susmIta Saha

Inspirational

3  

susmIta Saha

Inspirational

হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি

হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি

10 mins
1.3K


সে ছিল এক বইএর জগতের মেয়ে।বাস্তবটা যেন বুঝতেই পারতো না।শৈশব থেকেই বাবার উৎসাহে গল্পের বই পড়তে পড়তে...বইএর পাতায় লেখা সবকটি কথাকেই একেবারে ধ্রুবসত্য বলে মনে হত তার। বাবামায়ের সুশিক্ষা থেকে ও জেনেছিল -বয়োজ্যেষ্ঠ হলেই তাঁরা প্রায় ভগবানের মতই হ'ন। শ্বশুর-শাশুড়ি হলেন দ্বিতীয় পিতামাতা,বন্ধু মানেই তারা এককথায় হৃদপিন্ডটা উপড়ে দিতে পারে। ঘরের দেওয়ালে টাঙ্গানো জ্যাঠাইমা কাকীমার হাতে লেখা-'পতি পরম গুরু' কি কখনও মিথ্যা হতে পারে? ভাগ্যটাও মোটামুটি সহায় ছিল।

শৈশব কৈশোরের দিনগুলো এইসব বিশ্বাসটিশ্বাস নিয়ে দিব্যি কেটে গেল।কিন্তু তারপরের অভিজ্ঞতাগুলো...যাক্ গে সেসব কথা। বরং বিখ্যাত কবির কবিতার চারটে লাইন এখানে লিখে ফেলা যাক্- "কৈশোর পেরুতে না পেরুতেই স্বর্গ মুছে যায়... ঝলসায় বড় বেশি রোদ,চচ্চড় করে পুড়তে থাকে চামড়া... সহজ পথগুলো জটিল হয় ক্রমশঃ... ঈশ্বরও টালমাটাল হয়ে পড়ে চার্বাক দর্শনে অথবা মার্ক্সবাদে" রোদ্দুরে পুড়ে যাওয়া কালো চামড়া নিয়ে সুতপা যখন আর মেয়েটি নেই, পরিণত বয়সের প্রায় এক প্রৌঢ়া তখন হঠাৎ একদিন সে অনুভব করলো-মনের ভেতরের সেই বাচ্চা মেয়েটা কিছুতেই হার মানতে চায় না। সে যেন কিছুতেই বড় হবেনা। সারা জীবন ধরেই সেই মেয়েটা বই এ লেখা কতগুলো শব্দ খুঁজে বেড়ায়...বানান করলে যেগুলো হয়-''ভালোবাসা'',''মনুষ্যত্ব"...এইসব। বাচ্চা মেয়েটির পাগলামি দেখে ভারি হাসি পায় প্রৌঢ়াটির।

মাঝেমাঝে বকাঝকাও করেন।কত তর্ক চলে দুজনের মধ্যে। জেদীর মত বাচ্চা মেয়েটা মনেমনে আঁকড়ে ধরে থাকে তার বাবার শেখানো কথা-''দেশকে ভালোবাসার কথা,ভাষাকে ভালোবাসার কথা...স্বার্থহীন হয়ে মানুষকে ভালোবাসার কথা''। বিরক্ত লাগে প্রৌঢ়ার,কিছুতেই বোঝাতে পারেন না-''ভালোবাসা'' শব্দটাই আসলে একটা মিথ্যে শব্দ...ভারি নেগেটিভ...জীবনের সব গ্রোথ নষ্ট করে দেয়। স্বার্থপর হতে না পারলে কখনোই জীবনে উন্নতি করা যায় না,সাফল্য আসে না। বিনা স্বার্থে অন্যের উপকার করা?ওসব কথা লেখা থাকে শুধু ছোটবেলার মরাল সায়েন্স বইএর পাতায়।বাস্তবে ওসব বদভ্যাস থাকলে...অট্টহাসি হাসতে ইচ্ছে করে সুতপার... বাচ্চা মেয়েটা তবুও ঘাড় শক্ত করে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে...।

কারুকে জানতে দেবে না ও,একাএকা গভীর গোপন মনে ও খুঁজবেই একটু ভালোবাসা...একটু মনুষ্যত্ব...।

রেগে যান পোড়খাওয়া বয়স্ক রমণীটি,দাঁতে দাঁত চেপে বোকা মেয়েটিকে বলেন-"গ্রো আপ্ বেবি...গ্রো আপ্...ওসব ভালোবাসা টাসা হ'ল আসলে হরমোনের খেলা, বয়স হোক্...হরমোন নিঃসরণ যখন কমে যাবে...বাস্তবটাকে তখনই সঠিক চিনতে পারবে তুমি"। বিভিন্ন কাজের প্রয়োজনে সুতপাকে খুব ট্রেন জার্নি করতে হয় আজকাল...একা। এখন ভাবলে হাসি পায়-ছোটবেলায় সুতপার কি ভীষণ ভয়ই না করতো রেলওয়ে স্টেশনের নামে।বুঝতেই পারতো না ও মানুষ কি করে এক প্ল্যাটফর্ম থেকে অন্য প্ল্যাটফর্মে যায় ? কি করে খুঁজে পায় নিজের গন্তব্যের ট্রেনটাকে ?ট্রেন থেকে নেমে কোন্ গেট দিয়ে বেরোতে হয় ?

খুঁজে পাওয়া যায় কিভাবে বাড়ি ফেরার পথ?-ভয়ে বুক কাঁপতো...ছোট্ট সুতপার মনে হ'ত 'রেলওয়ে স্টেশন মানেই যেন কোথাও হারিয়ে যাওয়া'.... আর এখন?এক্কেবারে 'একা' ট্রেনজার্নিটা সব থেকে বেশি উপভোগ করে সুতপা।কিছুতেই কারুকে স্টেশনেও আসতে দেয়না ও, সি অফ্ অথবা রিসিভ করার জন্য। একলা সফর...মনেমনে কোথায় যেন হারিয়ে যাওয়া।

ট্রেন চলার সময় সব থেকে ভালো লাগে যখন মোবাইল ফোনের সিগন্যাল বা টাওয়ার পাওয়া যায় না। যেন সারা পৃথিবীর সাথে সম্পর্কশুন্য। তখন সুতপা কারুর মা নয়,স্ত্রী নয়...নয় কন্যা। কি অদ্ভুত একটা ভারহীন অনুভূতি। কারুর খবর নেওয়ার প্রয়োজন নেই...উপায়ও নেই।সুতপার খবরও যেন কেউ না পায়।একটা শুন্যতাময় মুক্তির আনন্দ...। ঠিক সত্যিকারের জীবনের মত...আসলে তো কেউ কারুর নয়,সামাজিক অনুশাসনে নকল সম্পর্কের বন্ধনগুলোকে টেনে নিয়ে যেতে হয়... আজকাল ট্রেনজার্নির সময় সুতপা নিজের ''মুড''কে ভারি প্রশ্রয় দেয়। যেবার যখন ওর ইচ্ছে করে অনেক কথা বলতে,সহযাত্রীদের সাথে খুব ভাব করে নেয় সেবার সুতপা।

কিন্তু ওই জার্নির সময়টুকুই ...স্টেশনে নেমেই তাদের ভুলতে একমিনিটও সময় এখন আর লাগেনা ওর। কখনও ঠিকানা,ফোন নম্বর আদানপ্রদান করেনা। বড় হয়ে যাওয়া সুতপা তো শিখেই গিয়েছে-জীবনের ''সব সম্পর্ক বয়ে নিয়ে পথ চলা যায় না"। তিরিশ ঘন্টার তিরিশটা মিষ্টি কথা শুধু ''কথার কথাই'' হয়। দশ বছর ধরে ভালোবাসার কথা বলার পরেও যেমন এক লহমায় সব সম্পর্ক শেষ করে দেওয়া যায়... যেবার সুতপার শুধু নিজের সাথে থাকতে ইচ্ছে করে...সেই সব সময়ে ও ভারি আনঅ্যাপ্রোচেবল্ একটা মুখ বানিয়ে একলা বসে থাকে।

ভেতরে ভেতরে একটা মজাও পায়।যেসব সহযাত্রী জীবনে প্রথমবার একলা ট্রেনে চেপেছেন,তাদের ভীত,অসহায় মুখগুলো দেখেও সাহায্যের হাত বাড়ায়না সুতপা।

এইরকম সময়গুলোতে নিজের আচরণে ভেতরের বাচ্চা মেয়েটা প্রথম প্রথম কষ্টে ছটফট্ করে উঠতো।এখন সেও শিখে নিয়েছে-জীবনে কেউই কারুকে কোনো সাহায্য করতে পারেনা...নিজে নিজেই শিখে নিতে হয়,অভিজ্ঞতাই সব শিখিয়ে দেয়... এ হেন সুতপা গত ডিসেম্বরের সাতাশ তারিখে চেপে বসলো পুণে থেকে হাওড়াগামী আজাদ্ হিন্দ্ এক্সপ্রেসে।ট্রেন এখন ওর কাছে ঘরবাড়ির মতই হয়ে গিয়েছে।যাইহোক্ এসি টু-টায়ারে লোয়ার বার্থের টিকিট...সেটা একটা বাড়তি নিশ্চিন্তি। গরমকালে এই ট্রেনে ও বহুবার যাতায়াত করেছে।শীতকাল বলে এবার একটা চিন্তাই মনের মধ্যে খচ্খচ্ করছে-ট্রেনটা হাওড়ায় পৌঁছায় একেবারে ভোররাতে...চারটের সময়।সেই সময়ে ট্যাক্সি চেপে একা হাওড়া থেকে উত্তর কলকাতায় পৌঁছানোর চিন্তাটা পোড়খাওয়া সুতপাকেও স্বস্তি দিচ্ছিলো না ।

সহযাত্রীরা কে কেমন হবেন,সেসব নিয়ে সুতপার কোনো মাথাব্যাথা নেই। তবু অভ্যাসবশত একবার দেখে নিলো- ওর উল্টোদিকেই বসে আছেন বয়স্ক অবাঙ্গালী দম্পতি।মহিলাটি তখনই বিছানা টিছানা পেতে শুয়ে পরার ব্যবস্থা করছেন। সুতপার উপরের বার্থের যাত্রী তখনও এসে পৌঁছায়নি ... এবারের জার্নিতে সুতপা একেবারেই 'কথা না বলার'মুডে রয়েছে।কাজেই ব্যাগট্যাগ গুছিয়ে রেখে ও মুখের সামনে একটা ম্যাগাজিন খুলে বসে পড়লো। ট্রেন ছাড়তে তখনও মিনিট দশেক বাকি...প্রবেশ করলো চতুর্থ যাত্রী। এক অতিশীর্ণকায়া বৃদ্ধা। প্রথম দর্শনেই কেমন যেন অসুস্থ রুগ্নভাব। সঙ্গে যে পুরুষটি পৌঁছে দিতে এসেছেন,তার কথায় আন্দাজ করা যায় ওনারা কোনো দক্ষিণী ভাষায় কথা বলছেন। সুতপা মনেমনে ভাবলো-'বাঁচা গেলো'... ট্রেন ছাড়ার পরে প্রায় ঘন্টা তিনেক কেটে গিয়েছে।রাতের খাওয়াদাওয়াও শেষ।আজ সুতপা সহযাত্রীদের দিকে একবার ফিরে তাকানোরও প্রয়োজন বোধ করেনি। নিজের মনেই বই পড়েছে,গান শুনেছে আর ইচ্ছে হলে জানালা দিয়ে বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থেকেছে।পাশের সহযাত্রীটিকে একবার চোখ দিয়ে জরিপ করার চেষ্টা করেছিলো...বোঝার চেষ্টা করেছিল তার সামাজিক অবস্থান।

কিন্তু মহিলাটির চেহারায় এমনই গ্রাম্য,রুগ্নভাব।অতএব তার দিকে মনোযোগ দেওয়ার কোনো প্রয়োজনই নেই ...। আর সুতপার তো এবার মুডই নেই।তাছাড়াও ও তো কবেই শিখে নিয়েছে-'স্ট্রং কানেকশনবিহীন লোকজনের সাথে কথা বলা মানে শুধুই সময় নষ্ট ...কোনো লাভ হয়না'... এবার শুয়ে পড়তে হবে। সুতপা বাথরুম থেকে ঘুরে আসলো। ভাবলো ওর নড়াচড়ার ইঙ্গিত পেয়ে মহিলাটিও হয়তো এবার উঠে গিয়ে উপরের বার্থে শোওয়ার আয়োজন করবেন। হঠাৎ মহিলাটি সুতপার দিকে তাকিয়ে দুর্বোধ্য ভাষায় কি যেন বলার চেষ্টা করলো।সুতপা অবাক হয়ে চেয়ে রইলো এবং কিছুই বুঝতে পারলো না... মহিলাটি এবার সুতপার হাতদুটো জড়িয়ে ধরলো...অবশেষে বোধগম্য হলো-তিনি সুতপাকে অনুরোধ করছেন লোয়ার বার্থটি ছেড়ে দেওয়ার জন্য,উপরে উঠতে পারবেন না তিনি।

ভেতরে ভেতরে ভারি বিরক্ত হলো সুতপা,মনেমনে বলেও ফেললো-"এতো ঝামেলা নিয়ে একা ট্রেনে চড়ার শখ কেন বাপু ? অন্য যাত্রীরা তোমার বায়না কেন মেনে নেবে?" তবে মুখে কিছু বললোনা ...শুধু নিজের মুখখানাকে আরও বেশি গম্ভীর আর রাগী রাগী করে রাখলো সুতপা। যাক্ গে ওর অবশ্য ওপরে উঠে শুতেও কোনো অসুবিধা নেই ... ওপরে উঠতে যাবে তখন আবার আর এক বিপত্তি।হঠাৎ তাকিয়ে দেখে বুড়ির শরীরের অবস্থা এমনই যে সে নিজের বিছানাটাও পেতে নিতে পারছে না।অতএব সুতপাকেই এগিয়ে আসতে হয়।গম্ভীর মুখে বিছানা করে ,মহিলাটিকে শুইয়ে...তার গায়ে চাদর টেনে উপরে উঠলো... ঘুমের সঙ্গে সুতপার যেন সতীন সম্পর্ক। বালিশে মাথা রাখলেই জীবনের যত স্মৃতি ওর মনের মধ্যে ভীড় করে আসে।এ রাতেও তার ব্যতিক্রম হ'ল না। আজ আবার তার সাথে যোগ হয়েছে-'পরশু ভোররাতে হাওড়াস্টেশনে পৌঁছানোর চিন্তা'.... মনের ভেতরের বাচ্চা মেয়েটার বড় ভয় করে,অভিমান হয়...ও ভাবে "আমি বারণ করেছি তো কি হয়েছে ? কেউই কি আমাকে একটু নিতে আসতে পারে না ? স্টেশন থেকে ?" প্রতিবারই স্টেশনে পৌঁছে যখন দেখে অন্য যাত্রীদের আত্মীয় স্বজন বা বন্ধু বান্ধবরা তাদের নিতে বা পৌঁছতে এসেছেন...ছোট্ট সুতপার বুকটা ফেটে যায় তখন...নিজেকে বড় অসহায় একা লাগে। মনের ভেতরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে ও...।

কিন্তু বাইরের সুতপা যে অনেক বড় হয়ে গিয়েছে...চোখ থেকে এক ফোঁটা জলও বেরোয় না আজকাল... ভোরবেলা অন্ধকার থাকতে থাকতেই ঘুম ভেঙ্গে গেলো...। ছোটবেলা থেকেই সুতপার অভ্যাস একবার চোখ খুলে গেলেই ও আর শুয়ে থাকতে পারে না।ইচ্ছে হ'ল নীচে নেমে জানালার ধারে গিয়ে বসে।কিন্তু সেখানেও তো আর এক জ্বালা।দক্ষিণী মহিলাটি ওর সিট দখল করে শুয়ে আছে...কখন উঠবে কে জানে ?বিরক্তিতে ভুরুটা কুঁচকে রইলো সুতপার ... না,বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না।সুতপার জেগে ওঠা টের পেয়ে বৃদ্ধাটি বিছানা ছেড়ে উঠে করুণ চোখে ওর দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।একরাশ বিরক্তি নিয়ে সুতপা নীচে নামলো।বৃদ্ধা এবারও ওর হাতদুটো জড়িয়ে ধরলেন... যাক্ ,এই কাজটা করাও বাকি ছিলো...বিরক্ত সুতপা বুড়িকে বাথরুমে নিয়ে গেলো... বাথরুম সেরে ফিরতে ফিরতেই যেন বৃদ্ধার সব শক্তি ফুরিয়ে গেল।ধপাস্ করে সিটের এক কোণে বসে পড়লেন তিনি। "আর বসবে নাই বা কেন ?"-মনেমনে গজরাতে গজরাতে সুতপা ভাবলো-"সর্বক্ষণের অ্যাটেনডেন্ট" সুতপা সাথে আছে যে বুড়ির বিছানা পাট করে তুলে রাখার জন্য... বুড়ির বিছানা গুছিয়ে রেখে সুতপা জানালার ধারে নিজের জায়গা করে নিলো।

হাতে ম্যাগাজিন...কানে গান শোনার যন্ত্র। ইতিমধ্যে উল্টোদিকের মারাঠি দম্পতিও উঠে বসেছে।হাতমুখ ধোয়া,বাথরুম টাথরুম সেরে তারা এবার গুছিয়ে বসলো।বোঝাই যাচ্ছে আলাপ পরিচয় করার ইচ্ছে তাদের... সুতপা মুখটাকে পাথরের মত করে রাখলো।একা ট্রেনজার্নির অভিজ্ঞতায় ও শিখে নিয়েছে যে কিছু মানুষ অকারণে বড় কৌতুহলী হয়।"চল্লিশোর্ধ একজন মহিলা কেন একা ট্রেনে চেপেছেন ? কোথায় যাচ্ছেন? কার কাছে যাচ্ছেন? মহিলা কি বিবাহিতা না অবিবাহিতা? ডিভোর্সী না কি বিধবা? অর্থাৎ তার কি কোনো পুরুষ অভিভাবক নেই? সন্তান আছে না সন্তানহীনা? যেন এই শতাব্দীতেও তিনি এক আজব জীব। তার জীবনের ইতিহাস ভূগোল এই যাত্রাতেই পুরোটা জেনে না নিলে ভারি অসুবিধা হচ্ছে তাদের... এসব মানুষকে কিভাবে ছেঁটে ফেলতে হয় সুতপা জানে।

সুতরাং নিরাশ হয়ে মারাঠি দম্পতি পাশের বুড়িটার খোঁজখবর নিতে শুরু করলো। ভাষাতেও বোধহয় একটু সুবিধা হলো। সুতপার কোনো ব্যাপারেই ইন্টারেস্ট নেই। তবে ওদের কথোপকথন থেকে যেটুকু কানে এলো,তাতে বুঝলো-দক্ষিণীবুড়ি চলেছে কলকাতায় চিকিৎসার কারণে। সেখানে তার ছেলে ও বৌমা চাকরী করে। রুগ্ন বুড়িটার সাথে বেশিক্ষণ গল্প চালানো গেলো না। সবাই ঝিমোতে থাকলো... ট্রেনও চলছে...সময়ও বয়ে যাচ্ছে... দুপুরবেলা মধ্যাহ্নভোজনের সময় মারাঠি দম্পতি ঠিক স্কুলের হিংসুটে বাচ্চাদের মত আড়াল করে নিজেদের খাওয়াদাওয়া সেরে নিলো। জার্নির সময় সুতপা প্রায় কিছুই খায়না। ট্রেনে খাওয়ার ব্যাপারে ও বড় পিটপিটে।

তাছাড়া একটা দিন উপোস করে থাকলে এমন কিছু মহাভারত অশুদ্ধ হয়না। পাশে বুড়িটাও চাদর মুরি দিয়ে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে রয়েছে... বেলা দুটো নাগাদ ট্রেনটা একটা স্টেশনে খানিক থামলো।অল্প একটু ক্ষিদের ভাব হচ্ছে সুতপার।একটু হাঁটাচলা করতেও ইচ্ছে করছে... প্ল্যাটফর্মে নেমে একটা শালপাতার প্লেটে চারটে ইডলী কিনে আনলো ও ।ফিরে দেখে ট্রেন থেমে যাওয়ার জন্যই বোধহয় বুড়িটা উঠে বসেছে। সুতপা কেমন যেন যন্ত্রের মত ইডলীর প্লেটসহ হাতটা বাড়িয়ে দিলো বুড়ির দিকে...বুড়িও ভাবলেশহীন মুখে দুটো ইডলী তুলে নিয়ে খেতে শুরু করলো... সুতপা মনেমনে ভাবলো-"ভালোই হ'ল,চারটে ইডলী খাওয়া যেত না, দুটো হয়তো ফেলেই দিতাম".... বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হ'ল।আজ সবাই আরও তাড়াতাড়ি খাওয়াদাওয়া সেরে শুয়ে পড়েছে। কাল ভোররাতেই ট্রেন স্টেশনে পৌঁছে যাবে।ঘুমটা পুরো না হলে বড় অসুবিধা হয়। রাতে শোওয়ার সময় সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি।বিছানা করে বুড়িকে শুইয়ে সুতপা উপরে উঠলো। মনের মধ্যে ফিরে এলো আবার সেই খচখচানীটা...। শীতের কুয়াশাঢাকা ভোররাতে স্টেশন থেকে ট্যাক্সি করে বাড়ি ফিরতে বড্ড ভয় করছে সুতপার। আচ্ছা,অত ভোরে ট্যাক্সি চালু হবে? না কি স্টেশনেই কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবে দিনের আলো ফোটার জন্য? সেটা নিরাপদ হবে তো ? মনের ভেতরের বাচ্চা মেয়েটা অভিমানে গাল ফুলিয়ে খুঁজতে লাগলো একটা সম্পর্ক...কোনো একটা নাম,যাকে ফোন করে এখনই বলা যায়-"আমাকে কাল ভোরে স্টেশন থেকে বাড়ি নিয়ে যেও...আমার যে বড্ড ভয় করছে...একা লাগছে"

-নাঃ,কোনো নাম সুতপার মনে আসেনা... বরং আরও বেশি অভিমানী মন নিয়ে ও ভাবে "আর কোনোদিন কারুকে ভালোবাসবো না...সাহায্যও করবো না, আরও বেশি একা হয়ে যাওয়া অভ্যাস করে নেবো"। সুতপা ছেলেমানুষের মত মনেমনে প্রার্থনা শুরু করলো-"ট্রেনটা যেন কাল অন্তত দুঘন্টা লেট হয়...যেন দিনের আলো ফোটার পরে স্টেশনে পৌঁছায়".... সুতপার জীবনের বেশিরভাগ প্রার্থনার মতই যথারীতি এই প্রার্থনাটাও মঞ্জুর হয়নি।বরং একটু উল্টোই হলো। ট্রেনটা বিফোর-টাইম...রাত তিনটে পনেরো নাগাদ হাওড়াতে পৌঁছে গেলো। সুতপা জানতো এরকমই হবে...এমনটাই হয়... ধীরেধীরে সব যাত্রী নামতে শুরু করলো।সুতপা চুপ করে বসে রইলো...ওর নামতেও ইচ্ছে করছিলো না। ট্রেনটা যখন প্রায় খালি হঠাৎ ওর নজরে পড়লো পাশের বুড়িটা একদৃষ্টে ওর দিকে তাকিয়ে বসে আছে।

ভীষণ বিরক্ত লাগলো সুতপার।

মহারানী যেন অপেক্ষা করে আছেন-কখন তার দাসী হাত ধরে তাকে নামাবে প্ল্যাটফর্মে... সে কাজটাও করতে হ'ল সুতপাকে। কিন্তু না...আর নয়...অনেক হয়েছে।নীচে নেমে মুখটাকে কঠোর কঠিন করে সুতপা একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালো। ততক্ষণে প্ল্যাটফর্ম প্রায় খালি। অসহায় বুড়িটা এদিকওদিকে তাকাচ্ছে আর খুঁজছে বোধহয় ওর নিজের কোনো লোকজনকে...। মিনিট তিনেকের মধ্যেই আধুনিক পোষাকে ঝকঝকে চেহারার দুটি ছেলেমেয়েকে বুড়ির দিকে এগিয়ে আসতে দেখা গেলো। একা সুতপা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো... সুতপা বুঝতে পারছেনা ও এখন কি করবে ? ট্যাক্সির লাইনের দিকে এগিয়ে যাবে না কি এখানেই দিনের আলোর অপেক্ষা করবে? হঠাৎ অল্পবয়সী মেয়েটি বুড়ির কাছ থেকে সুতপার দিকে এগিয়ে এসে পরিষ্কার ইংরেজীতে জানতে চাইলো-তার বাড়ি কোথায় ? সে কোন্ দিকে যেতে চায়? বেশ খানিকটা অবাক সুতপা উত্তর কলকাতার লোকেশন জানালো। ঝকঝকে মেয়েটি এবার নিজেদের পরিচয় দিয়ে বললো-ট্রেনের বৃদ্ধা ওর শাশুড়ি মা। পুত্র ও পুত্রবধূ দুজনেই কলকাতার আই.টি.সেক্টরে কর্মরত। ওদের বাড়ি দক্ষিণ কলকাতায়। অসুস্থ শাশুড়ি এই প্রথম কলকাতায় এলেন। এই শহরের কিছুই তিনি চেনেন না। কিন্তু তিনি ছেলে বৌমাকে হুকুম দিয়েছেন-"ছেলের বাড়ি যেখানেই হোক্ না কেন,আগে সুতপাকে নিরাপদে তার বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে তবেই তারা নিজেদের বাড়িতে যাবেন ".... হতভম্ব সুতপা আপত্তি জানানোর ক্ষমতাটাও হারিয়ে ফেলেছিল। বিশাল বড় গাড়িটার পেছনের সিটে বৃদ্ধার পাশে বসে ওর মাথাটাও আর কাজ করছিলো না... অন্ধকারের মধ্যে বাড়ির গেটের সামনে গাড়িটা যখন থামলো,তখনও সুতপা কোনো কথা বলতে পারলো না।ট্রেনে বৃদ্ধা ঠিক যেরকম করছিলেন...ঠিক সেরকমভাবে ও শুধু বৃদ্ধার দুটো হাত জড়িয়ে ধরলো... বহুবছর পরে সুতপার চোখ থেকে নেমে আসলো কয়েকফোঁটা জলের ধারা... গলির মোড়ে বিশাল গাড়িটা যখন মিলিয়ে গেলো,মনের ভেতরে বসে মুচকি হাসি হাসতে থাকা বাচ্চা মেয়েটাকে সুতপা বললো-"হ্যাঁ রে বোকা মেয়ে,ভালোবাসা সত্যিই হরমোনের খেলা...আর সেজন্যই তো মাঝেমাঝে এমন হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপির প্রয়োজন হয়".....


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational