susmIta Saha

Tragedy

2  

susmIta Saha

Tragedy

তিনি বৃদ্ধা তবু তিনি নারী

তিনি বৃদ্ধা তবু তিনি নারী

4 mins
745


"ভালোবাসা যত সহজ,ভালোবেসে যাওয়া ততটা সহজ নয়..."

তিনি বৃদ্ধা...তবু তিনি নারী... বৃদ্ধাটির বয়স তিরানব্বই। বড় শোওয়ার ঘরের উত্তরদিকের সিঙ্গলবেডে তার শয্যা। দক্ষিণ কোনায় আরেকটি সিঙ্গল বেড।সেখানে বৃদ্ধার সাতানব্বই বছরের স্বামী গত চার বছর ধরে ঘুমিয়ে আছেন।তাঁর একটি ভয়াবহ অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল।তারপরে প্রায় বছর দেড়েক তিনি নার্সিংহোমে ছিলেন৷ সে গল্প অন্য গল্প । আজকের বাস্তবটা এই যে-আজ বছর চারেক ধরে দক্ষিণের বিছানাটিতে বৃদ্ধ স্বামী ঘুমিয়ে আছেন...কোমায়।অন্যদিকে বৃদ্ধা তার নব্বই বছর বয়স পর্যন্ত ছিলেন অত্যন্ত কর্মঠ ও জীবনীশক্তিতে ভরপুর একজন মানুষ।পাড়াপ্রতিবেশী,আত্মীয়স্বজন সকলের অতি প্রিয় দিদা অথবা মাসীমা।বছর তিনেক আগে বৃদ্ধার সেরিব্রাল অ্যাটাক হয়,কয়েক মাসের ব্যবধানে পরপর তিনবার।সেই থেকে তাঁর শরীরের অর্ধাংশ সম্পূর্ণ অবশ,অচল...এবং তিনি বাকরুদ্ধ। তাঁর মস্তিষ্ক কতখানি কাজ করে,সঠিক বোঝা যায় না। আর 'মন' নামক বস্তুটি যে শরীরের ঠিক কোথায় থাকে...তা তো আজও জানা যায়নি ...। তাই বৃদ্ধার মনখারাপ হয় কি না...পুরনো কথা মনে পড়ে কি না... বা কখনো সখনো মন ভালোও থাকে কি না...সেসব কথা কিছুই গত তিন বছর ধরে আর বোঝার উপায় নেই। শুধু তাঁর চোখের মণি দুটি সারাদিনে তিনবার নড়ে ওঠে। নার্স এবং আয়ারা সে ভাষা বুঝতে পারে । বৃদ্ধ এবং বৃদ্ধা দুজনেরই চিকিৎসার কোনো ত্রুটি হয়নি। বর্তমানেও তাদের দেখাশোনার ব্যবস্থা অত্যন্ত উচ্চমানের। তাঁদের চার সন্তান। দুই পুত্র ও দুই কন্যা। চারজনই আমেরিকা ও ইওরোপ এর বিভিন্ন যায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকেন। তারা প্রত্যেকেই বিশেষভাবে সফল ও কৃতী। চার সন্তানই পিতামাতার স্বপ্ন সার্থক করতে পেরেছে। বৃদ্ধ বৃদ্ধা তাঁদের নিজেদের যৌবনের শ্রেষ্ঠ সময় , জীবনীশক্তি ও অর্থব্যয় করেছিলেন সন্তানদের ঠিক এইরকমই সফল দেখার জন্য । বৃদ্ধ বয়সে কাছে না থাকার জন্য পিতামাতা কখনো সন্তানদের দোষী করেননি বা মনে কোনো অভিমানও পুষে রাখেননি । আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীরা অনেক সময় ছেলেমেয়েদের অপরাধবোধ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তারা বোঝেননি ,এই স্তরের কৃতী মানুষদের অতিকষ্টে অর্জিত বিদ্যার সফল প্রয়োগের সুযোগ আমাদের দেশ বহু ক্ষেত্রেই দিতে পারে না। এ এক নিষ্ঠুর বাস্তব সত্য । যাইহোক ,পিতামাতার অবশ্য এই ব্যপারে কোনো ক্ষোভ নেই। তাঁরা তাদের সন্তানদের ঠিক এমনভাবেই দেখতে চেয়েছিলেন । চার ভাইবোন প্রতিবছরই পালা করে এসে বাবা মায়ের কাছে থেকে যায় ।অর্থাৎ বছরের প্রায় বেশির ভাগ সময়ই কোনো এক সন্তান কাছে থাকেন । বিদেশী মুদ্রার সহযোগিতা থাকায় আয়া,নার্স ও সবসময়ের কাজের লোকের ভারি সুবন্দোবস্ত করা হয়েছে।বর্তমানে কাজের লোকরাই এই বাড়ির কত্রী। তিন কামরার বড় ফ্ল্যাটে বৃদ্ধ-বৃদ্ধার শোওয়ার ঘরটি বেশ প্রশস্ত। দুটি বিছানারই মাথার কাছে দুটি টেবিল, সেখানে তাঁদের ওষুধপত্র ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিষ সাজানো থাকে । "বৃদ্ধার চোখের মণি দুটি সারাদিনে ঠিক তিনবার নড়ে ওঠে" প্রথমবার...একেবারে ভোরবেলা,যখন তাঁকে বেডপ্যান দেওয়া হয়। বৃদ্ধার বয়স তিরানব্বই...তবু তিনি নারী। প্রাতঃকৃত্যর কাজটি তিনি আজও স্বামীর সামনে করতে পারেন না। বড় লজ্জা করে। বৃদ্ধার চোখের মণি দুটি নড়েচড়ে চঞ্চল হয়ে ওঠে । তাঁর দৃষ্টি যায় দুটি বিছানার মাঝে সরিয়ে রাখা পর্দাটির দিকে ...। নার্স ,আয়ারা প্রথম প্রথম রসিকতা করতো। তারা নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করে বলতো-"দিদার এখনও দাদুর সামনে লজ্জা করে ,ঘুমিয়ে থাকা দাদুর সামনে "। ক্রমশঃ তারাও বুঝে গিয়েছে ,ওই সময়ে পর্দাটি টেনে না দিলে দিদার প্রাতঃকৃত্য সম্পন্ন হবেনা । বৃদ্ধাকে ভোরবেলাতেই গা মুছিয়ে স্নানের মত কাজটি করিয়ে দিতে হয়। এটাও তাঁর দীর্ঘদিনের অভ্যাস। এটিও তিনি বদলাতে পারেননি। স্নান শেষ হলেই "দ্বিতীয়বার তাঁর চোখের মণি দুটি নড়ে ওঠে।" বৃদ্ধার দৃষ্টি চলে যায় টেবিলের উপরে রাখা বহু প্রচীন সিঁদুর কৌটোটির দিকে। নারীর মজ্জায় মিশে যাওয়া অভ্যাস...সংস্কার। ঘুমন্ত স্বামীর নামের সিঁদুরটি দিদার সিঁথিতে পরিয়ে দিতে হয় আয়া মেয়েটিকে । একদিনও এই নিয়মের ব্যতিক্রম হওয়া চলবেনা । রুটিনের মত দিন চলতে থাকে । বিকেল, সন্ধ্যা আর রাতের পার্থক্য বৃদ্ধ-বৃদ্ধা বোঝেন কিনা কে জানে ?একজন ঘুমিয়ে থাকেন , অপরজন বাকরুদ্ধ । তবুও ...তবুও বৃদ্ধার চোখের মণিদুটি সারাদিনের শেষে "তৃতীয়বার"নড়ে ওঠে। প্রতিদিন মণি দুটি অস্থির,চঞ্চল হয়ে ওঠে তাঁর রাতের খাওয়া শেষ হওয়ার পরে। সারাদিনে ঠিক এই একটি সময় বৃদ্ধার চোখ চলে যায় পাশের বিছানাটির দিকে...তাঁর স্বামীর দিকে ...। বৃদ্ধার কি তখন মনে পড়ে যায় তার যুবক স্বামীর সেই যৌবনময় দিনগুলোর কথা ?কত আদর,ভালোবাসা...কত অভিমান...শরীরের সেই উদ্দাম খেলা... কে জানে...কিছুই বোঝা যায় না। বৃদ্ধার মস্তিষ্কে স্মৃতির আর কোনো ভূমিকা আছে কি না কেউ জানে না ,কেউ বোঝেনা । প্রশ্ন করেও জানার উপায় নেই ...তিনি কোনোদিনই আর কথা বলবেন না ... শুধু এই সময়টায় প্রতিদিনই বৃদ্ধার চোখের মণিতে থাকে এক গভীর আর্তি ,এক নীরব প্রার্থনা। যেন তিনি তাঁর জীবনসঙ্গীকে বলার চেষ্টা করছেন-"তুমি থাকো...শুধু থাকো,এমনভাবেই থাকো...আমাকে একলা ফেলে রেখে চলে যেওনা ..." গতকাল সন্ধ্যায় বৃদ্ধ স্বামী চিরনিদ্রার দেশে চলে গিয়েছেন। এ তো ছিলো অমোঘ...অবশ্যম্ভাবী । নার্স,আয়াদের কাছে ফোন নম্বর দেওয়াই ছিলো। তারা বিদেশে দাদা দিদিদের খবর দিয়ে দিয়েছে। পাড়া প্রতিবেশী,আত্মীয় স্বজনরাও খবর পেয়ে আসা যাওয়া করছে। ছেলেমেয়েরাও দু একদিনের মধ্যেই সবাই এসে পরবে। তাদের জন্য পাড়ার লোকরাই ব্যবস্থা করে বৃদ্ধের দেহটিকে পিস্ হেভেনে রেখে আসার ব্যবস্থা করেছে । বৃদ্ধাকে আলাদা করে বলার আর কিছুই নেই । তাঁর শোক,দুঃখ কিছুই আলাদা করে বোঝা যায় না । শুধু তাঁর চোখের মণি দুটি একেবারে স্থির হয়ে গিয়েছে...গতকাল সন্ধ্যা থেকে তারা আর একবারও নড়ে ওঠেনি ...


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy