Manasi Ganguli

Classics

4.9  

Manasi Ganguli

Classics

সূর্যপ্রণাম

সূর্যপ্রণাম

4 mins
615


রোজ বিকেলে গঙ্গার ধারে পার্কে এসে আরতিদেবী আগেই গঙ্গার দিকে ফিরে দুই হাত জোড় করে প্রণাম করেন,তারপর ঘড়ি ধরে আধঘন্টা হাঁটেন আর তারপর বেঞ্চে বসেন, যতক্ষণ না সূর্য অস্ত যায় উনি বসে থাকেন,এটা তাঁর নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার। হাঁটার সময় উনি কোনোদিকে তাকান না,কারো সাথে কথা বলেন না,সেটা ওখানে যাঁরা আসেন সবাই জানেন তাই কেউ ওনাকে বিরক্ত করেন না। না,তাই বলে উনি অসামাজিক নন,বেঞ্চে বসে উনি গল্প করেন যিনি বা যাঁরা পাশে বসে থাকেন তাঁদের সঙ্গে। তেমনি সূর্যাস্তের সময় অস্তগামী সূর্যকে প্রণাম করে বাড়ি ফেরেন। এমনই চলছিল গত চার পাঁচ বছর।

    এরপর অমিতবাবু পার্কে আসা শুরু করলেন। দীর্ঘকাল প্রবাসে বাস করে ফিরে এসেছেন ঘরে,ছেলে বউয়ের সংসারে। বাড়ি যদিও ওনারই,স্হায়ীভাবে বসবাস করেননি কখনও বাড়িতে। চাকরির সুবাদে বাইরেই কাটাতে হয়েছে চিরকাল,এমনকি রিটায়ারমেন্টের পরেও চাকুরী থেকে অব্যাহতি পাননি তাঁর কর্মদক্ষতা ও সুনামের জন্য।তবে গত চারমাস আগে স্ত্রীর মৃত্যুতে একা হয়ে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ায় তাঁর ছুটি মেলে।কিন্তু বাড়ি ফিরেও তিনি শান্তি পান না একে তো জীবনসঙ্গিনীকে এইবয়সে হারিয়েছেন,তারপর এতদিন কর্মব্যস্ত ছিলেন,তাই অলস জীবন যেন তাঁর কাটতেই চায় না। ছেলে বউমার সাথে থাকাও অভ্যাস নেই, তারাও সারাক্ষণ নিজেদের কাজ নিয়ে ব্যস্ত,তাই সব সময় নিজেকে অবাঞ্ছিত,অবহেলিত মনে হতে থাকে তাঁর।

    গত সাত-আটদিন থেকে তিনি আসছেন গঙ্গাধারের এই পার্কে আর প্রথমদিন থেকেই চোখে পড়ছে তাঁর আরতিদেবীকে। দেখেই যেন মনে হয় শান্তির প্রতিমূর্তি। তাঁর ভক্তিভরে গঙ্গাপ্রণাম দেখে অমিতবাবুর মনে হয় কত শান্তি ওনার জীবনে,তাই এত ভক্তি আসে প্রাণে। আস্তে আস্তে কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ হয়,ভালোই লাগে পার্কে আসতে।আরতিদেবীর সাথেও আলাপ হয়,প্রথম প্রথম হাসি ও কুশল বিনিময়,পরে ক্রমে তা বন্ধুত্বে পরিণত হয়।

      ব্যক্তিগত কথার আদান-প্রদান শুরু হলে অমিতবাবু জানতে পারেন আরতীদেবীর স্বামী অনেককাল আগে গত হয়েছেন যখন তাঁর ছেলে ছয় বছরের। সেই ছেলেকে মানুষ করতে আরতিদেবীকে অনেক ঝড়ঝাপটা সামলাতে হয়,বয়স কম তাই নিজেকে সামলানোও প্রায় দুঃসাধ্য ব্যাপার ছিল। সব কিছু অতিক্রম করলেন তিনি,সেই ছেলে বড় হলো,চাকরি পেল,উনি তার বিয়ে দিলেন নিজেই পছন্দ করে কিন্তু এই প্রৌঢ়বয়সেও পরিশ্রমের হাত থেকে তাঁর মুক্তি নেই। সংসারের যাবতীয় কাজ,রান্নাবান্না সবই নিজের হাতে করেন। অমিতবাবু তাঁর বৌমার কথা জিজ্ঞাসা করলে আরতিদেবী সস্নেহে বলেন,"আহা ছেলেমানুষ এখন, আমার মেয়েরই তো মত,একটা মেয়ে থাকলে কি আমি তাকে করতে দিতাম?সারাটা জীবন তো রইলোই পড়ে,যখন আমি থাকব না......" আরতিদেবীকে অবাক করে দিয়ে অমিতবাবু হঠাৎ হাত দিয়ে তাঁর মুখটা চেপে ধরেন,বলেন,"আর কোনোদিন এমন বলবেন না,আমি শুনতে পারি না। আপনার কথা শুনে আমার আপনার জন্য কষ্ট হচ্ছে,আপনাকে যত দেখি আমি অবাক হই,জীবনে এত কষ্ট পেয়েও আপনি এত শান্তভাবে এমন কথা বলেন কি করে? এত ভক্তিমতী হলেন কি করে? এমন এক শান্তির প্রতিমূর্তি,আপনাকে দেখলে মনে হবে না এত কষ্ট পেয়েছেন জীবনে আর আজ এই বয়সেও এত পরিশ্রম হাসিমুখে,কোনো অভিযোগ নেই,কি করে করেন আপনি? আমি যেন দিন দিন কেমন হয়ে যাচ্ছি, জীবনটাকেই এখন অসহ্য মনে হয়"। আরতিদেবী অমিতবাবুর এই আচরণে খানিক থমকে যান কিন্তু চকিতে নিজেকে সামলে তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় মৃদু হাসেন,বলেন,"মশাই কষ্ট পেলে কি করে চলবে বলুন,আমাদের যার যেটুকু করবার তা তো করতেই হবে,যার যেটুকু পাবার সেটুকুই সে পাবে। আমার যে কদিন স্বামীসঙ্গ পাবার ছিল পেয়েছি,সেটাই মেনে নিয়েছি,তাই মনে কোনো অশান্তি ছিল না। হ্যাঁ,দুঃখ হত পাশের মানুষটাকে হারিয়ে,অসহায়ও লাগত অনেক সময়,কিন্তু নিজেকেই নিজে বোঝাতাম,না হলে আর কি-ই বা করতাম বলুন? আর নিজের সংসারের কাজ করব এতে দুঃখের কি আছে? আমি তো খুশিমনেই করি। আমি আমার সংসারটাকে বড় ভালবাসি জানেন"।অমিতবাবু যত দেখেন তত অবাক হন,কি অবলীলায় ভদ্রমহিলা বলে যাচ্ছেন,কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই ওনার তবে তিনি কেন পারছেন না সব মেনে নিতে,সবেতেই যে তাঁর অসহ্য লাগে,কেবল ভাল লাগে এই আরতিদেবীর সান্নিধ্যটুকু। এক অমোঘ আকর্ষণে ছুটে আসেন বিকেলে গঙ্গার ধারে এই পার্কে,ক্ষণিকের আনন্দ,ক্ষণিকের শান্তিটুকু পেতে। ওনার সান্নিধ্যে আস্তে আস্তে নিজেও একটু শান্ত হচ্ছেন অমিতবাবু,ওনার জীবনদর্শন অনুযায়ী চলার চেষ্টা করছেন,আর কিছুটা হলেও নিজেকে একটু করে শান্ত করতে পারছেন অমিতবাবু।

    কিন্তু আরতিদেবী সেদিন বাড়ি ফিরে আর নিজেকে শান্ত রাখতে পারেননি,বাথরুমে ঢুকে অঝোরে কেঁদেছিলেন,অমিতবাবুর হাতের স্পর্শে যেন তার ঠোঁটের ওপর চিরকালের জন্য দাগ কেটে দিল,অনেকদিন পর আজ স্বামী হারানোর শোকটা যেন জেগে উঠল,কিন্তু স্বামীর কথা মনে করতে অমিতবাবুর মুখটাই তাঁর চোখে ভেসে উঠতে লাগল বারবার। স্বামী মারা যাবার পর কত হাতছানি উপেক্ষা করে নিজেকে পবিত্র রাখার চেষ্টা করেছেন তবে আজ কেন এই স্পর্শ তাকে উতলা করে তুলল! আরতিদেবী নিজেকে শান্ত করতে পারছেন না,ভেতরে অপরাধবোধ হচ্ছে,এই প্রৌঢ়বয়সে এসে এ কি বিপর্যয়! সারারাত বিছানায় শুয়ে দুচোখ বেয়ে জল পড়েছে আর আকাশ-পাতাল ভেবেছেন,তাঁর কি করা উচিত,তিনি কি পার্কে যাওয়া বন্ধ করে দেবেন? পরদিন সকালে যখন তিনি অফিসযাত্রী ছেলেকে খেতে দিয়ে পাশে বসেছেন ছেলে সুখবরটি দিল যে তিনি নাকি ঠাকুমা হতে চলেছেন। আনন্দে আত্মহারা আরতিদেবীর কিন্তু প্রথমেই মনে হোলো অমিতবাবুর কথা,কখন তাঁকে এই সুখবরটা দেবেন।

     বিকালে যথারীতি পার্কে এসে আরতিদেবী দেখেন অমিত বাবু আগেই হাজির কিন্তু আরতিদেবীর নিয়মের ব্যতিক্রম নেই। তিনি তাঁর আবেগ দমন করে গঙ্গাপ্রণাম করে হাঁটতে শুরু করেন যেমন রোজ করেন। এক পাক ঘুরে আসার সময় দেখেন অমিতবাবুও গঙ্গাপ্রণাম করছেন। ভালো লাগায় মনটা ভরে গেল আরতিদেবীর এই ভেবে যে মানুষটা বোধহয় কিছুটা হলেও মানসিক শান্তির সন্ধান পেয়েছেন। তারপর অমিতবাবুও হাঁটতে শুরু করেন,এতদিন পার্কে এসে চুপ করে বসেই থাকতেন,জীবনকে নিজের গতিতে চলবার জন্য ছেড়ে দিয়েছিলেন। সেই তিনি আবার নিজের স্বাস্থ্যের কথা ভাবছেন,জীবনে এই প্রথম আরতিদেবী জয়ের স্বাদ অনুভব করতে লাগলেন। একটা মানুষকে শান্তির সন্ধান দিতে পারার মধ্যে যে এত আনন্দ আছে তা আগে তিনি জানতেন না। এর পর হাঁটা শেষ হলে বেঞ্চে বসলে খানিক পর অমিতবাবু হেঁটে এসে বসেন আরতিদেবীর পাশে। তখন আরতিদেবী সুখবরটা জানান আর অবাক হয়ে দেখেন অমিতবাবু এতটাই খুশি হয়েছেন যে সুখবরটা যেন তাঁর নিজস্ব জীবনের।

    দিনমনি পাটে বসলেন,দিনের আলো ফুরিয়ে এল,আকাশ লালে লাল,আরতিদেবী উঠলেন সূর্যপ্রণাম করতে। চোখ বুজে প্রণাম শেষে চোখ খুলে তাকিয়ে দেখলেন অমিতবাবু তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে তখনও সূর্যপ্রণাম করছেন।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics