Sayandipa সায়নদীপা

Classics

3  

Sayandipa সায়নদীপা

Classics

তোমায় নিয়েই গল্প হোক

তোমায় নিয়েই গল্প হোক

11 mins
1.0K


নিহারের গল্প


ইলিশেগুঁড়ি বৃষ্টি নিহারের বরাবরের অপছন্দ, এই বৃষ্টি শুধু মন খারাপের ছল। নিহার, ভালো নাম নীহাররঞ্জন সেন। নীহাররঞ্জন নামটা শুনলেই একটা বয়স্ক মানুষের ছবি ভেসে আসে সামনে। কিন্তু আমাদের নিহার তিরিশ পের করে একত্রিশ ছুঁয়েছে সবে। বাবা ছিলেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক নীহাররঞ্জন গুপ্তের গোয়েন্দা গল্পের ভক্ত, তাই ছেলের নামও রেখেছেন প্রিয় লেখকের নামে। নিহার তার বাবার মত রহস্য গল্প ভালোবাসেনা, নিহারের পছন্দ শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের "রিমঝিম", ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের "স্বাক্ষর"। বাবা ব্যঙ্গ করেন, বলেন এগুলো নাকি মেয়েলী গল্প। নিহারের খারাপ লাগে, তবুও রাশভারী বাবার মুখের ওপর প্রতিবাদ করতে পারেনা সে। বাবা লোকটার একচ্ছত্র আধিপত্য এই বাড়িতে, বাবা যা বলেন তার ঠিকভুলের হিসেব না কষেই চুপচাপ মেনে নিতে হয় ওদের। নিহারের মাঝেমাঝে ভীষণ ইচ্ছে করে অবাধ্য হতে, নিজের ইচ্ছে মতো যা খুশি করতে। চাকরিটা পাওয়ার পর নিহার ভেবেছিল এবার বুঝি মিলবে অবাধ্য হওয়ার স্বাধীনতা; প্রথম বেতন পেয়ে সে কিনে এনেছিল বাংলা ইংরেজি একগুচ্ছ পছন্দের উপন্যাস। বাবা দেখেই তেলেবেগুন হয়ে উঠেছিলেন। বাছা বাছা কয়েকটি বিশেষণে ভূষিত করেছিলেন নিহারকে, সেদিনও অবাধ্য হতে পারেনি নিহার। কান দিয়ে ধোঁয়া উঠেছিল, তবুও প্রতিবাদের একটা বুলিও ফোটেনি মুখ থেকে। সেইদিন টের পেয়েছিল নিহার, ছোটবেলার থেকে লোকটার একাধিপত্যের ভারে চাপা পড়তে পড়তে নিহারের ব্যক্তিত্বটা কবেই যেন মরে গিয়েছে নিঃশব্দে।


  জায়গাটার নাম চাঁদিপুর। জায়গাটার কথা নিহার প্রথম শোনে অফিসের গুঞ্জনদির কাছ থেকে। সে বলেছিল, "বালেশ্বর ব্রাঞ্চে কাজে যাচ্ছ যখন একবার ঘুরে এসো চাঁদিপুর জায়গাটা। মন ভালো হয়ে যাবে, গ্যারান্টি দিচ্ছি।"

বাড়িতে জানায়নি নিহার, বাড়িতে শুধু বলেছে বালেশ্বর ব্রাঞ্চে ডিউটি পড়েছে। চাঁদিপুর যাওয়ার কথা শুনলে বাবা আপত্তি করতেন না হয়তো, তবুও বলতে ইচ্ছে হয়নি নিহারের। একবার অবাধ্য হতে ভীষণ ইচ্ছে করছে।

এখানে আসার পর বুঝেছে গুঞ্জনদি ভুল কিছু বলেনি। এমন শান্ত স্নিগ্ধ সমুদ্রতট পাওয়া ভার।

ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। হোটেলের রুমে একলা বসে নিহার। সঙ্গে একটা উপন্যাস এনেছিল, স্মরণজিৎ চক্রবর্তীর "ওম"। গা'টা শিরশির করছে বটে তবে এই মুহূর্তে "ওম" এর ওম নিতেও ঠিক ইচ্ছে করছে না ওর। কেমন যেন অস্থির লাগছে নিজেকে। বাইরে থেকে ভেসে আসা আওয়াজটার তোড় ক্রমশ তীব্র হচ্ছে। বৃষ্টিটা কি বাড়ল তবে?


  ছাতাটা ফুটিয়ে সকলের অলক্ষ্যে বাইরে বেরিয়ে এলো নিহার। হোটেল থেকে সমুদ্রতট ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে। আজকের সমুদ্র সৈকত নিহারের মনটার মতোই শূন্য। দমকা বৃষ্টির ফোঁটাগুলো সজোরে বালিতে আঘাত করে ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে, চারিদিকে ধোঁয়া ধোঁয়া সব কিছু। কালকের পায়ের ছাপ আজ ধুয়ে মুছে একসা। ঝাউ গাছ গুলো আজ রং পাল্টে উদ্দাম নৃত্যে মগ্ন। ঝোড়ো হাওয়ার বেগ আছে ভালোই, ছাতাটাকে হাতের মুঠোয় শক্ত করে চেপে ধরে এগোতে থাকলো নিহার। কেউ ওকে লক্ষ্য করলে নিশ্চয় পাগল ভাববে, সে ভাবুক, কিচ্ছু যায় আসেনা নিহারের। 

কিন্তু ওটা কে! বৃষ্টির মধ্যেই নিহার দেখতে পেল তাকে। সে দাঁড়িয়ে আছে সমুদ্রের খুব কাছে, বৃষ্টির এই পাগলামির হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করার কোনো তাগিদই যেন নেই তার। লম্বা ঝুলের কুর্তি বৃষ্টির ভয়ে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে মেয়েটার শরীর। উত্তাল সমুদ্রের ঢেউ এসে ক্রমাগত আছড়ে পড়ছে ওর কাছে, যে কোনো মুহূর্তে ওরা গিলে নেবে মেয়েটাকে। বুকটা ধক করে উঠল নিহারের।

ছাতাটা সামলে প্রায় দৌড়ে মেয়েটার কাছে পৌঁছাবার চেষ্টা করল নিহার। এই প্রচন্ড বৃষ্টির কম্পনের মধ্যেও মেয়েটা টের পেয়ে গেল কি করে কে জানে, নিহার কাছাকাছি আসা মাত্রই ঘুরে তাকাল সে। চমকে গেল নিহার। এতো সুন্দরও মানুষ হতে পারে! বৃষ্টির ফোঁটাগুলো এসে আঘাত করছে মেয়েটার চোখে, ঠোঁটে, গালে… চোখের পাতাগুলো তুলে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকাই দায় তার, গোলাপি ঠোঁট দুটো একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে নিজেদের রক্ষা করতে ব্যস্ত, গাল দুটো বৃষ্টির ছোঁয়ায় লাল। সারা শরীরে এক অদ্ভুত শিহরণ খেলে গেল নিহারের। তার মনে হল এই তিরিশ বছরের জীবনে এমন সৌন্দর্য আর কখনও দেখতে পায়নি সে। দমকা একটা হাওয়া এসে ধাক্কা দিলো নিহারের শরীরে, কেঁপে উঠল রোমকূপগুলো। প্রতিবর্ত ক্রিয়াই হয়তো ওকে বাধ্য করলো আরও এগিয়ে যেতে তার আছে, ছাতাটা মেলে ধরতে তার মাথায়। মেয়েটাও নিস্পলক দৃষ্টিতে তাকাল নিহারের দিকে। মেয়েটার চোখ দুটো মৃদু লাল। ও কি কাঁদছে! অভিমানী মেঘের চোখের জলের সাথে ওর চোখের জল মিলে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে কি!

"তোমার চোখে জল!" ফিসফিস করে জানতে চাইল নিহার। 

জল...জল... প্রতিধ্বনিত হল নিহারের স্বর। চমকে গেল নিহার। অদ্ভুত লাগছে ওর। মেয়েটাকে ভীষণ চেনা চেনা মনে হচ্ছে কিন্তু কিছুতেই মনে পড়ছে না কোথায় দেখেছে ওকে। মনে হচ্ছে যেন মেয়েটা ওর বহুকালের পরিচিত, তাই তো ওকে কাঁদতে দেখে মুচড়ে উঠছে নিহারের মন।

নিহার জানে না কেন, কিসের আবেশে ডান হাতটা তুললো, ফর্সা আঙ্গুলগুলো ছুঁইয়ে দিতে চাইল মেয়েটার গালে, মুছে দিতে চাইল ওর সব দুঃখ সব কষ্ট। 

কিন্তু তার আগেই আচমকা একটা উত্তাল ঢেউ ধেয়ে এলো সমুদ্র থেকে। টাল সামলাতে পারল না নিহার, উল্টে পড়ল জলে। মেয়েটা মুহূর্তের মধ্যে কোথায় যেন হারিয়ে গেল। সমুদ্রের জলটা ঘুরছে… ঘুরছে…



                 ★★★★★


ওদের গল্প...


"কেউ কি আছো এখানে?" 

এখানে...এখানে...

"কে?"

কে...কে...


   আজ একটা চপল হরিণ শিশুর পেছনে ধাওয়া করতে করতে নার্সিসাস ঢুকে পড়েছে এই গভীর জঙ্গলে। শুরুর থেকেই তার মনে হচ্ছে কেউ যেন নিঃশব্দে অনুসরণ করে চলেছে তাকে। ক্রমাগত তার পেছনে আরেক পদযুগলের ঘর্ষণে শুকনো পাতায় উঠছে খসখস শব্দ। কৌতূহলী নার্সিসাস পেছন ফিরেও দেখতে পেলো না কাউকে। সে আবার ঘুরে এগোতে শুরু করল, কিন্তু কয়েক পা যেতে না যেতেই পেছনে আবার উঠল শুকনো পাতার সেই খসখস শব্দ। সচকিত হয়ে আবার পেছন ফিরল নার্সিসাস। প্রশ্ন করল, "কেউ কি আছো এখানে?"

খুব ক্ষীণ কণ্ঠে ভেসে এলো জবাব, "এখানে...এখানে..."

এ আবার কেমন জবাব। কৌতূহলী নার্সিসাস আবার প্রশ্ন করল, "কে?"

"কে...কে..." আবার ক্ষীণ কণ্ঠে ভেসে এলো উত্তর। অধৈর্য্য হয়ে উঠল নার্সিসাস, "কে তুমি?"

"তুমি...তুমি..."

"আমি নার্সিসাস, নদীমাতা লিরিওপের পুত্র। তুমি কে?"

"কে...কে..."

উফফ… ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যেতে চাইল নার্সিসাসের। আশেপাশে ঘুরে সে ভালো করে খুঁজে নিতে চাইল সেই রহস্যময়ীকে, সবুজ গাছগাছালীর ভীড়ে চোখ চালালো, লতাদের ফাঁকে উঁকি দিলো কিন্তু তবুও দেখতে পেলোনা কাউকে। নার্সিসাসের মনে হল ওই লতানে গাছটার কোমর জড়িয়ে থাকা বেগুনি ফুলগুলো যেন ওকে দেখে হেসে উঠল খিলখিল করে। গাছের ডালে বসে কোকিলজোড়া ওদের লাল লাল চোখ দিয়ে দেখতে থাকলো নার্সিসাসকে, একটা ময়ূর পেখম তুলে ফিক করে হাসল ওকে দেখে। 

আরও অধৈর্য লাগলো নার্সিসাসের। সে এবার দ্বিগুণ স্বরে চিৎকার করে উঠল, "কে আছো? কাছে এসো।"

এবারও শুনলো ছোট্ট উত্তর--- "এসো… এসো… "

আশ্চর্য! নার্সিসাস ভেবে পেলোনা তার কি করা উচিৎ। বিস্ময়াহত নার্সিসাস একের পর এক প্রশ্ন করেই চলল, আর সঙ্গে সঙ্গে অতি সংক্ষেপে আসতে লাগলো তার উত্তর। ঝোপঝাড়, ডালপালা সরিয়ে তন্ন তন্ন করে খুঁজলো নার্সিসাস, তবুও দেখা পেলোনা সে রহস্যময়ীর। 


  অবশেষে ক্লান্ত হয়ে পড়ল নার্সিসাস। ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। এই গভীর অরণ্যের মধ্যে থেকে আচমকা ভেসে আসা সেই কণ্ঠের কুহেলিকা ভেদ করার জন্য প্রবল আকুতি নিয়ে শেষবারের মত বলে উঠল নার্সিসাস, 

"কে তুমি? দয়া করে সামনে এসো। কেন তুমি এমন আড়ালে থেকে আমায় অনুসরণ করছো জানিনা, আমি ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, কিন্তু তোমায় না দেখা অবধি কিছুতেই শান্তি পাচ্ছিনা আমি। তুমি পারোনা আমার দৃষ্টিতে শান্তি এনে দিতে? পারোনা তুমি?"

সামনে দাঁড়িয়ে থাকা প্রকান্ড বটগাছটার ঝুরি গুলো আচমকা দুলে উঠল। মুহূর্তের মধ্যে চকিত হয়ে সেদিকে ঘুরে তাকাল নার্সিসাস। বুকের ভেতর তার আলোড়ন, শিরায় শিরায় শিহরণ… "এসো"।

গাছের কোটর থেকে অবশেষে বেরিয়ে এলো এক অপূর্ব সুন্দরী নারী। বিস্ময়, মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন হয়ে গেলো নার্সিসাস, অপলক দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে রইল মেয়েটির দিকে। মেয়েটির শরীর জুড়ে লজ্জা, মস্তক অবনত, তবুও তার চোখের তারায় প্রতিফলিত হল নার্সিসাসের নিখুঁত রূপ, যে রূপ দেবশিল্পী হেফাস্টেসের শিল্পকলাকেও হার মানায়। মন্ত্রমুগ্ধের মত এগিয়ে গেল নার্সিসাস, এগিয়ে এলো নামহীনা সেই মেয়েটাও। নার্সিসাস তার ছাঁচে গড়া সরু সরু আঙ্গুলগুলো তুলে স্পর্শ করল মেয়েটার পদ্ম পাপড়ির মত ঠোঁটে। কেঁপে উঠল মেয়েটা। চোখদুটো বন্ধ করে সে মাথা রাখল নার্সিসাসের পুরুষালি বুকে, নাক ঘষে গন্ধ নিতে চাইল তার ভালোবাসার পুরুষের। নার্সিসাসও তার কালো মেঘের মত চুলে হাত বুলিয়ে দিল, শক্ত করে তাকে বুকে টেনে নিয়ে চুমু এঁকে দিল তার নরম কপালে। নার্সিসাসের বুকে লাগল শীতল স্পর্শ। অবাক হয়ে তাকাল নার্সিসাস, দেখল তার প্রেমিকার চোখে জল। অবাক নার্সিসাস আঙ্গুল দিয়ে মুছিয়ে দিল তার চোখ, মুক্তোর মত অশ্রু বিন্দু পড়ে গেল মাটিতে… একটা সাদা ফুল হেসে উঠল সেখানে। নার্সিসাস নামাল মাথাটা, ওই পদ্ম পাপড়ির মত নরম ঠোঁটে ডুবিয়ে দেয় নিজের ঠোঁট দুটো। তাদের ভালোবাসার প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠে ইয়াডোরা দীঘির জলে। 


  চমকে উঠল ইয়াডোরা। একি! এই মেয়েটাকে তো সে ভালো করে চেনে। এই তো সেই অভিশপ্ত ইকো। দেবরাণী হেরার অভিশাপে যে তার বাকশক্তি হারিয়েছে। এই মেয়েটার তাদের ভাই নার্সিসাসের জীবনসঙ্গিনী হওয়ার স্বপ্ন দেখছে! সর্বনাশ! নিমেষের মধ্যে ইয়াডোরা পৌঁছে গেল নদীমাতা লিরিওপের কাছে, কানে কানে বলে দিলো সব কিছু। রাগ এবং আতঙ্কে কেঁপে উঠলেন লিরিওপে। তার অমন সুন্দর পুত্র শেষে কিনা একটা বোবা মেয়ের প্রেমে মাতোয়ারা!!! না না, এ কিছুতেই সম্ভব না। এন্ড্রোমিডার মত কোন রূপবতী গুণবতীই একমাত্র যোগ্য নার্সিসাসের। যে করেই হোক ইকোকে সরাতেই হবে নার্সিসাসের কাছ থেকে। লিরিওপে নির্দেশ দিলেন ইয়াডোরাকে। মাতার নির্দেশ ফিরে এলো ইয়াডোরা। দেখলো নরম ঘাসের গালিচায় নগ্ন ইকো শুয়ে রয়েছে, আর তার উন্মুক্ত শরীরটাকে ফুল দিয়ে সাজিয়ে চলেছে নার্সিসাস। ভালোলাগার আবেশে ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছে ইকো, তার ঠোঁট দিয়ে ঝরে পড়ছে গোলাপের হাসি। এহেন দৃশ্য দেখে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠল ইয়াডোরা; এতো বড় সাহস ইকোর! ইয়াডোরা চুপিচুপি নার্সিসাসের সংগ্রহ করা ফুলের মধ্যে রেখে দিলো এক নিদারুণ বীজ, সেই বীজ একবার শরীরের সংস্পর্শে এলে শরীরে আগুন জ্বলে ওঠে, নিদারুণ জ্বালায় ছটফট করতে করতে মানুষ পাগল হয়ে যায়। ভালোবাসার মোহে আচ্ছন্ন নার্সিসাস বা ইকো কেউ খেয়াল করতে পারলনা ইয়াডোরার এই ছল। প্রেমিক নার্সিসাস অজান্তেই ফুলের সঙ্গে সেই নিদারুণ বীজ তুলে নিয়ে সাজিয়ে দিলো ইকোর নাভিতে। মুহূর্তের মধ্যে জ্বলে উঠল ইকোর সারা শরীর, যন্ত্রনায় চিৎকার করে উঠল সে। হতভম্ব নার্সিসাস জানতে চাইল, "কি হয়েছে তোমার? বলো…"

উত্তর দিতে পারলোনা ইকো, মুখ খুলতেই নার্সিসাসের বলা শেষ কথাটা প্রতিধ্বনিত তার গলায়, "বলো… বলো..."

বিস্ময়ে থমকে দাঁড়াল নার্সিসাস। ইকো যন্ত্রনায় কাতরাতে কাতরাতেই কিছু বলতে চাইল নার্সিসাসকে কিন্তু বলতে পারলোনা আর, এমনিই অভিশপ্ত জীবন তার। নার্সিসাস এগিয়ে যেতে গেল ইকোর দিকে কিন্তু পেছন থেকে ইয়াডোরার নির্দেশে লতারা তার পা জড়িয়ে ধরল, এগোতে পারলোনা নার্সিসাস। নিজেকে মুক্ত করার জন্য হাত পা ছুঁড়ল সে। কিন্তু ইকো ভাবল সে কথা বলতে পারেনা জানার পর তাকে চলে যেতে বলছে নার্সিসাস। প্রেমাস্পদের এহেন আচরণে বুকে বড় ধাক্কা লাগল ইকোর। অভিমানে ইকো এক পা দু'পা পেছাতে পেছাতে চোখ ভর্তি জল নিয়ে ছুট লাগল সেখান থেকে, মুহূর্তের মধ্যে ডালপালার অন্ধকারে অন্তর্হিত হলো সে। 


  চিৎকার করে উঠল নার্সিসাস, সে চিৎকার বোধহয় আর শুনতে পেলোনা অভিমানীনি ইকো। লতার বন্ধন থেকে নিজেকে ছাড়াতে উদ্যত হল নার্সিসাস। ইকো অন্তর্হিত হয়েছে, অতএব নার্সিসাস সুরক্ষিত। এইবার ওর পা ছেড়ে দিলো লতারা। আচমকা মুক্তিতে টাল সামলাতে না পেরে ইয়াডোরার কিনারে পড়ে গেল নার্সিসাস। দীঘির জলে ভেসে উঠল নার্সিসাসের প্রতিবিম্ব। হতবাক হয়ে গেলো নার্সিসাস, সবাই বলতো সে সুন্দর, তা বলে এতোটা! কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে নার্সিসাসের আবার মনে পড়ে গেলো ইকোর কথা। এই রূপ নিয়ে লাভ কি যদি না নিজের ভালোবাসার মানুষকে কাছে ধরে রাখতে পারলাম! চোখ ফেটে জল আসতে চাইল নার্সিসাসের। সে হাত দিয়ে নষ্ট করে দিতে চাইল নিজের প্রতিবিম্বটাকে, কিন্তু টাল সামলাতে না পেরে ঝপ করে পড়ে গেল দীঘির জলে…



                   ★★★★★



রহস্য যখন মন


"কি বুঝছেন ডাক্তারবাবু? সারবে আমার ছেলেটা?"


"এখনই কিছু বলা সম্ভব নয়। আরও কয়েকটা সিটিং দিতে হবে, ওষুধগুলোও খাওয়াতে থাকুন ঠিক করে।"


"উফফ কেন যে ছেলেটা যেতে গেল ওই জায়গাটায়! এই জন্য আমি একা কোথাও যেতে দিইনা।"


"আমি যদি বলি আপনি এমনটা করেননা বলেই আজ আপনার ছেলের এমন অবস্থা।"


"মানে!" 


"মানেটা খুবই সোজা। একটা বয়েসের পর থেকে বাচ্চারা স্বাধীনতা চায়, তখন তাদের সেই স্বাধীনতাটা দিতে হয়। অবশ্যই আপনি চোখে চোখে রাখবেন ছেলেকে কিন্তু কিছু কাজ তাকে নিজের মত করতে দিতে হয়। আপনি সেটা করেননি মনোতোষ বাবু। আর শুধু ছোটবেলাতেই নয়, বড় হওয়ার পরেও আপনি সেই স্বাধীনতা দেননি। আপনি ওকে নিজের ছাঁচে গড়তে চেয়েছেন বরাবর, আপনার মনের মত করে চালাতে চেয়েছেন। কিন্তু মনোতোষ বাবু আমরা প্রত্যেকে ভিন্ন ভিন্ন মানুষ, ভিন্ন ভিন্ন সত্তা আছে আমাদের। জন্ম দিলেই মা বাবার বৈশিষ্ট্যই যে ছেলে পাবে তার কোনো মানে নেই, আর পেলেও তার নিজের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য কিছু থাকবেই। কিন্তু আপনি সেই বৈশিষ্টগুলোকেই ধামাচাপা দিতে চেয়েছেন বরাবর। আর এর ফলে নিহারের মনের মধ্যে আপনার প্রতি একটা তীব্র বিদ্বেষ জন্ম নিয়েছে সেই ছোটর থেকেই। মুখে না বললেও আপনার বিরোধিতা করার, অবশ্য শুধু আপনার বলছি কেন, শুধু আপনি নন, এই জগৎ সংসারে যা কিছু ঘটে, যা কিছু নিয়ম তার বিপরীত স্রোতে চলার একটা প্রবল জন্ম নিয়েছিল ওর মনে। আপনি ওর কাছে এই সমগ্র পৃথিবীর একটা রেপ্লিকা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন।"


"এসব আপনি কি বলছেন? এসব কথা আপনি জানলেন কি করে?"


"যদি বলি নিহারই আমায় বলেছে সব। ওর প্রথম দুটো সিটিং বৃথা যায়নি। ওর মনের অনেক কথাই খুলে বলেছে নিহার।"


"কি বলেছে ও?"


"বলেছে যে চাঁদিপুর ঘুরতে যাওয়াটা আসলে ওর কাছে ঘুরতে যাওয়ার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল আপনার অনুমতি ব্যাতিত কিছু কাজ করা। আর এই জন্য ওর মধ্যে হয়তো একটা চাপা টেনশন কাজ করছিল সেখানে যাওয়ার পর থেকে। সমুদ্রের ধারে প্রেশার ফল করে হয়তো পড়ে যায় জলে।"


"সে সব তো হল কিন্তু তার সাথে এখন যা ঘটছে তার কি সম্পর্ক!"


"সম্পর্ক আছে মনোতোষ বাবু, সম্পর্ক আছে। ইন ফ্যাক্ট খুব গভীর সম্পর্ক। 

   একটু আগেই যে বললাম, আপনার অতিরিক্ত শাসন, অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ ওকে নিজের জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ করে তুলেছিল। ও বারবার চাইত এই জীবনের থেকে মুক্তি, আর সেখান থেকেই এই সমস্যার সূত্রপাত। প্যারাকজম… এমন এক মানসিক বিকার যেখানে মানুষ অনেক সময়ই বাস্তব আর কল্পনার পার্থক্য করতে পারেনা। এক্ষেত্রে মানুষ নিজেকে নিয়ে বেশি চিন্তা করে, তাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয় তার সেই কল্পনার জীবনের ঘটনাবলী।"


"তারমানে আপনি বলতে চাইছেন…"


"ইয়েস, প্যারাকজম এর টেন্ডেন্সি মূলত টিনএজারদের মধ্যে দেখা গেলেও প্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে আসা বিচিত্র কিছু নয়। হয়তো নিহার অনেক ছোটর থেকেই ওর কল্পনার জগতে একটু একটু করে প্রবেশ করতে শুরু করেছিল কিন্তু আপনারা খেয়াল করেননি। আর আপনি তো বলেছেন ও নাকি রোম্যান্টিক নভেল পড়তে বেশি ভালোবাসতো যেটা আবার আপনি ভালোবাসতেন না!"


"হুমম…"


"আমার বিশ্বাস তাই তো এমন একটা জগৎ বেছে নিয়েছে যেটা আপনার অপছন্দের, এমন ধরণের একটা গল্প ওর কল্পনায় ওকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে যেটা আপনার অছন্দের। এইভাবেই হয়তো ও প্রতিবাদ করতে চাইছে ওর অবচেতনে। গোটা বিশ্ব জানে নার্সিসাস আর ইকোর মিলন কোনদিনও সম্ভব হয়নি, নার্সিসাস প্রত্যাখ্যান করেছিল ইকোকে। কিন্তু নিহারের গল্পটা এই কিংবদন্তীর থেকে খানিক আলাদা। নিহার ওর জগতে নার্সিসাস আর ইকোর মিলন ঘটাতে চায়, আর এটাই ওর প্রতিবাদের ভাষা।"


"হে ভগবান!!!"


"শান্ত হোন মনোতোষ বাবু, ভরসা রাখুন আমার ওপর। আমি আমার হান্ড্রেড পার্সেন্ট দিয়ে চেষ্টা করব নিহারকে সুস্থ করে তোলার…"


★★★★★




মিলন হবে কত দিনে?


বিছানায় শুয়ে আছে নিহার। শরীরটা ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। আসলে শরীরটা ক্লান্ত লাগছে নাকি মনটা ঠিক মতো বুঝতে পারেনা নিহার। ডাক্তারবাবু প্রত্যেকবার সিটিং দিয়ে যাওয়ার পরেই এমনটা লাগে নিহারের। ওরা কেউ বিশ্বাস করেনা নিহারকে, ওরা বলে নিহার নাকি পাগল হয়ে যাচ্ছে। সত্যিই কি তাই! সত্যিই কি নিহার পাগল হয়ে যাচ্ছে! কিন্তু তা কি করে সম্ভব, নিহারের স্পষ্ট মনে আছে চাঁদপুরের সেই বিকেল। ইকোর সাথে ওর আবার দেখা হওয়ার গল্প… নানা এসব মিথ্যে হতে পারেনা। ইকোর সাথে আগের জন্মে মিল হয়নি ঠিকই কিন্তু এ জন্মেও ইকো ওকে ঠিক অনুসরণ করে পৌঁছে গিয়েছে ওর কাছে। পাগলী মেয়েটা, শুধু কাঁদে, ভাবে ও কথা বলতে পারেনা বলে ওর নার্সিসাস ওকে প্রত্যাখ্যান করবে! পাগলী, তোমার নার্সিসাসের ভালোবাসা এতোটাও ঠুনকো নয়। 

নয়… নয়… নয়…

মনেমনে বলা শেষ কথাটা প্রতিধ্বনিত হতেই চমকে উঠল নিহার, "ইকো তুমি এসেছো!"

তোমার কাছে না এসে যাবো কোথায়…! ইকোর গলার স্বর ফোটে না, তবুও নিহার বোঝে ওর মনের কথা। বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায় নিহার। ঘরের অন্ধকার কোণটায় দাঁড়িয়ে আছে ইকো, চোখে তার কালো মেঘের জল। অভিমানী… 

এগিয়ে গেল নিহার, হাতটা তুলে সরিয়ে দিতে চাইল প্রিয়ার চোখের জল। অভিমানীনি প্রিয়া ছিটকে সরে গেল দূরে… ছুটতে থাকলো সে, নিহার ছুটল পেছন পেছন। সিঁড়ির ধাপে নুপুরের রিনরিন শব্দ তুলে চপল পায়ে ছুটল ইকো। নার্সিসাসের শিকারীর ক্ষিপ্রতাও যেন হার মেনে গেল তার চঞ্চল পায়ের কাছে। ইকোর পিছু ধাওয়া করে ছাদে পৌঁছালো নিহার। চাঁদটা আজ মুখ লুকিয়েছে মেঘের কোলে, ছাদটা যেন এক অনন্ত সমুদ্র। ইলিশেগুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে আজও। দু'হাত মেলে দিয়ে পায়ে পায়ে কিনারের দিকে এগোতে থাকলো নিহার, "কাছে এসো…"

"এসো… এসো… এসো…" ইকোর গলায় প্রতিধ্বনিত হল নার্সিসাসের স্বর। 

"এবার আর কেউ আমাদের আলাদা করতে পারবে না…" ব্যাকুল স্বরে বলে উঠল নিহার। এতক্ষণে মেঘ সরে হাসি ফুটলো ইকোর ঠোঁটে। শূন্যে নিজের শরীরটাকে ভাসিয়ে দিলো নিহার… সহস্রাব্দের অপেক্ষার পর আজ অবশেষে নার্সিসাসের বুকে পরম নিশ্চিন্তে মাথা রাখল ইকো। মিথ্যে এই দুনিয়ার ধোঁয়া হয়ে মিলিয়ে গেল ওদের জীবন থেকে…


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics