অস্তিত্বের নিরাপত্তা
অস্তিত্বের নিরাপত্তা


এক আচ্ছন্ন ঘোর লাগা অবস্থা।ভারি চোখের পাতাদুটো টেনে খুলতে খুলতে তার মনে হলো-যেন তিনি গত জন্মের সফর সেরে ফিরছেন ...।তিনি কে ?এটা কোন্ জায়গা ?এখন কোথায় ?স্মৃতি-বিস্মৃতির ঠিক মধ্যবিন্দুতে ভাসছেন... ঘরের দেওয়ালগুলো হাল্কা সবুজ,জানালার ভারি পর্দাগুলোও।কীটনাশক,ওষুধপত্র...সব মিলেমিশে একটা আধা চেনা গন্ধ ভেসে আসছে...। 'কিসের গন্ধ যেন এটা ?কোথায় যেন এই গন্ধটা পাওয়া যায়?'-মনে পড়েও পড়ছে না...।তিনি একবার তলিয়ে যাচ্ছেন...একবার ভেসে উঠছেন ।ঘরটা ঠান্ডা...শীতাতপনিয়ন্ত্রিত। মাথাটা কেমন টলমল করছে।চোখদুটো জোর করে পুরোপুরি খুলে একটু চারদিকটা তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করলেন তিনি।ঘরের একদিকে কয়েকটা যন্ত্রপাতি।আগে দেখেছেন এরকম ?কোথায় ?ঠিক মনে পড়লো না।হঠাৎ চোখ আটকে গেলো দরজার ওপরে একটি লেখার দিকে..."রিকভারি রুম"।তিনি ইংরেজী ভাষায় লেখা শব্দদুটি পড়তে পারলেন।একটু একটু করে কিছু কথা তার মনে পড়তে শুরু করলো।যেন পূর্ব জন্মের স্মৃতি হাতড়ানো।ধীরে ধীরে অ্যানেসথেশিয়ার ঘোরটা কাটছে... মাস দুয়েক আগের কথা।কলকাতা থেকে সুমিত্রাদেবী এসেছিলেন মেয়ে সুলগ্নার কাছে বেঙ্গালুরুতে।এসেছিলেন মানে-মেয়েজামাই সুলগ্না আর মাধবন্ জোর করে তাকে কাছে আনিয়ে ছিলো।সুমিত্রার শরীরটা তার কিছুদিন আগে থেকেই বিশেষ ভালো যাচ্ছিল না।পেটের একদিকে একটা চিনচিনে ব্যথা,মাঝেমাঝেই গা-বমি ভাব,অল্পস্বল্প জ্বর।প্রথম প্রথম তিনি নিজে খুব একটা গুরুত্ব দেননি।কিন্তু প্রবাসী মেয়ে রোজ দুবেলা নিয়ম করে মায়ের খবর নেয়।বাবার মৃত্যুর পর থেকে মা কে ভালো রাখার সব দায়িত্ব যেন ওরই।কর্মসূত্রে দূরে থাকতে হয় ঠিকই,কিন্তু খোঁজখবর নেওয়া,কলকাতার বাড়িতে মায়ের ভালো থাকার সবরকম ব্যবস্থা বড় যত্নের সাথে দূর থেকেই করে ওরা।তাছাড়া বছরে দুবার তো সুমিত্রা বেঙ্গালুরুতে চলেই আসেন।মেয়েজামাইও কলকাতা ঘুরে যায় একবার দুবার। যাইহোক টেলিফোনেই কোনো এক সময় মেয়ের কাছে শারীরিক অস্বস্তির কথাটা বলে ফেলেছিলেন সুমিত্রাদেবী।ব্যস্ আর যাবেন কোথায় ?মেয়ে আর কোনো কথাই শুনবে না...মা কে বেঙ্গালুরুতে নিয়ে এসে ভালো ডাক্তার দেখিয়ে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে ওরা।জামাই মাধবনও বড় নরম স্বভাবের দায়িত্ববান ছেলে।সেও নাছোড়বান্দা।জামাইটি একবর্ণও বাংলা বলতে পারে না ,যদিও তাতে শাশুড়ির প্রতি শ্রদ্ধা বা মমত্ব জানাতে কোনো অসুবিধা হয়না।সে তো ফোন করে সোজাসুজি বলে দিলো-"মম্ ,আই অ্যাম সেন্ডিং ইয়োর এয়ার টিকিট...কামিং স্যাটারডে ইভনিং ইউ আর হিয়ার...প্রিপেয়ারিং মাই ফেভারিট ডিশ"... ব্যস্ ,এরপরে আর 'না'বলার কোনো উপায় রইলো না।বেশ কয়েকদিনের মতো প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে সুমিত্রা পৌঁছে গেলেন বেঙ্গালুরুর ইন্দিরানগরে মেয়ে জামাইএর কাছে।মাঝেমধ্যেই আসেন তিনি।গত কয়েক বছর ধরে নাতি রেহানের টানে তো আসতেই হয়... মন্দ লাগেনা শহরটা তার।আবহাওয়াটি চমৎকার।অন্তত কলকাতার দুর্বিষহ গরম,প্যাচপ্যাচে বর্ষা আর ভেজা ঠান্ডার থেকে তো অনেকটাই বেশি আরামদায়ক।মা কে বা দিদাকে পেয়ে ওরাও ভারি খুশি হয়।সুমিত্রাদেবীও মনের সুখে কটা দিন ওদের রান্না করে খাওয়ান।সন্ধ্যাগুলো জমাটি আড্ডায় কেটে যায়। শুধু দিনের বেলা বড্ড ফাঁকা লাগে।মাধবন ও সুলগ্না দুজনেই আই.টি সেক্টরে বেশ উঁচুপদে কাজ করে।রেহানও এখন স্কুলে যায়।ঠিকে কাজ করতে আসে একটি দক্ষিণী মেয়ে-'ভন্দনা'।প্রথমদিন সুমিত্রা তাকে আদর করে বন্দনা বলে ডাকতেই,সে তো হেসেই গড়িয়ে পড়লো।মেয়েটা লক্ষী।কিন্তু গল্পসল্প করার উপায় নেই।অফিসে বেরোনোর আগে সুলগ্নাই ওকে কাজটাজ সব বুঝিয়ে দিয়ে যায়।ও মেশিনের মতো কাজ করে।কোনোদিন নূতন কোনো কাজের নির্দেশ দিতে হলে নিজের ভাঙা ইংরেজী,ভাঙা হিন্দী নিয়ে সুমিত্রার একেবারে বেহাল অবস্থা হয়। আশেপাশের প্রতিবেশীদের সাথেও এই এক অবস্থা।সবাই বেশ ভালো।কিন্তু ভাষার কারণেই কারুর সাথে সেরকম আলাপপরিচয় গল্পগুজব করা যায় না।বেড়াতে এসে এই সময়গুলোতে সুমিত্রার একটু মনকেমন করে।নিজেকে যেন ছিন্নমূল পরবাসী মনে হয় ... যাইহোক্ এখানে আসার পরে সুলগ্না মা কে বেশ বড় হসপিটালে নামী ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়।ডাক্তার অভয় দিয়ে বলেন যে খুব ঘাবড়ে যাওয়ার মতো কিছু ব্যাপার নয়।তবে সুমিত্রাদেবীর প্রায় গল্ ব্লাডার ঘেঁষে একটি টিউমার মোটামুটি টেনিস বলের আকার নিয়েছে।যেটাকে অপারেট করে বের করে ফেলাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।অতএব সার্জারি ছাড়া গতি নেই। গত দিন পনেরো ধরে চলেছে হাজার রকমের পরীক্ষানিরীক্ষা।অবশেষে সকলের সুযোগসুবিধা দেখে আজ সকালেই অপারেশনপর্বটি সাঙ্গ হয়েছে। সুমিত্রাদেবীকে খানিকক্ষণ আগেই নিয়ে যাওয়া হয়েছে 'রিকভারি রুমে'। অ্যানেসথেশিয়ার ঘোরটা ধীরেধীরে কাটছে...সুমিত্রার শরীরটা বড় অস্থির লাগছে।একবুক তৃষ্ণা না কি গা টা গুলিয়ে উঠলো?বমি হবে না কি ?খেয়াল ছিলো না ...হাতে নল লাগানো ...উঠে বসার চেষ্টা করতেই ,কেমন যেন ভারি বোধ হলো।বসা তো দূরের কথা...সুমিত্রাদেবী নড়তেই পারলেন না।বড় অস্থির লাগছে। ধারেকাছেই ছিলো নার্সটি।সে এগিয়ে এসে মিষ্টি হেসে সুমিত্রাদেবীর গায়েমাথায় হাত বুলিয়ে দিলো,ইংরেজীতে জিজ্ঞেস করলো কি অসুবিধা হচ্ছে?সুমিত্রাদেবী কিছু বলতে পারলেননা...জিভটা কেমন যেন জড়িয়ে গেলো। সুমিত্রাদেবীর ছটফটানি লক্ষ্য করে নার্সটি তাড়াতাড়ি ডেকে নিয়ে আসলো তরুণ ডাক্তারবাবুকে।ভারি সৌম্যদর্শন ডাক্তারটি।এই কদিনে সুলগ্নাদের সাথে ভালোই আলাপ পরিচয় হয়ে গিয়েছে তার।এ রাজ্যেরই ছেলে...তার ভাষা কন্নড়।অত্যন্ত যত্নসহকারে সুমিত্রাকে পরীক্ষা করতে করতে তিনিও ইংরেজী ভাষায় অনেক প্রশ্ন করলেন পেশেন্টকে।ছেষট্টি বছর বয়সের সুমিত্রা মোটেই অশিক্ষিত নন্।প্রশ্নগুলো তিনি বুঝেছেন।কিন্তু তার অবসন্ন,অর্ধচেতন মস্তিষ্ক ইংরেজিতে অনুবাদ করে কিছুই বলতে পারলো না।তার শরীরের ভেতরে যে ঠিক কি হচ্ছে ...কি ভাবে বোঝাবেন তিনি ... এরই মধ্যে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষেরঅনুমতি নিয়ে জামাই মাধবন একবার ভেতরে এলো এবং পরম মমতায় শাশুড়ি মায়ের হাতটা নিজের হাতে নিয়ে বললো-"ডোন্ট ওরি মম্,অপারেশন ইজ সাকসেসফুল ...ইউ আর পারফেক্টলি অল রাইট"।সে আরও জানালো (অবশ্যই ইংরেজিতে)-সুলগ্না এতক্ষণ ও.টি.র বাইরেই ছিলো,ডাক্তারের সাথে কথা বলে এইমাত্র রেহানকে স্কুল থেকে আনতে গিয়েছে। সত্যিই মেয়েজামাই এর দায়িত্ব,কর্তব্যবোধের কোনো তুলনা হয় না ...কিন্তু সুমিত্রার দুচোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো কয়েক ফোঁটা অশ্রু।তার মনটা কেঁদে উঠলো আট বছর আগে চলে যাওয়া স্বামী পরিতোষের জন্য।আজ সে পাশে থাকলে ... সুমিত্রার বড্ড শীত করছে।কেউ যদি এ.সি.টা একটু কমিয়ে দিতো,অথবা তার গায়ে জড়িয়ে দিতো আর একটু ভারি একটা কম্বল।কি যে একটা কষ্ট হচ্ছে...অদ্ভুত একটা কাঁপুনি।মাথাটা আবার টলমল করছে...।নাঃ,অনুবাদ করে আর কিছুই বলা হলো না রোগিনীর .... কষ্টটা ক্রমশঃ বাড়ছে ...চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে সুমিত্রার...বাংলায় ...বলতে চাইছেন তিনি অনেকগুলো যন্ত্রণার কথা মাতৃভাষায় ...কিন্তু... ক্লান্তিতে চোখদুটো আবার জড়িয়ে আসছে।এত সুন্দর হাসপাতাল,এত যত্ন...মায়াদয়ারও কোনো অভাব নেই...তবুও কেন এমন উত্তাপহীনতা টের পাচ্ছেন সুমিত্রা ?এই নিরাপত্তার অভাববোধ কিসের জন্য ? স্মৃতির কি অদ্ভুত খেলা...গভীর ঘুমের মধ্যে তলিয়ে যেতে যেতেও সুমিত্রার ক্লান্ত মস্তিষ্ক জুড়ে ভাসতে লাগলো সেই কোন শৈশবে পড়া একটা গল্প ..."এক নিরুপায় কুমারী মা এক শীতের রাতে তার সদ্যোজাত শিশুকন্যাটিকে কম্বলে জড়িয়ে নিঃসন্তান এক দম্পতির সদর দরজার সামনে ফেলে রেখে যান।পরদিন সকালে সেই দম্পতি শিশুটিকে বুকে তুলে নিয়ে আশ্রয় দেন ও বড় আদরে মানুষ করতে থাকেন।"- আসল গল্প সেটা নয়... শিশুটি যত বড় হতে থাকে,একটি অদ্ভুত ব্যাপার তার পালক পিতামাতা লক্ষ্য করতে থাকেন-"মেয়েটির যখনই মনখারাপ হয়...দুঃখ হয় ,সে ছুটে চলে যায় তার সেই পুরোনো ছেঁড়া কম্বলটার কাছে।সেই প্রথমদিন থেকেই কম্বলটা না জড়ালে ও ঘুমাতে পারতো না...আজও ওই কম্বলটাই যেন ওর শেষ আশ্রয় ...ও কি সেখানে টের পায় ওর মায়ের উত্তাপ ?" হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে ছেষট্টি বছরের সুমিত্রার আজ প্রথমবার মনে হলো -"মাতৃভাষাই একজন মানুষের সবথেকে বড় আশ্রয়...তার অস্তিত্বের নিরাপত্তা।ঠিক মায়ের মতো মাতৃভাষার মধ্যে লুকিয়ে থাকে যে উত্তাপ ...তার কোনো বিকল্প হয় না"।