মনের মধ্যে
মনের মধ্যে
"গ্যাসের নব্ টা বন্ধ করেছিলে নভোনীল ?"... ফ্ল্যাটের সদর দরজাটা বন্ধ করে লোহার সেফটি-ডোরটা সবেমাত্র টানতে যাচ্ছিলো নভোনীল। গ্যাসের নব্ টার কথা মনে আসতেই সে একটু থমকে দাঁড়ালো...সত্যিই তো বন্ধ করেছিল গ্যাসটা ? মানে গ্যাসের সিলিন্ডারের নব্ টা ? ব্রেকফাস্ট বানানোর পরে ওভেনের নব্ টা তো বন্ধ করেছিলো-মনে আছে, কিন্তু সিলিন্ডারের টা ?ঠিক মনে পড়ছে না তো ... জলখাবার খেয়ে আর এক কাপ কফি খাওয়ার কথা ভেবেছিলো-মনে পড়ছে । কিন্তু কফিটা খেয়েছিলো কি ? না কি স্নানের জন্য সোজা বাথরুমে ঢুকে গিয়েছিলো ? তাহলে ? সিলিন্ডারের নব্ টা কি শেষপর্যন্ত বন্ধ করা হয়নি ?-এমনিতে সেরকম কিছু ব্যাপার নয়, মাঝেমাঝেই নভোনীল অফিস যাওয়ার সময় সিলিন্ডারের নব্ বন্ধ করতে ভুলে যায় ,কিন্তু আজ ও যাচ্ছে উটি বেড়াতে...তিনদিনের জন্য। কাজেই আজ ভুল করলে চলবে না। "সত্যিই নভোনীল এত আনমনা হলে চলে? একটু কেয়ারফুল হতে হবে তো " সেফটি-ডোরটা টানতে গিয়েও থেমে যায় নভোনীল। চাবি দিয়ে মেইন কাঠের দরজার তালাটা খোলে ও...আবার ঘরে ঢোকে। রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে যায়...। ইশ্...ভাগ্যিস্ মনে পড়েছিলো, সিলিন্ডারের নব্ টা খোলাই ছিলো...। "নভোনীল ঘরে যখন আবার ঢুকলেই, আর একবার প্রত্যেকটা লাইট ফ্যানের সুইচ চেক করে নাও। আর হ্যাঁ, বাথরুম আর রান্নাঘরের সবকটা কল দেখে নিতেও ভুলো না...মনে আছে তো সেই একবার কল খোলা রেখে চলে গিয়েছিলে...ফিরে এসে দেখেছিলে ঘরের ভিতরে বন্যা " "উফ্ মনে আছে, মনে আছে"-একথা ভেবেও নভোনীল একটুও বিরক্ত হলো না। বরং শান্তভাবে এক এক করে প্রত্যেকটা সুইচ চেক করে নিলো। সত্যিই অ্যাকোয়াগার্ডের সুইচটা অন্ করাই ছিলো। কল টলগুলো অবশ্য সবই ঠিকমতো বন্ধ করেছিলো। এতো হাজারবার সেই "ঘরের ভেতরের বন্যার"কথা মনে করিয়ে দিলে, কল বন্ধ করার কথা ভুলে যায় -কার সাধ্য ? যাইহোক্ এইবার নভোনীল বেশ গুছিয়ে ঘরের বাইরে বেরোলো। মেইন গেট ও সেফটি ডোরে তালা লাগিয়ে এগারো তলা বিল্ডিং এর নীচে গিয়ে অপেক্ষা করতে হবে । এমনিতে এই বেঙ্গালুরু শহরটা বেশ নিরাপদ। চুরি-চামারি সেরকম হয়না বললেই চলে। নভোনীলের এঞ্জিনিয়ারিং পড়া ও তারপরে ক্যাম্পাসিং থেকে চাকরি এই শহরেই। দেখতে দেখতে প্রায় সাত আটবছর কেটেও গেলো কলকাতার বাড়ি থেকে দূরে। বারো ক্লাস পাশ করার পরেই নভোনীল অবশ্য মনে মনে বাড়ি থেকে একটু স্বাধীনতা চেয়েছিলো...একটু দূরত্ব,একটু একা থাকা। বেঙ্গালুরু শহর ওকে সেই স্বাধীনতার স্বাদ দিয়েছে। এয়ারপোর্টে যাওয়ার জন্য গাড়ি আগে থেকেই বুক করা ছিল। সেটি নির্দিষ্ট সময়েই নভোনীলদের হাউসিং সোসাইটির গেটে এসে দাঁড়ালো। "বাড়ির তালাবন্ধ করে চাবিগুলো ঠিক জায়গামতো রাখা হয়েছে তো?" চেইন খুলে হাতের লেদার ব্যাগটার ভেতরের পকেটটা একবার দেখে নিলো নভোনীল। হ্যান্ডব্যাগটার ভেতরে আর আছে ওর ওয়ালেট। সেখানেই আই.ডি প্রুফ, এ.টি.এম কার্ড, সামান্য খুচরো টাকা ও অন্যান্য টুকিটাকি জিনিষ। সাথে রয়েছে আর একটা বড় ট্রলি স্যুটকেস। গাড়ির পেছনের সীটের দরজা খুলে নভোনীল গুছিয়ে বসলো। স্যুটকেসটা গাড়ির পেছনের ডিকিতে। হ্যান্ড ব্যাগটা খুলে এয়ার টিকিটের প্রিন্টআউটটা একবার দেখে নেওয়া যাক্। যদিও মোবইল ফোনে টিকিট তো রয়েছেই...তবুও...। "নভোনীল আই.ডি প্রুফ মানে পাসপোর্ট বা আধার কার্ড...কোনটা নিয়েছো? ওটা না হয় এখনই টিকিটের সাথে একসাথে...তাহলে এয়ারপোর্টে পৌঁছে আর হুড়োহুড়ি করতে হবেনা। মনে নেই...সেই যে একবার ব্যাগ খুলে আই.ডি প্রুফ বের করতে গিয়ে এ.টি.এম কার্ড নীচে পড়ে গিয়ে হারিয়ে টারিয়ে...সে কি কান্ড "... বেঙ্গালুরু শহরের জ্যামজট বিরাট বিখ্যাত। নভোনীলের বাড়ি থেকে এয়ারপোর্টে পৌঁছতে লেগে গেলো পাক্কা নব্বই মিনিট। গাড়ি থেকে নেমে এয়ারপোর্টের ভেতরে ঢোকার গেটের দিকে এগিয়ে গেল নভোনীল। হাতে টিকিটের প্রিন্টআউট আর আইডেন্টিটি প্রুফ পাসপোর্ট। গাড়িতে বসেই ও সব গুছিয়ে নিয়েছে। এয়ারপোর্টে পৌঁছে তাহলে আর ব্যাগ খুলে খোঁজাখুজি হুড়োহুড়ি করতে হবেনা...। বোর্ডিংপাস নেওয়া, সিকিওরিটি চেক নির্বিঘ্নেই হয়ে গেল। আর মিনিট দশেকের মধ্যেই বোর্ডিং শুরু হবে ...। "নভোনীল কানের ব্যথার ওষুধটা মনে আছে তো ?একটা খেয়ে নেওয়াই তো ভালো" যাতায়াত আজকাল সব প্লেনেই। দেখতে দেখতে প্রায় বিশ বাইশবার প্লেনে চড়াও হয়ে গেলো তবুও উড়ন্ত জাহাজটিতে উঠলেই নভোনীলের কানের মধ্যে কটকট্ করাটা এখনও কমলো না। সাথে অস্বস্তিকর ব্যথা। ভাগ্যিস মনে পড়লো... হ্যান্ডব্যাগটা খুলে নভোনীল ছোট্ট একটা ট্যাবলেট খেয়ে নিলো। এটা খেলে একটু স্বস্তি পাওয়া যায় । ঠিক সময়মতো বোর্ডিং হয়ে গেল। জানালার ধারেই সীট। ব্যাগেজ কেবিনে ব্যাগটা ঢুকিয়ে রেখে নিজের সীটে বসলো নভোনীল... "বোর্ডিং হয়ে গেলেই জানিয়ে দিস কিন্তু বাবু...ভুলিস না যেন" পকেট থেকে সেলফোনটা বের করলো নভোনীল। মেসেজিং এ গিয়ে টাইপ করা শুরু করলো-বি ও এ...লিখলো "বোর্ডেড" "বোর্ডেড"...এবার ? মেসেজটা কার কাছে, কোন্ নম্বরে পাঠাবে চব্বিশ বছরের যুবকটি ?দুটো নম্বরই যে... মাত্র কয়েক বছর আগের কথা। বাবামায়ের একমাত্র সন্তান নভোনীল সদ্য বারো ক্লাস পাশ করেছে। কৈশোরকে পেছনে রেখে তার দৃষ্টি তখন অজানা,অচেনা অনিশ্চিত যৌবনের দিকে। বড় উথালপাতাল বয়স ও সময় সেটা। স্বপ্ন আর আশঙ্কা মিলেমিশে একাকার... পিতামাতার অনুশাসন, স্নেহ, সন্তানের জন্য দুশ্চিন্তা সব কিছুতেই মাঝেমাঝে বড্ড বিরক্ত বোধ করতো নভোনীল। দমবন্ধ হয়ে আসতো । ওর মন তখন শুধু স্বাধীনতা চাইতো। বেঙ্গালুরুতে পড়াশোনা করতে এসে বাড়ি থেকে দূরে একা স্বাধীনভাবে থাকার সুযোগ পেল ও। মা বাবার দুশ্চিন্তা অবশ্য পিছু ছাড়লোনা। সারা দিনে কত রকম অজুহাতে যে মা ফোন করতো। ছেলেকে দূরে পাঠিয়ে মায়ের মনখারাপ আর কমতোই না। ফোন করে মা বলতো-"বাবু ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করছিস তো?" কখনও আবার-"বাবু তোর গলার আওয়াজটা যেন কেমন শোনাচ্ছে...শরীর খারাপ নয় তো ?সাবধানে থাকিস সোনা "। নভোনীল কতবার রেগে উঠে মুখঝামটা দিয়েছে। মা সেসব কখনও গায়ে মাখতোনা । বাবা অবশ্য একটু অন্যরকমভাবে। মায়ের মত বারবার ফোন করে নয়। সকালবেলার দিকে বাবা একেক দিন এক একটা মেসেজ লিখে পাঠিয়ে দিতেন, এই যেমন-"স্কুটার চালানোর সময় হেলমেটটা ভুলোনা যেন" অথবা "স্পীড এর ওপরে কন্ট্রোল যেন থাকে,ওটা সিভিক সেন্স "-এইরকম সব... ওহ্ ,সেলফোনটা এবার সুইচ অফ্ করতে হবে। এয়ারহোস্টেস ঘোষণা করে দিয়েছে। "বোর্ডেড"-মেসেজটা আজ আর কারুকে পাঠানোর নেই। গন্তব্যে পৌঁছে পৌঁছ-সংবাদও আর জানাতে হবেনা কারুকে। এখন আর নভোনীলের জন্য...তার খবরের জন্য অপেক্ষায় থাকেনা কেউ ...। যাঁরা প্রতিটা মুহূর্ত নভোনীলের জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকতেন, যে কোনো ভাবে ফোনের মধ্যে দিয়ে,মেসেজের মধ্যে দিয়ে সন্তানকে একটু ছুঁয়ে থাকতে চাইতেন...তাঁরা দুজনেই গতবছর মাত্র ছয়মাসের ব্যবধানে এই পৃথিবী থেকে হারিয়ে গিয়েছেন... কিন্তু সত্যিই কি তাঁরা হারিয়ে যান ? বোধহয় না...। তাঁরা শিক্ষা হয়ে, সংস্কার হয়ে থেকে গিয়েছেন নভোনীলের হৃদয়ে,মননে,মস্তিষ্কে...। তাদের অভিভাবকত্ব প্রতিমুহূর্ত আগলে রাখে সন্তানকে। তাঁরাই তো বারবার মনে করিয়ে দেন-"নভোনীল গ্যাসের নবটা বন্ধ করেছিলে তো ?" অথবা "এয়ারপোর্টে পৌঁছনোর আগেই টিকিট,আই ডি প্রুফ সব গুছিয়ে রাখো বাবা ...সাবধানে যেও সোনা...সাবধানে থেকো " তাঁরা থাকেন...এমনভাবেই মনের মধ্যে থাকেন। "মনের মধ্যে থাকাও "তো একরকমের থাকা ...। নভোনীল বাবামায়ের সব শিক্ষাকে মনের মধ্যে গুছিয়ে রাখে...