susmIta Saha

Inspirational

3  

susmIta Saha

Inspirational

বন্দনারা বেঁচে থাকুক

বন্দনারা বেঁচে থাকুক

5 mins
674


(আশেপাশের অনেক মানুষকে দেখে মাঝেমাঝেই শ্রদ্ধায় মাথা অবনত হয়ে আসে। আমার সীমিত ক্ষমতায় লিখতে ইচ্ছে করে তাদের কথা। আজ বেছে নিলাম বন্দনাকে ...)


কথায় কথায় হেসে গড়িয়ে পড়তো তরুণীটি । একেবারে প্রায় সব কথায়। যে প্রশ্নই করা হোক্ না কেন, গালভর্তি হাসিই ছিল ওর একমাত্র জবাব। খুশিতে ওর চোখদুটোও চকচক করতো...প্রায় সব সময়...বিনা কারণেই । কথপোকথনে ভাষাগত একটা সমস্যা তো ছিলই। আমার ভাষা বাংলা, , টুকরো ইংরেজি, ভাঙ্গা হিন্দী। ওর অস্ত্র কন্নড় আর মারাঠি। আমি কি প্রশ্ন করতাম-সে শুধু আমিই বুঝতাম। আর ও যে কি জবাব দিতো সেটা বুঝতো শুধু ও নিজেই । আমাদের দুজনের মধ্যে যোগসূত্রটা ছিল বন্দনার মুখের ওই ভুবনজয়ী হাসিটুকু। ওর এই স্বভাবমাধুর্য্যের কারণেই বড্ড ভালোবেসে ফেলেছিলাম সাহায্যকারিণী মেয়েটিকে । ভাষার ব্যবধানকে দূরে সরিয়ে আমার স্নেহের উত্তাপ সেও বোধহয় ঠিক টের পেত । এইসব গল্প দশ বছর আগেকার কথা। স্বামীর কর্মসূত্রে তখন সদ্য পুণেতে এসেছি। একটি মানুষকেও চিনি না। তবে বাড়ির কাজকর্মে সাহায্য করার জন্য একজনকে তো চাইই । আমাদের বিল্ডিং এর ওয়াচম্যান যোগাড় করে দিয়েছিলো বন্দনাকে। প্রথম আলাপে ও নিজের নাম বলেছিলো "ভন্দনা"। আমি আমার মতো করে বন্দনাই ডাকলাম। মেয়ের তাতেও সে কি গড়িয়ে পড়া হাসি। বন্দনার বয়স তখন চব্বিশ কিম্বা পঁচিশ হবে। দক্ষিণ পশ্চিম ভারতের গ্রামের মেয়ে...ওর বিবাহিত জীবনের বয়স তখনই প্রায় দশ। এবং ততোদিনে তিনটি শিশু সন্তানের জননী ও। উদয়াস্ত পরিশ্রম করেও মেয়েটির মুখের হাসিটি অমলিন। ওর স্বামী বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন সাইটে মজদুরের কাজ করে। অভাবী সংসারে খুশির কিন্তু কোনো অভাব নেই। অচেনা পরবাসে সেই শুরুর দিনগুলোতে এই বন্দনার সাথেই আমার যা কিছু একটু কথা বলার সুযোগ হতো। সেই দিনটা ছিল শনিবার। আমার বাড়ির সব কাজ সেরে বন্দনা এবার চলে যাবে। ও যেন একটু তাড়াহুড়োই করছিল সেদিন । কিন্তু টুকটাক গল্পগুজব না করে মুখ বুঁজে যে মেয়েটা কাজ করতে পারেনা । ঘর মুছতে মুছতে বন্দনা আমাকে প্রশ্ন করলো(ওর সেই বিচিত্র ভাষায়)-"দিদি, আজ তো শনিবার...বেড়াতে যাবেনা তুমি আজ দাদার সাথে? সিনেমা দেখতে যাবে না কি ?"- আমিও একটু দুষ্টুমি করে উত্তর দিলাম-"কেন রে...শনিবার হলেই বুঝি সিনেমা দেখতে যেতে হয় ? তুই যাচ্ছিস না কি আজ বরের সাথে? " প্রশ্ন শেষ হতে না হতেই একেবারে হেসে গড়িয়ে পড়লো তরুণীটি। ওর বক্তব্য-"হ্যাঁ তো শনিবার বলে কথা"। টেনে টেনে...যেন আবেশে জড়িয়ে ও বলেই চললো- "আজ আমরা পাঁচজনে মিলে মুভি যাবো...বাইরে খানা খাবো, বাচ্চাদের বেলুন কিনে দেবো...আজ আমাদের খুশির দিন । আমার মরদও আজ জলদি জলদি কাজ সেরে বাড়ি ফিরে আসবে বলে দিয়েছে"। ভারি ভালো লাগলো আমার বন্দনার চোখেমুখে এই ছোট্ট সুখের ছবিটুকু দেখে। তাড়াতাড়ি কাজ সেরে সেদিন বাড়ি চলে গেল বন্দনা... আমরা পুণেতে যে পাড়ায় থাকি, সেটা একেবারে নূতন পাড়া। চারিদিকে শুধুই কনস্ট্রাকশনের কাজ চলছে। গড়ে উঠছে নূতন সব হাই-রাইজ বিল্ডিং...নূতন বসতি। ছুটির দিনে বিকেলে স্বামীর সাথে হেঁটে গোটা সপ্তাহের বাজার সেরে রাখা আমাদের বহুদিনের অভ্যাস। সপ্তাহ জুড়ে ব্যস্ততায় সময়াভাব তো থাকেই। সেই শনিবার বিকেলেও সেরকমই হাঁটছিলাম। খেয়াল করলাম পাড়ার সব দোকানেই ভেসে বেড়াচ্ছে একটা খবর। "কাছেই একটি নির্মীয়মান বিল্ডিং এর এগারো তলা থেকে নীচে পড়ে গিয়ে সেদিনই দুপুর আড়াইটে তিনটের সময় মারা গিয়েছে একজন মজদুর"।খুব খারাপ লেগেছিল খবরটা শুনে । আহা রে কাজ করতে গিয়ে গরীব ঘরের একটি মানুষের এমন অকালমৃত্যু। তবে এরকম কত দুর্ঘটনা তো ঘটেই থাকে। অতএব খারাপ লাগার থেকে বেশি আর কি গুরুত্ব দেবো। যাইহোক্ বাজার টাজার সেরে সন্ধ্যাবেলা বাড়ি ফিরে এসেছিলাম। পরের দিন বেলা যখন প্রায় এগারোটা পেরিয়ে গেল, তখন আমার টনক নড়লো। বন্দনা তো এত দেরি কখনও করেনা। একেবারে ঘড়ি ধরে ওর কাজ। সাত বাড়িতে কাজ করে মেয়েটা। তখনও প্রতিবেশীদের সাথে খুব ঘনিষ্ঠতা আমার হয়নি। তবুও বন্দনার দেরির কারণ জানার জন্য একে অপরকে ফ়োনাফুনি তো করতেই হয়। সেভাবেই জানতে পারলাম দুঃসংবাদটি। ঠিক কতটা ধাক্কা লেগেছিল সেটা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবোনা... চার পাঁচজন প্রতিবেশিনীর সাথে পৌঁছে গিয়েছিলাম বন্দনার বাড়িতে। ঠিক দুঃখ নয়...শোক নয়...সে অনুভূতি অবর্ণনীয় । একগাল হাসিবিহীন বন্দনাকে আমি সেদিন চিনতে পারিনি। সে যেন এক অন্য মানুষ। বাকরুদ্ধ আমি কোনো স্বান্তনাও দিতে পারিনি। এরপরেও বেশ কয়েকদিন গিয়েছি বন্দনার বাড়িতে। ওর স্বামী যে বিল্ডার এর অধীনে কাজ করতো, তারা খুব দ্রুত দেড় লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। মহারাষ্ট্রের প্রমোটার বিল্ডার্সরা এতটাই প্রতিপত্তি ও বিত্তশালী এবং তারা আন্তর্জাতিক স্তরে এমন সব খেলায় ব্যস্ত থাকে যে এইসব ছোটখাটো খরচে ওরা কোনো দেরি বা ঝামেলায় যায়না । মাত্র পনেরো দিনের মধ্যেই সব ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছিল। শুধু একদিন নিজের অন্ধকার ঘরে বসে নতমুখে বন্দনা জানালো- "যে লোকদুটি বিল্ডার এর দেওয়া চেকটি পৌঁছে দিতে এসেছিলো গত সন্ধ্যায়...ওরা কাল সকালেও একবার এসেছিল। বন্দনাকে বলে গিয়েছিল ভালো করে মুরগীর মাংস রান্না করে রাখতে।" সন্ধেবেলা দারুর বোতল অবশ্য ওরা নিজেরাই সঙ্গে এনেছিলো। আমি মৃদুস্বরে প্রশ্ন করেছিলাম- বন্দনা মাংসের ব্যবস্থা করেছিল কি না? মুখ না তুলে বন্দনা চুপ করে বসেছিল। সেই সন্ধ্যায় আর কি ঘটেছিল - সে প্রশ্ন করার সাহস আমার হয়নি। হয়তো বন্দনার জবাবের মুখোমুখি হওয়ার মতো মনের জোর আমার ছিলনা। সদ্যবিধবা পঁচিশবছরের তরুণীটি পাথর প্রতিমার মতো বসে ছিল...কোল ঘেঁষে ওর তিনটি শিশু সন্তান। আমি আক্ষরিক অর্থে সেখান থেকে পালিয়ে এসেছিলাম । নাঃ, তিনটি নাবালক সন্তানকে নিয়ে একা বন্দনার পক্ষে পুণে শহরে আর বেশিদিন থাকা সম্ভব হয়নি। বড় অসহায় সে জীবন । বন্দনা ফিরে গিয়েছিল ওর গ্রামের বাড়িতে ...লাটুরে। সময়ের মনে সময় কেটেই যায়...। দেখতে দেখতে কেটে গিয়েছিলো আরও দুটো বছর। স্মৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই বন্দনার কথা আমার মনে কিছুটা ফিকে তো হয়েই ছিল। তারপর হঠাৎ একদিন বেলা দশটা নাগাদ বাড়ির কলিংবেলটা বেজে উঠলো। দরজা খুলে এক চমক। সদরে দাঁড়িয়ে আছে বন্দনা...। বড় কৃশ মলিন চেহারা। সাথে তিনটি সন্তান, বেশ মাথায় লম্বা হয়েছে তারা, একটু বড় বড় ভাব। অসহায় দৃষ্টি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মায়ের আঁচল ধরে। বন্দনার জীবনের এই দুটি বছরের ইতিহাসও খুব চেনা গল্প। ঠিক এরকমই তো হয়... বন্দনাকে রেহাই কেউ দেয়নি, কেউ দেয়ও না। ওর শ্বশুর, ভাশুর, দেওর এমন কি বাপেরবাড়িতেও ভাই, দাদা, দিদি জামাইবাবুরা ওর দেড় লক্ষ টাকার ভাগ নিয়েছে । সেই সাথে আর কী ? জানিনা এবারেও জানতে চাওয়ার সাহস হয়নি। বাস্তবের মুখোমুখি হওয়া বড় কঠিন। তবুও আবার নূতন করে জীবন শুরু করতে চায় বন্দনা। ও ওর পুরোনো কাজগুলো ফিরে পেতে চায়। আর কোনো পথ যে জানা নেই ওর। প্রতিবেশিনীদের সাথে আলাপ আলোচনা এবং বন্দনার অনুপস্থিতিতে যারা কাজ করছিলো তাদের সাথেও কথা বলে সকলে মিলেই বন্দনার জন্য কাজের ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়েছিল। কিছুদিন সময় তো লাগবেই, তবুও শেষ পর্যন্ত বন্দনা আবার ফিরে এসেছিল আমাদের মধ্যে এবং আজও আমাদের সাথে আছে। দেখতে দেখতে তারপরেও কেটে গিয়েছে আরও অনেকগুলো বছর। প্রায় বছর পাঁচেক তো হবেই। চোখের সামনে দেখলাম পিছিয়ে পড়া দলিত সমাজের এই শ্যামলা মেয়েটির লড়াই। ছেলেমেয়েদের স্কুলে পড়ানোর ব্যবস্থা করেছে বন্দনা , ধীরে ধীরে ওদের স্বাবলম্বী করে তুলছে। সব থেকে বড় কথা বন্দনা এখন আবার সেই কথায় কথায় হেসে গড়িয়ে পড়ে। খুশিতে চোখদুটো আজকাল চকচক করে ওর । মনখারাপের কথা একদিনও বলেনা মেয়েটা। আগে বড্ড স্নেহ করতাম বন্দনাকে , আজকাল মনে মনে বড় শ্রদ্ধা করি ওকে এবং ওর লড়াইকে । প্রতিনিয়ত প্রার্থনা করি- "বেঁচে থাক্ বন্দনা...বেঁচে থাকুক বন্দনারা...ওদের মুখের হাসি অমলিন থাকুক ...আলোয় ভরে উঠুক ওদের জীবন ...হ্যাপি উইমেনস্ ডে "


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational