তিন্নির আঁকার
তিন্নির আঁকার
আমার আর জোর করলাম না ওকে।হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো তিন্নি । ও এ কয়েকটি দিন বেশ খুশি ছিলো। স্কুল খুলেছে এতোদিন পর। নিশ্চিত কাল কোন বন্ধুর সাথে ওর ঝগড়া হয়েছে তাই মেজাজ টা একটু আলাদা ওর। প্রত্যেক বাবা মায়ের স্বপ্ন থাকে তাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে । অনেক সময় বাবা মা তাদের অপূর্ণ স্বপ্ন গুলো চাপিয়ে দেয় ছেলে মেয়েদের ওপর। তখন ওদের শৈশব টা হারিয়ে যায়।
আমরা ওকে কোনো দিন চাপ দিই নি। যাতে ওর শৈশব টা যেনো নষ্ট না হয়ে যায় সেই জন্য। কারণ আমাদের বাবা মা তো আমাদের কোন দিন চাপ দেয়নি তেমন। হয়তো অর্থনৈতিক ভাবে বিশাল সফল হতে পারি নি , ঝোলে ভাতে দিন গুজরান হয়ে যাচ্ছে।
তবুও করোনা মহামারী এসে ওর জীবনের দুটো তিনটে বছর কেড়ে নিলো। যাইহোক এখন আবার সব স্বাভাবিক হয়েছে নতুন করে বাঁচবো আবার আমরা। ও খুব খুশি স্কুল খুলেছে। সব বন্ধুদের সাথে আবার দেখা হয়েছে।
আমরা বাঙালি আমাদের সাহিত্য সংস্কৃতি আমাদের চরিত্র ফুটিয়ে তোলে। অন্নপূর্ণা ঈশ্বরী পাটনীর কবিতা টা মনে আছে তো। সোনার নৌকা উপহার পেয়ে ও পাটনী বলেছিলো অতো ঐশ্বর্য এর দরকার নেই তার। একটু আশির্বাদ পেলেই যথেষ্ট তার সন্তান যেনো দুধ ভাতে থাকে। তাই সন্তানের খুশি থাকাটা আমাদের কাছে সবচেয়ে বড়ো পাওয়া ।
বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বন। নদী মাতৃক দেশ বাংলা, সহজেই জোগাড় হয়ে যাওয়া দু মুঠো মাছ ভাত পেটে দিয়ে , সারাবছর উৎসবে মেতে থাকতো বাঙালি এক সময়। রথের মেলা, ঝুলন গাজন, দোল উৎসব , সাথে আছে শিব রাত্রি, ইতুপূজা শিতলা পূজা আরো কতো শত ব্রত। এখন হয়তো , বাঙালি ঘরের মেয়েরা আর তেমন ব্রত ত্রতো করে না বারো মাসে তেরো পার্বণ আর দেখা যায় না।
তবে এবছরের কথাটা আলাদা । এ বছর বাড়িতে নববর্ষ উপলক্ষে উৎসব করবো আমরা। ইলিশ মাছ পান্তা নাহোক, সিরাজ এর বিরিয়ানি এনে সেলিব্রেটি করবো। তবে আমার মায়ের মতো গোপাল পূজা দেবে। বাইরে থেকে খাবার প্লানটা আমার ভাই আর ভাই এর বৌ এর। সারা বছর মেয়েরা রান্না করবে এ কেমন কথা। আসলে তিন্নি ও দিন স্কুলে , পাড়ায় অনেক কয়টা নাচের অনুষ্ঠান করবে। তবে আমরা কিন্তু এ বিষয়ে ওকে চাপ দিইনা । ওর মা ভালো নাচে। ওর থেকে ই ও সব কিছু শিখেছে। আঁকা টাও ওর মায়ের থেকে শেখে। তবে মাঝে মাঝে আমি দেখিয়ে দিই। দুঃখ একটাই ও ওর মায়ের সব কিছু নকল করে আমার কিছু নকল করে না। জীবনে একটা কবিতা আবৃত্তি করতে শুনলাম না ওকে। ওকে আমি কোনো দিন কিছু বলিনি ।
কিন্তু ওর মাকে একবার অভিযোগ করেছিলাম এ বিষয়ে। ওর মা বললো " গাছে কাক আমি অবাক এইতো তোমাদের কবিতা। ওসব পড়ে ও মজা পায় না তাই করে না , ও আঁকা টা শিখেছে কারণ ও দেখেছে , তোমাদের ফেলে দেওয়া জিনিস দিয়ে কিভাবে ওর মাম মাম ঘরটাকে সাজিয়ে রেখেছে। তোমার কবিতা আমাদের কোন কাজ আসে। বরং তুমি একটু আদর করে দুইজনকে কাছে ডাকলেই ও বলে , মাম আমি পালাই নিশ্চয়ই বাবাই কবিতা লিখেছে আর সেটা শোনাতে ই ডাকছে।"
ছোট খাটো খুনসুটি, মজা, ভাই ভাইএর বৌ, মা বাবা নিয়ে আমাদের যৌথ পরিবার । করোনা মধ্যে অনেক ঝড়ঝাপটা গেছে। আমি বিদেশে চাকরি করতাম , চাকুরী ছেড়ে এসে ছিলাম , ভাই জোর করে টিকিট কেটে নিয়ে বাড়িতে ফিরছিল আমাকে। ভাইয়ের চাকুরী গেছিলো তখন আবার ও সংসার টা চালিয়েছে ওর টাকায়। এখন সব ঠিকঠাক হয়ে গেছে তাই নববর্ষ উপলক্ষে সবার জন্য নতুন জামা কাপড় কিনে আনবো। তিন্নিকে নিয়ে যাবো বললাম কিন্তু ও সকাল থেকে আঁকার খাতা নিয়ে ব্যাস্ত কি একটা ছবি আঁকাবে বলে।
ফিরে এসে ওকে ওর জামা কাপড় প্যাকেটা উপহার দিতে । ও বললো আমাদের জন্য ও কাছে একটা উপহার আছে। ও একটা ছবি আঁকছে সুন্দর দুটি মুখে মাকস পড়া ছেলে মেয়ে হাত ধরে , বলছে নতুন করে ওরা বাঁচবে এই পৃথিবীতে। ও বললো এটা বাবাই , আর এটা মাম মাম।আমি বললাম " তুমি কোথায়? আর ফ্যামিলি মানেতো কাকাই তোমার ছোট মা, দাদাই, ঠাম্মি সবাই থাকবে "
ও বললো " আমি মরে গেলে, তোমরাও বেবি আনতে ঘুরতে যাবে , সেখানে কাকাইরা গেলে হবে নাকি। বিল্লুর যে বনু হয়েছে। ওর কাকা কাকিমা একা ঘুরতে গিয়েছে বলে না হয়েছে"
ওর মুখে পাক্কা কথা শুনে আমরা একটু চিন্তিত হয়ে গেলে ও , সবচেয়ে বেশি চিন্তা হলো মরার কথা শুনে। ওর মা ওকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞাসা করলো" তুমি মরবে কেন সোনা"
আবেগ নয় শিশু দের মনে সব প্রশ্নের সংশয়ের উঁত্তর দেওয়া উচিত আমাদের। তাই আমি জিজ্ঞেস করলাম " কি কারন তোর মনে হলো তুমি মারা যাবে বলো আমাদের"
ও বললো " তুমি সেই দিন মাইক্রো ওভেন এনে সবাইকে ফুড টেম্পারেচার নিয়ে বলছিলে। বলছিলে ৮ থেকে ৬৫ ডিগ্রী পর্যন্ত খাবার ডেনজার জোন এসময় খাবারে ব্যাকটেরিয়া জন্মায় তাই খাবার সব সময় ৭৫ ডিগ্রীতে গরম করে খেতে হয় । তখন আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম। মানুষের ক্ষেত্রে ডেনজার জোন আছে কিনা তখন তুমি বলেছিলে
৯৮.৬ ডিগ্রি এর বেশি বা কম হলে বুঝতে হবে গন্ডগোল। জ্বর মানে শরীর নিজে ব্যাকটেরিয়াদের সাথে ডিসুম ডিসুম করছে। আর তখন ওষুধ খেয়ে নিই আমরা আর সেরা যাই । কিন্তু আমার তো ৩৭ ডিগ্রি । আমি কি করে বাঁচবো।"
আমি ওকে থার্মোমিটার টা এনে দেখালাম " 37টা রয়েছে c ঘর। বললাম" ৯৮.৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট আসলে ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। একসাথে দুই জনেই থাকে একটা থার্মোমিটারে তোমার মাম মাম আর বাবাই মতো। কিন্তু দুই জনে পুরোপুরি আলাদা মানুষ , আমদের ভালো লাগা খারাপ লাগা এক নয় তবু একসাথে থাকি।"
ও সব কিছু বুঝতে পেরে খুব খুশী। নতুন বছরের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পরলো।
