। আমার গন্তব্য স্টেশনে নেমে আমি সোজা গেলাম স্টেশন মাষ্টারের ঘরে। তিনি বছর পঞ্চাশের প্রৌঢ় মানুষ। প্রথমে কিছুই বলতে চান না, শেষে অনেক অনুরোধ উপরোধের পরে বললেন, "দেখো এসব কথা বলা বারণ রয়েছে, তবুও তুমি এতো করে অনুরোধ করছো তাই বলছি, কিছুদিন আগে আমাদের এই ট্রেনের কিছু কামরা বাড়ানো হয়েছে, তা তুমি হয়তো জানো।"

আমি সম্মতি জানিয়ে বললাম আমি জানি।

" দেখো এটা রেলের ভেতরের কথা বলা বারণ, তুমিও কাউকে বলোনা। বিশ্বাস করে বলছি।"

আমি বললাম "আমি কথা দিচ্ছি আমি কাউকে কিছুই বলবো না।"

তিনি ছোট্ট করে একটা শ্বাস ছেড়ে বললেন " যে কামরা গুলো দেওয়া হয়েছে তার কয়েকটি গাইসালের যে ট্রেন দূর্ঘটনা হয়েছিল, সেই ট্রেনের। আগে এই কামরা গুলোকে সারাই করে Sleeper এ ব্যবহারের চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু কি কারণে সেটা আবার বন্ধ হয়ে যায়। এতো বছর পরে নতুন একজন দায়িত্বে এসেছেন, তিনি সেগুলোর অবস্থা ভালো দেখে সেগুলোকে সারাই করে, Chair car আর General কামরার জন্য বরাদ্দ করেন। আমাদের ট্রেনে দিন দুই হলো ব্যবহার করা হচ্ছে।"

আমি আর কিছু বললাম না, ধন্যবাদ দিয়ে বেড়িয়ে এলাম।

বাড়ি স্টেশন থেকে ১১ কিমির মতো, বাস, ট্রেকার যায়। সাধারণ চাষি পরিবারের মেয়ে হিসেবে মানুষ হয়েছি, বড় হয়েছি। সাধারণত গ্রামে আমার বয়সী মেয়েদের বিয়ে হয়ে যায়। কিন্তু আমার বিয়ের জন্য না গ্রামের কারোর কথা বলতে দেখেছি, না মায়ের আগ্রহ দেখেছি। এখন বুঝতে পারি কারণটা, তিনি জানতে দিতে চাননি আমি তার গর্ভজাত সন্তান নয়,বিয়ের সময় ঠিক এসব নিয়ে কথা উঠতোই।অবশ্য আমি লেখাপড়ায় গ্রামের মধ্যে সবচেয়ে ভালো ছিলেম, তাই মা আমাকে পড়িয়েছেন। বাবা মাকে আগেই ছেড়ে গিয়ে অন্য জনের সাথে ঘর পাতিয়েছিল। মায়ের শ্বশুর শ্বাশুড়ির একমাত্র ছেলে আমার বাবা ছিল, মানে আমার দাদু ঠাম্মার একমাত্র ছেলে ছিল আমার মায়ের বর। কিন্তু ঠাম্মা দাদু আমার মায়ের পক্ষ নিয়ে মায়ের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন।সব সম্পত্তি আমার মাকে লিখে দেন। তারপর দুই একবার ঝগড়াঝাটি করতে মায়ের বরকে আসতে দেখেছি, তবে দাদু ঠাম্মা সবসময়ই মায়ের সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছেন। আমাদেরও তারা এতোটা স্নেহ করতেন, আমি কোনো দিনও বুঝতে পারিনি, বড় দাদার চেয়ে আমি আর ভাই আলাদা। আমি পুরস্কার পেলে সারা পাড়ার লোককে বলে বেড়াতেন, আমার নাতনি দেখো পুরস্কার পেয়েছে। আজ তারা নেই, আমি প্রতিষ্ঠিত, কিন্তু খুব মনে পড়ে তাদের কথা। পরিবার হারিয়েও এমন পরিবার পেয়েছি, তা বলার মতো না।

বাড়ি পৌঁছে দেখি আমার বছর দুয়েকের ভাইঝি আমার জন্য দরজায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমার দাদার মেয়ে। দেখে কোলে তুলে নিলাম কোলে। আদরে আদরে ভরিয়ে দিলাম। আমার ভাইপো তখন স্কুলের জন্য তৈরী হচ্ছিলো, নইলে সে আমাকে দেখে ছুটে আসতো। আমি ভাইঝি রিতাকে কোলে নিয়ে বাড়ির ভেতরে আসলাম। বৌদি খুব ভালো, আমাকে খুব স্নেহ করেন, হয়তো মায়াই করেন এখন। তিনি এগিয়ে এসে বললেন " কি গো মিনু এতো দেরি হলো কেন গা। তোমার দাদা আর ভাই ঘর বাহির করতে করতে মাঠে চলে গেল।"

আমার স্টেশন মাস্টারের সাথে কথা বলতে বলতে দেরী হয়ে গিয়েছে বলিনি। বললাম " একজন কলেজের বন্ধুর সাথে দেখা হয়ে গিয়েছিল, তার সাথে কথা বলতে বলতে দেরী হয়ে গেল। "

বৌদি বললো "যাও গিয়ে স্নান সেরে নাও।"

আমি রিতাকে কোলে নিয়ে ঘরে চলে গেলাম। ওর জন্য আনা উপহারগুলো ওর হাত ভরে দিলাম।ওর চলে যেতে ব্যগটা বন্ধ করতে যেতেই একটা জিনিস হাতে ঠেকলো, সেটা আর কিছুই না সোনার মালাটি। কি মনে হতে পড়ে নিলাম গলায়,আমি সাধারণত সাজতে পছন্দ করিনা। পড়ার আগে মালাটি ভালো করে দেখলাম, মালাটির তেমন বিশেষত্ব নেই, সাধারণ সোনার মালা, কিন্তু লকেটটা একটু অন্যরকম, একটা কিসের যেন মূর্তি।

আমি ফোনটা চার্জ দিতে বসালাম, একদম ফোনে চার্জ না থাকার জন্য ফোনটা Switch off হয়ে গিয়েছিল। ফোনটা চার্জে দিয়েই Switch on করেই কি মনে হতে গাইসাল বলে Internet এ সার্চ করলাম। বেড়িয়ে এলো গাইসালের মর্মান্তিক দূর্ঘটনার খবর 1999 এর 2 August উত্তর দিনাজপুর জেলার গাইসাল নামক স্থানে প্রায় রাত ১:৪৫ সময় রেল দূর্ঘটনা হয়েছিল। যা ভারতের সবচেয়ে বড় রেল দূর্ঘটনা বলে অনেকের দাবি। প্রায় ২৮৫ জনের মতো যাত্রী প্রাণ হারান আর ৩০০ জনের মতো। মাথাটা কেমন করে উঠলো, ওই ভদ্রমহিলার কথানুযায়ী আজ আমি ঠিক ওই সময় থেকে অস্থির হয়ে উঠি। কিছু ভালো লাগছিলো না, সবকিছু ওলট পালট হয়ে যাচ্ছিলো আমার। এমন সময় সামনে তাকাতেই সামনের দেওয়া ঝোলানো ক্যালেন্ডারের দিকে চোখ পড়লো, আমার ভাইপোর স্বভাব ক্যালেন্ডারে দাগিয়ে রাখা সেদিনের তারিখটি। আমি শিখিয়েছিলাম, সেখানে সময় দেখাচ্ছে 2 August.....

চলবে...


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror