বৃহন্নলা
বৃহন্নলা


প্রথমটায় সুচরিতা একেবারেই বুঝতে পারেনি। আসলে খুব ভালো করে তাকিয়ে দেখেনি। সুচরিতা মানুষটা এমনিতেই একটু আনমনা ধরনের, রাস্তাঘাটে চলাফেরার সময় অন্য কোন মানুষকে খুব বেশি খুঁটিয়ে দেখার অভ্যাস ওর নেই। বেলা তখন প্রায় দেড়টা বাজে। সংসারের দৈনন্দিন কাজকর্ম সেরে সুচরিতা বেরিয়েছিল কয়েকটা চিঠিপত্র ক্যুরিযর করতে। ফটোকপি ও প্রিন্ট আউট নেওয়ার কাজগুলোও ওই একই জায়গায় সেরে নেওয়া যাবে। বাড়ী থেকে ডিটিডিসির অফিসটা মিনিট দশেকের হাঁটাপথ। একটা ছোট শপিংমলের একতলায়। আজকাল শহরতলীর নূতন গড়ে ওঠা পাড়াগুলোতে দু-পা হাঁটলেই ছোট ছোট শপিংমল গজিয়ে উঠেছে। অবশ্য এর ফলে অনেক মানুষের জীবিকার সাথে সাথে সাধারণ মানুষেরও সত্যিই সুবিধা হয়, কারণ এসব জায়গায় যানবাহনের সুবিধা এখনও ততটা হয়নি। তাছাড়া স্বামীরা অফিস আর সন্তানরা স্কুলবাসে স্কুলে বেরিয়ে যাওয়ার পরে এখনকার গৃহবধূরা সত্যিই গৃহবন্দী। অতএব শপিং মলে ঘুরে বেড়ানোটাও তাদের জন্য কিছুটা মুক্তির যায়গা। জুন মাসের দুপুর আকাশটা সেদিন ছিল ঠিক একটা রাগী দৈত্যের মতো । টানা প্রায় নয়-দশদিন হতে চলল মেঘবৃষ্টির কোথাও কোনো চিহ্ন নেই। ক্যুরিয়ার অফিসে কাজ করে যে অল্পবয়সী মেয়েটি তার নাম রূপসা। ভারি চটপটে এবং স্বভাবটিও সুন্দর। ওকে দেখলেই মনে হয় প্রথম পাওয়া চাকরীটাকে ও খুব ভালোবেসে করে। এত সুন্দর আধুনিক সাজগোজ করে অফিসে আসে যে সকলেরই ভালো লেগে যায়। এটাও তো মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজির একটা অঙ্গ । কাজের সূত্র ধরেই সুচরিতা আর রূপসার মধ্যে একটা পারস্পরিক সুন্দর বোঝোপড়া আছে। সেটাকে প্রায় বন্ধুত্বের মতোই বলা যায়। এই অফিসে সুচরিতা সপ্তাহে দু-তিন দিন আসে। কিছু কাজ থাকে ওর নিজের। সুচরিতা কয়েকটা সমাজসেবা মূলক সংস্থার সাথে যুক্ত। বাকিটা স্বামীর ব্যবসা-বাণিজ্যসংক্রান্ত কাজ। প্রতিবারই রূপসার সাথে একটু গল্প-গুজব হয়। আজ অবশ্য একগাদা কাগজপত্রের চাপে সুচরিতার মনটা একটু বিরক্তিতে ভরা। হিমাদ্রি অফিসিয়াল পেপার ওয়ার্কের ব্যাপারে এত বেশি পিটপিটে পারফেকশনিষ্ট যে ওর কাজকর্ম করতে গেলে সুচরিতা একটু নার্ভাস হয়ে থাকে। আজ তার সাথে নিজেরও অনেক জরুরী চিঠিপত্র রয়েছে। কিছু কাগজের ফটোকপি করতে হবে, কিছু প্রিন্ট আউট নেওয়া, অনেকগুলো চিঠি ক্যুরিযর পোষ্টে পাঠানো...। সুচরিতাকে দেখে রূপসা যথারীতি হাসিমুখে কাউন্টারে উঠে দাঁড়ালো। সুচরিতাও মনেমনে সাজিয়ে রাখা কাজগুলো এক এক করে রূপসাকে বোঝাতে শুরু করল। কাউন্টার থেকে অল্প দূরে একটি চেয়ারে বসেছিলেন সেই মানুষটি। প্রথম ঝলকে তার অত্যধিক উগ্র সাজগোজটাই শুধু সুচরিতার চোখে পড়েছিল। জ্যৈষ্ঠের এমন গরম দুপুরে কেউ যে এরকম জড়ি-চুমকি বসানো ঝকমকে লাল শাড়ি পরে দিনেরবেলা পথে বেরোতে পারে.... তার ওপরে মুখে উগ্র চড়া মেক আপ, চোখে মোটা কাজল, টকটকে লাল রংয়ের আগুনে ঠোঁটদুটো যেন জ্বলছে। হাতে, গলায়, কানে নাকে সস্তার রং করা গয়নাগাটি চক চক করছে। খানিকটা সৌজন্যমূলকভাবে অথবা কি যেন একটা অস্বস্তির কারণেই সুচরিতা দৃষ্টিটা সরিয়ে নিয়েছিল। তারপরে কাগজপত্রের টেনশনে সে আর ওদিকে মন দেয়নি। স্বভাবগতভাবেও অন্য কোনো মানুষের ব্যক্তিগত পছন্দ -অপছন্দ নিয়ে সুচরিতা মাথা ঘামায়না । অপরের রুচিবোধ, ইচ্ছা-অনিচ্ছার ব্যাপারে ও শ্রদ্ধাশীল। ব্যাগ থেকে কাগজগুলো বের করে সুচরিতা রূপসাকে বোঝাচ্ছিল কোন কাগজটির কটা করে ফটোকপি করতে হবে, কোনগুলোই বা পোস্ট করতে হবে, কিসের চাই প্রিন্ট আউট ইত্যাদি। একাগ্ৰতাটা বিঘ্নিত হল চেয়ারে বসে থাকা মানুষটির কন্ঠস্বরে। কাগজপত্র থেকে চোখ তুলে সুচরিতা দেখল...তার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা মানুষটি হঠাৎই কেন যেন ভারী কন্ঠস্বরে বলছেন- "তুমি বড় ভালো মানুষ, আমি আশীর্বাদ করছি... তোমার সব স্বপ্ন, মনের ইচ্ছে পূর্ণ হবেই।" সুচরিতা বালিকা নয়, তরুণীও নয়। বয়সের হিসাবে মাঝবয়সী এক মহিলা। তবু এই মানুষটির মুখনিঃসৃত বাক্য দুটি শুনে সে একেবারে বাচ্চা মেয়ের মত এলোমেলো হয়ে গেল। কেন এলোমেলো হয়ে গেল? সুচরিতা পরে বারবার ভেবে দেখেছে....। এরকম বয়সে এসে হঠাৎ উপলব্ধি হয়... কতদিন স্নেহমাখানো দুটো ভালো কথা, আশীর্বাদ শোনা হয়নি। মাথার উপরের বয়োজ্যেষ্ঠরা যত হারিয়ে যায় , তাদের সাথেসাথে হারিয়ে যায় আমাদের শৈশব। মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা বাচ্চা মেয়েটা মরুভূমি হয়ে স্নেহ-বৃষ্টির অপেক্ষায় থাকে। সেজন্যই কি হঠাৎ স্নেহভরা এই আশীর্বানী শুনে এমন এলোমেলো হয়ে যাওয়া? ওই মানুষটি হয়তো নেহাৎ জীবিকার কারণে ভালো ভালো কথাগুলি বলেছিলেন .... তবু সুচরিতার মনটা বড় ভিজে গেল। না কি, মানুষটির কন্ঠস্বর শুনে, চোখ তুলে তাকিয়ে তার আসল পরিচয়টা সুচরিতা বুঝতে পারলো। মনে পড়ে গেল দীর্ঘদিনের সংস্কার.... " এই সব মানুষের আশীর্বাদ নাকি একেবারে সত্যি হয়"। ছোটবেলা থেকেই শুনেছে -"ওদের দেখলে দিন ভালো যায়, যাত্রা শুভ হয়"- ইত্যাদি। আজ সুচরিতা এসেছেও অনেক দরকারী কাজ নিয়ে..... সেগুলো তাহলে সব সফল হবে? স্বপ্ন সফলের আনন্দে মন এলোমেলো হয়ে গেল? কি যে হল... এলোমেলো হয়ে যাওয়া সুচরিতার ভীষণ ইচ্ছে হল ওই মানুষটির সাথে কথা বলতে, গল্প করতে। জানতে ইচ্ছে করল ওদের জীবনের গল্প। ওদের মতো মানুষদের সাথে সুচরিতা এর আগে কখনো কথা বলেনি। ওদের সাথে আর কেই বা কবে কথা বলে? ওদের ব্যাপারে ছোটবেলা থেকে আমাদের থাকে শুধু কিছুটা ভীতি মেশানো কৌতূহল। প্রকৃতির কোন খেয়ালে বা কোন্ খেলায় যে ওরা এরকম হয়। বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানে ওরা কয়েকজন দল বেঁধে আসে, কিছুটা নাচ গান করে, টাকা পয়সা চায়। সেই টাকা পয়সা চাওয়া নিয়েও বেশীরভাগ সময়ই হয় দারুণ ঝকমারি ব্যাপার। সুচরিতা নিজেও এর থেকে বেশি আর কিছু ভাবেনি কখনো। আজ ও নিজে এসেছে কিছু নতুন কাজের স্বপ্ন নিয়ে,সে ব্যাপারেই চিঠিপত্রে পোস্ট করতে। ওদের সংগঠনকে ধীরে ধীরে বড় করে তুলতে চায় ও। কত কিছু করার আছে। চারিদিকে বিরোধিতা-সহযোগিতা সবই আছে। বাধা বিপত্তি কাটিয়ে, পারিবারিক দায়-দায়িত্ব সামলে মাঝেমাঝে বড় ক্লান্ত লাগে। এরকম অবস্থায় অপরিচিত মানুষটির আশীর্বাদ পেয়ে সুচরিতার মনটা বড় দ্রব হয়ে গেল। আজ প্রথমবার ওর এমন মানুষটির জীবনের কথা জানতে ইচ্ছে করল তার নিজেরই মুখ থেকে...। নিজেকে এবং আশেপাশের মানুষজনদের বেশ খানিকটা অবাক করে দিয়ে সুচরিতা একটা চেয়ার টেনে নিয়ে মুখোমুখি বসলো সেই মানুষটির... নিজের দুহাতে তুলে নিল তার দুটি হাত। মনের অগোচরে একটা ইচ্ছেও দানা বাঁধতে লাগলো...। যদি এদের নিয়েই হয় ওর সংগঠনের পরবর্তী প্রজেক্ট । সত্যিই তো যে কোনো 'ভালো কাজ'ও তো আসলে একটা প্রোডাক্ট বা প্রজেক্ট । বাজারে তার চাহিদাটা কি রকম, সেটা না ভাবলে চলে না। ওদের জীবনের ছায়া নিয়ে মাঝেমাঝে একটা দুটো গল্প- উপন্যাস বা সিনেমা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু ঐ পর্যন্তই । ওদের নিয়ে বিশেষ উল্লেখযোগ্য সে রকম কাজ এখনও হয়নি... । অতএব...এটা সংগঠনের পরবর্তী প্রজেক্ট করা যেতেই পারে । প্রায় পয়তাল্লিশ মিনিট ধরে চলেছিল সুচরিতা ও সেই মানুষটির সাক্ষাতকার বা কথোপকথন । ব্যাপারটা যদিও খুব সহজ হয়নি।দুজনের জন্য দুটো আইসক্রিম কিনেছিল সুচরিতা। সহজ হতে বেশ কিছুটা সময় লেগেছিল । তবে আলাপচারিতা শেষ হওয়ার পরে সুচরিতার প্রথমেই মনে হয়েছিল - "ওরাও যে এত সুন্দর ভদ্রভাবে কথা বলতে পারে, ভাবতে পারে...কে জানতো। ওদেরও বুকে জমে আছে কি ভীষণ গভীর গোপন যন্ত্রণা...।" কথার ফাঁকেফাঁকে শুধু এইটুকুই জানা গিয়েছিল- "সেই মানুষটি বারো ক্লাশ পযর্ন্ত পড়াশোনা করেছেন। কোনো একদিন তারও একটা পরিবার ছিল... তারও ছিল বাবা-মা। সত্যি তো... তিনিও তো কারুর ঘরে আদরের সন্তান হয়েই জন্মগ্রহণ করেছিলেন... কিন্তু তারপর? তারপরের ইতিহাস ওরা আর কখনও বাইরের পৃথিবীকে বলে না, জানতে দেয়না । হ্যাঁ, বাকী গল্প শুধুই ওদের নিজেদের অসম্পূর্ণ পৃথিবীর দীর্ঘশ্বাসের গল্প। পারিবারিক জীবন থেকে কিভাবে ওরা এই জীবনে আসে? ওদের শিক্ষা-দীক্ষার ব্যবস্থা? স্বাস্থ্য? কেন ওদের এই ধরনের একটা পেশার মধ্যে থাকতে হয়? সুন্দর, সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনের কোনো ব্যাবস্থা কি সম্ভব নয়? কেমন ওদের যৌনজীবন? ইমোশন্যাল প্যাটার্নটাই বা কিরকম? সুচরিতার মনে পড়ে গিয়েছিল একটা গল্প, যেখানে এরকম একজন মানুষ রাস্তার একটি ভিখারী শিশুকে পরম যত্ন ও মমতায় বড় করে তুলছিলেন...। কিন্তু না, মাত্র একদিনের ভাবাবেগে এতসব প্রশ্নের উত্তর পায়নি সুচরিতা। ওর কান্না পাচ্ছিল, ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। সবশেষে বিহ্বল সুচরিতা শুধু জানতে চেয়েছিল- ক্যুরিয়ার অফিসের চেয়ারে মানুষটির বসে থাকার কারণ...। উত্তরটা একেবারে নাড়িয়ে দিল সমাজ সেবিকা সুচরিতা সান্যালকে। নিজেকে মানবতাবাদী ভেবে এতদিন পর্যন্ত প্রচ্ছন্ন গর্ব বোধ করত সে। কিন্তু কোথায়... ওদের এই কথাটা তো কখনো এভাবে ভেবে দেখেনি সে। কেউ কি ভেবেছেন?.... আমাদের দেশের সরকার? গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সুযোগ-সবিধা কিছু হয়তো আজকাল হয়েছে।, ভোটমুখী রাজনীতিতে সেগুলো হয়েও থাকে। কিন্তু বাকি থাকে যে আরও অনেক কিছু...। ঝলমলে রঙীন শাড়ি পরে, চোখে মোটা কাজল আর ঠোঁটে চড়া রঙ মেখে সেদিন এক ধনীগৃহে পুত্রসন্তান জন্মানোর আনন্দানুষ্ঠানে যাচ্ছিলেন মানুষটি। মাঝপথে হঠাৎ অসুস্থ বোধ করতে থাকেন, বাথরুমে যাওয়ার প্রয়োজন অনুভূত হয়। শপিংমলের সিকিউরিটি গার্ডরা "নারী ও পুরুষদের জন্য নির্ধারিত কোনো ওয়াশরুমেই তাকে ঢুকতে দেয়নি। নিরুপায় অসহায় মানুষটি রাস্তার ধারে বসে বমি করতে শুরু করেন।আমাদের দেশে কোথাও কি আছে ওদের জন্য আলাদা ভাবে নির্দিষ্ট বাথরুমের ব্যবস্থা ? ছোট ছোট ছেলেময়েরা তখন দূর থেকে ওর গায়ে ঢিল ছুড়ছিল, কাছেপিঠে দাঁড়িয়ে থাকা নারী-পুরুষের দল করছিল হাসাহাসি। একজন গোটা মানুষও সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেনি। ফুটপাতের উপর মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়া মানুষটি অবশ্য একটুও অবাক, বিচলিত, দুঃখিত বা ক্রুদ্ধ হননি। ঠিক এরকম ব্যবহারেই ওরা অভ্যস্ত, এসব ওদের গা-সহা হয়ে গিয়েছে... আমরা তো ওদের সাথে এরকমই করে থাকি। ওরা তো শুধুই আমাদের জন্য হাসি মজার খোরাক। শুধু আর হাঁটতে পারছিলেননা বলে ফুটপাত থেকে উঠে দাঁড়িয়ে মানুষটি একতলার ক্যুরিয়ার অফিসের একটি চেয়ার টেনে বসে পরেছিলেন। এবং সেই অবস্থাতেও কি সুন্দর দুটি আশীর্বাদ উচ্চারণ করে তিনি সুচরিতার মনটা খুশীতে ভরিয়ে দিয়েছিলেন। কে সেই মানুষটি? তিনি নারীও নন, পুরুষও নন। তাদের সকলে অসম্পূর্ণ বলেই জানে । কিন্তু তিনিও একজন মানুষ।
সেদিনই সুচরিতা স্থির করে বৃহন্নলাদের জন্য আলাদা বাথরুমের ব্যবস্থা করার কাজ সে শুরু করবে।