স্মৃতিচারণ
স্মৃতিচারণ
প্রতি বছর আমাদের হাসপাতাল থেকে প্রত্যন্ত গ্রামে ক্যান্সার ডিটেকশন ক্যাম্প করা হয় । এবার ওই ক্যাম্পে আমার ডিউটি পড়েছে। আমি এই হাসপাতালে জুনিয়র ডাক্তার হিসাবে নতুন জয়েন করেছি।
ক্যাম্পের রেসপন্স বেশ ভালো। বিকালের দিকে যখন আমরা ক্যাম্প শেষে ফিরে যাবার বন্দোবস্ত করছি একজন বয়স্ক ভদ্রমহিলা এলেন। ওনার পরনে একটা আটপৌরে কালো পাড় সাদা শাড়ি। দেখলাম আমাদের হাসপাতালের কয়েকজন নার্স যারা আগেও এই ক্যাম্পে এসেছে তারা ওকে চেনে।
আমি ওনাকে চেক-আপ করে জানালাম সব ঠিক আছে, চিন্তার কোন কারণ নেই। উনি আমাকে মৃদুস্বরে ধন্যবাদ জানিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। যাবার সময় দেখলাম উনি আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছছেন।
আমি অবাক হয়ে দেখছি দেখে আমার সঙ্গের নার্সটি জানালো আগের বছরও উনি এসেছিলেন আর ঠিক এই ভাবেই কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। আমার ভীষণ কৌতূহল হল। ওনাকে ডেকে পাঠালাম।
উনি এসে জড়সড় হয়ে বসলেন। ওনাকে এক কাপ চা দিতে বললাম। জিজ্ঞাসা করলাম,” কিছু মনে করবেন না, যখন লোকে জানতে পারে তার শরীরে ক্যান্সার নেই সে খুশী হয়। আর আপনি কাঁদছেন ?”
উনি কিছুক্ষণ নিঃশব্দে ফুঁ দিয়ে দিয়ে গরম চাটা খেতে লাগলেন, দেখে মনে হল কথাগুলো মনের মধ্যে গুছিয়ে নিচ্ছেন। তারপর ধীরে ধীরে বললেন,” আমি এই ক্যাম্পে অনেক বছর হল আসছি। “
আমি নিঃশব্দে ওনার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
“ তুমি আমার মেয়ের মত তোমাকে বলতে লজ্জা নেই। বুড়ো বয়েস অবধি আমার শরীর খারাপ হত। মাসে প্রায় দশ দিন চলত। আমার বিরাট সংসার। পাঁচ ছেলে, তাদের বৌ, নাতি, নাতনি। লজ্জায় বাড়ীর কাউকে বলতে পারতাম না। কেউ খবরও রাখত না। একদিন ধরা পড়ে গেলাম কৃষ্ণার কাছে।“
“কৃষ্ণা কে?”
“কৃষ্ণা ? ও আমার ছোট ছেলের বৌ। আমার মেয়ের চেয়েও বেশি।“ ওনার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।
উনি বলে চললেন, “ আমায় বলল...তোমাকে ডাক্তার দেখানো দরকার। আমি তো লজ্জায় মরে যাই। কিন্তু সে মেয়ে কোন কথা শুনলো না। বাড়ীর সবাইকে লুকিয়ে আমাকে মন্দিরে নিয়ে যাবার বাহানা করে নিয়ে গেল ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার দেখে বলেলেন , খুব সময় মত এনেছেন নাহলে ক্যান্সার হয়ে যেত। তারপর থেকে প্রতি বছর ওই আমাকে নিয়ে আসতো এই ক্যাম্পে। “ দু ফোঁটা জল ঝরে পড়লো ওনার চোখ থেকে।
“ কৃষ্ণা কোথায়?”
“ দু বছর আগে, একটা বাস দুর্ঘটনায়......... ও আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। বড্ড বড় মনের মেয়ে ছিল। “ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন উনি।
কি বলে সান্ত্বনা দেবো বুঝতে না পেরে চুপ করে রইলাম।
উনি আবার বলতে শুরু করলেন, “ যখনই আমি এখানে আসি আমার ওর কথা খুব মনে পড়ে। আমারই তো চলে যাবার কথা ছিল। কিন্তু...জানো মারা যাবার আগে আমার কাছে কথা আদায় করেছিল যেন প্রতিবছর আমি এই ক্যাম্পে এসে নিজের চেকআপ করাই......তাই আসি...... অনেক ভাগ্য করে লোকে অমন বৌ পায় ।”
ধীরে ধীরে চেয়ার থেকে উঠে উনি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
মনে মনে ভাবলাম ভাগ্যবতী কৃষ্ণাও কম নয় যে এমন একজন শাশুড়ি পেয়েছে। যে ওর মারা যাবার এতদিন পরেও ওর জন্য চোখের জল ফেলছে।
ভাবতে ভাবতে বোধহয় অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। নার্সের ডাকে সম্বিত ফিরে পেলাম।
“ আচ্ছা ম্যাডাম কৃষ্ণার মত মেয়ে যদি ঘরে ঘরে থাকতো, তাহলে আমাদের লড়াইটা অনেক সহজ হত তাই না?”
ম্লান হেসে বললাম ঠিকই বলেছ,” ২০১৮ তে সারা ভারতবর্ষে ৯৭০০০এরও বেশী মহিলার জরায়ু মুখের ক্যান্সার হয়েছিল। তারমধ্যে ৬০০০০ মহিলাকে আমরা বাঁচাতে পারিনি। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই তারা এতো দেরীতে এসে পৌঁছোয় আমাদের কাছে, যে তাদের জন্য আমরা কিছুই করতে পারিনা।“