সময়
সময়
কতদিন ধরে তোকে বলছি বলতো, দেখা কর, দেখা কর; বলে বলে মুখ ভোঁতা হয়ে গেল , তবুও আর বাবুর সময়ই হয় না। আরে বাবা, রাগ করছিস কেন, বললাম তো যাব।কয়েকটা দিন দাঁড়া, একটুও সময় পাচ্ছি না রে।আর তুই তো জানিস তোর বাড়ি গেলে হাতে সময় নিয়ে যাওয়াটা খুব দরকার, নয়তো আড্ডা দেব কি করে বল। ঠিক বলেছিস একদম সৈকত;আসলে তুই হলিস আমার পি.এন.পি.সি. করার একমাত্র সঙ্গী কিনা , তাই। আচ্ছা শোন আজ রাখছি তবে , ভালো করে থাক আর খুব জলদি আমি আসছি তোর বাড়িতে। ও আর হ্যাঁ এবারে কিন্তু একটা গান শোনাতেই হবে ঊর্মি, নো অজুহাত। ঠিক আছে নে শোনাবো, তবে আসিস জলদি করে প্লিজ।
ঊর্মি আর সৈকত ব্যাচমেট হলেও বয়সের তফাৎ ছিল ঠিক এক বছরের তাদের। সেই নিয়ে একটা দিদিগিরি সবসময়ই চলত ঊর্মির। এমনকি ও সৈকতের মা কে বলেও এসেছিল, সৈকতের বিয়েতে ওর একটা শাড়ি চাই। মেয়েটা খুব ছটফটে আর প্রাণবন্ত ছিল। গানের গলার জাদুতে 'জুবি-ডুবি' গানে মাতিয়ে দিয়েছিল পুরো কলেজকে। তবে একবছর হল সে মা-কে হারিয়েছে আর বাবা না থাকারই সমান। মা-এর চলে যাওয়াটা ঊর্মি কে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। ঘর থেকে বেরোনো, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা সবকিছুর থেকেই নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিল সে। আপন বলতে ছিল দিদি-জামাইবাবু, যাদের কাছে সে ছোট্ট আদরের মেয়ের চেয়ে কম কিছু ছিল না।
সৈকতের সঙ্গে বন্ধুত্ব তার কলেজের প্রথম বর্ষে। যদিও সৈকত পড়তো অন্য কলেজে তবুও তার প্রেমিকার টানে আড্ডা দিতে আসত এই কলেজে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে যেত, তবুও আর এদের আড্ডায় বিরতি নামত না।ও হ্যাঁ বলতে ভুলে গেছি, ওদের একটা ছোট্ট গ্রুপ তৈরী হয়েছিল যারা সবাই প্রতি মুহূর্তে একে অপরের পাশে থাকত। তখনো মোবাইল ফোনের এতো বাড়ন্ত হয়নি, তবুও তারা নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলত কিন্তু। যাই হোক তাদের এই ছোট্ট গ্রুপের একজন দারুণ গায়িকা ছিল ঊর্মি। মাঝে মধ্যে তাদের বৈঠকী আসর বসত ঊর্মি দের সিঁড়ির নীচের ছোট্ট একটা ঘরে। কলেজ পেরোনোর পর ঘটনাক্রমে সম্পর্কের বাঁধনগুলো আলগা হতে থাকে। যে যার মতন করে এগিয়ে যেতে চাই; সেই ইঁদুর দৌড়ে দুজন পিছিয়ে পড়ে- সৈকত আর ঊর্মি। রাখি আর
ভাই ফোঁটা খুব ইস্পেশাল হয়ে উঠেছিল দুজনের কাছেই। এমন কোনো বছর নেই যে তারা ঐ দুটো দিন পালন করে নি। সত্যিই দিনগুলো ভারী মিষ্টি ছিল।
যাহ্ বাবা! আজ ফেসবুক জুড়ে শুধুই ঊর্মির ছবি যে; কি ব্যাপার মেয়ের? ক্ষেপে গেল নাকি হঠাৎ? এসব মনে ভাবতে ভাবতেই সবকটা ছবিতে লাইক দিচ্ছিল বসে বসে সৈকত। দাঁড়া আজ ফোন করতে হবে একবার, ব্যাপারটা কি জানতে হবে তো। হঠাৎ একটা বিষয়ে খটকা লাগে সৈকতের, ছবি গুলো তো সব পুরানো, নতুন তো নয় একটাও। 'ভালো থাকিস স্মৃতিতে' ক্যাপশনটাই চোখ পড়তেই ফোনটা হাত থেকে পড়ে যায়, শরীর টা যেন অসাড় হয়ে আসে। যা দেখছি তা কি সত্যিই? এই প্রশ্নের তদন্তে শুরু হয় একটার পর একটা ফোন। ঠিক ভাবে কেউ কিছুই বলতে পারে না ; শুধু উপসংহার টা মিলে যায় গল্পের। পাগলের মতো সে যেতে চায় একবার ঊর্মির কাছে ; কিন্তু না সেটা আর সম্ভব নয়। সে বিশ্বাসঘাতকতা করে চলে গেছে অনেক দূরে, সব সম্পর্কে ইতি টেনে দিয়ে। শ্মশানেও তখন ভস্ম থেকে অস্থি বাছা চলছে; না আজ আর কোথাও যাওয়া সম্ভব নয়। কান্নাটাও আজ পালিয়েছে সৈকত কে ছেড়ে। অপরাধী সে নিজের কাছেই চিরতরে, না পারবে সে কোনোদিন করতে ক্ষমা নিজেকে আর না দেবে তাকে কেউ শাস্তি? একটু সময় কি দেওয়া যেত না সত্যি? আজ উত্তর টা , হ্যাঁ যেতো কিন্তু দুজনের কেউই জানতো না আদতে সময়টা তাদের কাছে ছিলই না।
বছর পেরিয়েছে, আরো নতুন গল্প হয়েছে লেখা জীবনে শুধু ঊর্মি টা নেই সেটা শোনার জন্যে। সৈকত আর ঐ রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করে না; ঘর-বাড়ি-বাগান সব রয়েছে শুধু ব্যালকনি থেকে হাত দেখানোর মানুষ টা আজ অন্য কোথাও। আড্ডার আসর আর বসেনা, ধুলো জমছে প্রতিদিন একটু একটু করে গীটারে, ওটা যে ঊর্মির সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু ছিল; স্ট্রিং গুলোও হয়তো আজও খুঁজে ফেরে তার প্রিয় গীটারিস্টের চেনা স্পর্শ।
'বন্ধু' তুই ভালো থাকিস। ১৩ই ফেব্রুয়ারি- খসে পড়া তারা- গেঁথে থাকবে চিরকাল। গল্পটা বাকি রয়ে গেছে; হবে খুব শীঘ্রই দেখা হবে। এখন প্রচুর সময়, ঘড়ির সময় এগোচ্ছে উজানের টানে ; নেই শুধু মানুষ টা। তবে আর ফাঁকি দিয়ে যাস না। রাখি আসছে-চলে আয়।