স্মৃতির ছবি
স্মৃতির ছবি


"The connection between us
Is perfectly forged
and is so strong
I feel it always
No matter how far apart we are.
The deep spark of our love
Is brighter than ever
And every thought I have about you
Seems to make the distance
Appear smaller
And smaller.
Until -
One day soon
That distance will disappear
Completely
And we'll be free to let our love's bright spark
Burn into a wildfire."
------ Fire of Our Love
By Amy Finley
বাবা যেদিন কথাটা পাড়লেন সেদিন থেকেই আনন্দ আর ধরেনা তাতাই আর পিচাইয়ের। এতো বড় গেছে দুজন তাও বাড়ি রং হবে শোনার থেকে আনন্দে লাফাচ্ছে তারা। বাড়ি রং হওয়া মানে শুধু তো নিজেদের প্রিয় বাড়িটাকে নতুন রূপে পাওয়া নয়, সেই সাথে আরও অনেক কিছু প্রাপ্তি। যেমন জিনিসপত্র নাড়াঘাঁটা করতে গেলেই হঠাৎ হঠাৎ বেরিয়ে পড়া একেকটা ধনরত্ন থুড়ি স্মৃতির ভান্ডার। এইবারেও তার ব্যতিক্রম হল না। বাড়ির এখান সেখান থেকে এক এক করে খুঁজে পাওয়া যেতে লাগল তাতাইদের কোনো পুরোনো বই, খাতা, হারিয়ে যাওয়া রং পেন্সিল, পোস্টার, এরকম আরও কত কি।
তা কাল দাদু ঠাম্মির ঘরটা রং হবে। সন্ধ্যেবেলায় ঘরের আসবাব সরানোর কাজ চলছিল। এক এক করে সব সরাতে সরাতে আলমারীটার কাছে এসে বাবা বললেন, "উঁহু এভাবে হবে না। ভেতরের জিনিসপত্র খালি করো মা, ভীষণ ভারী।"
এই অপেক্ষাতেই ছিল ভাইবোন। ঠাম্মির সঙ্গে আলমারী ফাঁকা করার কাজে হাত লাগাল তারা। এটা সেটা জিনিস বের করে রাখতে রাখতে আচমকা তাতাইয়ের হাতে এলো একটা বহু পুরোনো এলবাম। এই এলবামটা সে আগে কখনও দেখেনি, তাই স্বভাবতই কৌতূহলী হয়ে বলল, "ঠাম্মি এটা কবেকার এলবাম গো?"
"অনেক দিনের রে।"
অতি উৎসাহের সঙ্গে এলবামটা নিয়ে বসল তাতাই। সত্যিই খুব পুরোনো এলবাম, সাদা কালো ছবিসব, সেগুলোও আবার বেশিরভাগই নষ্ট হয়ে গেছে। তবুও তাতাই পিচাই পাশাপাশি বসে ওই ছবির থেকেই চেনার চেষ্টা করছিল মানুষগুলোকে। অচেনা কাউকে দেখতে পেলেই ঠাম্মিকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিচ্ছিল তাঁর পরিচয়। আচমকা এলবামের শেষ পাতায় এসে চোখ আটকে গেল তাতাইয়ের। কম বয়সী একটি মেয়ের হাসি মুখের ছবি। যদিও ছবিটা সাদাকালো তবুও বুঝতে অসুবিধা হয়না যে ছবির মেয়েটি অপূর্ব সুন্দরী ছিল সে সময়।
"এনি কে ঠাম্মি?" ছবিটার ওপর আঙ্গুল রেখে জিজ্ঞেস করল তাতাই। ঠাম্মির মুখে সঙ্গে সঙ্গে যেন আঁধার নেমে এলো। তাতাই ঠিক ধরতে পারল না কারণটা। সে ভ্রু কুঁচকে তাকাল ঠাম্মির দিকে। ঠাম্মি নিচু গলায় বললেন, "তোমার দাদুর ছোটো বোন।"
"দাদুর ছোটো বোন!" আকাশ থেকে পড়ল তাতাই। দাদুর কোনো বোন আছে বলে তো সে শোনেনি কোনোদিন, "ইনি কোথায় থাকেন? এনার কথা শুনিনি কেন কখনও? ইনি তো কখনও আসেননি আমাদের বাড়ি?"
একসঙ্গে অনেকগুলো প্রশ্ন করে ফেলল তাতাই। ঠাম্মি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর ধীর গলায় বললেন, "ইনি তোমাদের বুবাই কাকুর মা।"
"বুবাই কাকুর মা!" আরেকবার চমকে উঠল তাতাই, "বুবাই কাকুর মা তো সেজো ঠাম্মা!"
"সেজো ঠাম্মা বুবাইয়ের নিজের মা নন, পালিকা মা। ছবিতে যাকে দেখছো সে মারা গিয়েছিল।"
"ওহ। কিন্তু ঠাম্মি এনার কথা আমি কখনও শুনিনি কেন? মানে…"
তাতাইয়ের কথা শেষ হওয়ার আগেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ঠাম্মি, তারপর বললেন, "কষ্টের স্মৃতি কেউ মনে করতে চায়না দিদিভাই।"
ঠাম্মির মুখটা দেখে তাতাই স্পষ্ট বুঝতে পারল এ কষ্ট শুধু কারুর মৃত্যুর কষ্ট নয়, এর গভীরে লুকিয়ে আছে অন্য গল্প।
★★★★★
চার ছেলের পর অনেক বয়েসে মেয়ে জন্মাতে বাবা আদর করে নাম রেখেছিলেন শ্রীরাধা। দাদাদের চেয়ে বয়েসে অনেক ছোটো হওয়ার কারণে শুধু মা বাবাই নয়, দাদা বৌদিদেরও চোখের মণি ছিল শ্রীরাধা। এদিকে যেমন তার রূপ তেমনই ব্যবহারও ছিল মধুর মত। আদরের বোনকে সব সময় চোখে হারাত দাদারা, সবসময় আগলে আগলে রাখতে চাইত। কিন্তু এই আগলে রাখার মাঝেই কিভাবে যেন ঘটে গেল একটা অঘটন। স্থানীয় ব্যাংকে ম্যানেজার হয়ে এলো একটি ছেলে, অরিন্দম। কলেজ যাতায়াতের পথে নাকি অন্য কোথাও কিভাবে যেন শ্রীরাধা আর অরিন্দমের মধ্যে গড়ে উঠল একটি প্রণয়ের সম্পর্ক। এমনিতে তো গ্রামাঞ্চলে যে কোনো খবর হাওয়ার চেয়েও আগে ছোটে, কিন্তু কিভাবে যেন শ্রীরাধা আর অরিন্দমের এই মন দেওয়া নেওয়ার খবর রয়ে গেল লোকচক্ষুর আড়ালেই। যতদিনকে জানাজানি হল ততদিনে সম্পর্ক অনেক গভীরে চলে গিয়েছে, দুইটি মানুষ যেন এক হয়ে গিয়েছে ভেতরে। অরিন্দমরা ছিল নিচু জাত। বাবা কিছুতেই এ সম্পর্ক মেনে নিতে পারতেন না। যে মেয়েকে একদিন মাথায় করে রাখতেন, সেই মেয়েকেই আজ ঘরবন্দি করলেন বাবা। সম্বন্ধ দেখা শুরু হল পুরোদমে। অরিন্দম ছেলেটা এসে বাবার হাতে পায়ে ধরল। বলল, "আমি নিচু জাতের হতে পারি কিন্তু আপনার মেয়েকে সুখে রাখার ক্ষমতা আমার আছে। আপনি একবার আমার ওপর ভরসা করে দেখুন, আপনার মেয়েকে অনেক সুখে রাখবো আমি।"
বাবা ছিলেন গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের একজন। তাঁর মেয়ের বেজাতে বিয়ে হলে গ্রামে মান থাকবে না। অতএব, অরিন্দমের কথায় মন গলল না বাবার। শূন্য হাতে ফিরে গেল অরিন্দম। শ্রীরাধার বিয়ে হয়ে গেল অন্যত্র। অষ্টমঙ্গলা থেকে সেই যে ফিরে গেল আর কোনোদিনও বাপের বাড়ি আসেনি শ্রীরাধা। বাবাও কোনোদিনও যাননি মেয়ের বাড়ি। দাদা বৌদিরা এক দু'বার গিয়ে দেখেছে সেই প্রাণোচ্ছল মেয়েটা কেমন যেন আনমনা হয়ে গেছে এখন। নিঃশব্দে নিজের কর্তব্য করে যায় শুধু। এক বছরের মাথায় শ্রীরাধার ছেলে হল। বাবা এই নিয়ে প্রথমবার ছুটে গেলেন মেয়ের বাড়ি, কিন্তু বাবা পৌঁছানোর আগেই শেষ। সব মান অভিমান, দুঃখ কষ্ট এসবের উর্ধ্বে চলে গেল শ্রীরাধা। সবাই বলল ছেলের মুখটাও নাকি দেখার সুযোগ পায়নি মেয়েটা। শ্রীরাধার স্বামী আবার বিয়ে করল অল্প দিনের মধ্যেই, আর ছেলেকে শ্রীরাধার নিঃসন্তান সেজ দা সেজো বৌদি দত্তক নিয়ে নিল।
★★★★★
---- আর সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার কি জানো?
---- কি?
---- শ্রীরাধার মৃত্যুর এক সপ্তাহের মধ্যে এক অজানা জ্বরে মারা গেছিল অরিন্দম।
---- সত্যিই?
---- হুমম। আশ্চর্য না?
ঠাম্মির গল্পটা শেষ হতে আর কোনো কথা বলতে পারল না তাতাই। তাতাই দেখলো নিঃশব্দে ঠাম্মির চোখের কোণ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে। এতোদিনে বুকের মধ্যে চেপে রাখা কিছু স্মৃতি আবার রোমন্থন করে ভিজছে তাঁর কুঁচকানো গাল। তাতাইয়ের ভেতরে অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছে, যাকে কোনদিনও চোখে দেখেনি তার জন্য কেন না জানি আজ কাঁদতে ইচ্ছে করছে ভীষণ। সত্যিকারের ভালোবাসা বোধহয় এমনই হয়, জীবনে না হোক মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মিলন ঘটে দুটি হৃদয়ের;
"One day soon
That distance will disappear
Completely
And we'll be free to let our love's bright spark
Burn into a wildfire."
ঠাম্মির ঘর থেকে চুপচাপ বেরিয়ে এলো তাতাই। নিজের রুমে এসে ফোনটা তুলে ডায়াল করল একটা নম্বর, বহু দূরে যে রয়েছে অন্য শহরের বুকে, এই মুহূর্তে একবার সেই মানুষটার গলাটা শুনে নিতে চাইল সে---- দিশান।