STORYMIRROR

susmIta Saha

Classics

3  

susmIta Saha

Classics

অন্যরকম

অন্যরকম

9 mins
976


পাখির ডাকের মত সুরে বাইরের দরজায় কলিং বেলটা বজতেই নয় বছরের বাচ্চা মেয়ে 'ঢেউ' খাতা বই ফেলে ছুটে গেল দরজা খুলতে। ভারি ছটফটে স্বভাবের মিষ্টি নাতনীটি সুজাতার । দরজার বাইরে কোন্ অতিথি দাঁড়িয়ে রয়েছেন সেটা ওকেই প্রথম জানতেই হবে...। দরজা খুলে দিয়ে একেবারে লাফাতে লাফাতে, হাঁফাতে হাঁফাতে ও ঠামিকে এসে বললো-"জানো ঠামি , আমাদের বাড়িতে একজন বেঙ্গলী-মিডিয়াম আন্টি এসেছেন, তোমার সাথে কথা বলতে চাইছেন।" ঠাম্মা সুজাতাদেবী তখন শোওয়ার ঘরের লাগোয়া ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দূরের সবুজ পাহাড় দেখছেন। বেশ বেশি বয়সে কলকাতা ছেড়ে পুনেতে এসে বসবাস করতে হচ্ছে বলে সুজাতাদেবীর মনটা প্রায় সবসময়ই একটু খারাপ হয়ে থাকে। কিছুতেই যেন মন বসেনা। নিজের শহর, নিজের ভাষা, আত্মীয় স্বজন বন্ধুবান্ধব , পুরনো জীবনের সব কিছুকেই বড় মিস্ করেন তিনি... সবসময়। শুধু এই বাড়ির বারান্দা থেকে পাহাড় দেখতে পাওয়াটা এক বিরাট মজার ব্যাপার। ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালেই যেন মনে হয় হয় হিল্ স্টেশনে বেড়াতে এসেছেন। স্বামী মনোময় বছর চারেক হল রিটায়ার করেছেন। কাজ করতেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের দপ্তরে। কাজেই তার কর্মজীবনে যা কিছু বদলি হয়েছিল তা ওই পশ্চিমবঙ্গের মধ্যেই। ছেলের পড়াশোনার জন্য অনেক জায়গায় তো সুজাতা কোলকাতা ছেড়ে যেতেও পারেননি।কাজেই জন্ম থেকে সুজাতার জীবনটা কেটেছে মোটামুটি কলকাতার মধ্যেই । কিন্তু একমাত্র ছেলে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে আর কলকাতায় থাকতে পারলোনা। তার চাকরী বাকরী, বিয়ে এবং শেষে লোন নিয়ে বিশাল ফ্ল্যাট কিনে ফেলা সবই ঘটে চলল এই পুনে শহরে। স্বামীর রিটায়ারমেন্টের পরেও বছর তিনেক কর্তাগিন্নী কলকাতাতেই ছিলেন। কিন্তু গত বছরই সুজাতার একটা ছোটখাট স্ট্রোক হতেই ছেলে অর্ণব আর কোন কথাই শুনতে রাজি হল না। মা-বাবাকে সে কাছে এনে রাখবেই। নাতনী ঢেউকে দেখাশোনার দোহাই দিয়ে মাকে বেশ কিছুটা ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলিং করতেও অর্ণব ছাড়েনি। পুত্রবধূ মন্দাকিনী মহারাষ্ট্রের মেয়ে। ভারি বুদ্ধিমতী ও মিষ্টি স্বভাব। শ্বশুর শাশুড়ির প্রতি কর্তব্যবোধ ও যত্নআত্তিতে বিন্দুমাত্র ত্রুটি নেই। সে নিজেও খুব বড় চাকরি করে এবং সারাদিনই প্রায় বাড়ির বাইরে থাকে। তবুও কোনো ভাবেই সে সংসারের যাবতীয় কাজের বোঝা মোটেই শাশুড়ির উপর চাপিয়ে দেয়নি। এখানে কাজের লোকের খুবই সুবন্দোবস্ত করা হয়েছে। ছেলে অর্ণব শুধু আব্দার করেছে - ঢেউ দুপুর বেলা স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে আসার পর মা যেন তাকে একটু বাংলাভাষা লিখতে পড়তে শেখায়। সুজাতা এখানে বাংলা খবরের কাগজ পড়তে পান না, ম্যাগাজিন, গল্পের বই যোগাড় করতেও বেশ ঝামেলা পোহাতে হয়। বাংলায় গল্প করার সুযোগও তেমন হয়না । তাই সারাদিনের মধ্যে ওই দুপুর বেলাটুকু নাতনীকে বাংলা শেখানোর কাজটা তিনি বেশ উপভোগই করেন। কিন্তু বাকী দিনটাতে মন খারাপের ভাবটা যেন আর কাটতেই চায় না। শুধু ভালো লাগে ব্যালকনিতে এসে পাহাড়গুলোর দিকে তাকালে...। বাড়ির বারান্দা থেকে পাহাড় দেখার কথা তো আর কলকাতার লোক ভাবতে পারেনা। এখানে পাহাড় গুলো এত কাছে.... ঠিক যেন একেবারে নিজের বাড়ির লোক। নাতনীর আধো আধো উচ্চারণে "বেঙ্গলী মিডিয়াম আন্টি" শব্দটা শুনে সুজাতাদেবী ভারি মজা পেলেন। একই সাথে তার মাথায় দুটো ভাবনা উঁকি দিয়ে গেল। প্রথমেই মনে হল বাহ্ বাচ্চা মেয়েটা ওর বয়সানুযায়ী বোধবুদ্ধি দিয়ে কি সুন্দর একটা শব্দ তৈরী করেছে তো । যে কোনো ভাষার মধ্যেই অনেক বিদেশী শব্দ তো থাকেই। মনের ভাব প্রকাশ করাটাই তো ভাষার প্রধান কাজ। এত ছোট একটা মেয়ে তো আর 'বঙ্গললনা' বা 'বাঙালি মহিলা' বলতে পারে না। ও ঠিক ওর মত করেই বুঝিয়ে বলেছে। দ্বিতীয়ত একজন "বেঙ্গলী মিডিয়াম আন্টির" সাথে কথা বলার সুযোগ পেলে যে ঠাম্মার ভালো লাগবে, সেকথা শিশুটির চোখের তারায় চক্ চক্ করে উঠেছে। শিশু নাতনী যে তার ঠামির মনের কথা এইটুকু বুঝেছে, ভেবেই সুজাতাদেবীর মনটা দ্রব হয়ে গেল। ড্রয়িংরুমে পা দিয়ে সুজাতাদেবী দেখলেন - খোলা দরজায় দাঁড়িয়ে রয়েছে বড় লাবন্যময়ী চেহারার শাড়ি পরা একটি মেয়ে। হাতে শাঁখাপলা কিছু নেই, চুলের সিঁথিতে সিঁদুরেরও বিশেষ আধিক্য নেই কিন্তু তার মুখমন্ডলের জলপাই রঙের কমনীয়তাই তাকে চিনিয়ে দেয় একজন বাঙ্গালী বলে। ঢেউ অবশ্যই এত সব কিছু বোঝেনি। মেয়েটির বাংলা কথা শুনেই সে তাকে বাঙালি বলে বুঝেছে। দুই গল্প করতে করতে বিকালের চা খাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছিল। স্বামী মনোময় তখন ঢেউকে সঙ্গে নিয়ে পার্কে বেড়াতে যাবেন। শ্রাবন্তীর হাত ধরে সুজাতাদেবী যখন তাকে সোফায় বসিয়েছিলেন, ঘড়িতে তখন বেজেছিল দুপু‌র দেড়টা। তিন সাড়ে তিন ঘণ্টা সময় যে কখন কিভাবে পেরিয়ে গিয়েছে দুজনের কেউই টের পায় নি। যতক্ষণ শ্রাবন্তীর সাথে গল্প করছিলেন সুজাতাদেবীর মাথায় শুধু একটা চিন্তাই ঘুরপাক খাচ্ছিল-"মেয়েটা বড় অন্যরকম"। তা সেই "অন্যরকমটা" যে কিসে সেটা একদম বোঝা যাচ্ছিল না। কিন্তু চিন্তাটা এক মুহূর্তের জন্যও সুজাতাদেবীর মন থেকে সরেনি। একেবারে প্রথম দিনের সাড়ে তিন ঘন্টার আলাপে দুই অসমবয়সী নারীর মনের কোন তারটি যে ঠিক মিলে গেল... সারা দুপুর প্রাণ খুলে গল্প করলেন তারা। আর শ্রাবন্তীর চলে যাওয়ার পর থেকে "অন্যরকম" শব্দ টা যেন সুজাতাদেবীকে তাড়া করতে লাগলো। আলাপচারীতার শুরুতেই প্রায় সব প্রবাসী বাঙালিই সবাইকে যে স্বাভাবিক প্রশ্নটি করেন, সুজাতাও তেমনি শ্রাবন্তীকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন - "তোমার তো বলছ - কলকাতাতেই জন্মকম্মো, বড় হওয়া, স্কুল কলেজে পড়াশোনা সবই কলকাতায়... পুনেতে এসে কোলকাতাকে মিস্ করো না?...এখানকার শহরটা, এখানকার জীবন যাত্রা... সব কিছু এত আলাদা...।" সুজাতাকে একটু অবাক করে দিয়ে নিরানব্বই শতাংশ বাঙালিদের থেকে আলাদা একটা অন্যরকম উত্তর দিয়ে শ্রাবন্তী বলেছিল-"না, কাকীমা, আমার কলকাতায় থাকার সময় যেমন ভালো লাগতো, পুনেও ঠিক সেইরকমই ভালো লাগে, একেবারে প্রথম দিন থেকেই । আমি সারাদিন সংসারের কাজকর্ম আর বাগান নিয়ে থাকি তো তাই কখনও স্মৃতিকাতরতায় ভুগিনা।" সুজাতার মনে পড়ে গিয়েছিল একটা বিখ্যাত কবিতার লাইন - "বাল্যকালে একটা ছিল বিষম সুখ, তখন কোনো বাল্যকালের স্মৃতি ছিল না।" মেয়েটার শৈশবের সারল্য আর সাদা কাগজের মত মনটা এখনও হারিয়ে যায়নি । তারপরে কথা প্রসঙ্গে সুজাতা জানলেন শ্রাবন্তীর বেশ বড় পরিবার। বৃদ্ধ শ্বশুর শাশুড়ি ছাড়াও একসাথে থাকেন একজন বিকলাঙ্গ ভাশুর। শ্রাবন্তীরা স্বামী স্ত্রী ও তাদের দুটি ছেলে মেয়ে এবং এক ভাগ্নী ওদের কাছে থেকেই পুনে সিমবায়োসিস কলেজে পড়াশোনা করে। পরিবারের সকলের দেখা শোনা, এমনকি এতগুলো লোকের রান্নাবান্না শ্রাবন্তী নিজেই করে। ঠিকে কাজের লোক থাকলেও রান্নার কোনও লোক নেই। বড় সংসারের দায় দায়িত্ব ও কাজের বোঝা নিয়েও শ্রাবন্তীর কোনো অভিযোগ নেই। এমনকি এত দিক সামলায় বলে কথায় কোনো প্রচ্ছন্ন অহংকারের সুরও নেই। কথার ফাঁকে ফাঁকে সুজাতা যে একটু অপেক্ষা করছিলেন না তাও নয় - বারে বারেই মনে হচ্ছিল এই বোধ হয় মেয়েটি তার শ্বশুর শাশুড়ি, ভাশুর অথবা ভাগ্নী কে নিয়ে কোনো অভিযোগ বা কোনো ব্যথা পাওয়া কিম্বা কোনো সমস্যার সমাধান আলোচনা করতে চাইবে। মানুষ তো সাধারণত সুখের কথা জানাতে, দুঃখের কথা ভাগ করে নিতে বা সমস্যা সমাধানের পথ খোঁজার জন্যই বন্ধুত্বের দিকে হাত বাড়ায়। কিন্তু না শ্রাবন্তী সেরকম কোন কথাই বলল না। সুজাতা অবশ্য এও ভাবলেন... "একেবারে প্রথম দিনেই কি সব কথা

বলা যায়? হয়ত আজ আলাপ করতে এসেছে... পরে সব বলবে।" কিন্তু মেয়েটা যে ঠিক কোথায় একটু "অন্যরকম" সেটা কিছুতেই খুঁজে পেলেন না। যাই হোক কথা বলতে ভারী ভালো লাগছিল বলে সুজাতা একসময়ে শ্রাবন্তীর মোবাইল ফোনের নম্বরটি চাইলেন, বললেন-"আমিও কখনোসখনো তোমার কাছে চলে যাবো... তবে তুমি ব্যস্ত মানুষ তোমাকে ফোন করে জানিয়ে তবেই যাব।" এবারও সুজাতাকে অল্প একটু অবাক করে শ্রাবন্তী জানালো যে সে মোবাইল ফোন ব্যবহার করেনা। মাছের বাজারে মাছ বিক্রি করে যে মহিলাটি থেকে শুরু করে বাড়ির বাথরুম পরিস্কার করতে আসেন যিনি, সবার হাতেই মোবাইল দেখে আজকাল চোখ সয়ে গিয়েছে। এমনকি ফুটপাথের ভিখারী থেকে কুম্ভমেলার নাগা সন্ন্যাসীর হাতেও মোবাইল ফোনের ছবি খবরের কাগজে দেখতে পাওয়া যায়। যাইহোক তার মধ্যেও মোবাইল ফোন ব্যবহার না করে খবর তৈরী করেছেন - এমন মানুষও যে একেবারে নেই, তা নয়। কিন্তু এই মেয়েটিকে এত বেশি অন্যরকম কেন লাগছে সুজাতার ? মনে মনে এই প্রশ্নের উত্তরটা হাঁতড়েই চলেন তিনি...। বিকেল সাড়ে পাঁচটা বাজলে গল্প শেষ করে উঠে পড়তেই হয় শ্রাবন্তীকে। ছেলে মেয়ে দুজনেরই স্কুল থেকে ফেরার সময় হয়ে গিয়েছে । চলে যাওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে একটি অদ্ভুত অনুরোধ করে শ্রাবন্তী। সুজাতাদেবীর হাত দুটো ধরে, কন্ঠস্বরে এক তীব্র আকুতি নিয়ে সে বলে - "কাকীমা, আজ রাতে আপনি একটু আমাদের বাড়িতে আসবেন?" প্রশ্নটা বুঝতে সুজাতার একটু সময় লাগে, একটু থতমত খেয়ে যান তিনি। মনে মনে ভাবেন- "শ্রাবন্তী কি এটা তাকে ডিনারের নেমতন্ন করছে?" একেবারে প্রথম দিনেই? দুই পরিবারের বাকি সদস্যদের সাথে তো আলাপ পরিচয়ই হয় নি...।" প্রশ্নটা সঠিক বুঝতে না পেরে মিনিট দুয়েক চুপ করে থেকে সুজাতা বললেন - "ও মা, আজই কি করে হবে বলো দেখি? আমার ছেলে বৌমা তো ফেরে বেশ রাত করে.... ওদের সাথে কথা না বলে তো কিছু বলতে পারব না ভাই।" সুজাতার মুখের কথা প্রায় শেষ করতে না দিয়েই শ্রাবন্তী বলে ওঠে - "না, না অন্য কারুকে বিব্রত করার দরকার নেই কাকীমা, শুধু আপনি একাই আসবেন।" সুজাতাকে আরও অবাক করে সে বলে চলে - "আপনি চিন্তা করবেন না, আপনার ডিনার ও অন্যান্য সব কাজ সেরে রাত সোওয়া এগারো সাড়ে এগারোটা নাগাদ আসলেই হবে... মাত্র মিনিট পনেরোর জন্য। প্লীজ কাকীমা না বলবেন না... আজকের রাত টা... ঠিক ঐ সময়ে একবার আসবেন।" - বলেই শ্রাবন্তী আর দাঁড়ায় নি। লিফটের কাছে চলে গিয়েছিল একই বিল্ডিং এর টপ ফ্লোরের দিকে যাবে বলে...। এবার সুজাতাদেবী সত্যি সত্যি অবাক হয়ে গেলেন। জীবনে এরকম নিমন্ত্রণ তিনি কখনো পাননি, অন্য কারুর কাছে শোনেনও নি। তবে কি শ্রাবন্তীর জীবনে লুকিয়ে আছে গভীর কোনো দুঃখ? কোনো সমস্যা? কোনো বিপদ?... ও কি সুজাতার কাছে সাহায্য চাইছে? ভেবে ভেবে কোনো কূলকিনারা পেলেন না তিনি। তিন রাত সাড়ে নটার সময় স্বামী, ছেলে ও বৌমার সাথে ডিনার সারছেন সুজাতা। ঢেউ ঘুমিয়ে পড়েছে খানিকক্ষণ আগেই। রাতে একসাথে খেতে বসেই সকলের সারাদিনের গল্প হয়। আজ সুজাতাদেবী শ্রাবন্তীর গল্প শোনালেন, এমনকি সেই অদ্ভুত নিমন্ত্রণের কথাও বাদ দিলেন না। স্বামী মনোময় সাবধানী মানুষ, শুনেই তিনি মন্তব্য করলেন - "একদম এসব ঝামেলার মধ্যে যেতে হবে না। নিজে তো বিপদে পড়বেই, ছেলে বৌমাও কোনো অসুবিধার মধ্যে পড়ে যাবে।" দুপুর বেলা তিনিও শ্রাবন্তীকে দেখেছেন ঠিকই কিন্তু জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রথম থেকেই মানুষকে অবিশ্বাস করার নীতিতে বিশ্বাসী মনোময় । আজ স্বীকার না করেও উপায় নেই যে অভিজ্ঞ স্বামীর কথা জীবনের বহু ক্ষেত্রেই 'সত্যি'ও প্রমানিত হয়েছে। অর্ণবও বেশ বুদ্ধিমান ছেলে, তবে ও প্রথমেই কোনও মন্তব্য করেনা। যদিও তার বডি-ল্যাঙ্গুয়েজও বাবারই পক্ষে। সুজাতার মন কিন্তু মানছে না। নিজের কোনো বিপদের কথা তিনি ভাবছেননা ঠিকই তবে ছেলে বৌমার অসুবিধার কথা তো ভাবতেই হয়। কিন্তু শ্রাবন্তী মেয়েটার এই "অন্যরকম" রহস্যটা যে তাকে জানতেই হবে। বৌমা মন্দাকিনী কিন্তু অনেকটাই খোলামেলা মনের আধুনিক মেয়ে । সোসাইটির বিভিন্ন অনুষ্ঠানে স্নিগ্ধ ব্যক্তিত্বের অধিকারিণী শ্রাবন্তীকে সে দেখেছে ঠিকই তবে আলাপ পরিচয় করা হয়ে ওঠেনি। পুত্রবধূটি বরং শাশুড়ি মাকে সাহস জুগিয়ে বলল-" আপনি অত ভাববেন না মা , আপনার কাছে মোবাইল ফোন তো থাকবেই, কোনো বিপদ হলে বা প্রয়োজন হলে আপনি আমাকে একটা কল করবেন। আমি নীচে জেগে থাকবো... আপনি ঘুরে আসুন তো, দেখুনই না হয়.... ভদ্র মহিলা কি বলতে চান... কেন আপনাকে এত রাতে ওপরে যেতে বলেছেন?" চার রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ সুজাতাদেবী তিনতলা থেকে লিফটে করে উঠে এলেন বারো তলায়। শ্রাবন্তীদের ফ্ল্যাটের দরজার কাছে এসে কলিং বেলটা তাকে আর বাজাতে হলনা। ড্রয়িংরুমের দরজা খুলে রেখে সোফায় বসে শ্রাবন্তী। সে অপেক্ষা করছিল সুজাতাদেবীরই জন্য। তার পরিবারের অন্য সদস্যরা কেউই তখন আর জেগে নেই। সকলেই ঘুমিয়ে পড়েছে। সুজাতাদেবীর যে একটু অস্বস্তি হচ্ছিল না তা নয়। কিন্তু অদম্য কৌতূহলের কাছে সেটা নগন্য। তাঁকে দেখতে পেয়েই শ্রাবন্তী উঠে এসে হাতটা ধরে বলল-" আপনাকে আমার সাথে একটু ছাদে যেতে হবে কাকীমা"। এবার সুজাতা সত্যি একটু ভয় পেলেন, তার বুকের ভেতরটা ধক্ করে উঠল...। কিন্তু শ্রাবন্তীর কন্ঠস্বরে, তার চোখের দৃষ্টিতে কি যে এক আকূতি.... এক উত্তেজনা...। সুজাতা যেন নেশাগ্রস্তের মত, মোহাচ্ছোন্নের মতো ওকে অনুসরন করলেন। শুধু হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরে রাখলেন মোবাইল ফোনটা। এবার আর লিফট নয়। বারোতলার মাথার উপরেই ছাদে উঠে এলেন সুজাতা ও শ্রাবন্তী... সিঁড়ি বেয়ে। হিপনোটাইজড হওয়ার বাকিটা সম্পন্ন হল ছাদে এসে। একেবারে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল সুজাতার। কি অসাধারণ, অপূর্ব, অলৌকিক এক বাগান নিজের হাতে বানিয়েছে শ্রাবন্তী।পুরো ছাদ জুরে । সেই বাগানের ঠিক মাঝখানে রয়েছে একটি "ব্রহ্মকমল" ফুলের গাছ। কথিত আছে - প্রকৃতিকে রূপে রসে বর্নে গন্ধে সাজিয়ে তোলার পর ঈশ্বর একেবারে নিজের জন্য সৃষ্টি করেছিলেন এক অলৌকিক পুষ্প -সেটি"ব্রহ্মকমল"। গভীর মায়াবী কোনো এক রাতে স্রষ্টাকে শান্তি দিতে, বিশ্রাম দিতে, আনন্দ দিতে প্রস্ফুটিত হয় ব্রহ্মকমল। পৃথিবীতে তখন স্বর্গ নেমে আসে...আকাশ ভরে যায় রামধনু রংএর আলোয়... কোথা থেকে যেন ভেসে আসে সুরের মূর্ছনা... দেবদূতরা চলে আসেন পৃথিবীর কাছাকাছি... আকাশ বাতাস ভরে যায় স্বর্গীয় সুষমায়...ব্রহ্মকমলের সুঘ্রানে। মাত্র কয়েক লহমার জন্য স্হায়ী হয় এই স্বর্গীয় পরিবেশটি। তারপর ব্রহ্মকমল আবার নিজেকে গুটিয়ে নেয়। শুধুমাত্র বিরল সৌভাগ্যের অধিকারীরাই এই দৃশ্যের সাক্ষী হতে পারে... প্রায় জ্ঞান হারানোর মত অবস্থা হয়েছিল সুজাতার। এক হাতে মোবাইল আর অন্য হাতে তিনি শক্ত করে ধরে রেখেছিলেন শ্রাবন্তীর হাত। খানিকটা ধাতস্থ হওয়ার পর ওঁর মনে হল কেন "শ্রাবন্তী অন্যরকম ? প্রতিদিন নিজের হাতে গাছের যত্ন করতে করতে ঠিক ধাত্রীমায়ের মতনই সে বুঝতে পেরেছিল- "আজই সেই রাত, যখন গভীর রাতে প্রস্ফুটিত হবে ঈশ্বরের একান্ত প্রিয় পুষ্প - ব্রহ্মকমল। পৃথিবীতে আজ রাতে রচিত হবে স্বর্গ।" সেই স্বর্গীয় জন্মমূহুর্তটির সাক্ষী হওয়ার জন্য, ব্রহ্মকমলের জন্মলগ্নটিকে সেলিব্রেট করার জন্য, সুজাতার মনখারাপ করা একঘেয়ে জীবনে এমন একটা অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা উপহার দেওয়ার জন্য শ্রাবন্তী তাকে রাতদুপুরে ছাদে ডেকে এনেছে। "সত্যিই কি মেয়েটা অন্যরকম নয়?"সুজাতা অবাক হয়ে ব্রহ্মকমলের দিকে চেয়ে রইলেন ...


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics