Sonali Basu

Tragedy

2  

Sonali Basu

Tragedy

স্মৃতিমেদুর

স্মৃতিমেদুর

6 mins
1.3K


ঝমঝম করে একটু আগেই বৃষ্টি শুরু হল। মুহূর্তেই ঝাপসা হয়ে গেলো চরাচর, এমনকি যে আট বাই দশ ঘরটায় ও এখন বসে সেই ঘরের কাঁচের জানলাও ঝাপসা হয়ে গেলো। সেই ঝাপসা জানলা দিয়েই ও বাইরে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল রাস্তার ওপর দিয়ে গাড়ির যাতায়াত। এটা কোন বাড়ি নয় নদীর ওপর ব্রিজে ওঠার আগে টোল ট্যাক্সের অফিস। কয়েক বছর কাজ করছে এখানে স্বপন। কোন গাড়ি কাছাকাছি এলেই চেন টেনে গেট নামিয়ে গাড়িকে দাঁড় করায়। গাড়ির চালক বা সহকারী টোল দিতে আসে, সেটা নিয়ে রসিদ কেটে আবার গেট ছাড়ে। একটা গাড়ি বেরিয়ে যায় আবার পরবর্তী গাড়ি এসে দাঁড়ায়। সারাদিন রাত একই কাজ, তবে বিরক্ত হয়না ও, বরং কাজটা মন দিয়েই করে। ভালো লাগে পুরনো নতুন লোক দেখতে কথা বলতে। এখন গাড়ির সংখ্যা অনেক কম, রাত বলে নয় বোধহয় বৃষ্টির কারণে। কয়েকদিন ধরে ধারা বর্ষণ শুরু হয়েছে।পাহাড়ি রাস্তা তো দিনের বেলা চলাচল করলেও রাতে বেশি সাহস কেউ দেখাতে চায় না যদি না খুব দরকার থাকে। কি দরকার বিপদ ডেকে আনার?


কয়েকটা গাড়ি পার করে দেওয়ার পর রাস্তা পুরোই ফাঁকা। অনেকক্ষণ বসে আছে বলে পা-টা একটু ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য স্বপন উঠে এলো দরজার কাছে। এই অফিসে ও আর রজত কাজ করে, তবে আজ রজত আসেনি। কেন কে জানে? তবে ও মাঝেমাঝেই ডুব মারে বলে ওকে নিয়ে স্বপন তেমন ভাবে না। দরজার কাছে এসে দাঁড়াতে ভিজে হাওয়ার ঝাপটা এসে লাগলো শরীরে। বেশ লাগলো এই ভিজে হাওয়ার ঠাণ্ডা আলিঙ্গন। দোলার আলিঙ্গন ছিল এর ঠিক উল্টো, গরম! জড়িয়ে ধরলেই স্বপনের মনে হত মোমের মতো গলে যাবে।

স্বপনের মনটা খারাপ হয়ে গেলো। যতই চেষ্টা করুক দোলাকে ভুলে যেতে কিন্তু মন ভুলতে পারছে না। ওর মা তো সমানে বলে চলেছে চাকরিতে তো থিতু হয়েছিস এবার বিয়েটা করে ফেল। আর কত কাল আমি এই সংসার ঠেলবো। কিন্তু মাকে আর বলা হয়ে ওঠে না সংসার তো তুমি ঠেলতে বাধ্য! নাহলে একজন তো তোমার ছেলেকে ভালোবেসেই তার ঘর করতে চেয়েছিল।


দোলাদের বাড়ি ওর স্কুল পাড়ায় তাই যাওয়া আসার পথে প্রায়ই দেখা হত। প্রথমে খেয়াল না করলেও ক্লাস নাইনে ওঠার পর দৃষ্টিতে যখন মেয়েদের অন্য রূপ ধরা দিতে শুরু করলো তখন দোলাকেও খেয়াল করলো ও। প্রথম প্রথম ভয়ে ভয়ে তাকাতো মেয়েদের দিকে, কে জানে যদি অশালীন আচরণ বলে উল্টোপাল্টা শুনিয়ে দেয়। কয়েকদিন আড়চোখে ওকে দেখার পর খেয়াল করলো দোলাও ওর দিকে তাকিয়ে থাকে, আড়চোখে নয় সোজাসুজিই। একদিন স্কুল শেষে ফিরছে হঠাৎ জোরে বৃষ্টি নামলো। মাথা বাঁচানোর ইচ্ছে ছিল না বরং বৃষ্টিতে ভিজবে বলে একটু আস্তে আস্তেই হেঁটে যাচ্ছিলো, হঠাৎ কেউ হ্যাঁচকা টান মারলো। কে টানলো দেখার জন্য সেদিকে তাকাতেই দেখলো দোলা, ওকে টেনে ওর বাড়ির বারান্দার দিকে নিয়ে যেতে যেতে বলল,

“বৃষ্টিতে ভিজছ ঠিক আছে কিন্তু বাজ পড়লে কি করবে? আচ্ছা বুদ্ধু তো! ঘনঘন কান ফাটানো শব্দে বাজ পড়ছে বুঝতে পারছো না?”


স্বপন অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখল কত সহজে এক অচেনা ছেলেকে একজন মেয়ে বাঁচানোর তাগিদে সুরক্ষিত জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে। বারান্দায় উঠে শান্ত হয়ে দাঁড়ানোর পর ও জিজ্ঞেস না করে পারেনি,


“তুমি আমার জন্য এতো ভাবলে কেন? সবার জন্যই কি এভাবে ভাবো?”

“সবার জন্য ভাবলেও সবার জন্য তো একই কাজ করা যায় না, বিশেষ কারো জন্য করা যায়।”

“আমি কি সেই বিশেষ কেউ?”


ও এক মুহূর্ত স্বপনের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “এতদিনেও বোঝনি বুঝি?”


স্বপনের সেই মুহূর্তে মনে হয়েছিল ওর সারা শরীর আনন্দে প্রজাপতির মতো উড়তে চাইছে। ইচ্ছে হয়েছিলো দোলাকে সেই মুহূর্তে জড়িয়ে ধরে চুমু খায় কিন্তু সেটা অশালীন হবে ভেবে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। ভাবছিল আরও কিছু বলবে কিন্তু সেই মুহূর্তে বাড়ির দরজা খুলে গেলো আর একজন মহিলা বেরিয়ে এলেন হাতে গামছা। ওদের দেখতে পেয়ে বললেন,

“একি দোলা তুই কখন ফিরলি স্কুল থেকে? আর এই বা কে?”

“এই তো ফিরলাম মামণি। এ রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলো বৃষ্টি পড়ছে বলে এসে দাঁড়িয়েছে।”

“ও... তা তোমার নাম কি?”

“স্বপন সরকার।”

“কোথায় থাকো?”

“বিদ্যাসাগর পল্লিতে।”

“তা ভেতরে এসো, বাইরে আর কতক্ষণ দাঁড়াবে!বৃষ্টি থামতে ঢের দেরী।”


একবার বাইরের দিকে তাকিয়ে বললেন উনি। ইতস্তত করলেও শেষে ওঁর অনুরোধে ভেতরে এসে বসেছিল ও। কিছুক্ষণ বসলেও একা আর পায়নি দোলাকে। ওর মায়ের সাথে খানিক গল্পগুজব করে চলে এসেছিল।


পরেরদিন যখন দেখা হল তখন ও কিছু বলার আগেই দোলা বলেছিল,

“কাল মামণির সামনে তোমার সাথে কথা বলিনি কারণ মামণি তাহলে ঠিক ধরে ফেলতো ।কিন্তু আমাদের তো এখনো সেভাবে আলাপ হয়নি। তাই মামণি জিজ্ঞেস করলে বলতেও পারতাম না সেই জন্যই কিছু বলিনি আর।”


স্বপনের রাগ চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল। এরপর দেখা সাক্ষাৎ বেড়ে চলে। আলাপচারিতা আস্তে আস্তে এগোয় প্রেমের পথ ধরে। স্কুল শেষে বা পালিয়ে ওরা প্রায়ই এই নদীর ধারে দেখা করতো,বসে থাকতো, গল্প করতো আরও কত কি! মাঝেমাঝে ভবিষ্যতের স্বপ্নেও মশগুল হত দুজনে। স্কুল জীবন শেষ হয়ে স্বপন কলেজে ঢুকলো কিন্তু দোলার পড়াশোনার পর্বে ইতি ঘটে গেলো। ও কারণ জিজ্ঞেস করলে বলেছিল,

“দাদার পড়াশোনার খরচ অনেক, বাপি আর টানতে পারছে না।”

তারপর বলেছিল,

“তুমি পড়াশোনা শেষ করে কাজ নাও। তারপর আমাদের বিয়ে হবে। বিয়ের পর তোমার ইচ্ছেমতো আমাকে লেখাপড়া শিখিয়ো।”


বেশ চলছিল এই প্রেম প্রেম খেলা কিন্তু বিধি বোধহয় অন্য কিছু লিখে রেখেছিলো ওদের জন্য। সরিয়ে নিয়ে গেলো দোলাকে ওর জীবন থেকে, চিরদিনের মতো।


কড়াৎ করে বাজ পড়লো খুব কাছে কোথাও, সাদা আলোয় চোখ দুটো ধাঁধিয়ে গেলো। সেই আলোর রেশ কেটে যেতে আবার অন্ধকার এগিয়ে এলো নিজের বেদখল জায়গা পুনরুদ্ধার করতে। ভারি বৃষ্টি আর হাওয়া মিলে নদীকে আজ অশান্ত করে তুলেছে। ওর পায়ে এখন পাগলপারা নাচনের তাল, সেই আনন্দে ও ছুটতে ছুটতে নাচতে নাচতে চলেছে। সেই আওয়াজ এখান থেকেও শোনা যাচ্ছে। এই নদী প্রতিবারই আসেপাশের এলাকার মানুষকে ভাসিয়ে সর্বস্বান্ত করে। যেভাবে একনাগারে বৃষ্টি হয়ে চলেছে জল যে বাড়ছে এটা একশো শতাংশ নিশ্চিত। তাই ছাতা মাথায় স্বপন জল কতটা উঠেছে তা দেখতে চলল। নদীর কিনারায় এসে দেখলো বিপদ সীমা দাগানো রঙের কাছে জল লাফালাফি করছে। ঠিক এখানে...... এইখানেই দেখা গিয়েছিল দোলার শরীরটা। কোন জেলে নাকি প্রথম দেখতে পেয়েছিল ওকে। খবর পেয়ে যখন ছুটে এসেছিল ও ততক্ষণে পুলিশ শরীরটা তুলে ফেলেছে। জিজ্ঞাসাবাদ করছে দাঁড়ানো লোকজনদের। ও এক মুহূর্ত দাড়িয়ে থাকতে পারেনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিল মাটিতে।


কেন হল, এ প্রশ্ন ওর মাথায় সারাক্ষণ ঘুরঘুর করে গেছে! কিন্তু কাকে জিজ্ঞেস করবে?কেন মেয়েটা এত বড় একটা প্রতিশোধ নিলো তাও নিজের ওপরে?পরে শুনেছিল সবটা। দোলা ওর মামণির নিজের মেয়ে নয়। তবে যাকে ও বাপি বলতো তারই ঔরসজাত সে। মামণিকে বিয়ে করার পরও সেই ভদ্রলোকের অন্য মহিলার সাথে সম্পর্ক ছিল। তার থেকেই দোলার জন্ম। কিন্তু সেই মহিলা দোলাকে নিতে অস্বীকার করে যখন দোলার বাপি সেই মহিলাকে স্ত্রীর মর্যাদা দিতে অস্বীকার করে। ওর বাপি তখন দোলাকে অনাথ বাচ্চার তকমা দিয়ে নিয়ে আসে ওর মামণির কাছে। এতদিন মামণি ওর নিজের ছেলে শুভ আর দোলাকে একইভাবে মানুষ করেছে কোন তফাৎ করেনি। কিন্তু কয়েক মাস আগে উনি কিভাবে যেন জানতে পেরে যান মূল ঘটনাটা! তারপর থেকেই বাড়িতে মামণি আর বাপির মধ্যে তুমুল অশান্তি। প্রথমে ব্যাপার কি দোলা বুঝতে না পারলেও আস্তে আস্তে পারলো। তারপর থেকে ওর মন ভীষণ খারাপ থাকতো। এতদিন যেটা জানতো (মানে ও অনাথ) সেটা তবু সহ্য করা গিয়েছিল কিন্তু এবারেরটা? অবৈধ্য সন্তান! একদিন তো শুভ দোলাকে দুটো কথাই শুনিয়ে দিলো এই কারণে,

“তোর মতো বাইরের লোকের জন্যই আমাদের বাড়ির পরিবেশ নষ্ট হয়ে গেলো। তুই চলে গেলেই তো পারিস। কেন আছিস এখনো এ বাড়িতে?”


দোলা কাঁদতে কাঁদতে চলে গিয়েছিলো স্বপনদের বাড়ি। ততদিনে স্বপনদের বাড়িতে যাতায়াতের ফলে সবাই ওকে চেনে পছন্দ করে। সেদিন স্বপন কাজে গিয়েছিল, জানে না ওর আর মায়ের মধ্যে কি কথাবার্তা হয়েছিল!কিন্তু খুব গম্ভীর কিছু হয়েছিল কারণ সেই বাড়ি থেকে বেরনোর পর দোলা আর বাড়ি যায়নি। স্বপনের ধারণা মা এমন কিছু বলেছিল, দোলার মনে খুব লেগেছিল কথাটা।কিন্তু ও এভাবে সরে যাবে তা স্বপন কল্পনাও করতে পারেনি।

নদীর জল ছলাৎ ছলাৎ শব্দে পায়ের কাছে নাচছে। স্বপন সেখানে বসে পড়ে বলল,

“তুই নেই! কি নিয়ে আমি থাকবো বললি না তো! একবার অন্তত বলে যা দোলা”

নদীর স্রোত গর্জন করে ওঠে! 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy