Jay Adhikari

Abstract Drama Tragedy

4.8  

Jay Adhikari

Abstract Drama Tragedy

সম্পর্কের খাতা

সম্পর্কের খাতা

172 mins
3.9K



 

"আপনার শরীরের ওপর দিয়ে যদি একটা বুলডোজার চলে যায়, কি হবে আপনার ? "

 

"মানে ? কি বলতে চান আপনি ? " চমকে ওঠে মেহেক। কি বলে চাইছে কি লোকটা ? সন্ধে থেকেই এর আচার আচরণ দেখে একটু ঘাবড়েই আছে মেহেক এমনিতে। অন্যদের থেকে আলাদা এই লোকটার স্বভাব, ভাব ভঙ্গি। না - অন্যদের মতো ওকেই দেখে ওর ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে নি লোকটা, খুলে নিতে চায় নি ওর জামা কাপড় জোরে করে টেনে টেনে , বা জোর করে বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে দেয় নি , তবুও যেন কেমন একটা করছে মনের ভেতরটা ! মাঝে মাঝে ভয় হচ্ছে, মাঝে মাঝে মায়া ! আবার এক দুবার , ভীষণ ভীষণ ভালবাসতে ইচ্ছে করছে লোকটাকে। অন্য কাউকে দেখে আগে এরকম মনে হয়নি মেহেকের। কাজ করেছে, কাজ শেষে টাকা নিয়ে চলে গেছে। কিন্তু এই লোকটার মধ্যে কিছু একটা আছে, একটা রহস্য - কোনো গোপন কথা ; সেটাই লোকটাকে করে তুলেছে ভীষণ মনোরম - চিত্তাকর্ষক - আকর্ষণীয় !

 

আলো আঁধারের মধ্যে জানালার পাশে বসা লোকটা হেসে ওঠে ধীরে ধীরে। "কিছুই বলতে চাই না আমি ; আমি শুধু জিজ্ঞেস করেছিলাম মেহেক - আপনাকে যে যদি একটা বুলডোজার আপনার ওপর দিয়ে চলে যায়, কি হবে আপনার ? আচ্ছা আমিই বলছি। ভয় পাবেন না আবার , প্লিজ। আপনি ভয় পেলে আমার খুব খারাপ লাগবে। এরকম কিছু হলে আপনার শরীর পুরো গুঁড়িয়ে মাটির সাথে মিশে যাবে, হাড় গোড় ভেঙে চুরচুর হবে ; আপনার শরীরের ভেতরের রক্ত বেরিয়ে আসবে গলগল করে , ভিজিয়ে দেবে রাস্তা। আপনার অস্তিত্বটাই আর থাকবে না। সব শেষে আপনার জায়গায় পড়ে থাকবে একটা দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া - মাংসপিন্ড। "

 

"উহহ , বন্ধ করুন আপনি , আমার একদম ভালো লাগছে না। " ঘেন্নায়, বিবমিষায় গা গুলিয়ে ওঠে মেহেকের। তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে টেবিলের ওপরে রাখা জলের বোতলের ঢাকনা খুলে ঢকঢক করে ঠান্ডা জল ঢালে গলার মধ্যে।

 

লোকটা বলতে থাকে, "তবুও এটাতো চোখে দেখা যায় ; কিন্তু যদি আপনার মনের ওপর দিয়ে - কয়েকশো বুলডোজার চলে যায় ? সেই রক্তক্ষরণ , সেই না বেরিয়ে আসা মনের গভীরে - গোপনে ফেলা চোখের জল , প্রতিদিন একটু একটু করে মরতে থাকা মানুষের কাহিনী , সেই গল্প সেই ব্যর্থতার আখ্যান, বিচ্ছেদের আঁচড় - সেটা কি কেউ দেখতে পায় ? " বলতে বলতে চোখ থেকে বেরিয়ে আসে জল, আবার ! মেহেক বুঝতে পারে না কি করবে ! ওর কি দাঁড়ানো উচিত, না কি চলে যাওয়া ? একসময় মনস্তত্বের উজ্বল ছাত্রী, বেরোতে গিয়েও বেরোতে পারে না। আটকে পড়ে লোকটার বাড়িতে। ওকে শুনতেই হবে, জানতে হবে - কেন এই লোকটা নিজেকে ঠেলে দিচ্ছে এইভাবে মৃত্যুর দিকে একটু একটু করে ? কেন ওর এই অক্ষমতা, ব্যর্থতা ? কার জন্য আজকের দিনেও লোকটা ঠেলে সরিয়ে দিলো মেহেক কে ? পারলো না কিছু করতে ? কার জন্য হঠাৎ বেরিয়ে আসে চোখের জল ? অনেক সময় ভেতরের কথা - দুঃখ - কষ্ট - যন্ত্রনা অন্য কাউকে বলতে না পেরে অনেকে ডুবে যায় কালো অন্ধকার কোনো এক জায়গায়, বেরোতে চায় তারা , ছটফট করে - কিন্তু বেরিয়ে আসতে পারে না !

 

এগিয়ে আসে মেহেক লোকটার দিকে , ওর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলে ওঠে ," শুনুন, আপনি আমাকে বলতে পারেন আপনার কথা। আমি সব শুনবো, আপনার যত সময়ই লাগুক না কেন ! আমাকে, আপনি অন্য কিছু না ভেবে - আপনার খুব ভালো বন্ধু ভাবতে পারেন। "

 

'বন্ধু' কথাটা শুনে জ্বলজ্বল করে ওঠে লোকটার চোখদুটো। "বন্ধু ? বন্ধু ? জানেন আমি ভুলেই গেছি এইরকম একটা শব্দ আছে জীবনে। আপনি, আপনি সত্যি শুনবেন আমার কথা ? " একটা আকুতি ঝরে পড়ে লোকটির গলার স্বরে।

 

 

++++++++++

 

 

প্রায় চারঘন্টা আগে - আজ সন্ধেতে, মেহেক ওর ভাই মায়াঙ্ক এর সাথে দেখা করে পার্ক স্ট্রিটে , মেট্রোর সামনে। ওর সাথে একটু কথা বলে, ওর হাতে কিছু টাকা তুলে দেয় মেহেক। মায়ের জন্য ওষুধ কিনতে হবে, ডাক্তার দেখাতে হবে ! তারপরে মায়াঙ্কের হাত ধরে, ওকে নিয়ে আসে এশিয়াটিক সোসাইটির সামনের রাস্তায়। একটা রোলের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে, দুজনে মিলে এগ রোল খাওয়া হলে - তারপরে মেহেক ছাড়ে ভাইকে। মায়াঙ্ক ফিরে যাবে বাস ধরে আমতলাতে। সেখানেই ওদের বাড়ি।

 

মায়াঙ্কের সুন্দর চেহারাটা কিরকম ভেঙে গেছে হঠাৎ করে। কঠিন পৃথিবীর বাস্তবের সামনে এসে, নরম - সরম, কোমল স্বভাবের ভাইটা হয়ে উঠেছে কাঠখোট্টা ! ওর গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করার পরে, হঠাৎ বাবা মারা যায় ; মারা যাওয়ার কোনো কারণ ছিলো না কিন্তু। বাবা রাস্তার এক পাশ দিয়েই হেঁটে বাড়ি ফিরছিলো সেদিন অন্যদিনের মতো ; হঠাৎ একটা বাস আর একটা বাসকে টপকাতে গিয়ে, বাবার ওপর দিয়ে.....

 

একটা সময় ছিল বাড়িটা কিরকম মেতে থাকতো ওরা চারজন একসাথে থাকলে। এখন শুধু বাবার অনুপস্থিতিতে , বাকি তিনজন একসাথে থাকলেও সারা বাড়ি জুড়ে ঘুরে বেড়ায় একটা হাহাকার।

 

বাবা একটা প্রাইভেট হসপিটালের অ্যাডমিন হেড ছিলো; মেহেক আর মায়াঙ্ককে কোনোদিন কোনো অসুবিধের মধ্যে পড়তে হয় নি। বাবা যখন বাসের চাকার তলায়, ঠিক সেই সময়ে মেহেক মুম্বাইয়ের জুহু বিচে দাঁড়িয়েছিল রবিকে জড়িয়ে ধরে ! আরব সাগরের নীল জলরাশির মধ্যে ডুবতে থাকা সূর্যকে সাক্ষী রেখে রবির ঠোঁট নেমে এসেছিলো ওর ঠোঁটের ওপরে। আজও ভাবলে অবাক লাগে মেহেকের। এই তো সেদিন বিকেলেও ও ছিল রবির সাথে ; পড়াশোনা করছিলো একটা মেডিকেল কলেজে, মনস্তত্ব নিয়ে। কয়েক সেকেন্ড নাকি কয়েকটা মুহূর্ত সব কিছু ওলোটপালোট করে দিলো ওর জীবনের, সাথে ভেঙে গেলো পুরো সংসার।

 

বাবার মারা যাওয়ার খবর পেয়েই ছুটে আসে মেহেক তাড়াতাড়ি কলকাতায়। ধীরে ধীরে জানতে পারে বাবা কোনোকিছুই প্রায় সঞ্চয় করে রাখেনি, সবার বিপদে আপদে পাশে দাঁড়িয়ে, নিজের সঞ্চয়ের ভাঁড়ার প্রায় শূন্য ! এমনকি বাড়িটাও পর্যন্ত বন্ধক রেখে দিয়ে মেহেক আর মায়াঙ্কের কলেজের ফি দিয়ে এসেছিলো এতদিন ধরে। কি করে নিজে কলেজে পড়বে , কি ভাবে অসুস্থ মায়ের চিকিৎসা হবে, বা ভাইয়ের হায়ার স্টাডিজ হবে , কি ভাবে বাড়িটাকে ছাড়িয়ে আনবে - এই ভেবে ভেবে মেহেক যেন এক সপ্তাহেই অনেক বড়ো হয়ে ওঠে। মুম্বাইতে নিজের কলেজে কথা বলে ; ওরা জানিয়ে দেয় টাকা না দিলে কোনোভাবে হেল্প করতে পারবে না। রবিকে ফোন করে, সব জানায় ; রবি সহানুভূতি জানায় , কিন্তু সরে যায় পাশ থেকে। আত্মীয় স্বজনদের সাথে কথা বলে ; তারাও সরে যায় ওদের জীবন থেকে। এক ধাক্কায় কেউ যেন মেহেক কে ছুঁড়ে ফেলে দেয় কোনো উঁচু একটা পাহাড় থেকে, নিচে - কঠিন রুক্ষ প্রান্তরের মধ্যে।

 

মায়াঙ্ক চেয়েছিলো পাইলট হতে, ভেবেছিলো আকাশে উড়বে। বাবার হঠাৎ মৃত্যুতে, ওর স্বপ্নের নীল আকাশ ছিঁড়ে গেলো - ঘুড়ির পাতলা কাগজের মতো। চাকরি খুঁজতে শুরু করে ও। চাকরির বাজারে বেরিয়ে দেখে ওর মতোই লাখে লাখে ছেলে মেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে সারাদিন ধরে , যদি একটা জ্যাকপট কারোর ভাগ্যে জোটে। মানসিক অবসাদের মধ্যে চলে যেতে থাকে মেহেকের ভাই।

 

মেহেকের মনে পড়ে মুম্বাইয়ের এক বান্ধবীর কথা , ফোন করে জানায় কোমল কে সবকিছু। কোমল ওকে এই চ্যানেলের সন্ধান দেয়। কিছুই না , শুধু বড়োলোক ক্লায়েন্টদের সঙ্গ দিতে হবে ; সেটা কখনও কয়েক ঘন্টার জন্য হতে পারে, কখনও বা সারা রাতের জন্য, কখনও বা পুরো একসপ্তাহের জন্য। অনেক ভেবে, পড়া ছেড়ে দেয় মেহেক। খারাপ কি, নিজের এখন সম্বল বলতে এই শরীর। শরীর নিয়ে কোনো ছুৎমার্গ কোনোদিনই ছিল না ওর। আর সারা মাসে দুই থেকে তিনজনকে সঙ্গ দিয়ে সারা মাসের খরচ যদি উঠে আসে , তাহলে তো কোনো সমস্যাই নেই। নাই বা হলো নিজের কোনো স্বপ্নপূরণ , ভাই - মা এদেরকে তো ভালো রাখতে পারবো ; পরিবারটা তো বেঁচে যাবে।

 

এখন মেহেক থাকে একটা ফ্ল্যাটে - ভাড়ায়। ওর সাথে থাকে আরো তিনজন মহিলা - একজন মডেলিং এর কাজ করে , একজন একটা স্কুলের শিক্ষিকা, আর একজন একটা নতুন খোলা ফাস্ট ফুড চেনের দোকানে কাজ করে। চারজন একসাথে থাকলেও, কেউ কারোর ব্যাপারে নাক গলায় না, অতিরিক্ত কৌতূহল প্রকাশ করে না কাউকে নিয়ে। যেটুকু না জানলে নয়, সবাই সবাইকে নিয়ে ততটাই জানে। সপ্তাহান্তে , প্রায় সময়ই কেউই থাকে না ফ্ল্যাটে। সবাই দুদিনের ছুটিতে ফিরে যায় নিজের পরিবারের লোকজনের সাথে সময় কাটাতে , ফিরে যায় স্বামী - সন্তান - বাবা - মা - ভাই - বোনের কাছে। মেহেক এর কোনো কাজ না থাকলেও ও যায় না বাড়িতে। আসলে বাবার সৃষ্টি করা অভাব অনটনের মধ্যে গিয়ে দাঁড়াতে চায় না ও। দূর থেকেই প্রয়োজন মেটাতে চায় ওদের সবাইয়ের।

 

তবে একটা পরিবর্তন এসেছে ওর নিজের মধ্যেও এই কয়েকদিনে। কিছুদিন আগে শরীর দেওয়া নেওয়ার খেলাটা ছিল ওর কাছে প্রয়োজন ; এখন সেটা নেশায় দাঁড়িয়ে গেছে ওর জন্য। যখন লোমশ - লম্বা - বেঁটে - ভুঁড়িওয়ালা - সিক্স প্যাক - ধুতি পরা - ভগবানের নামগান করা পুরুষগুলো ওর সামনে নিজেকে নিঃশেষ করে দিতে থাকে , ওর সান্নিধ্যে এসে করতে থাকে হরেক রকম বায়নাক্কা - আবদার ; মজাই লাগে মেহেক এর। এক এক জায়গায়, চাহিদা অনুযায়ী এক একরকম নাম ওর। কখনো ও ষোড়শী , কখনো কলেজের ছাত্রী , কখনো হসপিটালের নার্স, কখনো বৌদি , কখনো শাড়ি , কখনো জিন্স , কখনো জিম এর ড্রেস, কখনো মডেলদের মতো হাই হিল আর গাঢ় লাল লিপস্টিক, কখনো গাউন, কখনো ফুল ড্রেস , কখনো মাইক্রো আবার কখনো বা মিনি।

 

এই কয়েকমাসে একটা জিনিস বুঝেছে মেহেক ; এই সব পুরুষেরাই আসলে ভীষণ একা। সবাই থেকেও জীবনের কাছে ওরা শুধু চায় ভালোবাসা , একটু আদর, একটু প্রেম। সেটা যখন পায় না নিজের স্ত্র্রী বা গার্লফ্রেন্ডের কাছে, তখন এরা সুখ খোঁজে টাকার বিনিময়ে। তবে কেউ কেউ আছে যারা শুধু টাকার বিনিময়ে ফূর্তি করতে চায়, অত্যাচার করে মেয়েদের ওপরে - তবে এখনো পর্যন্ত মেহেক সেরকম কোনো ক্লায়েন্ট পায় নি। এই পুরুষ গুলো অনেকেই ওকে সারা রাত পেতে চায় নিজের মতো করে। কিন্তু পাঁচ থেকে পনেরো মিনিটের মধ্যেই সবাই রতিক্রিয়ায় ক্লান্ত - তৃপ্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে মেহেককে জড়িয়ে।


++++++++++


 

কিন্তু, আজকের এই লোকটি, সবার থেকে আলাদা। মায়াঙ্ক চলে যাওয়ার পরে, মৌলালীতে নিজের ফ্ল্যাটে ফিরে আসার জন্য হাঁটতে শুরু করে মেহেক রফিক কিদওয়াই রোড ধরে। তখনই ফোন আসে ওর কাছে। কোমল বলে ওঠে ,"আজ সাতটার সময়ে যেতে হবে সল্টলেক। বেশিক্ষণ নয় , মাত্র তিনঘন্টা। লোকটা তিরিশহাজার দেবে তিন ঘন্টার জন্য। কোনো আলাদা ডিমান্ড নেই , শুধু কিছুটা 'ভালো' সময় কাটাতে চায়।

 

মেহেক ভেবেই রেখেছিলো আজ আর সন্ধেতে কিছু করবে না , একটু ফ্ল্যাটে ফিরে গিয়ে সিনেমা দেখবে চুপ করে। কিন্তু টাকার অঙ্কটা শুনে ও রাজি হয়ে যায়। একটা মেডিসিন শপ থেকে এক বাক্স কন্ডোম কিনে ওঠে ট্যাক্সিতে। ট্যাক্সিতে বসে করে ফেলে হাল্কা মেকআপ , লাগিয়ে নেয় পারফিউম, চিরুনী বের করে ভালো করে বেঁধে নেয় চুল।

 

লোকটার ফ্ল্যাটে আসার পরে, কিরকম যেন সব গুলিয়ে যায় মেহেকের।  

 

সল্টলেকে এই জায়গায় আসে পাশে ফ্ল্যাট বেশি নেই , সবার নিজস্ব একতলা - দোতলা বা তিনতলা বাড়ি। এই সব বাড়িগুলো এখন অধিকাংশই দাঁড়িয়ে আছে একা একা বা কেয়ারটেকার এর তত্ত্বাবধানে। যারা বাড়িগুলো তৈরী করেছিল থাকার জন্য, একসাথে সারা পরিবার মিলে মিশে থাকার স্বপ্ন দেখেছিলো, আজ তারা এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেছে কোনো এক শূন্যস্থানে। তাদের ছেলে মেয়েরা ছড়িয়ে পড়েছে দেশে বিদেশে, বিভিন্ন প্রান্তে। কাজ ব্যবসা বা অন্য কাজে খুব একটা আসতে পারে না তারা এখানে। অধিকাংশ বাড়ির বাইরের দেওয়ালে পড়েছে ফাটল, একসময়ের উজ্জ্বল রং, রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে ঝুরঝুর করে পড়ে যাচ্ছে। যেসব বাড়িতে কেয়ারটেকার আছে, তারা তাদের পরিবার নিয়ে থাকে এখানে আর বাড়িঘর পরিষ্কার রাখে। অনেক বাড়িতে আবার, ভাড়ায় থাকে লোকজন। কিছু বাড়ি করে দেওয়া হয়েছে গেস্টহাউস যেখানে বিভিন্ন কোম্পানির লোকজন এসে থাকে। কিছু বাড়িতে আবার গেস্টহাউসের নাম করে 'বিনোদনের' ব্যবস্থা করা হয়। কলেজ এর মেয়েরা আসে বি এম ডব্লিউ বা মার্সিডিজে চড়ে ; চোখে কালো সানগ্লাস, হাই হিল পরে ঢুকে যায় ভেতরে গটগট করে , দুই থেকে তিন ঘন্টা কাটিয়ে আবার ফিরে চলে যায় 'ঘন্টা'র দাম নিয়ে । মেহেক আগেও এক দুবার এসেছিলো এইরকম জায়গাতে , কলে

 

বেশ কয়েকটা একতলা আর দোতলা বাড়ির মাঝে দাঁড়িয়ে আছে এই পাঁচ তলার ফ্ল্যাটটা। আগে হয়তো কারোর বাড়ি ছিল এই জমিতে , বিক্রি করে দিয়েছে প্রোমোটারকে। পাঁচতলা ফ্ল্যাটের চতুর্থ ফ্লোরে, দরজার সামনে এসে দাঁড়ায় মেহেক। সাতটা বাজতে তখনও এক মিনিট বাকি। কোথাও কখনও মেহেক শুনেছিলো - কোনো কাজে যেন লেট না হয়, আগে পৌঁছে যাওয়া তবুও ভালো, কিন্তু লেট একদম নয় ! কলিং বেল বাজায় !  

 

একজন এসে ফ্ল্যাটের দরজা খোলে , সামনে মেহেককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, হাতের ঘড়িতে সময় দেখে জিজ্ঞেস করে,"ও , আপনি চলে এসেছেন ? আসুন ভেতরে। ভালো লাগলো আপনি সময়ের আগেই চলে এসেছেন। "

 

মেহেক ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে জিজ্ঞেস করে ওঠে, "আপনি কি করে বুঝলেন যে আমিই কল এ এসেছি? অন্য কেউ ও তো আসতে পারতো !”

 

একটু থমকে দাঁড়িয়ে , ঘুরে দাঁড়ায় মেহেকের দিকে। বলে ওঠে,"আমি আর কারোর জন্য অপেক্ষা করি না ; আর আমার জন্য ও কেউ আর কোথাও অপেক্ষা করে নেই। তাই....যাক গে ! ফিল ফ্রি। আপনি যদি শাওয়ার ব্যবহার করতে চান, এইদিকে আছে। আমি আপনার জন্য কিছু খাওয়ার ব্যবস্থা করি। "

 

ভীষণ অবাক হয় মেহেক। এইভাবে তো আগে কেউ কোনোদিন ওর সাথে ব্যবহার করে নি। এই লোকটাকে প্রথম দেখাতেই ভীষণ রহস্যময় মনে হয়েছিল। এখন তো দেখছি ইনি একজন পারফেক্ট জেন্টেলম্যান ও বটে। হ্যান্ডব্যাগটা লিভিং রুমের সোফার ওপরে রেখে, হ্যান্ডব্যাগ থেকে একটা প্লাস্টিক প্যাকেট নিয়ে বাথরুমের দিকে পা বাড়ায় মেহেক। পুরো ফ্ল্যাটটা অন্ধকারে ঢাকা , শুধু বাইরের ঘরে একটা হলুদ আলোর ছোঁয়া ভেসে আসছে ওপরের ফলস সিলিং এর ফাঁকে থাকা গুচ্ছখানেক লাইট থেকে। লোকটি প্রায় অন্ধকারাচ্ছন্ন একটা কোণে বসে আছে চুপ করে , মনে হচ্ছে কিছু ভাবছে। ওর সামনে একটা টেবিল, টেবিলের ওপরে একটা ফটো ফ্রেম রয়েছে। মাথার অবস্থান দেখে মনে হচ্ছে ওর চোখ এখন ওই ফ্রেমের ওপরে। ফ্রেমে কি আছে দেখতে ভীষণ কৌতূহল হচ্ছে , তবুও চুপ করে ঢুকে যায় বাথরুমের ভেতরে মেহেক।

 

গিজার অন করে গরম জলে নিজেকে বাইরের সব ধূলো ধোঁয়া থেকে পরিষ্কার করে পরে থাকা সাধারণ সালোয়ার কামিজ চেঞ্জ করে 'বেবিডল' পোশাকে নিজেকে ঢেকে , একটু হাল্কা মেকআপ করে বাইরে বেরিয়ে আসে লাস্যময়ী মীনা !

 

আজ মেহেকের পরিচয় মীনা।

 

'বেবিডল' ড্রেস গুলো এমনই যে যত না শরীর ঢেকে রাখে, তার থেকে বেশি উন্মোচন করে শরীরের ভাষা - কথা - ইশারা। প্রথম প্রথম এগুলো পরতে ওর একটু অস্বস্তি হতো ঠিকই, এখন এগুলো সব জলভাত হয়ে গেছে। 

 

মীনা বাইরে এসে হেসে বসতে যায় লোকটির পাশে। লোকটি হঠাৎ যেন চমকে, কোনো এক ঘোর থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে টেবিলের সামনে রাখা ফ্রেমটা উল্টো করে গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, "আপনি রেডি হয়ে গেছেন ? আসুন, আমরা ভেতরে যাই। "

 

লোকটি হেঁটে সামনের দিকে এগোতে থাকে, পেছনে আসতে আসতে মীনা দেখলো হাতের আঙ্গুলগুলো দিয়ে চোখের জল মুছলো লোকটি। ভেতরে বেডরুমে এসে দাঁড়িয়ে থাকে চুপ করে দেওয়ালে ভর দিয়ে। দেখতে থাকে মেহেক কে। মেহেক বুঝতে পারে না কি করবে , আসলে আগে অন্য সব জায়গাতে ও আসার পরেই ক্লায়েন্টরা নিজে থেকেই ওর ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়তো, বা নিজেরাই আগে এগিয়ে আসতো ওর দিকে। এ তো হাঁ করে চুপ করে দেখছে ওকে , মনে হচ্ছে কিছু যেন বলতে চাইছে কিন্তু পারছে না। মেহেক কিছু বলতে যায় , তার আগেই লোকটি বলে ওঠে ,"আপনার নাম মীনা, তাই তো ? ভালো, ভালো ! আচ্ছা আপনি বলুন কিভাবে আমরা শুরু করবো। মানে আপনি বিছানায় শুয়ে পড়বেন, না আমি আপনাকে কোলে তুলে শুইয়ে দেব, তারপরে আমরা...ওহ, সরি সরি। তার আগে আমাকে চেঞ্জ করতে হবে, তাই না ? লোকটি মেহেকের দিকে পেছন ফিরে জামা প্যান্ট খুলতে শুরু করে। মেহেক এগিয়ে আসে ধীরে ধীরে ওর দিকে , লোকটির হাত ধরে ওকে নিয়ে এসে বসিয়ে দেয় বিছানার ওপরে। নিজের হাতে ধীরে ধীরে লোকটির জামা খুলতে খুলতে বলে ওঠে,"আমার আসল নাম মেহেক। আপনি আমাকে মেহেক বলে ডাকতে পারেন। "

 

মেহেক বুঝতে পারে না, কেন হঠাৎ করে নিজের আসল নাম বলে দিলো লোকটিকে। লোকটি কিছু না বলে চোখ বন্ধ করে আছে। মেহেক হাসে নিজের মনে। সব পুরুষগুলোই এইরকম , একটু একটু ভয় পায় প্রথমে, তারপরে জেগে উঠবে, আর কয়েক মিনিটের মধ্যে শেষ। তাও ভালো মাত্র তিনঘন্টার জন্য ও আজ আছে এই লোকটার কাছে। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যেতে হবে এখান থেকে , কেন যে লোকটার ওপরে মায়া হচ্ছে !

 

ধীরে ধীরে জামা প্যান্টের ভেতরের আদিম নগ্নতা জেগে ওঠে মেহেকের সামনে। লোকটি এখন সম্পূর্ণ নগ্ন , বসে ওর সামনে। বয়স হয়ে গেলেও লোকটির শরীরে কোনো মেদ নেই, বুকের ওপরে রয়েছে অল্প কিছু লোম , ঊরুর ওপরে সুন্দর পেশী গুলো যেন খোদাই করে বসানো। বুঝতে পারে মেহেক, লোকটি নিয়মিত শরীর চর্চা করে, বা ভারী কোনো শারীরিক পরিশ্রমের কাজ করে প্রতিদিন। মেহেক লোকটির বুকের ওপরে হাত দেয়, এগিয়ে আসে লোকটির মুখের দিকে।

 

লোকটি হঠাৎ সজোরে জড়িয়ে ধরে মেহেক কে। ওকে ধরে তুলে নেয় কোলে , দাঁড়িয়ে পড়ে। চুপ করে দেখতে থাকে মেহেককে। ধীরে ধীরে পাগল হয়ে যাচ্ছে লোকটা। আর একটু সময়, তারপরেই....লোকটি শুইয়ে দেয় মেহেককে বিছানার ওপরে , ধীরে ধীরে শুয়ে পড়ে ওর পাশে। আধশোয়া অবস্থায়, মেহেকের দিকে ফিরে হাত দিয়ে স্পর্শ করে মেহেক কে।

 

মেহেক উত্তেজিত হওয়ার অভিনয় করে, মুখ দিয়ে আওয়াজ করতে শুরু করে। লোকটি মেহেক এর কানের কাছে এসে ধীরে ধীরে বলে, "অভিনয় করতে হবে না। যা হবে, যেটা হবে সেটা যেন সত্যিকারের হয় ! আমি আসল আর নকল বুঝতে পারি খুব ভালো করে। "

 

মেহেক চুপ করে যায়, হাঁ করে তাকায় লোকটির দিকে। লোকটি মেহেকের 'বেবিডল' ধীরে ধীরে খুলে দেয় নিজের আঙ্গুল দিয়ে। তিরতির করে কেঁপে ওঠে মেহেক , ঠিক যখন এক প্রেমিক তার প্রেমিকাকে প্রথমবার নিজের সামনে উন্মোচন করে, তখন যে অবস্থা হয়, আজ মেহেকের সেই অবস্থা। নিজেই নিজেকে বুঝতে পারছে না মেহেক। আগে তো কত শরীর ঘেঁটেছে ও, কারোর সাথে তো এরকম কোনো অনুভূতি হয় নি ! আজ সব কিছু উল্টো পাল্টা কেন হয়ে যাচ্ছে।

 

একটু পরে লোকটি ধীরে ধীরে উঠে আসে মেহেকের ওপরে। নামিয়ে আনে নিজের ঠোঁট মেহেকের ঠোঁটের ওপরে। মেহেক ধীরে ধীরে ফাঁক করে নিজের ঠোঁট, উত্তেজিত হয়ে উঠছে মেহেক।

 

হঠাৎ লোকটি চেঁচিয়ে ওঠে জোরে ,"না আআআ.......নাআআআ......" মেহেকের পাশে উঠে বসে লোকটি, বিছানার ওপরে ঘুঁষি মেরে উঠে দাঁড়ায় লোকটি। এক তীব্র হতাশায় নিজের মাথার চুল জোরে টেনে ধরেন নিজের দু হাত দিয়ে। মেঝেতে রাখা জামা প্যান্ট টেনে পরে নিয়ে মেহেক এর দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে, "আমাকে ক্ষমা করবেন মেহেক। আমি অক্ষম , আমি আমি কিছুই করতে পারবো না। সরি আপনার সময় নষ্ট করলাম বলে। তবে আপনি একদম চিন্তা করবেন না। আপনার ফুল পেমেন্ট রেডি আছে। আপনি জামা কাপড় পরে বাইরে আসুন, আমি বাইরেই আছি।

 

বাইরে বেরিয়ে যায় লোকটি। মেহেক চুপ করে উঠে বসে বিছানার ওপরে। এতো মাসের অভিজ্ঞতায়, এই প্রথমবার এই রকম অভিজ্ঞতা হলো ওর। কিন্তু লোকটি তো অক্ষম নয় , আমি আমি তো অনুভব করেছি লোকটিকে, আমার শরীরে স্পর্শ করেছে সেই উত্তেজনা।

 

কিছুই বুঝতে পারে না মেহেক। চুপ করে উঠে বাইরে রাখা সালোয়ার কামিজ টা ভেতরে নিয়ে এসে পরে নিয়ে বাইরে এসে বসে মেহেক। লোকটি মনে হয় বাথরুমে বা ব্যালকনিতে ! তাড়াতাড়ি মেহেক টেবিলের সামনে গিয়ে উল্টে রাখা ফ্রেমটা সোজা করে দেখে।

 

একটা সুখী পরিবারের ছবি ফ্রেমে বন্দী ! লোকটি জড়িয়ে ধরে আছে আরেকজন ভদ্রমহিলাকে, দুজনেই দুজনের দিকে তাকিয়ে হাসছে , লোকটির কাঁধে চড়ে বসে আছে একটি ছোট বাচ্চা ছেলে।        

 


++++++++++



"মা, ও মা ! শোনো না , দুদিন পরে আমার জন্মদিনে, আমাকে একটা বাইসাইকেল কিনে দেবে ? একদম টুকটুকে লাল রঙের ? ওই যে স্ট্রেট হ্যান্ডেল, গীয়ার দেওয়া ? জানো ওই রূপান এর ও একটা স্ট্রেট হ্যান্ডেল সাইকেল আছে , আর মাতঙ্গ এর ও আছে। তবে ওদের কারোরটায় না গীয়ার নেই। আর, আর ওই যে সাইকেলের হ্যান্ডেলের নিচে বোতল রাখার জায়গা থাকে , সেরকম ও একটা থাকতে হবে ! কি গো ? বলো না, কিনে দেবে ? " স্নিগ্ধাকে ধরে হাত ধরে টানতে টানতে জিজ্ঞেস করে ওঠে আট বছরের শৌনক।

 

স্নিগ্ধার এখন কোনো সময় নেই কোনো দিকে তাকানোর। যদিও এখন ঘড়ির কাঁটা দৌড়োচ্ছে নটার দিকে, তবুও কাজ যেন শেষ হয়েই চাইছে না। আর তার মাঝে এই ছেলের একঘেয়ে ঘ্যানঘ্যান, বিরক্ত হয়ে ওঠে স্নিগ্ধা। সুপর্ণা গেলো কোথায় ? কান থেকে হেডফোনটা খুলে জোরে ডাক ছাড়ে স্নিগ্ধা ,"সুপর্ণা ? এই সুপর্ণা ! একটু এসে সোনু কে নিয়ে যা তো , টিভিটা ছেড়ে দে। আর ওকে খাইয়ে দে। " আমার কানে হেডফোন লাগিয়ে নেয় সুপর্ণা। রাতে একটার সময়ে কল টাইম দিয়েছে স্টুডিও থেকে।

 

শৌনক মুখটা শুকনো করে ছেড়ে দেয় মা কে। ধীরে ধীরে সরে আসে মায়ের কাছ থেকে। মা যেন কিরকম হয়ে যাচ্ছে এখন। ঘরে থাকতেই চায় না , আর ঘরে থাকলেও সারাক্ষণ এই হেডফোন কানে লাগিয়ে শুনতে থাকে গান। তবে টিভিতে যখন মা কে দেখায় , মা যখন কোনো প্রোগ্রামে গান করে , কি ভালোই না লাগে শুনতে , নাচতে ইচ্ছে হয় খুব। শৌনকের নিজের গলাতে তো কোনো সুর নেই, তবুও চেষ্টা করে মায়ের মতো করে গাইতে, কিছুতেই পারে না। স্নিগ্ধা অনেকদিন আগে বলেছিলো, "তুই চেষ্টা কর, প্রতিদিন সকালে উঠে গান সাধা প্র্যাক্টিস কর। দেখবি, তুইও কত ভালো গান করতে পারবি। " সেদিন শৌনক জিজ্ঞেস করেছিলো ,"তুমি শেখাবে আমাকে ? "

 

ঘুম ঘুম চোখে স্নিগ্ধা উত্তর দেয়, "হ্যাঁ বাবা। আমি তোকে শেখাবো। কেমন ? এখন আমাকে একটু ঘুমোতে দে তো। তোর তো আবার স্কুল আছে। সুপর্ণাদিকে বল, ও তোকে রেডি করে দেবে। কাল অনেক রাতে ফিরে এসেছি তো , এখন খুব ক্লান্ত লাগছে সোনু। " সেই দিন আর আসে নি , স্নিগ্ধাও ভুলে গেছে ছেলেকে করা প্রমিস।

 

শৌনক এসে দাঁড়ায় বড়ো কাঁচের জানলার সামনে। পার্ক সার্কাসের একটা বহুতল এর একদম ওপরের ফ্লোরে একটা পেন্টহাউসে থাকে ওরা - মানে ওরা তিনজন। চৌত্রিশের স্নিগ্ধা, আট বছরের শৌনক আর ওদের বাড়িতে সবসময়ের একজন দিদি কাম কেয়ারটেকার সুপর্ণা। বছর তিন আগে ওরা এখানে এসে থাকতে শুরু করে। বাইরে চওড়া রাস্তা দিয়ে কত গাড়ি চলছে , মনে হচ্ছে যেন ভেসে ভেসে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। কত লাল আর হলুদ আলো , কাঁচের জানলার ওপারে মিটমিট করে জ্বলছে , আর তাদের মাঝে সাদা পোশাক পরা কয়েকজন ট্রাফিক কাকু, হাতে লাঠি আর মুখে বাঁশি নিয়ে সবকিছু সামলানোর চেষ্টা করে চলেছে। তার মধ্যে কত মানুষ, কত আঙ্কেল, কত আন্টি, কত মানুষ। বাবা ? বাবাও কি ওই ভিড়ের মধ্যে আছে ? আচ্ছা, বাবা কি জানে, এখন আমি এখানে দাঁড়িয়ে বাবাকে খুঁজে চলেছি ? আমি যদি বাবাকে দেখতে পাই, যদি হাত নাড়ি , বাবা...দেখতে পাবে আমাকে ? শৌনক রাস্তার ওপর থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে তাকায় অন্যদিকে।

 

ওদের এই বড়ো সোসাইটিতে আছে পাঁচটা টাওয়ার , ঠিক যেন মোমবাতির মতো করে উঠে গেছে নিচ থেকে। প্রত্যেকটা মিলে তৈরী করেছে একটা সার্কেল। সেই প্রথম যখন মা ওকে দেখিয়েছিলো এই জায়গাটা , ও বলে উঠেছিল ,"মা, দেখো ! সার্কেল। আবার সার্কেলের মাঝেও আর ও একটা ছোট সার্কেল। " অবাক হয়ে তাকিয়েছিলো সেদিন শৌনক।

 

স্নিগ্ধা জিজ্ঞেস করেছিলো ,"তোর পছন্দ হয়েছে ? " ও ঘাড় নেড়ে বলেছিলো , "হ্যাঁ ! " বলেই শৌনক টেবিলের ওপরে রাখা পেপারওয়েট নিয়ে খেলতে শুরু করে দিয়েছিলো। স্নিগ্ধা বিল্ডারকে বলেছিলো ,"দেখুন ছেলের যখন পছন্দ হয়েছে , তাহলে আপনার এখানেই আমি সব ফাইনাল করতে চাই। তবে দামটা একটু কমান। আর আমার বারোতলার ওপরে - পেন্টহাউসই চাই , ওই যে চারটে রুমের পেন্টহাউস , মানে নিচে একটা বেডরুম, আর ওপরে তিনটে ! ঐটা। আমি আসলে নিচে, নিজের জন্য একটা স্টুডিও সেটআপ করবো , সেখানে আমার সব মিউজিক্যাল ইনস্ট্রুমেন্ট থাকবে, আর ওপরে সবাই আমরা থাকবো। আর দেখুন, আমার কিচেনের রংটা ঠিক পছন্দ হচ্ছে না। আমার সব কিছু ব্রাইট.... " শৌনক ইন্টারেস্ট হারিয়ে ফেলে। মাকে ধরে টানে, "ও মা, চলো না ! আর ভালো লাগছে না তো। বাবা , বাবা আসবে না আমাদের সাথে থাকতে ? "

 

স্নিগ্ধা একটু চমকে ওঠে, নিজেকে তাড়াতাড়ি সামলে, একবার বিল্ডার এর দিকে তাকিয়ে, তারপরে ছেলেকে নিজের কোলের ওপরে টেনে বলে ওঠে স্নেহের স্বরে ,"আসবে তো সোনু। বাবা ও আসবে। আগে আমরা এখানে সব ঠিকঠাক করে নিই ? " ছেলেকে কোল থেকে নামিয়ে সোফার ওপর থেকে উঠে দাঁড়ায় স্নিগ্ধা। সামনে বিল্ডার ও উঠ দাঁড়ায় , দেঁতো হাসি হেসে বলে ওঠে ,"ম্যাডাম, আপনি চিন্তা করবেন না একদম। আমি আপনাকে সব থেকে ভালো ডিল দেবো। আমি একটু সবকিছু ওয়ার্কআউট করে নিয়ে, আপনাকে মেল করে দিচ্ছি....এই ধরুন ঘন্টা দুইয়ের মধ্যে। তারপর আপনি টোকেন মানি হিসেবে লাখ দশেক দিয়ে দিন , আর বাকিটা আমাদের ওপরে ছেড়ে দিন। মাস দুই লাগবে আপনার এই নতুন বাড়িতে আসতে। আর আপনি যে পেন্টহাউসটা নিয়েছেন, একদম পারফেক্ট ম্যাডাম। ওপর থেকে চাঁদের আলো, বারান্দায় দাঁড়ালে বৃষ্টি বা রোদ , যা চাইবেন। আবার অন্যদিকের বারান্দা থেকে আপনি দেখতে পাবেন ঘন সবুজ জায়গা। মানে কলকাতার বুকে এতো সুন্দর জায়গা আপনি আর পাবেন না। "

 

শৌনক তাকায় মাম্পিদের ফ্ল্যাটের দিকে। মাম্পিরা থাকে দশতলার ওপরের একটা ফ্ল্যাটে। একই স্কুলে পড়ে দুজনেই , শুধু সেকশন আলাদা। মাম্পি বারান্দায় বাবার সাথে বসে কিছু একটা খেলছে , পাশে কাকীমা ও বসে কি একটা যেন বলে উঠলো। সবাই হেসে ওঠে ওরা , মাম্পিকে দুজনে জড়িয়ে ধরে দুদিক দিয়ে। মনে পড়ে যায় শৌনকের , বাবাও ওকে কাঁধের ওপরে নিয়ে ঘুরে বেড়াতো , ওপরে ছুঁড়ে দিতো আকাশে, তারপর আবার লুফে নিতো নিজের কোলে। মা ভয় পেতো , বাবা বলতো ,"আমি আছি না ? আমি ঠিক ধরে নেবো আমার সোনুকে। " জলে ভেজা চোখদুটো ঘুরতে থাকে এই ফ্ল্যাট থেকে অন্য ফ্ল্যাটের দিকে। অনেক ফ্ল্যাটেই অন্ধকার হয়ে আছে , আবার কিছু ফ্ল্যাটে শৌনক দেখতে পাচ্ছে বাবার সাথে বসে কেউ টিভি দেখছে, কাউকে বাবা পড়াচ্ছে ! কেউ আবার নিজে পড়ছে , পাশে মা বসে কিছু করছে, বাবা পাশে বসে পেপার নিয়ে পড়ছে। নিচের বাগানে কেউ কেউ বাবা মায়ের সাথে ব্যাডমিন্টন খেলছে। কি যেন হয়ে যায় শৌনকের বুকের ভেতরে , অভিমানে, রাগে গলায় যেন কিছু একটা দলা পাকিয়ে ওঠে ওর। তাড়াতাড়ি ছুটে উঠে যায় ওপরে, নিজের রুমে। ঝাঁপিয়ে পড়ে বিছানার ওপরে।

 

কান্নায় ভিজে যেতে থাকে বালিশ, বিছানা। বারবার জিজ্ঞেস করতে থাকে নিজেকে, বাবা কেন আসছে না ? কেন মা বাবাকে মেরেছিলো ? কেন আড়ি করে আছে ওরা দুজনে ? এই তো সেদিন আমার পুপুনের সাথে আড়ি হয়ে গেলো, দুদিন আমরা কারোর সাথে কথা বলিনি। এখন তো ওই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ? তাহলে মা বাবা কেন বেস্ট ফ্রেন্ড হতে পারছে না ? কেন ভাব করে নিচ্ছে না ?

 

শৌনকের দুড়দাড় করে ওপরে ছুটে যাওয়া দেখেও কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে স্নিগ্ধা। গানটা পুরোটা আরেকবার শুনে নিয়ে, হেডফোনটা রেখে ধীরে ধীরে উঠে আসে ওপরে। শৌনকের রুমের ভেজিয়ে রাখা দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢুকে আসে। ছোট্ট শরীরটাকে কান্নার দমকে ফুলে ফুলে উঠতে দেখে নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে স্নিগ্ধা। নিজেকেই প্রশ্ন করে, - তাহলে কি সব ভুল হয়ে যাচ্ছে ? শৌনক এর কি এখনও এতো অভিমান আমাদের দুজনকে নিয়ে ? আমাদের দুজনের ইগো কোথাও ওকে দুর্বল করে দিচ্ছে না তো ?

 

নিজেকে শক্ত করে শৌনকের কাছে এসে বসে স্নিগ্ধা , ওকে কোলে তুলে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করে ,"কি হয়েছে আমার সোনুর ? কান্না কেন ? ও সাইকেল ? সেতো আরো দুদিন দেরি আছে, তাই না ? আমি দেবো তো তোকে। " আরো জোরে কেঁদে ওঠে শৌনক , ছোট দুটো হাত দিয়ে জোরে চেপে ধরে মাকে ! স্নিগ্ধা হাসতে হাসতে বলে ওঠে,"পাগল ছেলে আমার ! কি হয়েছে, বলবি তো আমাকে ? আজ পিজ্জা খাবি ? অর্ডার করবো ? "

 

কান্না থামিয়ে, ফোঁপাতে ফোঁপাতে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে শৌনক ,"বাবা কি আসবে আমার জন্মদিনে ? তুমি আর বাবা ভাব করে নাও না মা ! "

 

শৌনককে ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ায় স্নিগ্ধা , হিসহিস করে বলে ওঠে ,"তুমি বড়ো হচ্ছ শৌনক। তোমার বোঝা উচিত, সবকিছু ভাব করে মেটানো যায় না ! চলো, বাথরুমে যাও , চোখে মুখে জল দিয়ে নিচে এসো। খেতে হবে। আজ আমি তোমাকে খাইয়ে দেব। আর আমাকে বেরোতে হবে তারপরে। সুপর্ণা কে আমি বলে যাবো , ও সোফাতে শোবে তোমার কাছে আজ রাতে। আর একদম আজে বাজে উল্টোপাল্টা বায়না করবে না ! " রুম থেকে বেরিয়ে আসে স্নিগ্ধা। 

 

কিচেনে গিয়ে সুপর্ণা কে সব বুঝিয়ে নিজে এসে ভালো করে স্নান করে স্নিগ্ধা। আজ একটা ভালো শাড়ি পরতে হবে , আর অনেকটা গভীর ক্লিভেজ দেখানো ব্লাউজ তার সাথে। রেকর্ডিংয়ের আগে সুপারস্টার পারভীন এর সাথে দেখা করতে হবে। ও অনেকদিন থেকে বলে রেখেছে। আজ নিজের ও কিরকম একটা হচ্ছে সেই সকাল থেকে , খুব কাউকে কাছে পেতে ইচ্ছে করছে , কারোর স্পর্শ মাখতে ইচ্ছে করছে নিজের শরীরে।

 

স্নান সেরে, ভালো করে সুগন্ধী মেখে, একটু মেকআপ করে নিচে এসে সুপর্ণা কে ডেকে বলে স্নিগ্ধা , "শোন, তুই সোনু কে খাইয়ে দে। আর আমি বেরোচ্ছি এখন। ফিরতে রাত হবে , একটা রেকর্ডিং... " কথা শেষ না করতে করতেই সুপর্ণা বলে ওঠে,"দিদি, সবে তো দশটা বাজে। তোমার রেকর্ডিং তো একটার সময়ে। আর একটু সময় থাকো না সোনুবাবার সাথে। তুমি তো ওকে খাইয়ে দেবে বলেছিলে ! "

 

"আহঃ , সুপর্ণা। তুই যেটা বুঝিস না সেটা নিয়ে কথা বলিস কেন ? জানিস ওখানে গিয়ে এখন আমাকে মিউজিসিয়ানদের সাথে প্র্যাক্টিস করতে হবে এখন একটু ? সেটার জন্য সময় লাগবে না ? " গটগট করে বেরিয়ে চলে আসে স্নিগ্ধা।

 

ওপর থেকে শৌনক নেমে আসে , "মা কোথায় ? সুপর্ণা দি, মা কোথায় ? "

 

"মা তো চলে গেলো। এসো আমি তোমাকে খাইয়ে দিচ্ছি !"        

 

শৌনক চেঁচিয়ে ওঠে, "মা চলে গেলো ? মা চলে গেলো ?মা যে বললো, আমাকে খাইয়ে দেবে ? আমি আজ কিছু খাবো না ! কিচ্ছু খাবো না ! " কাঁদতে কাঁদতে সিঁড়ির ওপরেই বসে পড়ে শৌনক।      

 

সুপর্ণা ভেবে পায় না কি বলবে এই ছোট ছেলেটাকে। কার দোষ ? কার অভিশাপ লেগে গিয়েছে এই মা ছেলের জীবনে ? যাপনে ? কেন স্নিগ্ধাদি মাঝে মাঝেই রাতের পর রাত বেরিয়ে যায় ছেলেকে একা ছেড়ে ? জানে না ছেলে কিরকম ভাবে আঁকড়ে ধরে থাকতে চায় মাকে? দীর্ঘ একটা শ্বাস কোনোরকমে বুকের গভীরে চেপে ধীরে ধীরে সরে আসে সুপর্ণা সিঁড়ির সামনে থেকে। রান্নাঘরের বাকি কাজগুলো শেষ করতে করতে আরো ঘন্টাখানেক লেগে যাবে। শৌনক যতই অভিমান করুক, ও ঠিক আসবে গুটি গুটি পায়ে , এসে সুপর্ণাকে টেনে তুলে বলবে - খেতে দাও। চলে গেলো সুপর্ণা চোখের সামনে থেকে।

 

 

++++++++++ 



শৌনক কাঁদতে কাঁদতে উঠে দাঁড়ায়, ছুটে চলে আসে মায়ের রুমের ভেতরে। বিছানার ওপরে মায়ের ছেড়ে রাখা হাউসকোট তুলে নেয় হাতের ওপরে, একটা কোণ জড়িয়ে শুয়ে পড়ে শৌনক। অনুভব করে মায়ের স্পর্শ। কাঁদতে কাঁদতে চোখের জল শুকিয়ে গেছে ছোট্ট আট বছরের ছেলেটার। নিজের রুমে গিয়ে টেডিটা জড়িয়ে ওর সাথেই কথা বলতে শুরু করে শৌনক, "জানিস টেডি ! আমাকে কেউ ভালোবাসে না। বাবা তো ভালোবাসেই না , মা ও খালি আমাকে একা একা ছেড়ে দিয়ে কোথায় যে চলে যায় ! তুই, তুইও আমাকে ছেড়ে চলে যাবি ? তুই যদি আমাকে ছেড়ে চলে যাস, আমি ও তোর সাথে কোনো কথা বলবো না। আড়ি আড়ি আড়ি ! " জোরে দেওয়ালের ওপরে ছুঁড়ে মারে টেডিকে। মুখ ঘুরিয়ে চুপ করে বাবু হয়ে বসে শৌনক। বেশ কিছুক্ষণ পরে দৌড়ে উঠে আসে, মেঝে থেকে কোলে তুলে নেয় টেডিকে।

 

টেডিকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে,"তোর খুব লেগেছে, তাই না ? সরি , সরি ! আমি আর আড়ি করবো না তোর সাথে। দাঁড়া, দেখি তোর কোথায় লেগেছে। ব্যান্ডেজ আর ইঞ্জেকশন লাগাতে হবে না ? " খেলার 'ডক্টর সেট' নিয়ে এসে টেডিকে ভালো করে টেবিলের ওপরে বসিয়ে রেখে বলে ওঠে শৌনক , "জানিস টেডি ? আমার ও না সেদিন স্কুলে খুব লেগেছিলো। সেই যে , দোলনায় চড়তে গিয়ে পড়ে গেলাম ? খুব কষ্ট হচ্ছিলো সেদিন। বিকেলে এসে মা কে বললাম, মা সুপর্ণা দি কে ডেকে কিসব লাগিয়ে দিলো। ভালো লাগছিলো, কিন্তু আমি তো মাকে জড়িয়ে ধরে, মায়ের কোলে মাথা রেখে শুতে চেয়েছিলাম সেদিন। মা আমাকে উল্টে রাগ দেখালো, আমি নাকি তাড়াহুড়ো করছিলাম আর তাই পড়ে গিয়েছিলাম। সেদিন, সেদিন যখন পপিন্স পড়ে গিয়েছিলো খেলতে খেলতে, কাকিমা ওকে তাড়াতাড়ি কোলে করে তুলে নিয়ে কত আদর করলো , তুই তো দেখেছিস ওপর থেকে, তাই না ? আমাকে কেউ আদর করে না টেডি। কেউ না ! তোর মনে আছে বাবা আমাকে....ও তখন তো তুই আসিস নি , তোর কি করে মনে থাকবে ? বাবা সেই সকালে অফিসে বেরিয়ে যেত, আর ফিরে আসতো কত রাত করে। ফিরে আসতেই আমি তো লাফিয়ে বাবার কাঁধে উঠে পড়তাম, বাবাকে বলতাম ঘোড়া হতে। আর বাবা অফিসের ব্যাগ পাশে রেখে ঘোড়া হয়ে যেত , তারপর সারা ঘরে আমাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াতো। আমিও চেঁচাতাম। মা তো তখন আমার সাথেই ঘরে থাকতো , মা ও কি খুশি হতো আমাকে দেখে। তারপর আমরা তিনজনে মিলে মাঝে মাঝে বাইরে খেতে যেতাম, বাবা আমাকে নিজের হাতে খাইয়ে দিতো। মা একটু বকাবকি করতো, কিন্তু বাবা বলতো, আমার প্রিন্সকে আমি খাইয়ে দেবো ! আমিও তখন হেসে দাঁত দেখতাম মা কে। একটু পরে মা নিজেও হেসে উঠতো। আজও তো আমার খুব ইচ্ছে করে টেডি, বাবা আবার এসে আমাকে খাইয়ে দিক। কবে যে আসবে বাবা ! "

 

টেডিটাকে টেবিলের ওপর থেকে মেঝেতে বসিয়ে তাড়াতাড়ি টেবিলের ওপর থেকে একটা খাতা নিয়ে টেডির সামনে রেখে বলে ওঠে শৌনক , "তুই তো আমার বাবাকে দেখিস নি , তাই না ? জানিস, আমি বাবা, মা আর আমার ছবি এঁকেছি। দেখাবো তোকে ? " খাতার পাতাগুলো ওল্টাতে ওল্টাতে একটা পাতায় এসে দাঁড়িয়ে যায় শৌনক। "এই দেখ, আমার বাবা, মা আর আমি। দেখেছিস? বাবা কি লম্বা ? আর আর চোখে চশমাও আছে বাবার। আর এই যে পাশে মা, মা শাড়ি পরে বাবার পাশে দাঁড়িয়ে। আর এই, এই ছোট্ট বেবিটা, ওটাই তো - আমি ! তখন আমি আরো ছোট ছিলাম না ? বাবা আমাকে বাজারে নিয়ে যেত, আমাকে পার্কে খেলতে নিয়ে যেত। মা তো গান করতো তখন ! তাই মাঝে মাঝে ফাংশন করতে যেত শনি রবিবার করে ! তখন বাবা আমাকে নিয়ে অপেক্ষা করতো মায়ের জন্য। কতবার মা কে আমি সামনে থেকে বসে গান করতে শুনেছি , বাবার কোলে বসে। কিন্তু বাবা যে কেন কাঁদতো, জানি না। মা এর প্রোগ্রাম শেষ হয়ে গেলে, আমরা একসাথে ফিরে আসতাম। "

 

টেডির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে শৌনক , "কি রে ? ঘুম পাচ্ছে তোর ? আমার তো খিদে পাচ্ছে। কিন্তু আমি আজ খাবো না , খাবো না, খাবো না। কেন খাবো ? মা আমাকে ছেড়ে , না খাইয়ে কেন চলে যাবে ? " আবার খাতার পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে একজায়গায় এসে চুপ করে থাকে শৌনক। নিজেই বলতে থাকে, "জানিস টেডি, একদিন বাবা না, খুব কেঁদেছিলো। আমাকে জড়িয়ে ধরে খুব , খুব কেঁদেছিলো। আমিও কিছু না বুঝে বাবাকে কাঁদতে দেখে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদছিলাম সেদিন। সেদিন না মা খুব বকা দিয়েছিলো আমাকে। আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে চলে এসেছিলো , আমাকে আর একটা রুমে বন্ধ করে বলেছিলো, "একদম বাবার মতো করবি না। তোর বাপ টা একটা অমানুষ , নোংরা লোক। ওর সাথে ঘর করা যায় না ! " আমাকে মা ও জড়িয়ে ধরে বলেছিলো সেদিন, "সোনু, শোন বাবা। আমি তোকে এখান থেকে নিয়ে চলে যাবো আমার সাথে। সেখানে তুই খুব ভালো থাকবি। এই, এই তোর বাবার মতো করে একদম তৈরী করবো না তোকে আমি। তোকে অনেক বড়ো হতে হবে। তোর বাবার মতো কথায় কথায় চোখের জল ফেললে হবে ? " আমাকে ছেড়ে মা বেরিয়ে গেলো বাইরে। বাইরে থেকে দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছিলো যাতে আমি বেরিয়ে আসতে না পারি।   

 

পরে কি হয়েছিলো জানিস টেডি ? আমি তো কিছুই জানি না। আমি শুধু মা বাবার চিৎকার শুনতে পাচ্ছিলাম, মাঝে মাঝে কিছু ছুঁড়ে ফেলার শব্দও পেয়েছিলাম। মা বোধহয় বাবাকে চড় থাপ্পড় মেরেছিলো - জানি না। তবে আমাকে মা মারলে যেরকম আওয়াজ হয়, সেইরকম আওয়াজ পাচ্ছিলাম তো সেদিন। একটু পরে দড়াম করে আমার রুমের দরজা খুলে ঢোকে মা ঘরে। মায়ের মাথার চুল খুলে গিয়েছিলো ক্লিপ থেকে , কপালের কাছটা ফুলে গিয়েছিলো ভীষণ , দু চোখ কি লাল ছিল সেদিন। কি সব জোরে জোরে বলতে বলতে আমার হাত ধরে জোরে টেনে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছিলো মা। তারপরে বাবার দিকে আঙ্গুল তুলে আরো কিসব বলে আমাকে নিয়ে মেন দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এসে একটা ট্যাক্সি ডেকে - আমরা চলে আসে দাদু দিদার বাড়িতে। বাবাকে দেখেছিলাম আমি ট্যাক্সির পেছনের কাঁচের জানালা দিয়ে , ছুটে আসছিলো গাড়ির সাথে , তারপরে পড়ে যায় রাস্তার ওপরে। মা আমাকে জোর করে টেনে নেয় নিজের কাছে , আমার মুখটা নিজের বুকের ওপরে চেপে ধরে জোরে। মা কিরকম ফোঁসফোঁস করছিলো সেদিন রাগে ! রেগে গেলে মায়ের যে কি হয়......! “

 


++++++++++


 

দিদি চলে গেছে বেশ কিছুক্ষণ হয়ে গেছে। খিদেটা আবার পাচ্ছে। একটু আগেই দিদি এগরোল খাওয়ালো, তবুও যেন খিদে মিটছে না। কি যে হয়েছে এই পোড়ার পেটে ? পেট যদি না থাকতো, কি ভালোই না হতো। কোনো চিন্তা করতে হতো না। মাঝে মাঝে আর কিছু ভালো লাগে না মায়াঙ্কের। সব কিরকম যেন অর্থহীন হয়ে যাচ্ছে চারদিকে। কোনো চাকরি পাওয়া যাচ্ছে না, না পারছি পড়াশোনা করতে। ওদিকে মা, বাবা চলে যাওয়ার পরে আরো ভেঙে পড়েছে। প্রতিদিন এই ওষুধ - ডাক্তার করে করেই মা আরো বিছানার সাথে মিশে যাচ্ছে কিরকম ভাবে। দিদিটার ওপরেই এখন সব ভার এসে পড়েছে সংসারের। দিদির নিজেরও তো পড়াশোনা কমপ্লিট হলো না ! মুম্বাই থেকে সব ছেড়ে চলে এলো ? কাদের জন্য, কেন এসব করছে দিদি ? দিদি তো বিয়ে করে চলে যেতে পারতো ! মুম্বাইতে এতো বছর ছিল, ওখানে প্রেম হয়নি , ভাব ভালোবাসা হয়নি কারোর সাথে, বিশ্বাস করি না। তার সাথেই তো থেকে যেতে পারতো, বা ওখানেও চাকরি করতে পারতো। কেন ফিরে এলো এই শহরে ? এই শহর, কলকাতা, আসলে একটা অন্ধকূপ, সব কেড়ে নেয় সবার কাছ থেকে , ফিরিয়ে দেওয়ার সময় মুখ ঘুরিয়ে নেয়। বাবা, এই তো বাবার কাছ থেকেই তো সব কিছু নিয়ে নিলো, বাবারই কলিগরা , আর বাবা মারা যাওয়ার পরে কজন এসেছিলো দেখা করতে ? পাশে দাঁড়াতে ? সব স্বার্থ। যে যার নিজেরটা আগে বুঝে নাও, ভালো মানুষ পেলে, গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে তার সব কিছু চেটে পুটে লুটে নাও , ছিবড়ে করে ফেলে দাও। থু: করে পাশে রাস্তার ওপরে থুতু ফেললো মায়াঙ্ক।

 

পাশ থেকে হঠাৎ করে কেউ একজন লাফিয়ে উঠে চেঁচিয়ে ওঠে , "হেই , হোয়াট আর ইউ ডুইং ? ইউ ব্লাডি বাগার ! ডিসগাস্টিং। " চোখ তুলে দেখে মায়াঙ্ক। তিনটে মেয়ে পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছে , তিনজনেরই পরণে ঘন নীল রঙের গলাবন্ধ জ্যাকেট আর গায়ের সাথে লেগে থাকা হাঁটু পর্যন্ত স্কার্ট। গলায় কলারের কাছে সাদা আর নীল রঙের ছোপ ছোপ করা রুমাল গুঁজে রাখা। একটা প্লেন কোম্পানির এয়ার হোস্টেস এরা। পার্ক স্ট্রিটে এখানে একটা ট্রেনিং স্কুল আছে ওই ফ্লাইট কোম্পানির। সেখানেই এসেছিলো হয়তো এরা! মায়াঙ্ক শুকনো মুখে উঠে দাঁড়িয়ে বলে ওঠে "সরি, সরি ! প্লিজ কিছু মনে করবেন না। "

 

তিনজনের মধ্যে মাঝের জন বলে ওঠে, "লুক, দিস বেগার নোজ হাও টু স্পিক ইন ইংলিশ। " হাহাহাহা করে হেসে ওঠে তিনজনেই। মুখ ঘুরিয়ে চলে যায় ওর সামনে থেকে। অপমানের জ্বালাটা এককান দিয়ে ঢোকার আগেই বের করে দিয়ে চুপ করে বসে পড়ে মায়াঙ্ক। বাবা মারা যাওয়ার পরে, এরকম অনেক কথাই শুনতে হচ্ছে আসে পাশের লোকজনের কাছে। এখন আপনজন বলতে শুধু মা আর দিদি। আর, আর হয়তো সেই মেয়েটা....জানি না !

 

আবার আর একবার ওই তিনটে মেয়ের দিকে তাকায় মায়াঙ্ক। কি সুন্দর চকচক করছে ওদের সারা শরীর, ওদের কথাবার্তা। আরে এটা আবার কি ? এয়ারহোস্টেস মেয়েগুলো পায়ে কালো রঙের নেটের মতো পাতলা কি একটা মোজা পরে , ওটা নাকি থাই পর্যন্ত লম্বা হয়, কি যেন বলে ওটাকে ? স্তো....স্ট...স্টকিংস ! যে মেয়েটা এতো কথা শুনিয়ে গেলো, ওর স্টকিংসটা তো পেছন থেকে ছিঁড়ে গেছে , পাতলা নেট গুলো বেরিয়ে এসে উড়ছে। হাহাহাহা , আমাকে বেগার বলা হচ্ছিলো ? এইজন্যই বলে, অন্যকে কিছু বলার আগে, নিজের দিকে আগে দেখতে ভালো করে।

 


++++++++++ 



উঠে দাঁড়ায় মায়াঙ্ক , হেঁটে যেতে হবে শহীদ মিনারের নিচে বাস স্ট্যান্ডে। ডায়মন্ড হারবার বা রায়চকের বাস ধরে আমতলা যেতে হবে ওকে। মিনি বাসেও যাওয়া যায় , তবে এই ছোট ছোট লাল - হলুদ বাক্সে উঠতে ইচ্ছে করে না ওর। তার থেকে আরামে বসে বসে যাবে ও। শহীদ মিনারের সামনে এসে একটা বাসের হ্যান্ডেল ধরে ওপরে উঠতে যাবে ,ওপর থেকে গর্জন করে একটা প্লেন চলে গেলো একদিন থেকে আরেকদিকে, রেখে গেলো নীল আকাশের গায়ে শুধু সাদা রেখা। আমিও তো চেয়েছিলাম পাইলট হতে। পাইলট হতে পারলে, আমার আসে পাশেও এই সব এয়ারহোস্টেসরা ঘুরে বেড়াতো , তখন কি আর করতে পারতো এইরকম অপমান ? তখন উল্টে আমার ভাজঁ করে রাখা হাতের মধ্যে নিজের একটা হাত ঢুকিয়ে হেসে তাকাতো আমার দিকে। বুকচাপা একটা নিঃশ্বাস - হাহাকার বেরিয়ে এলো ভেতর থেকে। হেসে ওঠে নিজের মনেই মায়াঙ্ক। ধীরে ধীরে বাসের গর্তের ভেতরে ঢুকে পেছনে জানালার ধারে একটা সিটে বসে পড়ে মায়াঙ্ক।

 

মনে পড়ে যাচ্ছে মেয়েটার কথা , সেই মেয়েটা, কয়েকমাস আগে মেট্রোতে দেখা হয়েছিল। মাঝে মাঝে দিদির আসতে দেরি হলে, মায়াঙ্ক মেট্রোতে করে একটু ঘুরে আসে। পার্ক স্ট্রিট থেকে চাঁদনী আবার চাঁদনী থেকে পার্ক স্ট্রিট। সেদিনও দিদি বলেছিলো ওর আসতে ঘন্টাখানেক দেরি হবে। সেই সময় মেয়েটাকে দেখে মায়াঙ্ক। হঠাৎ এই প্রচন্ড খারাপ শহরের মধ্যে যেন হাতের কাছে পায় কোনো এক সোনার কাঠি - রূপোর কাঠি, যার ছোঁয়াতে ও বেঁচে উঠবে - যে ওর ছন্নছাড়া জীবনে এসে, ওকে পূর্ণ করবে। মেয়েটা খুব ভয় পাচ্ছিলো সেদিন মেট্রোর দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতে। দু দুদুটো ট্রেন মিস করেছিলো মায়াঙ্ক মেয়েটার নাটক দেখতে দেখতে। একটু পরে ওর পাশে গিয়ে জিজ্ঞেস করে ,"আপনার কি কোনো অসুবিধে হচ্ছে মেট্রোতে চড়তে ? "

 

অবাক চোখে মেয়েটা ওর দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে ,"আসলে মেট্রোতে ভেতরে এলেই না আমার মাথাটা কিরকম করতে থাকে , দমবন্ধ হয়ে আসে ! এতো লোক , এতো ভিড় ! মনে হয় অক্সিজেন কমে আসছে। কিন্তু আপনি কে ? আপনাকে তো আমি চিনি না !"

 

"আমি? আমি কেউ না। দূরে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম আপনাকে। মনে হলো আপনার হেল্প দরকার, তাই ! ঠিক আছে, আমি চলে যাচ্ছি। সরি। " মায়াঙ্ক চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। 

 

মেয়েটা হঠাৎ কাকুতি স্বরে ওকে বলে ,"প্লিজ আমাকে একটু মেট্রোতে উঠিয়ে দেবেন ? আপনাকে দেখে তো আজেবাজে লোক মনে হচ্ছে না , এইটুকু হেল্প যদি করেন। আসলে হঠাৎ না দিদির ফোন এসেছে, আমাকে যেতে হবে দমদমে। এখন আমি যদি এইসময় ট্যাক্সি নিয়ে যাই, অনেক সময় লেগে যাবে। আর ওদিকে দিদির ছেলের ও স্কুল থেকে আসার সময় হয়ে যাবে। প্লিজ। "

 

পরের ট্রেনটা আসার সময় হতে হাত বাড়িয়ে দেয় মায়াঙ্ক। একটু ইতস্তত করে মেয়েটা হাত ধরে নেয় মায়াঙ্কের। ওকে নিয়ে ট্রেনের কূপের ভেতরে ঢুকে আসে দুজনে। মায়াঙ্ক একটু পরে বলে, "দেখলেন তো ? কত সোজা এই মেট্রোতে ওঠা নামা করা ? আপনি খামোখা ভয় পাচ্ছিলেন। আচ্ছা আমি এবার আসি ! আমাকে নামতে হবে। "

 

মেয়েটি জিজ্ঞেস করে,"আপনার নাম ? "

 

"মায়াঙ্ক , আর আপনার ? "

 

"সুপর্ণা। " বলে ওঠে মেয়েটি।

 

কিছু একটা ভেবে মায়াঙ্ক তাড়াতাড়ি ওর কাছে এসে একটা কাগজের টুকরো পকেট থেকে বের করে নিজের ফোন নম্বর লিখে সুপর্ণাকে দিয়ে বলে , "আচ্ছা, এইটা আমার নম্বর। যদি কখনো কোনো দরকারে পড়েন, বা আবার কোনোদিন মেট্রোতে উঠতে সমস্যা হয়, আমাকে ফোন করবেন ! আমি চলে আসবো ! কেমন ? "

 

ফোন নম্বর লেখা কাগজের টুকরোটা নিয়ে মাথা নিচু করে হেসে ওঠে সুপর্ণা। সেদিন রাতেই ফোন করেছিল সুপর্ণা ওকে , অনেক ধন্যবাদ দিয়েছিলো। ধীরে ধীরে কবে যে কথা বলতে বলতে দুজন কাছাকাছি চলে এসেছে....

 

হঠাৎ একটা ঝাঁকুনিতে চমকে ওঠে মায়াঙ্ক। দিদির দেওয়া টাকাটা একবার বের করে দেখে নেয় - সব ঠিক আছে তো ? গুণে দেখে , দিদি যা দিয়েছে প্রায় দিন পনেরো চলে যাবে ভালো করে। আবার তাহলে দিন পনেরো পরে আসতে হবে - দিদিকে ফোন করে বলে দেবো পরে। দিদি কি চাকরি করে, কোথায় করে জানার একটা অদম্য ইচ্ছে হতে থাকে মায়াঙ্কের। কি করে দিদি এতো টাকা পয়সা কামাচ্ছে ? কোন অফিসে দিদি কাজ করে ? দিদিকে জিজ্ঞেস করেছিলো বেশ কয়েকবার। প্রথম প্রথম দিদি ওর গালে হাত রেখে হেসে বলেছিলো, "ভাই, তুই এসব নিয়ে ভাবছিস কেন ? আমি তো আছি, বাইরের কাজগুলো করছি। তুই একটু দেখনা কোনো চাকরি বাকরি পাস কি না ! তাহলে আমি তখন ঘরে বসে থাকবো পায়ের ওপর পা তুলে। " পরের দিকে জিজ্ঞেস করলে, দিদি কারণে অকারণে রেগে উঠে বিরক্তির স্বরে বলে উঠতো ,"তোদের সমস্যাটা কোথায় ? বাবা তো একটা কিছু রেখে যায় নি আমাদের জন্য। আমার পড়াও শেষ হলো না , তোর পাইলট হওয়াও.....আমি যা কিছু রোজগার করছি, নিজের ক্ষমতায় করছি। ভালো কাজ করছি বলেই না মাসের শেষে একটু মোটা টাকা আসছে। সেটার অর্ধেকেরও বেশি আমি আমাদের সংসারে দিচ্ছি। কেন এতো প্রশ্ন তোর ? "

 

মেহেকের রাগের কারণ বুঝতে পারে মায়াঙ্ক। ও পড়াশোনায় খুব ভালো ছিল একসময় , ভেবেছিলো মুম্বাইতে নিজের কেরিয়ার তৈরী করবে। বাবার আকস্মিক মৃত্যু সব কিরকম যেন ওলোট-পালোট করে দিলো। তবে একটা ব্যাপার কিছুতেই বুঝতে পারে না মায়াঙ্ক , দিদি নিশ্চয়ই ভালো কোথাও কিছু করে , নিশ্চয়ই ভালো কাজ ও করে। বসিয়ে বসিয়ে তো আর টাকা দেবে না ? তা হলে, তা হলে দিদির পার্সে , ওগুলো কেন ছিলো ? কোথাও যেন মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে , কিন্তু দিদিকে জিজ্ঞেস ও করতে পারছে না ভয়ে। যদি দিদি বেরিয়ে চলে যায় ? কোনো সম্পর্ক না রাখে ?

 

সেদিন ছিল এক ছুটির দিন - রবিবার। দিদি বাড়িতে এসেছিলো , তখন স্নান করতে ঢুকেছিলো। একটা ফোন এসেছিলো মায়াঙ্কের , কোনো একটা কোম্পানি থেকে ইন্টারভিউর কল ! হাতের কাছে পেন খুঁজে না পাওয়ায়, জোরে জোরে দিদিকে জিজ্ঞেস করে ,"তোর কাছে পেন আছে ? "

 

"পেন ? দেখ না , আমার হ্যান্ডব্যাগে আছে। সাইডের পকেটে। "

 

তাড়াতাড়ি পেন নিয়ে সবকিছু লিখে নেয় মায়াঙ্ক। লেখা হয়ে গেলে পেনটা ভেতরে রেখে দেয়, হঠাৎ হাতে শক্ত কিছু লাগে। কৌতূহলের বশে দিদির হ্যান্ডব্যাগের মাঝের চেনটা খুলে ফেলে মায়াঙ্ক। ভয়ে বুক কেঁপে ওঠে মায়াঙ্কের। এতো গুলো কন্ডোমের প্যাকেট ? দিদির হ্যান্ডব্যাগে ? আর, এই গোলাপী রঙের, মোমবাতির মতো নরম, লম্বা জিনিসটা কি ? ও বুঝতে পারে, বাইরে থেকে এটাই শক্ত হয়ে হাতে লেগেছিলো ওর।

 

মেহেক স্নান সেরে বেরিয়ে আসে ভেতর থেকে। মায়াঙ্ককে ওই অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করে, "কি রে পেন পেয়েছিস ? কাজ হয়েছে ? রেখে দিয়েছিস তো জায়গা মতো। " চিরুনী খুঁজতে এদিক ওদিক তাকায় মেহেক। খোলা হ্যান্ডব্যাগে দেখে একটু রেগে তাড়াতাড়ি বিছানার ওপর থেকে হ্যান্ডব্যাগটা তুলে নিয়ে চেন লাগিয়ে রাগী রাগী চোখে তাকায় মায়াঙ্কের দিকে। কাটা কাটা গলায় বলে ,"তুই এতো বড়ো হয়েছিস, আর এটা জানিস না যে কখনো কোনোদিন কোনো মেয়ের ব্যাগ ঘাঁটতে নেই ? "

 

মায়াঙ্ক কিছু না বলে মাথা নিচু করে বেরিয়ে যায় বাইরে। দিদি সন্ধেতে কলকাতায় চলে যাওয়ার পরে, ইন্টারনেট ঘেঁটে জানতে পারে, গোলাপী রঙের, মোমবাতির মতো নরম, লম্বা জিনিসটাকে 'ডিলডো' বলে - একরকমের সেক্সটয় !   

 


++++++++++


 

ছোটো থেকেই আমার পড়াশোনার ভীষণ শখ ছিলো। দুই দাদাকে দেখতাম, সকাল হলেই, ঘুম থেকে উঠে, পুকুরে স্নান সেরে বসে পড়তো মাটির দালানে। মাটির সেই দালান, উঠোন , আরো ভোরে ঘুম থেকে উঠে, মা গোবর জল দিয়ে ভালো করে মুছে পরিষ্কার করতো। তারপরে বাড়ির অন্য ছেলেদের ওঠার আগেই আমাকেও জোর করে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে, অন্ধকার থাকতে থাকতে মাঠের এক কোণে, ঝোপের আড়ালে ঘটি নিয়ে দৌড়োত ! সকালের কাজ কর্ম সেরে, অন্ধকার থাকতে থাকতেই, ঘরে ফিরে আসার সময় শুনতে পেতাম মোরগের ডাক - ভোর হওয়ার আহ্বান। মা তারপরে ফিরে এসে স্নান সেরে নিতো, আমার হাতে থাকতো নিমের ডাল। আমিও ঘাটের ধারে বসে থাকতাম চুপ করে। দূর থেকে ভেসে আসা হারমোনিয়ামের সুরে , হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করতো খুব। মা উঠে আসার পর, ভেজা কাপড়েই তুলসীতলায় গিয়ে প্রদীপ জ্বেলে, সূর্যের দিকে ঘুরে, পূব আকাশের দিকে চেয়ে প্রণাম করতো , কি সব বলে যেত মনে মনে। এর মধ্যে বাবাও ঘুম থেকে উঠে চলে আসতো, তখন ওদের জন্য পুকুর থেকে জল তুলে এনে রাখতাম আমি উঠোনের এক কোণে। মা, উনুনে জ্বাল দিয়ে, চায়ের জল বসাতো। আমি দাদাদের কাছে গিয়ে ওদের তুলে দিতাম। ওরা উঠলে, ওদের বিছানা ঠিক করতে হবে যে !

 

দাদারা নিচে এসে, স্নান সেরে বসে যেত বই নিয়ে বাবার সামনে। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে পড়তো ওরা ! ছোড়দা নামতা পড়তো - এক একে এক; এক দুইয়ে দুই; এক তিনে তিন.....আর বড়দা তখন পড়তো ভূগোল - পলি মাটি, বেলে মাটি, এঁটেল মাটি....কি করে তৈরী হয়, কোথায় পাওয়া যায় এইসব। আমি দূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনতাম ওদের পড়া। পড়া শেষে ওরা খেতে বসতো একসাথে। এক বাটি মুড়ি, আর দুধ , সাথে গুড় দিয়ে মেখে, খেয়ে ওরা চলে যেত স্কুলে। আমি দাঁড়িয়ে থাকতাম পেছনে, দেখতাম, ভাবতাম, স্বপ্নের জাল বুনতাম। মাকে একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম, "আমি কবে স্কুলে যাবো মা ? "

 

মুখ ঝামটা দিয়ে মা জবাব দেয়, "মেয়ে হয়ে জন্মেছিস তুই। ভুলে যাস না ! তোর পড়াশোনার কি দরকার ? আমার সাথে সংসারের কাজ শেখ , পরে স্বামীকে খুশি রাখতে হবে তো, না কি ? " বাবা সেদিন শুনতে পায় মায়ের এই কথা, মাকে খুব বকাবকি করে। আমাকে কাছে টেনে নিয়ে, আমার মাথায় হাত রেখে বলে, "না রে মামনি , তুই পড়াশোনা করবি তো। আর কিছুদিন যাক। তুই তো এখনও ছোট , তাই না ? "

 

তখন আমার ছিল পাঁচ বছর বয়স, ছোড়দার সাত আর বড়দার দশ।

 

বাবা বলে উঠতো, "কই গো ! আমাকেও এবার খেতে দাও। মাঠে যেতে হবে তো। আর দুপুরে খাওয়ার নিয়ে মামনিকে পাঠিয়ে দিও মাঠে। " বাবা খেয়ে, মাথায় একটা গামছা জড়িয়ে, লাঙ্গলটা কাঁধে তুলে বেরিয়ে পড়তো মাঠে। সারাদিন ধরে মাঠে মাটি চষে, বীজ বুনে, সার দিয়ে, সোনার ফসল ফলাতো বাবা।

 

একদিন এইরকম গরমের এক দুপুরে, আমি মাঠে গিয়ে বাবাকে গাছের নিচে, বাবার জায়গায় দেখতে না পেয়ে মাঠের মধ্যে নামি। নরম কাদামাটিতে পা বসে যাচ্ছিলো আমার মাঝে মাঝে। কয়েকটা সাপ পাশ দিয়ে চলে গেলো , কিছু জায়গাতে শামুক - গেঁড়ি - গুগলির শুকিয়ে, ভেঙে যাওয়া, শক্ত হয়ে থাকা, ধারালো খোলস সাবধানে দেখে পা ফেলে অবশেষে দেখতে পাই বাবাকে। বাবা মাঠের কাদার মধ্যে মুখ থুবড়ে পড়েছিলো সেদিন। ভীষণ জোরে চেঁচিয়ে উঠেছিলাম আমি, আমার চিৎকারে আসে পাশের কিছু গ্রামের লোক ছুটে আসে। তারাই ধরাধরি করে বাবাকে তুলে নিয়ে আসে। কিন্তু বাবার দেহে তখন আর প্রাণ নেই। কবিরাজ মশায় এসে বলেন, বাবার নাকি যক্ষা হয়েছিলো অনেকদিন। চেপে রেখেছিলো, আর এছাড়াও বাবা নাকি মাঠে বসে দেশি মদ গিলতো। সব মিলিয়ে সেদিন বাবা আমাকে, আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে গেলো।




++++++++++



খুব কেঁদেছিলাম সেদিন , বাবার জন্য নয় - আমার পড়ার স্বপ্নভঙ্গের জন্য। আমি যেন পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম, মা আমাকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেবে কারোর সাথে, কোনো বুড়ো হাবড়ার সাথে। কিন্তু জানতাম না আমার কপালে এর থেকেও খারাপ কিছু ছিলো।

 

বাবা মারা যাওয়ার পরে, হঠাৎ দেখলাম কোথা থেকে এক ভিনদেশী এসে হাজির হয় গ্রামে, আমাদের বাড়িতে। সে নাকি বাবার বন্ধু ছিল, এখন শহরে থাকে। বেশ সাহেব সাহেব দেখতে লোকটাকে। দুই দাদা স্কুলে চলে গেলে, মা ওর সাথে ভেতরে ঢুকে , দরজায় খিল দিয়ে দিতো। বেরোনোর পরে দেখতাম মায়ের মুখে হাসি , লোকটা বেরিয়ে আসতো খালি গায়ে, বুকের ওপরে থাকা লোমগুলোর ওপরে আঙ্গুল দিয়ে চুলকাতে চুলকাতে।

 

সেদিন আমি জিজ্ঞেস করে ফেলেছিলাম , "মা, তুমি ভেতরে কেন ঢুকে যাও ? আমি কবে থেকে স্কুলে যাবো ? "

 

মা কিছু একটা বলে আসে, লোকটা আমার কাছে এসে ভালো করে আমাকে দেখতে দেখতে হেসে ওঠে , মায়ের উদ্দেশ্যে বলে ,"ও বড়ো হয়ে গেছে , বুঝলে ? ওকে স্কুলেই পাঠাবো। তবে গ্রামের স্কুলে নয় , শহরে। "

 

আরো কয়েকমাস পরে লোকটা আমাকে, মাকে আর দুই দাদাকে নিয়ে শহরে আসে। বলে আমাদের চিড়িয়াখানা ঘোরাবে, জাদুঘর দেখাবে , শহরের লোকজন, ট্রাম, বাস, মেট্রো দেখাবে। মা সেদিন খুব সেজেছিলো। চুলে সাবান মেখে, খোঁপা করে গুঁজেছিলো একটা শুকিয়ে যাওয়া গোলাপ , পরেছিলো একটা প্রিন্টেড শাড়ি। দাদারা পরেছিলো, জামা আর প্যান্ট। আমাকেও সেদিন মা সাজিয়েছিলো , আমার চোখ ধেবড়ে দিয়েছিলো কাজলে, পরিয়েছিলো শাড়ি আমাকে। সস্তার সুগন্ধী ঢেলে দিয়েছিলো আমার ওপরে। মুখেও কি সব চ্যাটচ্যাটে ক্রিম দিয়েছিলো মাখিয়ে সেদিন। মা যখন দুই ভাই কে নিয়ে চিড়িয়াখানায়, হঠাৎ লোকটা আমাকে বললো, "মামনি, তুমি তো স্কুলে পড়বে বলেছিলে, তাই না ? এইখানে একটা ভালো স্কুল আছে। চলো আমরা দেখে আসি। "

 

আমি ভয় পাই, ভালো করে চিনি না, জানি না, এই লোকটাকে দেখে এমনিতেই ভয় করে , তার ওপরে আবার নতুন শহর যার কিছুই জানি না , এর সাথে যেতে হবে আমাকে ? আমি মায়ের দিকে তাকালাম। মা বলে উঠলো, "আরে চিন্তা করছিস কেন ? আমরা তো এখানেই আছি , যা , ঘুরে আয় !

 

লোকটা আমাকে নিয়ে এলো স্কুলে, চিড়িয়াখানা থেকে অনেকটাই দূরে। সত্যিই সেটা একটা স্কুল ছিলো বটে ! তবে সেই স্কুলে সেখান হতো কি করে রাস্তায় সেজে গুজে, রং মেখে দাঁড়িয়ে, চোখের ইশারায় , হাতের মুদ্রায় , শাড়ির আঁচল এদিকে ওদিকে সরিয়ে, একটু খোলা বুক - পেট - কোমর দেখিয়ে, রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া - মাতাল, পান খাওয়া, বিড়ি ফোঁকা 'ভদ্রলোকগুলিকে' ডেকে অন্ধকার ঘুপচি ঘরে নিয়ে যেতে হয়। আর শেখানো হতো, কি করে বেচতে হয় শরীর - ঘন্টায় ঘন্টায়, মিনিটে মিনিটে। সেই 'পড়াশোনা'র কাজটা কিন্তু সোজা ছিলো না। এমনও দিন গেছে যখন আমাকে দিনে দশ থেকে বারোটা লোককে পরীক্ষা দিতে হতো। যাকে যত খুশি করতে পারতাম, তার কাছে তত কদর বেশী ছিলো আমার।  

 

লোকটা তো আমাকে এই স্কুলে এক মোটা মাসীর কাছে রেখে অনেকগুলো কড়কড়ে টাকা নিয়ে চলে গেলো। আমার এডমিশন ও সেদিনই হয়ে গিয়েছিলো ওখানে। তার পরে, কোনোদিন আমি আমার মা, দুই দাদা, বা সেই লোকটাকে দেখিনি।  

 

কেটে যায় বেশ কয়েকটা বছর ! তখন আমার বয়স বাইশ বছর। হঠাৎ এইসময় একদিন সুযোগ পেয়ে আমি কোনোরকমে পালিয়ে আসি সেই 'স্কুল' থেকে। কেউ যেন কখনও বলেছিলো পুলিশের কথা। লোকজনকে জিজ্ঞেস করে একটা থানাতে চলে আসি আমি। থানার বড়োবাবুকে বলার পরে, আমাকে বসতে বলেন উনি। একটু পরে আর একজন দিদি আসে , সাথে ছিলো বেশ কয়েকটি ছেলে। ওরাই আমাকে নিয়ে আসে একটা হোমে। আমাকে ধীরে ধীরে কত কি শেখায় ওরা, আমি শিখি পড়তে - বই ; শিখি হাতের কাজ ; শিখি ব্যাঙ্কের কাজকর্ম; শিখি কম্পিউটার চালাতে।

 

একদিন এই হোমে , প্রথম দেখি এক মধ্যবয়স্ক দম্পতিকে। ওরা আমার সাথে অনেকক্ষণ কথা বলে ,আমাকে নিয়ে যায় ওদের বাড়িতে , সর্বক্ষণের কাজের লোক হিসেবে। সেখানেই আমার প্রথম দেখা স্নিগ্ধাদির সাথে। ওদেরই মেয়ে ছিলো স্নিগ্ধাদি। তারপর তো স্নিগ্ধাদির বিয়ে হলো, চলে গেলো স্বামীর ঘরে , আমি থেকে গেলাম কাকু কাকীমার সাথে। ওদেরকে আমি বই পড়ে শোনাতাম, পেপার পড়তাম , রান্না করতাম ওখানে, আবার একসাথে আমরা সিনেমা দেখতাম , ঘুরতে যেতাম এদিক সেদিক। কাকু কাকীমা যেন আমাকে নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসতেন।

 

হঠাৎ একদিন রাতে স্নিগ্ধাদি, ছোট্ট শৌনককে নিয়ে গভীর রাতে বাড়িতে এসে হাজির। শুনলাম, স্বামীর সংসার ছেড়ে চলে এসেছে , কোনোদিন আর যাবে না। আরো কয়েকদিন পরে , স্নিগ্ধাদি, নিজের নতুন বাড়ি কিনলো , আমাকে নিয়ে এলো সাথে। কাকু কাকীমার কাছে এখন অন্য আরেকটা ছেলে থাকে কাজ কর্মের জন্য।

 

বাইরের ঘরে বসে এইসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ ফোনটা বেজে ওঠে , দেখলাম ,মায়াঙ্ক করছে। লাফিয়ে উঠলো বুকের ভেতরটা আনন্দে। এই ছেলেটার সাথে কথা বলতে ভালোই লাগে, তবে ভয় হয়। যখন জানতে পারবে আমার অতীত ?

 

ফোনটা ধরলাম , ওদিক থেকে মায়াঙ্কের গলা ভেসে এলো, "সুপর্ণা ? "

চুপ করে আমি ফোনটা কানে লাগিয়ে তাকিয়ে থাকলাম সামনের দিকে। বলে দেবো মায়াঙ্ককে সবকিছু ? ওকে যে আমার ভালো লাগতে শুরু করেছে। আগে, অন্য কারোর জন্য এইরকম ভালোলাগা, তৈরী হয়নি কখনো। মনে হচ্ছে , এই তো, এই সেই ছেলে, সেই পুরুষ যার জন্য আমি অপেক্ষা করে আছি - ছিলাম - থাকবো। কিন্তু কি হবে যখন ও জানবে আমার অতীত ? কি হবে যখন ও জানবে ওর সুপর্ণা আসলে, আসলে একজন রান্ডি - বেশ্যা ? সমাজ যাদের ছিঁড়ে খুঁড়ে খায়, শেষ করে, প্রতিদিন - প্রতিনিয়ত ; কিন্তু প্রকাশ্যে তাদের কথা ভাবতেও ভয় পায় ? মায়াঙ্ক কি আমাকে মেনে নেবে আমার সত্যিটা জানার পরে ? ও কি আমাকে করবে নিজের ?

 

মনের গভীরে, আমার হৃদয়-নিজে থেকেই যেন দুভাগে ভাগ হয়ে গেছে। একটা অংশ চেঁচিয়ে বলছে - না, না সুপর্ণা , তোর সব ভাবনা আসলে মিথ্যে। মায়াঙ্ক খুব ভালো ছেলে, ও ঠিক তোকে কাছে টেনে নেবে, ভালোবাসবে। আর একটা অংশ অন্য টুকরোটার দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে হাসছে , চেঁচিয়ে বলছে - ওরে বোকা, তোর মাথায় আজকেও কি কোনো কিছু ঢুকছে না ? যখন সত্যিটা জানতে পারবে মায়াঙ্ক, ও তোকে তখন ছুঁড়ে ফেলে দেবে জীবন থেকে। ও কেন মেনে নেবে তোকে ? ওর দিদি আছে, মা আছে , আর তার থেকেও বড়ো কথা - সমাজ আছে। ও পারবে না বেরোতে , তোকে খালি হাত নিয়েই ফিরে আসতে হবে।

 

চোখের কোণ থেকে বেরিয়ে আসা নোনা জলটা মুছে নিয়ে মনস্থির করে নেয় সুপর্ণা। কন্ঠস্বর দৃঢ় করে বলে ,"মায়াঙ্ক, কাল দুপুরে আমার সাথে দেখা করতে পারবে ? এই আমার ফ্ল্যাটে ? মানে আমি যেখানে থাকি ? তোমার সাথে খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা আছে। "

 

উত্তেজনার আভাস ফুটে ওঠে মায়াঙ্কের গলায় , "তোমার বাড়িতে ? মানে তুমি যেখানে থাকো ? তোমার দিদির কাছে ? " একটু থেমে আবার জিজ্ঞেস করে মায়াঙ্ক, "কিন্তু তোমার দিদি ? আর দিদির ছেলে ? "

 

"আরে না না ! কাল তো রবিবার। কাল দিদি , ছেলেকে নিয়ে বেরোয় ঘুরতে। ওরা সারাদিন একসাথে থাকে, ঘুরে বেড়ায় , সিনেমা দেখে। পরশুতো আবার সোনুর জন্মদিন, কাল দিদি ওর জন্য নতুন জামাকাপড় কিনবে, গিফ্ট নেবে। ওদের ফিরে আসতে সময় লাগবে। আর তাছাড়া দিদি থাকলেও বা কি ? তুমি তো আমার বন্ধু, তাই না ? আর আমার বন্ধু আমার সাথে দেখা করতে এলে তো কোনো সমস্যাই নেই। "

 

"শুধু , বন্ধু ? আমি বুঝি তার থেকে বেশি কিছু হতে পারিনি ! সুপর্ণা ? " জিজ্ঞেস করে মায়াঙ্ক।

 

একটু ভেবে উত্তর দেয় সুপর্ণা , "সেটা, আসলে কাল বোঝা যাবে মায়াঙ্ক। তাই তো বলছি, কাল এসো , এই আড়াইটে নাগাদ। আমি তোমাকে ঠিকানা বলে দিচ্ছি , লিখে নাও ! "

 


++++++++++


 

লোকটি বেরিয়ে আসছে ভেতরের ঘরের বাথরুম থেকে। শব্দ পেয়ে তাড়াতাড়ি মেহেক ফিরে আসতে যায় , আর তখনই ঘটে যায় অঘটন। তাড়াহুড়োতে হাত লেগে পড়ে যায় ফ্রেমটা টাইলসের মেঝেতে , সশব্দে ভেঙে পড়ে, গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যায় ফ্রেমের সামনে থাকা কাঁচ। কাঁচের ভেঙে পড়ার আওয়াজে হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠে লোকটি। জোরে চেঁচিয়ে ওঠে - ভয় পেয়ে, আতঙ্কে। মেঝেতে দু কানের ওপরে হাত দিয়ে চেপে বসে পড়ে উবু হয়ে। বেশ কিছুক্ষণ পরে মেঝেতে বসে বসেই সরে যায় দেওয়ালের দিকে , থরথর করে কাঁপতে থাকে কোনো অজানা এক কারণে। তাড়াতাড়ি মেহেক ছুটে যায় লোকটির কাছে। ওকে ধরে জিজ্ঞেস করে, "কি হয়েছে আপনার ? এরকম করছেন কেন ? "

 

লোকটি হাঁটুর মধ্যে গুঁজে থাকা মুখটা কোনোরকমে বের করে বাইরের ঘরে টেবিলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে ,"কিসের আওয়াজ হলো ? কি ভাঙলো ? কি ? কি ভাঙলো ? "

 

মেহেক লোকটির দু কাঁধে হাত দিয়ে উঠিয়ে আনে ওকে কোনোরকমে , সাহায্য করে ওকে সামনের দিকে নিয়ে গিয়ে সোফার ওপরে বসতে। ধীরে ধীরে বলে ওঠে,"সরি। আসলে আমার হাত লেগে, ওই টেবিলের ওপরের ফ্রেমটা মেঝেতে পড়ে.....আপনি চিন্তা করবেন না। আমি সব পরিষ্কার করে দিচ্ছি। আপনি একটু পা তুলে বসুন দেখি। "

 

দরজার কোণে রাখা ঝাড়ু নিয়ে এসে ভেঙে যাওয়া কাঁচের টুকরো গুলো পরিষ্কার করতে করতে শুনতে পেলো মেহেক , লোকটি নিজের মনে বলে যাচ্ছে - যা ভেঙে যায়, সেটা আর জোড়া লাগে না। জোর করে জোড়া লাগলেও, ভাঙার দাগ থেকেই যায় ! রেখা - আঁচড়, অপমানের - কষ্টের..... লোকটির অসংলগ্ন কথা শুনেও না শোনার ভান করে মেঝে পরিষ্কার করে এসে বসে ওর সামনে মেহেক। লোকটির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে , "আপনি, আপনি ভয় পেয়েছেন কেন ? কিছুই তো হয় নি। আমি সব পরিষ্কার করে দিয়েছি , দেখুন ! এতো বড়ো হয়েও আপনি সামান্য কাঁচের ভেঙে যাওয়ার শব্দে এতো ভয় পেয়ে গেলেন ? "

 

"সামান্য ? সামান্য নয় মেহেক। সামান্য নয় ! তিন তিনটে বছর হয়ে গেছে, আজ ও সেই রাত আমাকে রাতে ঘুমোতে দেয় না ! সেই অভিশপ্ত রাত, সেই ভেঙে যাওয়া ফুলদানী, টেবিলের ওপরে থাকা কাঁচের গ্লাসের ভেঙে যাওয়ার শব্দ - সবকিছু শেষ হয়ে যাওয়ার রেশ, আজ ও আমার কানে বাজে। আমি ভয় পাই এই শব্দে , মনে হয় আরো কত সম্পর্ক, আরো কত প্রেম - ভালোবাসা এইসময়ে এইভাবেই ভেঙে যাচ্ছে ! আর তার জন্য আমিই দায়ী। আমি ভয় পাই মেহেক ! "

 

মেহেক কিছু না বুঝতে পেরে চুপ করে তাকিয়ে থাকে লোকটির দিকে। লোকটি একটু পরে একটা জলের বোতল টেনে নিয়ে ঢকঢক করে জল খেয়ে নিজেকে স্থির করে মেহেকের দিকে তাকায় ভালো করে। পকেটে হাত দিয়ে বের করে আনে অনেকগুলি টাকা। "কথা মতো এর মধ্যে পুরো তিরিশ হাজার আছে। " মেহেকের দিকে বাড়িয়ে দেয় টাকার বান্ডিলটা।

 

মেহেকের মনে পড়ে যায় , ও আসলে লোকটির কেউ নয় ! সময়ের বিনিময়ে টাকা দিয়ে কেনা কিছু সুন্দর সুখী মুহূর্ত মাত্র ! লোকটা আসলে ওর আরো অনেক ক্লায়েন্টের মতোই একজন ক্লায়েন্ট। হাত বাড়িয়ে টাকা নিয়ে উঠে আসে মেহেক। হ্যান্ডব্যাগ আর পার্স তুলতে গিয়ে হাতের ঘড়ির দিকে চোখ যায় ওর। মাত্র দেড় ঘন্টাই হয়েছে। কনট্র্যাক্ট অনুযায়ী, আরো দেড় ঘন্টা ওর সময়। ইচ্ছে করলে টাকা নিয়ে বেরিয়ে যেতেই পারে মেহেক। কিন্তু লোকটিকে এই অবস্থায়, একা ছেড়ে যেতে মন ও চাইছে না। বারবার নিজের মনকে বোঝাতে থাকে মেহেক , কে এই লোকটা? কি এর পরিচয় ? কেন আমাকে এভাবে টানছে ওর দিকে ? কেন এক প্রবল অক্ষমতায় নিজেকে শাস্তি দিচ্ছে লোকটি ? আরো একটু সময় তো কাটানোই যায় ওর সাথে। নাই বা করলো কিছু, শুধু চুপ করে বসে ওর কথাও তো শোনা যায় ! মেহেক টাকাটা পার্সে রেখে লোকটির একদম পাশে এসে বসে। ধীরে ধীরে কোনো কিছু না বলে, ভেবে, চিন্তা করে লোকটির বাঁ হাত নিয়ে নেয় নিজের হাতের মধ্যে। কেঁদে ওঠে লোকটি। মনে হয় অনেকদিন এইভাবে কেউ ওর পাশে এসে বসেনি, মমতার সাথে জড়িয়ে ধরেনি ওর হাত। লোকটির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে মেহেক , "আপনার সাথে আমার আরো দেড় ঘন্টা থাকার কথা ! আমি পুরো সময় শেষ না হলে তো যাবো না। আচ্ছা একটা কথা বলুন, আপনি কি কিছু খেয়েছেন ? আমার কিন্তু খুব খিদে পাচ্ছে। "

 

ফ্যালফ্যাল করে লোকটি তাকিয়ে ওঠে মেহেকের দিকে। "খাওয়া ? মানে , খেয়েছিলাম ! সেই সকালে। তারপরে আর...."

 

ভীষণভাবে অবাক হয়ে উঠে দাঁড়ায় মেহেক। রান্নাঘরের দিকে পা বাড়িয়ে আদেশের সুরে বলে ওঠে ,"আমি দেখছি কি করা যায় ! আপনি চুপ করে বসে থাকুন, যেখানে বসে আছেন। "

 

একটু পরে খিচুড়ি বানিয়ে আনে মেহেক। এসে লোকটির সামনে প্লেট এগিয়ে দিয়ে বলে ওঠে, "দেখুন, কিচেনে তো কিছু ছিল না। আমি একটু চাল আর ডাল দেখতে পেয়ে তাড়াতাড়ি করে বানিয়ে ফেললাম। আগে একটু খেয়ে নিন তো দেখি। খেয়ে দেখুন তো কেমন লাগছে ? অনেকদিন হলো আমি নিজের হাতে কিছু রান্না করি নি। "

 

চুপ করে প্লেটটা নিজের দিকে টেনে নিয়ে খেতে খেতে জিজ্ঞেস করে লোকটি ,"কেন ? নিজে রান্না করেন না কেন আপনি ? বেশ ভালোই তো...." চুপ করে যায় লোকটি নিজের থেকে , উত্তর খুঁজে পেয়ে ! হেসে ওঠে মেহেক, "ঠিকই ধরেছেন। আমি কবে কোথায়, কার সাথে থাকি , কোনো ঠিক নেই। আর রান্না। যাই হোক। আমার তো খাওয়া শেষ, আপনার ও তো শেষের দিকে। দেখে তো মনে হচ্ছে অনেকদিন কিছু খান নি ভালো করে। কেন বাইরে থেকে অর্ডার করে খাওয়ার নিয়ে আসেন রোজ ? ওগুলো খাওয়া কি ভালো ? নিজে কি কোনোদিন রান্না করেন নি ? শিখে নিন একটু ইউ টিউব দেখে। দেখবেন, ভালো লাগছে। "

 

লোকটি জিজ্ঞেস করে ,"আপনি, আপনি কি করে জানলেন ? " চুপ করে মেহেকের দিকে তাকিয়ে আবার হেসে ওঠে লোকটি ,"ওহ, কিচেনে সব প্যাকেট ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। তাই না ? "

 

লোকটির খালি প্লেট টেনে নিয়ে মেহেক আদেশ করে লোকটিকে ,"যান দেখি , হাত মুখ ভালো করে ধুয়ে আসুন। আমি সব ধুয়ে মুছে..." লোকটি মেহেককে কথা শেষ করতে না দিয়ে বলে ওঠে, "আপনি কেন ? সকালে আমার কাজের লোক আসবে , সেই করে দেবে। "

 

কিচেনের দিকে যেতে যেতে মেহেক বলে ওঠে ,"আমার এরকম ভাবে এঁঠো বাসন ফেলে রাখতে ভালো লাগে না। যেটা যখনকার, তখনই সাফ করে, ধুয়ে মুছে রাখতে ভালো লাগে। " কিচেনে ঢুকতে ঢুকতে মেহেক শুনতে পেলো লোকটি বলছে ," সেও এরকম ভাবে কথা বলতো। কেন চলে গেলে স্নিগ্ধা ? কেন ?

 

মিনিট দশেক পরে মেহেক কিচেন থেকে বেরিয়ে আসে বাইরে। এতক্ষণ বাসনপত্র ধুতে ধুতে বারবার ভাবছিলো, কেন করছি আমি এইসব ? কে এই লোকটি ? ওর জন্য কেন হঠাৎ একটা টান অনুভব করছি আমি ভেতরে ভেতরে ? কেন মনে হচ্ছে এই লোকটিকে সবরকম বিপদ থেকে রক্ষা করে , বুকে টেনে নিয়ে জড়িয়ে বসে থাকি সারারাত ? কেন বারবার ওই অসহায়, ভেঙে পড়া, জীবনের কাছে হেরে যাওয়া, বেঁচে থেকেও নিজেকে মেরে ফেলা মানুষটাকে আবার ফিরিয়ে আনতে ইচ্ছে করছে আমার ? আমি কি প্রেমে পড়ে গেলাম হঠাৎ করে ? এরকম তো হওয়ার কথা ছিল না , আমাকে তো কোনো ক্লায়েন্টের সাথে মন দেওয়া নেওয়া করতে নেই ! শরীর দিয়ে দাও, সব নির্যাস - রূপ - রস - গন্ধ উজাড় করে দাও ; কিন্তু নিজের আত্মা যেন অন্য কারোর কাছে বাধা না পড়ে ! এটাই তো আমাদের মূলমন্ত্র। আজ কি হচ্ছে আমার ? কেন মনে হচ্ছে সারাজীবন এই মানুষটার কাছে থেকে যেতে ?

 

নিজেই নিজেকে শাসন করে মেহেক। অনেক বুঝিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। এবার আর না , বেরোতেই হবে এই আমাকে এই অক্ষম ভালোবাসার কাছ থেকে , এই লোকটার থেকে সরে যেতে হবে অনেক দূরে।

 

কোনোদিকে না তাকিয়ে সোফায় রাখা হ্যান্ডব্যাগ আর পার্স তুলে নেয় মেহেক। হঠাৎ লোকটি জিজ্ঞেস করে ওঠে , "আপনার শরীরের ওপর দিয়ে যদি একটা বুলডোজার চলে যায়, কি হবে আপনার ? "

 

লোকটির গলার স্বরে কিছু একটা ছিল, দুর্বল হয়ে পড়ে মেহেক আবার। একটু পরে লোকটির সামনে বসে মেহেক বলে ওঠে ," শুনুন, আপনি আমাকে বলতে পারেন আপনার কথা। আমি সব শুনবো, আপনার যত সময়ই লাগুক না কেন ! আমাকে, আপনি অন্য কিছু না ভেবে - আপনার খুব ভালো বন্ধু ভাবতে পারেন। " 

 

'বন্ধু' কথাটা শুনে জ্বলজ্বল করে ওঠে লোকটার চোখদুটো। "বন্ধু ? বন্ধু ? জানেন আমি ভুলেই গেছি এইরকম একটা শব্দ আছে জীবনে। আপনি, আপনি সত্যি শুনবেন আমার কথা ? " একটা আকুতি ঝরে পড়ে লোকটির গলার স্বরে।

 

"মেহেক, আপনাকে মনে হয় আমার নাম বলিনি আমি, তাই না ? আমার নাম হলো বিতান। “

  


++++++++++ 



অনেক অনেক দিন আগে, যখন টাকা পয়সা রোজগারের কোনো চিন্তা ছিল না আমার, যখন আমি কলেজে পড়তাম, যখন দিনগুলো ছিল উজ্জ্বল, রাতগুলো ছিল আড্ডামুখর, ক্লাসগুলো ছিল মজা করার জায়গা আর ক্যান্টিনটা ছিল গানবাজনার মঞ্চ , সেই তখনকার কথা বলছি আমি। বাবা একটা ভালো চাকরি করতো , বেশ উঁচু পোস্টে ছিলো, কাজের জন্য মাঝে মাঝেই দেশের বাইরে কাটাতে হতো বাবাকে। মা ও একটা স্কুলে পড়াতো। তা বলে এটা ভাববেন না কিন্তু মেহেক, যে আমি একদম বখে যাওয়া ছেলে ছিলাম একটা। না ! না ! বাবা মা কে ভীষণ ভালোবাসতাম আমি, ওরাও আমাকে। যখনই আমরা সবাই একসাথে থাকতাম, তখন একসাথে রাতে খাওয়ার টেবিলে আড্ডা, একসাথে বসে টিভিতে সিনেমা দেখা, মাঝে মাঝে আবার তিনজনেই একসাথে বসে, হাতে ওয়াইন এর গ্লাস নিয়ে রাতের আকাশে তারা গুণে সময় কাটাতাম। আমি আমার লেখা কবিতা পড়ে শোনাতাম ওদের কে।

 

হ্যাঁ, তখন আমি কবিতা লিখতাম। জানি না কেমন লিখতাম, তবে কিছু কিছু লিটিল ম্যাগাজিনে বেরোতো সেই কবিতাগুলো। এক দু বার, রাজ্যের সবথেকে ভালো ম্যাগাজিনেও বেরিয়েছিল। এইভাবেই দিনগুলো বেশ কেটে যাচ্ছিলো আমার। কলেজ শেষে , একটা চাকরিও জোগাড় করে ফেলেছিলাম। মিথ্যে বলবো না আপনাকে, চাকরি পাওয়ার পেছনে, বাবার লম্বা হাত একটু কাজ করেছিলো। আমাকেও কাজের সূত্রে মাঝে মাঝে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতে হতো। আবার এইরকম কাজে, আমার পাহাড়ের টিমের সাথে দেখা করতে যেতে হয়েছিলো আমায়। ওখানে কাজ ছিলো দুদিনের। আমার প্রথমদিনেই কাজ শেষ হয়ে গিয়েছিলো। তখন পরের দিন ভাবলাম আরো একটু ওপর থেকে ঘুরে আসি, দেখে আসি পাহাড়ে বরফ দেখতে পাই কিনা। সেই তরুণ বয়সের শখ আর এডভেঞ্চার আর কি। আর সেখানেই, সেখানেই আমি প্রথম দেখলাম সেই মেয়েটিকে , স্নিগ্ধাকে।

 

স্নিগ্ধা তখন ওখানে একটা ক্যাফেতে গিটার নিয়ে গান করতো - খালি গলায়, মাথার ওপরে থাকা ঘন-সোজা-লম্বা একটু লাল আর নীলের ছোঁয়ায় রাঙানো চুলগুলো এসে পড়তো কপালের সামনে থেকে মুখের একদিকে , আরেকদিকে দেখা যেত ওর কোমল মুখ, তার ওপরে ভীষণ ভাবে জেগে থাকা সমুদ্রের ঘন নীলের মতো চোখটা। কত যে কথা বলতে চাইতো সেই চোখদুটো। আমার সাথে অফিসের যে দুজন ছিলো , আমাকে বলেছিলো , সারপ্রাইজ দেবে, শোনাবে লাইভ মিউজিক ! আর আমি তো প্রথম দর্শনেই ক্লিন বোল্ড হয়ে গিয়েছিলাম। আরো আশ্চর্যের ব্যাপার কি জানেন মেহেক, ও আমার লেখা কবিতা, নিজের মতো করে সুর দিয়ে গাইছিলো সেদিন। আমার লেখা কবিতা, আমার সৃষ্টি, সেটা অন্য একজনের মুখে ,এই সুদূর পাহাড়ে , আবার গানের আকারে শুনে কি ভালোই যে লাগছিলো সেদিন আমি আপনাকে বলে বোঝাতে পারবো না। তখন ও ওর নাম জানতাম না আমি। আমার সাথে বাকি যে দুজন ছিলো, আমি ওদেরকে বলি, আমি নিজে একটু একা একা ঘুরতে চাই। ওরা আমাকে ছেড়ে চলে গেলো, আমি ওই ক্যাফেতেই সন্ধেটা কাটিয়ে দিলাম, শুনছিলাম ওর গানগুলো। সব কটা গান শেষ হয়ে গেলে, যখন ও গিটার গুছিয়ে ব্যাগে রেখে বেরোতে যাবে , আমি ওর কাছে গিয়ে বললাম ,"হাই ! আমার নাম বিতান। "

 

আমার দিকে না তাকিয়ে কোনো কথা না বলে ক্যাফের দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো। বেশ কয়েক সেকেন্ড আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে, তারপরে আবার দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম, ওর পাশে দৌড়ে এসে দাঁড়িয়ে , আবার বললাম ,"আমি বিতান। "

 

আমার চোখে চোখ রেখে রাগের স্বরে বলে ওঠে ও ,"আর আমি এবার পুলিশ ডাকবো। রাস্তা ছাড়ুন। " আমি তখন কি বলবো বুঝতে না পেরে, হাঁ করে তাকিয়ে ছিলাম ওর দিকে। সন্ধের ঠান্ডা থেকে বাঁচতে, মাথায় একটা উলের টুপি পরেছিলো সেদিন ও, গায়ে গলা পর্যন্ত ঢাকা পুলওভার আর নিচে কালো রঙের জিন্স। ঠোঁটে টকটকে লাল লিপস্টিক, গালে কোনো কোল্ড ক্রিম ছিলো লাগানো, কিন্তু ঠান্ডায় সেটাও লাল হয়ে উঠেছে। কানে ছোট্ট দুটো ঝোলা দুল , গলায় বিভিন্ন রঙের পাথরের একটা মালা , পিঠে গিটারের ব্যাগ। দেখতে যে ভীষণ আহামরি সেরকম কিছুই নয় , উল্টে সাধারণ মেয়েদের থেকে একটু বেশি লম্বা ছিলো ও। কিন্তু ওর কথার মধ্যে যে কনফিডেন্স , কথা বলার স্টাইল আর তার ওপরে নিজে সুর করা , আমার কবিতাকে প্রাণ দেওয়া - সব নিয়ে আমি ভীষণ ভীষণ রকম উত্তেজনা অনুভব করছিলাম সেদিন। চেঁচিয়ে ওর হাত ধরে বলতে ইচ্ছে হচ্ছিলো, আমাকে আপনি নতুন জীবন দিয়েছেন।

 

কিন্তু আমি কিছু না বলে , হাঁ করে দাঁড়িয়ে ছিলাম সেদিন রাস্তার মাঝে।

 

পরের দিন ফিরে আসার কথা , কিন্তু আমার বারবার মনে হচ্ছিলো ওর সাথে দেখা করতেই হবে , আর একবার। না হলে কিছু যেন একটা অসম্পূর্ন থেকে যাবে, হয়তো কোনো গল্প শুরু হওয়ার আগেই শেষ হয়ে যাবে। আমি সেদিন ও - থেকে গেলাম ওই ছোট্ট ওই পাহাড়ী শহরে। ঠিক যখন বিকেল চারটে, আমি চলে আসি ক্যাফেতে। বসে যাই একটা জায়গায়। ক্যাফের ম্যানেজার কে ডেকে জিজ্ঞেস করি ,"গতকাল যে মেয়েটা গান করছিলো, ও আজ ও আসবে তো ? "

 

টেবিলের ওপরে রেজিস্টারে কিছু একটা করতে করতেই বলে ওঠে সেই ম্যানেজার ,"দেখুন, আমার এখানে আজেবাজে ঝামেলা চাই না। আপনি গতকাল রাতেও অনেকক্ষন বসেছিলেন, স্নিগ্ধার গান শুনছিলেন। কিছু কাজ থাকলে , ওর ডিউটি শেষ হয়ে গেলে ওর সাথে বাইরে কথা বলে নেবেন। "

 

"ঝামেলা ? কিসের ঝামেলা ? " একটু রেগেই বলে উঠলাম আমি।

 

"আপনারা এই সমতলের লোকজন ভাবেন এখানে পাহাড়ে এসে, আমাদের পাহাড়ী মেয়েদের সাথে যা খুশি করবেন ! তাই না ? একটু সাবধানে থাকবেন কিন্তু। আপনি যতই হোক , বাইরের লোক। আর বেশি কিছু করলে....." টেবিলের নিচ থেকে একটা কুকরি বের করে টেবিলের ওপরে রাখে ম্যানেজার। আড়চোখে দেখতে থাকে আমাকে।

 

আমিও কিছু একটা বলতে যাই, হঠাৎ পেছন থেকে শুনতে পাই ওর গলা , স্নিগ্ধার গলা। "চলে এসেছি আমি। একটু কফি খাওয়াবে ? বাইরে কি ঠান......" আমার দিকে তাকিয়ে শেষ করে বাকিটা , "ডা " !

 

সেদিন ও অনেক জনপ্রিয় কবিতা , ও নিজের মতো করে সুর বসিয়ে গেয়ে যায় পরপর। আমার আরো তিনটে কবিতা ছিলো ওর মধ্যে। সেদিন ওর প্রোগ্রাম শেষ হলে, বাইরে না বেরিয়ে আমার সামনে এসে বসে স্নিগ্ধা। সরাসরি আমাকে জিজ্ঞেস করে ওঠে ,"কি ব্যাপার বলুনতো ? আপনি কি চান ? "

 

"আমার নাম....বিতান। "

 

"হ্যাঁ, জানি তো। আপনি গতকাল ও বলে....." হঠাৎ চোখ ছোট হয়ে আসে স্নিগ্ধার, আর একটু আমার দিকে ঝুঁকে আসে ও। ভালো করে দেখতে থাকে আমাকে। বিস্ময়ের সাথে একটু পেছনে সরে গিয়ে বলে , "না না ! আমি যেটা ভাবছি....মানে, আমি, আমি আপনার কবিতা গুলোই....! আপনি, আপনি সত্যি , সেই বিতান ? মানে যে কবিতা লেখে ? বিভিন্ন ম্যাগাজিনে বেরোয় ? আমি জাস্ট বিলিভ করতে পারছি না। আমি তো , আমি তো ভেবেছিলাম কবিতাগুলো কোনো এমন মানুষের লেখা যার অনেক বয়স হয়ে গেছে , সাদা চুল মাথায়, খদ্দেরের পাঞ্জাবী পরে , কাঁধে শান্তিনিকেতনী ঝোলা ! "

 

আমি হাসতে হাসতে বললাম, "কেন ? কবি মানেই কি এরকম হতে হবে ? "

 

ধীরে ধীরে আমাদের মধ্যে কথা শুরু হলো, কোথাও যেন একটা প্রেমের অংকুর ও ধীরে ধীরে বড়ো হতে শুরু করে সেইসময় থেকে। ক্যাফে বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরেও, আমি আর স্নিগ্ধা অনেকক্ষণ রাস্তায় হেঁটেছিলাম সেই রাতে , পাশাপাশি - সামনে পেছনে - ভিড়ের মধ্যে - ফাঁকা - স্তব্ধ গলিতে - কথা বলতে বলতে - নিশ্চুপ ভাবে - হোঁচট খেতে খেতে - বুকের বাড়তে থাকা ধুকপুক শব্দকে চাপা দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টায় আড়চোখে তাকিয়ে দেখতে দেখতে। আমি আমার আরো কিছু কবিতা আবৃত্তি করেছিলাম ওর সামনে সেদিন। জেনেছিলাম, ওর বাবা কলকাতায় একজন মিউজিক ডিরেক্টরের সাথে কাজ করে , মাঝে মাঝেই যাওয়া আসার মধ্যে থাকে। আর বাবার উৎসাহেই, বাংলা সাহিত্য, কবিতা এসব পড়ে ও, আর সেখান থেকেই আমার কবিতার সাথে ওর পরিচয়।

 

প্রায় এগারোটা পর্যন্ত ঘোরাঘুরি করে ওকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আমি ফিরে আসি আমার হোটেলে। পরের দিন সকালে বেরিয়ে যেতে হবে , ফিরে যেতে হবে আমার কর্মক্ষেত্রে। মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিলো, বারবার মনে হচ্ছিলো, কেন সময়টা শেষ হয়ে গেলো এতো তাড়াতাড়ি ?

 

পরের দিন সকালে উঠে আমরা দশটার সময়ে শুরু করলাম আমাদের যাত্রা, পাহাড় থেকে সমতলে - নিচের দিকে নামার জন্য জীপে উঠলাম আমরা। পাহাড়ের আঁকা বাঁকা সরু পথ ধরে, সবুজ রডোডেনড্রন এর সাথে কথা বলতে বলতে বেশ কিছুটা আসার পরে হঠাৎ দেখি রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছে একটি অবয়ব, হুড দিয়ে মাথা ঢাকা, পিঠে ঝোলানো একটা গিটার। দূর থেকে দেখে মনে হলো , এটা কি স্নিগ্ধা ? এতোটাও ভালো কি আমার ভাগ্য ?

 

ওর পাশে যখন আমরা এলাম, আমাদের গাড়ি হাতের ইশারায় থামাতে বললো সেই অবয়ব। হুড খুলে সামনে এলো , দেখলাম , সামনে দাঁড়িয়ে স্নিগ্ধা ! মনটা যেন নেচে উঠলো এক অসম্ভব আনন্দে। অন্যদের বুঝতে না দিয়ে , আমি জীপটা দাঁড় করিয়ে নেমে এলাম। স্নিগ্ধা আমাদের দেখে খুব অবাক হলো ! ও জানালো, ওর গিটার এর কয়েকটা স্ট্রিং ছিঁড়ে গেছে , সেটা ঠিক করতে ওকে যেতে হবে নিচের শহরে। কিন্তু ও যে বাসে আসছিলো, সেটা খারাপ হয়ে পেছনে পড়ে আছে। ও হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে এসেছে রাস্তা ধরে, যদি কোনো হেল্প পাওয়া যায়।

 

আমি হেসে ওকে উঠে আসতে বললাম পেছনে। আমিও পেছনে গিয়ে ওর পাশে বসলাম। আবার জীপ চলতে শুরু করে।

 

একটু পরে আমরা একটা বাঁকে এসে হাজির হই , এই রাস্তার সবথেকে ভয়ঙ্কর জায়গা এটা ! তার ওপরে হঠাৎ করে কুয়াশায় ঢেকে গেছে রাস্তাটা। সামনে থেকে কি আসছে, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। আমাদের ড্রাইভার খুব সাবধানে গাড়িটা ঘোরাতে শুরু করে বাঁ দিকে, ডান দিকে নিচে গভীর খাদ ! ভয়ে তাকাতে পারছি না ওই খাদের দিকে। হঠাৎ কুয়াশা ভেদ করে একটা জোরালো আলো এগিয়ে আসে আমাদের জীপের দিকে, সাথে প্রচন্ড জোরে বাজতে থাকা হর্ন। 

 

আমাদের গাড়ির ড্রাইভার কোনোরকমে জীপটাকে একটা সাইডে নিয়ে আসে তাড়াতাড়ি। গাড়ি থামায় , কিন্তু গাড়িটা পেছনে গড়াতে থাকে, খাদের দিকে। ভয়ে কেঁপে উঠি আমরা সবাই। ড্রাইভার প্রাণপনে চেষ্টা করছে গাড়িটা দাঁড় করাতে , সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে, কিন্তু কোনো এক অমোঘ শক্তি যেন সবাইকে পেছনে টেনে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আমরা সবাই ঠান্ডার মধ্যেই ভয়ে ঘামতে শুরু করি, হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে। মৃত্যুকে একদম সামনে থেকে দেখছি আমরা, অথচ কিছুই করতে পারছি না। এর মধ্যেই হঠাৎ আমি আমার হাতের ভেতরে পেলাম আর একটা নরম হাতের ছোঁয়া ! পাশে তাকিয়ে দেখলাম স্নিগ্ধার ফ্যাকাসে সাদা হয়ে যাওয়া মুখ। ঠিক সেই মুহূর্তে আমার মনে হলো, এই মেয়েটার সাথে আমি কি আর একটু সময় থাকতে পারবো না ? কাটাতে পারবো না আমার সারাটা জীবন ওর সাথে? হে পরমেশ্বর, আমার - আমাদের যাত্রা কি তাহলে এইটুকুই ছিলো ? কেন তাহলে এই সুন্দর মুহূর্ত নিয়ে এলে আমাদের মাঝে ? " আমি চেপে ধরি ওর হাতটা আমার হাতের মধ্যে , চোখের ইশারায় আশ্বাস দিই স্নিগ্ধাকে !

 

হঠাৎ আমাদের জীপটা থেমে গেলো। ড্রাইভার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলে ওঠে, "যাক ! এ যাত্রা আমরা বেঁচে গেলাম। রাস্তার একদম ধারের একটা মাইলস্টোনে লেগে আটকে গেছে আমাদের গাড়িটা। কিছুক্ষণ পরে , আমরা ধীরে ধীরে নেমে এলাম, ড্রাইভার ধীরে ধীরে জীপটা সামনে নিয়ে এগোনোর পরে, আবার আমরা উঠলাম জীপে।

 

বাকি মিনিট পনেরো ছিলো আমার কাছে স্বর্গের মতো। ওই টুকু রাস্তা স্নিগ্ধা আমার পাশে বসেছিলো চুপ করে , ওর হাত ছিলো আমার হাতের মুঠোর মধ্যে।



++++++++++ 



কলকাতায় ফিরে আসার পরে, কি যেন একটা হয়ে গেলো আমার মধ্যে। আমি জানি না , আসলে কলেজ লাইফে কখনও কারোর সাথে প্রেম করিনি তো, তাই হয়তো বুঝতে পারিনি সেই সময় আমার মনের অবস্থা। প্রথম প্রথম প্রেমে পড়লে , কি হয় মেহেক ? জানেন আপনি ? আমার মনে হয়, আপনি জানেন সেই অভিজ্ঞতার কথা। আপনি এই এসকর্ট হিসেবে কাজ করলেও, আমি বুঝতে পারছি আপনি এখনো কোথাও ভেতরে ভেতরে কারোর জন্য হয়তো অপেক্ষা করে আছেন। আমার সেই অবস্থা হয়েছিলো সেই সময়। অফিসে বসে কাজ করতে ইচ্ছে করতো না, সবসময় মনের গভীরে, চোখের সামনে ভেসে উঠতো সেই মুহূর্ত গুলো, সেই যখন স্নিগ্ধা জীপের মধ্যে আমার পাশে বসে, আমার হাতের মুঠোর মধ্যে ওর ঠান্ডা হাত ঢুকিয়ে পেতে চেয়েছিলো বেঁচে থাকার আশ্বাস - ভরসা ! আর ওর কথা ভাবলেই মনের ভেতরে একটা অদ্ভুত ভালোলাগা, একটা অন্যরকম পরশ, একঝাঁক খোলা মুক্ত হাওয়া চলে আসতো কোথাও থেকে। মনে হতো, কি হবে এইসব কাজ করে , ক্লায়েন্টের জন্য খেটে ? জীবনে যদি ভালোবাসাটাই না থাকে, কি হবে বেঁচে থেকে ?

 

তখন তো আর এখনকার মতো সবার হাতের মুঠোয় মোবাইল ছিলো না , তাই সপ্তাহান্তে কিছুক্ষণ বুথে গিয়ে ওর সাথে কথা বলার সময়ের জন্য অপেক্ষা করে থাকতাম বাকি ছয়দিন ধরে। চাতক পাখীর থেকেও বেশি তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠেছিলাম আমি। আবার সপ্তাহান্তে যখন ঘড়ির কাঁটা ধীরে ধীরে এগোতো বিকেল পাঁচটার দিকে, তখন হাত পা ঠান্ডা হয়ে যেত, পেটের মধ্যে একটা গুড়গুড় ভাব , বুকের মধ্যে দুরুদুরু , মাথা যেন ফাঁকা হয়ে যেত, মনে হতো চোখের সামনে আর কিছুই নেই, শুধু আমি আর আমার সামনে ফোনের বুথ। মাঝে মাঝে ভয় হতো, স্নিগ্ধা আসবে তো ? কথা বলবে তো আমার সাথে ? হঠাৎ যদি কোনো কারণে না আসে ? বা যদি কিছু হয়ে যায় ? কোনো অঘটন ? পরে বুঝেছি, যাকে আপনি সবথেকে বেশি ভালোবাসেন, তাকে নিয়ে চিন্তা সবথেকে বেশি হয়, আর চিন্তা হলেই প্রথমে দুর্ঘটনার কথা মাথায় চলে আসে।

 

আবার মাঝে মাঝে আরো একটা ভয় চেপে বসতো আমার মাথায় সেই সময়। আসলে আমি স্নিগ্ধার থেকে বয়সে একটু বড়োই ছিলাম, আট বছরের। মনে হতো, ওর যদি সমবয়সী কাউকে পছন্দ হয়ে যায় ? যদি ওর বাবা ওকে অন্য কোথাও বিয়ে দিয়ে দেয় ? এইসব হাজারো রকম চিন্তা ভাবনা নিয়ে এগিয়ে গিয়ে ফোনে ডায়াল করার পরে , যখন ওর গলার আওয়াজ শুনতে পেতাম, শুনতাম ওর হাসি, ওর হাজারো আবদার আর কিছু প্রেম ভালোবাসার কথা , মনটা ভালো হয়ে যেত। প্রতি রবিবারের মিনিট দশেকের কথা আমাকে পরের ছয়দিন বাঁচার প্রয়োজনীয় অক্সিজেন দিয়ে যেত।

 

এইভাবেই কেটে গেলো বেশ কিছু সপ্তাহ। আজকাল যেমন ইন্টারনেটে, ছেলে মেয়েরা ঝপাঝপ প্রেমে পড়ে , আমাদের সময়ে তার সুযোগ কম ছিল, তবে ফোনে ফোনেও প্রেম হতো আমাদের সময়ে। যদিও সেটা অনেক কস্টলি ছিলো। আপনি হয়তো জানেন না, সেই সময় এক মিনিট কথা বলার চার্জ ছিল, প্রায় সাড়ে তিনটাকা ! আপনার মনে আছে মেহেক ? স্নিগ্ধা সেই সময় একটা ক্যাফেতে গান করতো ! সেই ক্যাফেতেই ও ফোন রিসিভ করতো, আর আমি আমার বাড়ির কাছের একটা বুথ থেকে। যদিও তখন আমার তিরিশ বছর বয়স, তবুও বাবা মায়ের একটা ভয়-না আসলে ভয় নয় ; বলতে পারেন সংস্কার বা অন্য কিছু , সেটার জন্য বাড়ি থেকে ফোন না করে বাইরে থেকে করতাম। 

 

যাই হোক, অবশেষে একদিন অনেকটা সাহস বুকের মধ্যে এনে , স্নিগ্ধাকে আমি জিজ্ঞেস করেই ফেললাম ;"আমরা যে প্রতি সপ্তাহের শেষে এইভাবে কথা বলছি , কেন ? আমরা কি শুধুই বন্ধু, না কি আরো বেশি কিছু ? "

 

বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে যায় স্নিগ্ধা। সেই কয়েকটা মুহূর্ত যে কষ্টের, কি যন্ত্রণার ছিলো, বোঝাতে পারবো না আপনাকে। মনে হচ্ছিলো, কখন শেষ হবে এই স্তব্ধতা? এই মৌনতা ? প্রায় তিরিশ সেকেন্ড পরে আমাকে লাজুক স্বরে উত্তর দেয় , "জানি না ! যাও ! " ওইটুকু কথার মধ্যেই , সব পরিষ্কার হয়ে যায় আমার সামনে। আমি হেসে ফেলি। মজা করে বলি ,"সত্যিই তো ? তুমি সত্যিই জানো না ? তাহলে আর কি, ফোনটা রেখে দিই। "

 

আর্তনার করে চেঁচিয়ে ওঠে স্নিগ্ধা ,"ভালো হবে না বলছি, বিতান। তোমাকে সামনে পেলে না , সামনে পেলে..." কথা হারিয়ে ফেলে স্নিগ্ধা। আমি ফিসফিস করে বলে উঠি , "কি ? সামনে পেলে কি ? আমাকে জড়িয়ে ধরবে ? আমার ঠোঁটে মিশে যাবে তোমার নরম গোলাপী কাঁপতে থাকা ঠোঁট দুটো ? "

 

স্নিগ্ধা নিজেও হেসে ওঠে আমার উত্তরে। আবার কিছুক্ষণ চুপ করে , তারপর বলে ,"শোনো , কি হবে, বা কি হতে পারে এসব কল্পনা আর করতে হবে না। দশদিন পরে জানতে পারবে। বাবা পুরোপুরি কলকাতায় চলে আসছে ! আমাদের এখানকার বাড়ি বিক্রি করে দিচ্ছে। আসলে বাবার কাজে অসুবিধে হচ্ছে, এখন মাঝে মাঝে মুম্বাইতেও যেতে হচ্ছে। তাই ! বুঝলে কবি মশায় ? তাহলে ঠিক দশদিন পরে আমাদের দেখা হবে। কিন্তু কোথায় দেখা হবে ? আমি তো কলকতার সেরকম কিছু জানি না , চিনিও না। " আরো কিছু টুকরো টুকরো কথার মধ্যে কেটে গেলো বাকি সময়।

 

দিন দশেক পরে আমাদের দেখা হওয়ার কথা ছিল কলেজ স্ট্রিটে , কফি হাউসের সামনে। কিন্তু সেদিন আমি একা আসিনি। আমার সঙ্গে এসেছিলো আমার মা বাবা দুজনেই। দুজনেরই খুব পছন্দ হয়েছিলো স্নিগ্ধাকে। আসলে আমি আর পারছিলাম না একা একা এইভাবে থাকতে। যাকে ভালোবাসি, যে নিজেও আমার কাছে আসতে চাইছে , তখন আর দেরী করে কি হবে ? মা বাবা অনেকক্ষণ স্নিগ্ধার সাথে কথা বলে কফি হাউসের ওপরে বসে , আর আমাকে নিচে পাঠিয়ে দেয়। প্রায় আধঘন্টা পরে ওরা তিনজনেই নেমে আসে , আর আমাকে কেন কিছু না বলে, প্রায় বগলদাবা করে, একটা ট্যাক্সি ডেকে সবাই চলে আসি স্নিগ্ধাদের বাড়িতে। সেদিন স্নিগ্ধার বাবা , মা দুজনেই ছিলেন বাড়িতে।

 

হঠাৎ করে সব যেন স্বপ্নের মতো হয়ে গেলো। সেদিনই দুই বাড়ির প্রায় একরকমভাবে কথা পাকা হয়ে গেলো ! বাকি ছিলো শুধু পাঁজি দেখে দিনক্ষণ ঠিক করা।   

 

আগেই বলেছিলাম, স্নিগ্ধার বাবা মিউজিক ইন্ডাস্টির সাথে যুক্ত ছিলেন , আর স্নিগ্ধাও বেশ ভালোই গান করতো। সেই সময় হঠাৎ করেই ব্যান্ড কালচার ভীষণ পপুলার হয়ে ওঠে আমাদের দেশে। আর তখন ছিলো ইন্ডিপেন্ডেন্ট মিউজিক এর যুগ। ওদিকে হিন্দিতে আলিশা, লাকি আলি , সোনু নিগম; এদিকে বাংলায় চন্দ্রবিন্দু, শহর, ক্যাকটাস , লক্ষীছাড়া, ফসিলস , ভূমি আর আরো কতজন। এইরকম একটা ব্যান্ডের সাথে কাজ করছিলেন স্নিগ্ধার বাবা। ওই ব্যান্ডের একজন ফিমেল সিঙ্গার এর দরকার ছিলো, আর ওরা ও চাইছিলো একদম নতুন কোনো ভয়েস। তখন ওর বাবা স্নিগ্ধার কিছু গান ওদেরকে শোনায় , পরিচয় গোপন করেই। ওদের ভীষণ পছন্দ হয় স্নিগ্ধাকে। স্নিগ্ধা তখন ওদের হয়ে কাজ করে দুটি এলবামে। স্নিগ্ধার নিজেরও একটা পরিচিতি তৈরী হয়।


আমার খুব ভালো লাগতো যখন দেখতাম স্নিগ্ধা স্টেজে গান করছে, বা মিউজিক ওয়ার্ল্ডে এসে প্রোগ্রাম করছে, বা শুনতাম রেডিওতে এফ এম এ ওর গান হচ্ছে। ইচ্ছে হতো সবাইকে জোরে জোরে বলতে, এই দেখো, স্নিগ্ধা গান করছে , ওকে আমি ভালোবাসি, আর কয়েকদিন পরে আমাদের চার হাত এক হয়ে যাবে। ভীষণ গর্ববোধ হতো ওর জন্য।


ওদিকে বিয়ের ডেট ঠিক হয়ে গেছে আমাদের, আরো মাস চারেক পরে আমাদের বিয়ে। আমরা দুজনেই ভীষণ খুশি, এখন কোনো বাড়ি থেকেই কোনো বাধা নেই, আমরা নিজেরা স্বাধীন ভাবে, একসাথে ঘোরাঘুরি করি, হাতে হাত রেখে রাস্তা দিয়ে হাঁটি ! এইসময় একদিন আবার আমাকে অফিসের কাজে যেতে হয় গৌহাটিতে দিন দুইয়ের জন্য। পরে শনি আর রবিবার দুদিন ছুটি। আর সেই একইসময়ে স্নিগ্ধাকে ওর ব্যান্ডের সাথে একটি প্রোগ্রামে যেতে হয় গৌহাটিতে একটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের অ্যানুয়াল ফেস্টে, শুক্রবার রাতে।


আমরা ঠিক করি একসাথে আমরা ফিরে আসবো একসাথে রবিবার।


প্রোগ্রাম শেষ হয়ে গেলে, ওর ব্যান্ড মেম্বাররা শনিবার সকালেই ফিরে চলে যায় কলকাতায়। স্নিগ্ধা চলে আসে আমার হোটেলে। এই প্রথম, আমরা পুরোপুরি একা ! সামনাসামনি , আর কেউ কোথাও নেই। সারাদিন আমরা একসাথে ঘুরে বেড়িয়ে , কামাক্ষ্যা মন্দিরে গিয়ে আমাদের আগামী দিনগুলো যাতে ভীষণ ভালোভাবে কেটে যায় সেই প্রার্থনা করে , ফিরে আসি বিকেলে।  



++++++++++



এতটা বলার পরে থামলো লোকটি, মানে বিতান। সোফা থেকে উঠে, ফ্রিজ খুলে জলের বোতল বের করে টেবিলের ওপরে রাখা গ্লাসে জল ঢেলে মেহেকের দিকে বাড়িয়ে নিজে ঢকঢক করে জল ঢেলে নেয় গলায়। মেহেক চুপ করে হাত বাড়িয়ে গ্লাসটা টেনে নেয় নিজের কাছে। সত্যি ভীষণ জল তেষ্টা পেয়েছে। ঘড়ি বের করে সময় দেখে মেহেক। সময় প্রায় সাড়ে এগারোটা। ওর কন্ট্রাক্ট অনুযায়ী সাড়ে দশটাতেই ওর চলে যাওয়ার কথা। ওদেরকে শেখানো হয়েছিলো কোনো ক্লায়েন্টের সাথে যেন মানসিক ভাবে ওরা ঘনিষ্ঠ না হয়ে পড়ে। এতমাস ধরে সেটাই অক্ষরে অক্ষরে পালন করে এসেছে মেহেক। ও সার্ভিস দিয়েছে, কাজ শেষে টাকা নিয়ে বেরিয়ে গেছে। কিন্তু এবার ঘটনাপ্রবাহ যেন ওর নিজের ধরাবাঁধার বাইরে চলে গেছে। কিছুতেই জোর করে বেরিয়ে আসতে পারছে না ও। ভীষণ কৌতূহল হচ্ছে ওর জানতে - চিনতে - বুঝতে বিতান কে।  


মেহেক জিজ্ঞেস করে ওঠে, " এতো প্রেম, এতো ভালোবাসা, তারপরে যেখানে আপনাদের বিয়ে হলো, এতো সুন্দর একটা ছোট ছেলে আপনাদের, তাহলে....তারপরেও কি হলো ? কেন ভেঙে গেলো সবকিছু ? কেন এই দুঃখের বোঝা বুকে চেপে আছেন আপনি ? কেন বেরিয়ে আসতে পারছেন না ? আর আপনার স্ত্রী ? মানে স্নিগ্ধাদি ? "


দীর্ঘ একটা শ্বাস নিয়ে মাথাটা দুদিকে নেড়ে , নিচের দিকে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে থাকে বিতান কিছুক্ষণ। একটু পরে হতাশ ভঙ্গীতে বসে পড়ে সোফার ওপরে। ধীরে ধীরে বলে ওঠে, "আসলে , ভুলটা হয়তো আমার। বা হয়তো ভুলটা স্নিগ্ধার। বা হয়তো ভুলটা দুজনেরই ! জানি না মেহেক। মাঝে মাঝে নিজেকে প্রশ্ন করি , যতই উত্তর খুঁজতে যাই, আরো গভীরে তলিয়ে যেতে থাকি। সম্পর্ক তৈরী করা যতটা সোজা, তার থেকে অনেক বেশি সোজা হয়তো সেটা থেকে বেরিয়ে আসা। বেরিয়ে আসতে শুধু একটা ছোট্ট কারণই যথেষ্ট , একজন আরেকজনের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে , অন্যকে অপরাধী প্রমাণ করে বেরিয়ে আসতে খুব একটা সময় লাগে না। কিন্তু সেটা তো,যেখানে ভালোবাসা থাকে না ! আমি তো তাই জানতাম। অথচ আমাদের দুজনের মধ্যে এতো টান - ভালোবাসা - প্রেম সবকিছুর পরেও কিকরে যে এরকম হয়ে গেলো ! আমি আজ আর ভাবি না , ভাবতে চাই না ! তবে কিছু জিনিস আছে, যেটা আমরা জেনেও না জানার ভান করে থাকি , বা অস্বীকার করি সবার সামনে। অথচ মনের গভীর গোপনে আমরা জানি কোনটা ঠিক বা কোনটা ভুল। যখন আমরা প্রেম করি, বা কাউকে ভালোবাসি, বা কারোর সামনে নিজেকে তুলে ধরি যাতে সামনের মানুষের ভালোবাসা পেতে পারি, তখন আমরা কি করি মেহেক ? আমরা আমাদের দোষ ত্রূটি গুলো দূরে সরিয়ে নিজেদের ভালো হওয়ার মুখোশটাই তাদের সামনে তুলে ধরি। আমাদের ভেতরে খারাপ দিক গুলো কিন্তু আমরা সযত্নে লুকিয়ে রাখি। যখন সেই দুটি মানুষ পরে একসাথে, এক ছাদের তলায় এসে বসবাস শুরু করে, প্রথম কয়েকটা প্রেমের রামধনুতে রাঙানো রঙিন মাসগুলোর পরে, একে অপরের অন্যদিকটা - নতুন করে আবার চিনতে শুরু করে। সেই মানিয়ে নেওয়ার ব্যাপারটা অনেকেই মেনে নেয় ; কিন্তু কিছু মানুষ থাকে, যারা মানতে পারে না ! তখন তারা বারেবারে তাদের প্রেম পর্যায়ের সেই মানুষটিকে খুঁজতে থাকে সম্পর্কের মধ্যে। আর তাকে না পেলেই শুরু হয়ে যায় অশান্তি। আবার এর আরো একটা দিক আছে - একটা মেয়ে বিয়ের পরে যখন তার মা-বাবা-ভাই-বোনের চেনা পরিচিত পরিসর ছেড়ে নতুন একটা পরিবারে চলে আসে ,তখন সেই নতুন পরিবারের সবকিছু মানিয়ে নিতে তারও কষ্ট হয়। নতুন পরিবারে সবাই মেয়েটিকে সাহায্য করলেও, সে কোথাও যেন সেই নিজের যে একটা স্বাধীনচেতা মন, নিজের অস্তিত্ত্বকে একটু হলেও বিসর্জন দিতে বাধ্য হয়। আর আমাদের সমাজটাই এমন যে সেটা করতে বাধ্য করা হয় মেয়েদের। এটাই হয়ে এসেছে, হয়ে চলেছে, হয়তো ভবিষ্যতেও হবে। হয়তো এইসব কিছু নিয়েই আমাদের মধ্যেও একটা চিড় ধরে গিয়েছিলো , আর তার চূড়ান্ত পরিণাম আমাদের বিচ্ছেদে। তবে কিভাবে কি হয়েছিলো জানতে গেলে, আমাদের আরো পিছিয়ে যেতে হবে, সেই গৌহাটিতে , যেদিন আমরা , মানে বিয়ের মাস চারেক আগে আমি আর স্নিগ্ধা একসাথে ছিলাম প্রায় দেড়দিন। " একটু থেমে মেহেকের গোলগোল চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে বিতান , "সরি, আপনাকে আমি বোর করছি না তো ? আসলে আমি বকবক করতে শুরু করলে , যা মনের ভেতরে আসে, বকেই যাই ! "


হেসে মেহেক বলে, "না না ! আপনি ভাববেন না। আর আমি তো শুনতেই চাই আপনার কথা। তাই না ? আপনি বলুন। আপনার সব কষ্ট উজাড় করে দিন আমার সামনে। আপনি হয়তো জানেন না, কত মানুষ তাদের মনের কথা বলার সুযোগ পায় না , ভেতরে ভেতরে গুমরে মরতে থাকে।"



++++++++++



বিকেলে রুমে ফিরে আসার পরে, আমরা বারান্দায় বসি , হাতে হাত রেখে, পাশাপাশি, দুটো চেয়ারে। অনেকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করার জন্য দুজনেই ক্লান্ত ছিলাম ভীষণ, আমি তাই রুম সার্ভিসে ফোন করে দুটো কফি অর্ডার করবো বলে উঠতে যাই বারান্দার চেয়ার থেকে। স্নিগ্ধা আমার দিকে তাকায় গভীরভাবে - ওর সেই সমুদ্র ঘন নীল চোখদুটো দিয়ে। ধীরে ধীরে উঠে এসে বসে আমার কোলে, ঠিক যেমন একটা বাচ্চা তার বাবা বা মায়ের কোলে এসে বসে - সেইভাবে। আমার মুখের কাছে নিজের মুখটা এনে বলে ওঠে ,"এতো সুন্দর একটা পরিবেশ, পাহাড়ে ধীরে ধীরে সন্ধে নেমে আসছে , বাইরে এতো মনোরম হাওয়া, ধীরে ধীরে ঠান্ডার পরশ ছড়িয়ে পড়বে আমাদের ওপরে। এইসময় কি কফি ভালো লাগে ? তুমি বরং ওদের 'বিকিনি মার্টিনি' দিতে বলো ! আমি অনেকদিন আগে একবার খেয়েছিলাম, সেই কলেজের ফার্স্ট ইয়ার এ পড়ার সময়। ওটা ভোদকা , কোকোনাট রাম আর পাইনাপেল জুস দিয়ে তৈরী হয়। খুব ভালো লাগবে , তুমি দেখো। " হাত থেকে বার এর মেনুকার্ড নামিয়ে রাখে পাশে স্নিগ্ধা।


আমি কেমন যেন সম্মোহিত হয়ে গিয়েছিলাম সেই দিন, স্নিগ্ধার কথামতো অর্ডার করলাম 'বিকিনি মার্টিনি' । এর ফাঁকে স্নিগ্ধা বারান্দা থেকে চেয়ার দুটো সরিয়ে নিয়ে, ভেতরের রুম থেকে বের করে আনে দুটো ব্ল্যাঙ্কেট। একটা ব্ল্যাঙ্কেট বারান্দার মেঝেতে পেতে দিয়ে, আরেকটা পাশে রেখে বসে পড়ে ওর ওপরে।


আমাকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করে স্নিগ্ধা, "কি হলো ? কি দেখছো ?


আমি কাব্য করে বলে উঠি ,

"দেখছি গোধূলি আলোতে ,

আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যেকে ;

এসেছে সে সাজিয়ে তুলতে,

আমাকে - আমার জীবনকে যতনে। "


লজ্জা পেয়ে স্নিগ্ধা ঘুরিয়ে নেয় ওর মুখ অন্য দিকে । আমি ধীরে ধীরে এসে পাশে বসি , ওর চিবুকের নিচে হাত রেখে - কনে দেখা আলোতে লাজুক মুখটাকে ধীরে ধীরে ঘুরিয়ে, টেনে আনি নিজের দিকে, নিজের কাছে। স্নিগ্ধার দু চোখের পাতা, স্পর্শ করে আমার ঠোঁট। আবেশে বন্ধ হয়ে আসে চোখের পাতা দুটি। ঠান্ডায় লাল হয়ে যাওয়া গালের ওপরে নেমে আসে উষ্ণ ঠোঁটের পরশ , তিরতির করে কেঁপে ওঠে স্নিগ্ধার দুটি ঠোঁট। কাঁপতে থাকা ঠোঁটদুটি ধীরে ধীরে খুলে যায় , অপেক্ষা করতে থাকে আমার স্পর্শের, ঠোঁটের। আমার নিজের চোখ দুটোও বন্ধ হয়ে যায়, একটা মধুর সম্ভাবনার আনন্দে মনটা ভরে ওঠে। স্নিগ্ধা হাতড়ে হাতড়ে খুঁজে নেয় আমার হাত , হাতের আঙ্গুল। নিজের নরম হাত ঢুকিয়ে দেয় আমার হাতের মুঠোতে। আমি অনুভব করি ওর গরম নিঃশ্বাস প্রশ্বাস , বাড়তে থাকা একটা চাপা উত্তেজনা ধীরে ধীরে পাগল করতে থাকে আমাদের। ধীরে ধীরে আমার ঠোঁট নেমে আসে ওর ঠোঁটের ওপরে।


ডিং ডং - ঠিক তখনই দরজায় এসে হানা দেয় - বেরসিক রুম সার্ভিসের ছেলেটি। মুখ শুকনো করে আমি উঠে আসি, পেছন থেকে ভেসে আসে স্নিগ্ধার খিলখিল করে হাসির আওয়াজ। আমি ফিরে আসি দু গ্লাস 'বিকিনি মার্টিনি' নিয়ে। আমার রাগী মুখ দেখে উঠে আসে স্নিগ্ধা, আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে ওঠে ,"রাগ হয়েছে তোমার ? এতো রাগ ? আচ্ছা আর রাগ করতে হবে না। আমি সব সুদে আসলে শোধ করে দেবো। এবার এসো তো, আমার পাশে এসে বসো , গ্লাসে অল্প চুমুক দাও, আর ধীরে ধীরে পাহাড়ের ওপরে নেমে আসা সন্ধেটা উপভোগ করো। "


আমি আর স্নিগ্ধা পাশাপাশি বসলাম নিচে , গায়ে জড়িয়ে নিলাম ব্ল্যাঙ্কেটটা ভালো করে। আমি বারান্দার দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসলাম আর স্নিগ্ধা আমার বুকে মাথা রেখে। ধীরে ধীরে গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে যখন সন্ধেটা হবো হবো করছে, স্নিগ্ধা শুরু করলো শহর ব্যান্ডের একটা জনপ্রিয় গান,


যখন.. নীরবে দূরে, দাঁড়াও এসে

যেখানে পথ বেঁকেছে।

তোমায় ছুঁতে চাওয়ার মুহূর্তরা

কে জানে কি আবেশে দিশাহারা

আমিও ছুটে যাই সে গভীরে

আমিও ধেয়ে যাই কি নিবিড়ে

তুমি কি মরীচিকা না ধ্রুবতারা। .......


গানের শেষে কখন যে ওর ঠোঁট এসে আমার ঠোঁটে মিশে গেলো, বুঝতে পারিনি। কতক্ষণ আমরা পরস্পরের ঠোঁটের মধ্যে ডুবে ছিলাম সেদিন, সাক্ষী ছিলো শুধু রাতের কালো আকাশ, অনেক ওপরে মিটমিট করতে থাকা কিছু তারা আর দূর আকাশের বাঁকা একফালি হাসতে থাকা চাঁদের টুকরো। ধীরে ধীরে গ্লাস দুটো পাশে সরিয়ে আমরা দুজনেই ঢুকে পড়লাম ব্ল্যাঙ্কেটের মধ্যে , শুয়ে পড়লাম বারান্দাতেই মেঝের ওপরে।   



++++++++++



বিতানকে হঠাৎ থামিয়ে দেয় মেহেক। মেহেক বলে ওঠে ,"আর ডিটেলস এ প্লিজ বলবেন না। মানে এইসব মোমেন্টস, মুহূর্তগুলো আপনাদের ভীষণ একার, ব্যক্তিগত। এগুলো মনের ভেতরে গেঁথে যাওয়া মণি মুক্তো ! এগুলোকে খুঁড়ে আনছেন কেন আপনি ? কেন বিতান ?    


বিতান হেসে ওঠে , মুখটা একটু বিকৃত করে বলে ওঠে, "ঠিক বলেছেন মেহেক। আপনি সত্যি কথাই বলেছেন। তবে এর মধ্যেই হয়তো সেই বিচ্ছেদের রেখা আঁকা হয়ে গিয়েছিলো, সেদিন যেটা বুঝতে পারিনি ভালো করে। ভেবেছিলাম দুজনেই, সব ঠিক হয়ে যাবে সময়ের সাথে। "


"মানে ? ঠিক বুঝলাম না। " অবাক হয়ে ওঠে মেহেক।



++++++++++



সেদিন আমরা কেউ আর নিজেদের মধ্যে ছিলাম না। স্বাভাবিক জৈবিক তাড়নায়, ভালোবাসায় বা প্রেমে নিজেদেরকে সমর্পণ করে দিয়েছিলাম একে অন্যের কাছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা আমাদের জামাকাপড় সব ছেড়ে, পাশে রেখে, ঠান্ডা আর আকাশ থেকে ড্যাবড্যাব করে আমাদের দেখতে থাকা চাঁদের কাছ থেকে নিজেদের লুকোতে, ব্ল্যাঙ্কেট ঢাকা দিয়ে লুকিয়েছিলাম দুজনের নগ্নতাকে। জীবনে প্রথমবার, নিজের জীবনসঙ্গীকে সম্পূর্ণ ভাবে নিজের করে পাওয়ার উত্তেজনা বা অন্য কোনো দুর্বলতার জন্য কিনা জানিনা , মাত্র দেড় মিনিটের মধ্যেই আমি তৃপ্ত হই, জড়িয়ে ধরি সজোরে অতৃপ্ত স্নিগ্ধাকে। স্নিগ্ধা তখনও আমাকে জড়িয়ে, আমাকে উল্টে দিয়ে আমার ওপরে বসে পেতে চাইছিলো চরম সুখ। সেদিন সেই সুখ আমি দিতে পারিনি ওকে। একটু পরে হতাশ, ব্যর্থ স্নিগ্ধা নেমে পড়ে আমার ওপর থেকে, কোনো কিছু না বলে চুপ করে শুয়ে থাকে অন্যদিকে ঘুরে। ওকে আমি পেছন থেকে জড়িয়ে ধরি, ও আমার হাত সরিয়ে দেয়। পরে ধীরে ধীরে আমার দিকে ঘুরে আমার বুকের মধ্যে মাথা গুঁজে দেয়। "


পরে আমাকে বলে স্নিগ্ধা , "বিতান প্লিজ রাগ কোরো না আমার আচরণের জন্য। আসলে আমি ভেবেছিলাম আমাদের প্রথম মিলন হবে একদম স্বপ্নের মতো, ঠিক যেরকম বিভিন্ন গল্প বা উপন্যাসে পড়ি। তবে এটা তোমার ও প্রথমবার, আমার ও তাই , তাই হয়তো সেরকম কিছু ঘটেনি , তবে তুমি দেখো, সব ঠিক হয়ে যাবে। বিয়ের পরে , যখন নিয়মিত আমরা একসাথে....সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। আর যাই হোক না কেন বিতান, আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। কোনো কিছু নিয়ে চিন্তা করতে হবে না তোমাকে। তুমি আরো, আরো কবিতা লিখবে, আমি সেই কবিতায় সুর দিয়ে গানে গানে ভরিয়ে তুলবো আমাদের ভালোবাসার ছোট্ট নীড় !"


কিন্তু কোনো কিছুই আর ঠিক হয় নি কখনও।


মাস চারেক পরে ধুমধাম করে আমাদের বিয়েও হয়ে গেলো। বিয়েতে ইন্ডাস্ট্রির কিছু লোকজন এসেছিলো, যারা ওর বাবার সাথে কাজ করেছে বা ওর বাবাকে চিনতো। সেই প্রথমবার পর্দার আড়ালে থাকা তারকাদের দেখলাম চোখের সামনে। আর সেখানেই দেখা হলো পারভীনের সাথে।


"মেহেক, আপনি বুঝতে পেরেছেন তো ? আমি কোন পারভীনের কথা বলছি ? "              



++++++++++


       

ওল্ড বালিগঞ্জ রোডের একটা বিশাল বড়ো বাড়ি , সামনে প্রায় বারো ফিটের বড়ো গেট। গেটের বাইরে থেকে কিছুই দেখা যায় না ভেতরে , তবে দুদিকে দুটো সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো, সেটা দিয়ে ভেতরের লোকজন দেখতে পায় বাইরে কে এসেছে। প্রায় পনেরো হাজার স্কোয়ার ফিট জায়গা জুড়ে তৈরি এই জায়গায়, মাঝে রয়েছে একটা পোস্টকার্ডের মতো সাজানো দোতলা একটা বাড়ি। পেছনদিকে রয়েছে প্রাইভেট পুল। বাড়ির ভেতরে রয়েছে বিশাল বড়ো বড়ো পাঁচটা বেডরুম, তিনটে লিভিং রুম, দুটো লাইব্রেরি, একটা ছোট প্রাইভেট থিয়েটার , দুটো বড়ো কিচেন , একটা সুসজ্জিত পূজার ঘর। বাইরের লনের একদিকে রয়েছে গাড়ি রাখার জায়গা। সেখানে রয়েছে দেশি বিদেশী পছটা গাড়ি , চারটে বাইক। আর একদিকে রয়েছে একটা খোলা ফাঁকা মাঠ , সুন্দর সবুজ কার্পেট ঘাসে মোড়া। দেখেই বোঝা যায়, প্রতিদিন সেটাকে যত্ন করা হয়। মাঠের কোণে আর একদিকে রয়েছে একটা জিম , জিম থেকে বিভিন্ন যন্ত্রপাতির আওয়াজ ভেসে আসছে।


জিমে এখন শরীরচর্চা করছে এখনকার অন্যতম স্টার পারভীন। পরের সিনেমাতে পারভীন কমান্ডোর রোল করছে, তাই ওকে এখন দু মাসে ওজন ঝরিয়ে আরো মাসল বানাতে হবে। সেটার চেষ্টাই করে চলেছে পারভীন। জিমে চলছে কোনো বিদেশী মেটাল , ড্রামস আর ইলেকট্রিক গিটার এর শব্দের মাঝে কেউ একজন চেঁচিয়ে যাচ্ছে জোরে জোরে। তার মাঝে পারভীন এক্সারসাইজ করে চলেছে সব ভুলে। সময় এখন প্রায় এগারোটা, বাইরে ঘন অন্ধকার। জিমের বাইরে ওর পোষা দুটো লাব্রাডর ঘুরে বেড়াচ্ছে। আরো মিনিট পাঁচেক পরে পারভীন বেরিয়ে আসে জিম থেকে। সবকিছু বন্ধ করে , তোয়ালে দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে একটু জগিং করে এসে বাড়ির পেছনের পুলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সাঁতার কেটে অন্য প্রান্তে গিয়ে একটু ওয়াইন গ্লাসে নিয়ে আবার নেমে আসে পুলের ধারে। চোখ বন্ধ করে ওপর দিকে তাকিয়ে সারা শরীর জলের মধ্যে রেখে মাথাটা তুলে দেয় আকাশের দিকে।


আজ ভীষণ খুশি পারভীন। আজ অনেকদিন পরে স্নিগ্ধা আসছে ওর কাছে, আবার। প্রায়, প্রায় মাস পাঁচেক পরে। ভেবেই একটা শিহরণ জেগে ওঠে শরীরে। এই বয়সেও নিজেকে কিভাবে যে ধরে রেখেছে স্নিগ্ধা। সেই ছোটবেলায় যখন প্রথম দেখেছিলো ওকে, পাহাড়ের রাস্তায় স্কুলে যেতে যেতে, তখনই কেমন যেন সব ওলোট পালোট হয়ে গিয়েছিলো। অনেকদিন পরে সাহস করে যখন স্নিগ্ধার কাছে গিয়ে, ওর সামনে দাঁড়িয়ে প্রপোস করে ওকে , সবার সামনে স্নিগ্ধা ওকে প্রচন্ড অপমান করে , বের করে দেয় চোখের সামনে থেকে। সেটাই সেদিনের মুখচোরা পারভীনকে বানিয়েছে আজকের স্টার। সেদিন ও সরে এসেছিলো সামনে থেকে , প্রচন্ড অপমানে আত্মহত্যার কথাও ভেবেছিলো। কিন্তু সেই সাহসটাও তো ছিলো না ওর। চলে আসে কলকাতায় , সবকিছু ছেড়ে। দশ বছরের অনেক স্ট্রাগল এর পরে, এই টালিগঞ্জ - এই ইন্ডাস্ট্রি ওকে গ্রহণ করে নেয়। আর তারপরে স্নিগ্ধার বিয়েতে হঠাৎ করে আবার ওর মুখোমুখি, আবার সেই পুরোনো অপমানের জ্বালাটা ফিরে আসে ওর ভেতরে। সেদিনই ও ঠিক করে নিয়েছিলো, শেষ করে দেবে স্নিগ্ধাকে, শেষ করে দেবে ওর সুখের সংসারকে। ও নিজেও পুড়ুক , দেখুক , বুঝুক, জানুক কেমন লাগে অপমানিত হতে। কেমন মনে হয় যখন অপমান শুধু মনের ওপরে না থেকে ভেতরের আত্মাকে মেরে ফেলে। 



++++++++++



ঘড়ির কাঁটা এখন দৌড়োচ্ছে ধীরে ধীরে এগারোটার দিকে। ঘড়ির কাঁটার সাথেই কালো রাজপথ দিয়ে ছুটে চলেছে একটি গাড়ি। পাশ দিয়ে পেরিয়ে যাচ্ছে রাতের কলকাতা! সেই কলকাতা - যে একদিকে মধ্যবিত্ত আর দারিদ্র্যের সাথে প্রতিদিনের সংগ্রামে রণক্লান্ত-বিদ্ধস্ত; আবার অন্যদিকে বিত্তবানদের কাছে মায়াবী, মোহময়ী, অলীক, অশ্লীল অবৈধ সুখের হাতছানি নিয়ে হাজির হয় প্রতিদিন। সেই কলকাতার চেহারা যেন পরিবর্তিত হয়ে যায় গভীর রাতে, মুহূর্তে মুহূর্তে। সবাই সেটা জানে না, উপভোগ করতে পারে না বা ভয় পায় - চেনা গন্ডীর বাইরে পা ফেলে সেই কলকাতাকে জানতে, চিনতে, মেতে উঠতে সেই মত্ততায়।


গাড়ির ভেতরে বসে স্নিগ্ধা, নিজেই ড্রাইভ করে চলেছে পারভীনের কাছে। আজ আবার শরীর জেগে উঠেছে প্রচন্ড ভাবে , একটা বলিষ্ঠ স্পর্শ চাইছে উপোসী শরীর। গত কয়েকমাস অনেক করে নিজেকে বুঝিয়ে, নিজেকে শাস্তি দিয়ে, কখনও বা আকন্ঠ তরল গরলে ডুবে ভুলে থাকতে চেয়েছে নিজেকে, নিজের শরীরের কামনা বাসনাকে। কিন্তু যে গানটা রেকর্ডিং করতে হবে, সেটার কথা আর সুর শুনে , নিজেকে আর স্থির রাখতে পারছে না স্নিগ্ধা।


কয়েকবছর আগেও বিতানের লেখা সুন্দর নিষ্পাপ প্রেমের কবিতাগুলোতে নিজে সুর করে গান গাইতো স্নিগ্ধা। ধীরে ধীরে সেই জনপ্রিয়তা হারাতে থাকে। বাজার চাইছে এখন শরীরী গান, চাইছে গানের মধ্যে যৌনতা - শীৎকারের শব্দ। সেই গান গাইছে বাচ্চা থেকে বুড়ো সবাই। মাঝে মাঝে কষ্ট হয়, একা থাকার সময়ে ভাবে স্নিগ্ধা ! মানুষের রুচি কি এতটাই নিম্নগামী হয়ে গেছে ? কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে বোঝায় স্নিগ্ধা , ও একজন শিল্পী। আর মানুষ যা চাইছে, সেটাই ওকে দিতে হবে, নাহলে মানুষ ওকে ছুঁড়ে ফেলে দেবে। যেভাবে বিয়ের পরে বিতান ধীরে ধীরে ওকে ছুঁড়ে ফেলে দেয় নিজের জীবন থেকে।


মনের গভীরে, তবুও একটা অপরাধবোধে নিজেকে ক্ষত বিক্ষত করতে থাকে স্নিগ্ধা প্রায় প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত। বিতান কি সত্যিই দোষী ? সবটুকু দোষ কি শুধু বিতানের ? আর আমি ? আমি তো বিতানকে ভরসা দিয়েছিলাম, বুঝিয়েছিলাম সব ঠিক হয়ে যাবে সময়ের সাথে সাথে। আসলে কি হয়েছিলো আমাদের মধ্যে ? কেন হঠাৎ সব শেষ করে দিলাম আমি ? নিজেই নিজেকে জিজ্ঞেস করে ওঠে স্নিগ্ধা।


ভীষণ জোরে গাড়িতে ব্রেক দিয়ে রাস্তার এক কোণে এসে গাড়ি দাঁড় করায় স্নিগ্ধা। একটা সিগারেট ধরিয়ে তাকিয়ে থাকে বাইরের দিকে। একের পর এক গাড়ি সরে যাচ্ছে সামনে থেকে , উধাও হয়ে যাচ্ছে কালো পিচের রাস্তা, সামনে এগিয়ে আসছে বিতান ধীরে ধীরে , হাতে ওর কবিতার বই , কিছু একটা আবৃত্তি করছে, মুখে সেই হাসি।


বিয়ের পরেও সুখ - শরীরের; মনের; কোনোদিন আসে নি স্নিগ্ধার জীবনে। বিতান এক থেকে দেড় মিনিটের মধ্যেই নিঃশেষ হয়ে যেতো, পাশে শুয়ে ছটফট করতো স্নিগ্ধা , চেপে ধরতো বিতানের নগ্ন ঊরু নিজের দুই ঊরুর মাঝে, কখনও বিতানের হাত জোরে করে ধরে টেনে নিয়ে আসতো নিজের তলপেটে - গোপন সন্ধিস্থলে। তবুও তৃপ্তি পেতো না স্নিগ্ধা। বিতান ঘুমিয়ে পড়লে, চেপে ধরতো পাশবালিশ। শেষে ব্যর্থতা, অপমানে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়তো কখন, নিজেও জানতো না, বা জানতে চায় নি কখনও।


সকাল হলে, সব কাজের মাঝে বোঝাতো নিজেকে, মুখপুড়ি তোর এতো জ্বালা কিসের ? কত মেয়ে প্রতিদিন ভালোবাসা না পেয়েও যাপন করছে তাদের জীবন, স্বামী - সন্তান - পরিবার নিয়ে। আর বিতান তো কত ভালোবাসে তোকে , তোর কথায় কি না করতে পারে ও ! কত মেয়ে তো জানেও না শরীরের সুখ কি জিনিস, স্বামীর সুখেই তাদের সুখ। তোর এতো, সবকিছু নিয়ে বাড়াবাড়ি কেন? আবার রাত হলে সেই অন্ধকূপ, গুহার মধ্যে নিজেকে ঠেলে দেওয়া রোজ - স্নিগ্ধা কিছুতেই যেন পারছিলো না নিজেকে সামলাতে।


পাহাড়ে বড়ো হওয়ার জন্য, কনভেন্টে পড়াশোনা করা স্নিগ্ধা, ছোট থেকেই ছিলো প্রচন্ড স্বাধীনচেতা। এই শেকল পরে থাকতে পারছিলো না আর। প্রায় মাস ছয়েক কেটে যাওয়ার পরে, একদিন বিতানকে বলে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে। ডাক্তার দেখানোর পরে, বেশ কিছু টেস্ট হওয়ার পরে, জানতে পারে, বিতানের নার্ভের একটা অংশ ঠিক ভাবে কাজ করে না ছোট থেকেই। আর তাই বিতান কোনোদিনই ওকে সেই সুখ দিতে পারবে না।


সব জেনে ভেঙে পড়েছিলো বিতান। বারবার নিজেকে দোষ দিচ্ছিলো সেদিন। বলেছিলো স্নিগ্ধাকে, ওকে ছেড়ে এই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে যেতে। কিন্তু স্নিগ্ধা সেদিন পারে নি বিতানের ভালোবাসা - প্রেম অস্বীকার করে বেরিয়ে যেতে। সব জেনে ভেঙে পড়েছিলো বিতান। বারবার নিজেকে দোষ দিচ্ছিলো সেদিন। বলেছিলো স্নিগ্ধাকে, ওকে ছেড়ে এই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে যেতে। কিন্তু স্নিগ্ধা সেদিন পারে নি বিতানের ভালোবাসা - প্রেম অস্বীকার করে বেরিয়ে যেতে।         


তখনও স্নিগ্ধা ব্যান্ডের সাথে কাজ করতো, তবে অনেক কমিয়ে দিয়েছিলো রাত করে দূরে কোথাও গিয়ে প্রোগ্রাম করা। এই টিভিতে কোনো অনুষ্ঠান, বা পাড়ার ক্লাবে , বা সামনে , আসে পাশে , এগুলোতেই ব্যস্ত রেখেছিলো নিজেকে। বিতান নিজেও কবিতা লেখা বন্ধ করে দিয়েছিলো ধীরে ধীরে। বিতান বারবার বলতো, ও আর পারছে না নতুন কিছু লিখতে , যখনই কিছু লিখতে বসে , তখনই অপরাধবোধ, গ্লানি, নিজের অক্ষমতা বারবার ওকে পোড়াতো। কাজের মধ্যে ডুবিয়ে দিতে থাকে নিজেকে বিতান। স্নিগ্ধা ও সংসারের হাজার একটা কাজে নিজেকে নিমজ্জিত করে ফেলে। বিতান বারবার বলতো ওকে, "কেন তুমি এসব করছো ? এসবের জন্য তো দুজন কাজের লোক আছে ! তুমি গান করো , গান গাও। কত ভালো গান করো তুমি। আমি তো তোমার পাশে আছি। "


ঠোঁট উল্টে স্নিগ্ধা বারেবারে অপমান করতো বিতানকে তখন, "তুমি ? তুমি আমার পাশে আছো ? কিভাবে বিতান ? একটা অসুস্থ মানুষ তুমি, অক্ষম , ক্লীব , দুর্বল। আমাকে পেরেছো কোনোদিন ভালোবাসতে ? শুধু নিজেরটুকু বোঝো , নিজের সুখ খোঁজো ! কোনোদিন জানতে চেয়েছো আমি সুখী কিনা ? আমাকে পেরেছো সুখী করতে ? ভালোবাসা ? ভালোবাসা ? তোমার মতো লোককে যে কি করে ভালোবেসেছিলাম আমি , আমার কপাল ! কে জানে, কি পাপ করেছিলাম আমি আগের জন্মে ! আমার কথা ভাবতে হবে না তোমাকে , থাকো নিজেকে নিয়ে। আমি যেটা নিয়ে, যেভাবে ভালো আছি, ভালো থাকতে চেষ্টা করছি, সেটা আমাকে বুঝে নিতে দাও। "


বিতান অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতো স্নিগ্ধার মুখের দিকে , ধীরে ধীরে মাথা নিচু করে বেরিয়ে চলে আসতো। বিতানকে এইভাবে কষ্ট দিয়ে , মনে মনে বেশ খুশি হয়ে উঠতো স্নিগ্ধা। নিজেকে সান্ত্বনা দিতো, এটাই তো ওর পাওনা। এইরকম মানুষ জীবনে থাকার চেয়ে, না থাকা অনেক ভালো। ঘন্টাখানেক পরে বাথরুমে গিয়ে জল ছেড়ে অঝোর ধারায় কাঁদতো স্নিগ্ধা। বিতানকে কষ্ট দিতে গিয়ে, কোথাও যেন নিজেই নিজেকে কষ্ট দিয়ে ফেলতো ও !       


তখন বিতানের মা বাবা দুজনেই বেঁচে ছিলেন - স্নিগ্ধাকে নিজের মেয়ের মতো করে, টেনে নিয়েছিলেন বুকে। ওদের সাথে সারাদিন গল্প করে, আড্ডা দিয়ে, ওষুধ খাওয়ানো, দুপুরে একসাথে বসে খাওয়া, বাগানের পরিচর্যা - এইসব করে, দিব্যি কেটে যেতো সারাদিন। তবুও মনের অসুখের কথা বোধহয় বুঝতে পেরেছিলেন বিতানের মা। এক দুপুরে, বাবা ঘুমিয়ে যাওয়ার পরে স্নিগ্ধার বিছানার পাশে এসে বসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন পরম স্নেহে , মমতায় উনি। স্নিগ্ধা ঘুমোচ্ছিলো তখন, একটু পরে ঘুম ভেঙে যায়। পাশে মা কে দেখে, তাড়াতাড়ি উঠে বসে। জিজ্ঞেস করে ,"মা, তুমি এখানে ? কিছু চাই তোমার ? "


"তোর কি হয়েছে স্নিগ্ধা ? তোদের মধ্যে কি কিছু সমস্যা হয়েছে ? তোদের মধ্যে প্রথম দিকে যেরকম ভাব ভালোবাসা ছিলো, আমি যেন দেখতে পাই, সেই সুর - তাল এখন কেটে গেছে। দুজনেই পাশে থেকেও কিরকম যেন দূরে দূরে থাকিস তোরা। কি হয়েছে রে মা ? " বিতানের মায়ের স্নেহ মেশানো প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারে না স্নিগ্ধা। মাকে জড়িয়ে হাউহাউ করে কাঁদতে শুরু করে।


মা ও ওকে জড়িয়ে ধরে, মাথায় হাত দিয়ে ধীরে ধীরে বলে ওঠেন ,"তোরা আজকালের ছেলে মেয়ে। কথা বল নিজেদের সাথে। বিতান আমার ছেলে বলে বলছি না, তবে ও খুব চুপচাপ থাকে। ওর মনের ভেতরে কি চলছে আমরাও অনেক সময় আগে বুঝতে পারতাম না। কিন্তু আমি জানি মা, তুই ওকে আমাদের থেকেও ভালো বুঝিস। তাই তো যে ছেলের এতো বছরে অন্য কাউকে দেখে কখনও ভালো লাগে নি, তোকে সেবার পাহাড়ে কাজে গিয়ে কয়েক মুহূর্তেই এতো পছন্দ হয়ে যায় ! জানিস, ও না প্রথমে আমাদের বলতেই চায় নি। ওকে কত জিজ্ঞেস করেছিলাম , পরে তো ধীরে ধীরে বললো। কিন্তু, কিন্তু এখন হঠাৎ কি হলো তোদের ? ওর কি কাজের চাপ বেড়ে গেছে খুব ? তোকে সময় দিচ্ছে না ? না কি অন্য কিছু। আমাকে তো তুই মা বলিস, তাই না ? বল না , আমাকে বল। "


স্নিগ্ধা আরো জোরে কেঁদে ওঠে , একটু পরে ধীরে ধীরে মায়ের কাঁধ ছেড়ে, বিছানার চাদরের দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে বলে ওঠে ধীরে ধীরে , "বিতান, বিতান...মা , আসলে বিতান এর একটা সমস্যা আছে। আর ওটার জন্য , আমি, আমাকে.....আমি কখনো তৃপ্ত হতে.....! "


চমকে ওঠেন মা , তাড়াতাড়ি কোনোরকমে নিজেকে সামলে বলে ওঠেন ,"কি বলছো তুমি? আমি, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। তবে একটা কথা বলবো স্নিগ্ধা ? সেভাবে দেখতে গেলে, আমি তো জানি না তুমি তৃপ্ত হওয়া মানে কি বলছো ? আমার কাছে তো বাবা , স্বামী, তারপরে বিতান ওদেরকে ভালো রাখা, সুস্থ রাখাই সংসারের আসল মন্ত্র। আর আমাদের সময় এতো কাজ করতে হতো সংসারের, নিজেকে নিয়ে কিছু ভাবার সময়ই পাই নি। তবে তোমাদের এখনকার ছেলে মেয়েদের ব্যাপার আলাদা। তোমরা এখন নিজেকে নিয়ে, নিজের সুখ আল্হাদ নিয়ে অনেক বেশি ভাবো। " উঠে দাঁড়ায় বিতানের মা। দরজার কাছে গিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে ওঠে ,"তোমরা একটা বাচ্চা নিয়ে নাও স্নিগ্ধা ! একটা বাচ্চা চলে এলে দেখো , খুব ভালো লাগবে। তখন এইসব কথা আর মাথায় আসবে না। শরীরের আর কি ? কয়েকদিন পরেই তো শরীরের আর কিছুই থাকবে না, তখন তো শুধু এই মন ! তাই না ? " ধীরে ধীরে বাইরে বেরিয়ে নিজের রুমে চলে যান উনি।  


আরো কয়েকমাসের মধ্যে প্রথমে মা, পরে বাবা ওদেরকে ছেড়ে চলে যান, পৃথিবীর সব মায়া ত্যাগ করে !



++++++++++



বিতানের মা বাবা দুজনেই মারা যাওয়ার পরে, ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে আটকে থাকার আর কোনো মানে খুঁজে পেলো না স্নিগ্ধা ! এমনিতেই বিতানের সাথে সম্পর্কের এই শিথিলতা, তার ওপরে নিজের ডুবতে থাকা কেরিয়ার, দুটো নিয়েই যেন দিশেহারা হয়ে যাচ্ছিলো ও। বিতানের মা বাবা মারা যাওয়ার পরে, একটু যেন মুক্তির আলো দেখেছিলো স্নিগ্ধা। 


আবার কাজের জগতে ধীরে ধীরে পা রাখতে শুরু করে স্নিগ্ধা ! এতদিন পরে ফিরে আসার পরে, বড়ো কোনো কাজ ও পাচ্ছিলো না। কেউ ওকে দিয়ে গান নতুন করে গাওয়াতেও রাজি হচ্ছিলো না। তখন স্নিগ্ধা কিছু এড ফিল্মের জন্য জিঙ্গেল গাইতে শুরু করে। সেখানেও যে খুব একটা কাজ আসছিলো, তা নয়, তবে এইভাবেই নিজেকে ব্যস্ত রাখতে চাইছিলো স্নিগ্ধা, যাতে সবকিছু ভুলে থাকা যায় ! কখনও কোথাও শুনেছিলো এই কথাটি স্নিগ্ধা; কাজের মধ্যে নিজেকে ব্যস্ত রাখলে, বাকি সব কথা, চাওয়া পাওয়ার হিসেবে, মান-অভিমান, রাগ-দুঃখ-কষ্ট-কামনা-বাসনা থেকে মুক্তি পাওয়া যায় !


তবুও দিনের শেষে, রাতের ঘন অন্ধকারে, স্নিগ্ধা, ভালোবাসার তাপ উত্তাপের জায়গায় নিজেকে বিলীন করে দিতো মৃত্যুর শীতলতায়।  


বিতান বেশ কয়েকবার বলেছিলো ওকে ডিভোর্সের কথা। কিন্তু বিতানের ভালোবাসা, প্রেম ছেড়ে বেরোতেও পারছিলো না স্নিগ্ধা। প্রতিদিন সকালে বিতান ঘুম থেকে উঠে, নিজের ব্রেকফাস্ট তৈরীর সাথে সাথে, স্নিগ্ধার জন্যও ব্রেকফাস্ট তৈরী করে দিতো। রাতে ফিরে এসে নিজেও কিছু রান্না করে রাখতো পরের দিনের জন্য। বাজার করা, সব্জী, মাছ - মাংস সবকিছু বিতান নিজে করে আনতো ! কোনোভাবে যাতে স্নিগ্ধার কোনোরকম অসুবিধে না হয়, সব দিকে ওর খেয়াল থাকতো।


একটু সামান্য হাত পুড়ে গিয়েছিলো একদিন, বিতান তাড়াতাড়ি অফিস থেকে ফিরে এসে জোরে করে ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলো। রাতে ঘুমোতে যাওয়ার পরে, বিতান স্নিগ্ধার ওপরে জোর করতো না কখনও। স্নিগ্ধার যখন শরীর জেগে উঠতো, বিতান নিজেকে পুরোপুরি সমর্পণ করে দিতো ওর কাছে। কতবার চেষ্টা করেছে স্নিগ্ধাকে তৃপ্তি দেওয়ার বিতান। স্নিগ্ধা নিজের চোখে দেখেছে , ব্যর্থতার রাতগুলিতে, সেই মুহূর্তে কিভাবে বিতান ভেঙে পড়তো , কাঁদতে কাঁদতে বিছানা থেকে নেমে যেত মেঝের এক কোণে। দেওয়ালে নিজের মাথা ঠুকতো , নিজেকে দোষ দিতো। এইরকম মানুষকে কি করে ও ফেলে চলে যাবে ? স্নিগ্ধা ভাবতেও পারে না , এই মানুষটার থেকে ডিভোর্স নেওয়ার কথা।


মাঝে মাঝে বিতানকে ওর মানসিক যন্ত্রনা থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য স্নিগ্ধা অভিনয় করতো। অভিনয়, চরম তৃপ্তি লাভের অভিনয়। বিতান খুব খুশি হতো, সবকিছু হয়ে যাওয়ার পরে, স্নিগ্ধার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করতো, "তুমি খুশি ? সুখী স্নিগ্ধা ? " ও বিতানকে জড়িয়ে নিজের বুকের মধ্যে ওর মাথাটা টেনে, গলার কাছে দলা পাকানো কষ্টটাকে চেপে বলে উঠতো, "হ্যাঁ বিতান। এই মুহূর্তে, আমি, পৃথিবীর সবথেকে সুখী নারী।"


স্নানের সময় একা, কখনো নির্জন দুপুরে , নিস্তব্ধতা ছাপিয়ে ভেসে আসতো স্নিগ্ধার শরীরী আবেশের স্বর - নিজেই নিজের সাথে, নিজের শরীরের সাথে খেলতে খেলতে, তৃপ্ত করতো নিজেকে। সেই মুহূর্ত গুলো খুব করে কাছে চাইতো ও বিতান কে , কিন্তু....



++++++++++



একদিন, এইরকম একটি বৃষ্টি ভেজা দিনে, অলস হয়ে বসেছিলো স্নিগ্ধা ওর বেডরুমে। সেদিন ওর কোনো কাজ ছিলো না , ছিলো না কোথাও যাওয়ার জন্য কোনো তাড়া! ভীষণ ভাবে আলসেমী জাপটে ধরেছিলো ওকে চারদিক থেকে।


ওদের পাশের বাড়ির ছোট ছেলে, নতুন বিয়ে করেছে। হনিমুন সেরে ফিরে এসেছে ছেলেটি আর ওর বৌ। বিতান অফিসে চলে গেছে। স্নান করে একটা গল্পের বই হাতে স্নিগ্ধা বসেছিল বেডরুমে বিছানার ওপরে। হঠাৎ খিলখিল গলার স্বরে, হাসির আওয়াজে অবাক হয়ে তাকায় স্নিগ্ধা বাইরের দিকে। কোনোকিছু বুঝতে পারে না, আবার পড়ায় মন দেয় ও। আবার মিনিট দুয়েক পরে সেই একইরকম আওয়াজে চমকে ওঠে স্নিগ্ধা। হাসির আওয়াজের উৎস খুঁজতে থাকে স্নিগ্ধা। বাইরের ঘরে বেরিয়ে এসে জানালা দিয়ে তাকায় পাশের বাড়ির দিকে।


ভীষণভাবে চমকে ওঠে স্নিগ্ধা, তাড়াতাড়ি পর্দা টেনে বসে পড়ে নিচে। একটু পরে পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে, দু আঙ্গুল দিয়ে খুব অল্প একটু ফাঁক করে নজর দেয় পাশের বাড়িতে। পাশের বাড়ির ছোট ছেলে সেদিন অফিস যায় নি। কাকু কাকিমাও বোধহয় ঘরে ছিলেন না সেদিন। ছোট ছেলের স্ত্রী স্নান সেরে ভেজা চুলে দাঁড়িয়েছিলো বারান্দায় , সেই সময় পেছন থেকে ছোট ছেলে এসে জড়িয়ে ধরেছে ওকে। ঘাড়ের কাছে ঠোঁট নিয়ে গিয়ে আদর করতে শুরু করে , হাত নেমে আসে স্নানের জলে ভেজা খোলা পেটের ওপরে, জড়িয়ে ধরে ও নিজের স্ত্র্রীকে পেছনদিক থেকে। মেয়েটা বোধহয় সুড়সুড়িতে বা আনন্দে হেসে উঠেছে খিলখিল করে। ধীরে ধীরে ছেলেটার হাত দুটো টেনে আনে মেয়েটি নিজের ব্লাউজের ওপরে। একটু পরে ছেলেটা মেয়েটাকে নিয়ে, জড়িয়ে ধরে ঢুকে যায় ভেতরে। একটু পরে আরো কিছু আওয়াজে, আদরের ঘন নিঃশ্বাস প্রশ্বাসে, মৃদু আবেশের শব্দে নিজে আর স্থির থাকতে পারে না স্নিগ্ধা। কোনোদিন যেটা করেনি, সেদিন সেটাই করে ফেলে , ফোন করে বিতানকে অসময়ে।


বিতান তাড়াতাড়ি চলে আসে ঘরে। এসে নিজের কাছে থাকা চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে এসে চেঁচিয়ে ওঠে , "কি হয়েছে , স্নিগ্ধা ? তোমার শরীর ভালো আছে তো ? "


স্নিগ্ধা বাথরুমের ভেতর থেকে চেঁচিয়ে ওঠে, "একটু এসো না ! প্লিজ। আমার কাছে একটু এসো ! "


বিতান ছুটে যায় ভেতরে , বাথরুমের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই, স্নিগ্ধা , হ্যান্ড শাওয়ারটা নিয়ে ভিজিয়ে দেয় বিতানকে। প্রথমে ভীষণ অবাক হয়ে যায় বিতান। একটু পরে নিজেও মেতে ওঠে স্নিগ্ধার সাথে আদিম উন্মাদনায়। স্নিগ্ধা যখন ধীরে ধীরে উত্তেজিত হতে শুরু করে, বিতান নিঃশেষ হয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে চরম আশ্লেষে , কেঁপে ওঠে ওর শরীর।


কয়েক মিনিট পরে স্নিগ্ধা প্রচন্ড রাগে, মারতে থাকে বিতানকে , বলে ওঠে ,"কেন বিতান ? কেন বিতান আমাকে এই শাস্তি দিয়ে চলেছো ? তুমি কি কোনোদিন,কোনোদিন আমাকে সুখী করতে পারবে না?.... আমি কি সারাজীবন এইভাবে,,,....." নগ্ন অবস্থায় বেরিয়ে চলে যায় ভেতরে স্নিগ্ধা , ভেতর থেকে বন্ধ করে দেয় বেডরুমের দরজা ।


বিতান অনেকক্ষন চুপ করে বসে ছিল বাথরুমের জলে ভেজা মেঝের ওপরে। রাগ কমে এলে স্নিগ্ধা বাইরে বেরিয়ে এসে ওকে উঠে দাঁড়াতে বলে, ওর হাতে তোয়ালেটা তুলে দেয়। বিতান হঠাৎ করেই স্নিগ্ধাকে টেনে নেয় নিজের কাছে সজোরে। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, "তুমি কি বললে একটু আগে ? আমি, আমি কোনোদিন তোমাকে সুখী করতে পারিনি? তাহলে রাতে যে আমাকে বলো, তোমার থেকে সুখী নারী আর কেউ নেই ! সে সব কি মিথ্যে ? "


নিজেকে বিতানের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে স্নিগ্ধা, "মিথ্যে, মিথ্যে....সব মিথ্যে। অভিনয় বোঝো ? বোঝো তুমি অভিনয় কাকে বলে ?"


বিতান কোনো কথা না বলে একটু পরে বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে। সেদিন অনেক রাত করে ফিরেছিলো বিতান বাড়িতে।



++++++++++


   

সেই ঘটনার মাস দুয়েক পরে, স্নিগ্ধার হঠাৎ করেই শরীর খারাপ লাগে ! কিরকম একটা বমি বমি ভাব, সারা শরীর ভারী ভারী লাগে ওর। প্রায় মাস দুয়েক পিরিয়ড ও মিস করে। ভয়ে তাড়াতাড়ি বিতানকে বলে ও। বিতান ওকে নিয়ে হসপিটালে আসে। ডক্টর কিছু টেস্ট করে হেসে বলে ওঠে ,"আনন্দের কথা তো , আপনারা মা বাবা হতে চলেছেন। আর কোনো আজে বাজে চিন্তা নয় ! "


প্রেগন্যান্সির সময়ে বিতান ভীষণ ভালোভাবে রেখেছিলো স্নিগ্ধাকে। নিয়ম করে দুজন কাজের লোক আলাদা ভাবে রেখেছিলো ওর দেখাশোনা করার জন্য। নিজেও তাড়াতাড়ি অফিস থেকে চলে আসতো, গভীর রাতে যদি কিছু খেতে ইচ্ছে হতো স্নিগ্ধার, নিজের হাতে বানিয়ে আনতো ! মাঝে মাঝে আইসক্রিম , বা অন্যকিছু খেতে ইচ্ছে হলে , গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়তো বিতান, গভীর রাতেও, ঠিক জোগাড় করে এনে দিতো, স্নিগ্ধার যা চাই।


এতো কিছুর মাঝেও স্নিগ্ধার মনে কোনো শান্তি ছিল না। বার বার মনে হতো, এর পর কি ? ছেলে বা মেয়ে, যাই হোক না কেন, একটা সময়ের পরে তো বড়ো হয়ে যাবে। তারপরে ? আমি? আমার কি হবে ?আমি তো এইরকম সংসারের স্বপ্ন দেখিনি ! আমি নিজেও যে কিছু করতে চাই, নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে , প্রতিষ্ঠিত হতে চাই, চেয়েছিলাম। কিছুই তো হতে পারছি না। আর তার সাথে আমার আর বিতানের এই ভাঙা সম্পর্ক ? আমি কেন সবসময় অন্যদের কথা ভাববো ? আমার নিজের কথা ভাবার কি কোনো অধিকার নেই আমার ? বিয়ে করেছি বলেই কি সবসময় স্বামীর কথা , তার চাহিদার কথা, তার ভালোলাগা,খারাপ লাগা, এরপরে বাচ্চা - এইসব নিয়েই ভাবতে হবে ? নারী হিসেবে কবে পূর্ণতা পাবো আমি ? লোকে বলে বাচ্চার জন্ম দেওয়াতেই একটা নারীর পূর্ণতা। সত্যিই কি তাই ? এতো সোজা পরিপূর্ণ হওয়া ? আমি, আমার অস্তিত্ব আজ কোথায়? স্নিগ্ধা কোথায় এখানে? সেও কি হারিয়ে যাবে অন্যদের মতো, আর ছেলেভোলানো কথা মেনে নেবে ?


এইসব ভেবে ভেবে আরো অসুস্থ হয়ে পড়তে থাকে স্নিগ্ধা !



++++++++++



স্নিগ্ধার মন খারাপের কারণ বুঝতে পারে বিতান , তবুও চেষ্টা করে ওকে হাসি খুশি রাখার। এইসময় একদিন বিতান স্নিগ্ধার বাবা মাকে নিয়ে আসে অফিস থেকে ফেরার সময়। স্নিগ্ধার মা , মেয়েকে দেখেই ছুটে আসে ওর কাছে। জিজ্ঞেস করে , "কি হয়েছে তোর ? চোখের তলায় এরোকম কালি কেন ? মনে হচ্ছে কত রাত ঘুমোস নি। তুই, তুই চল আমাদের সাথে। "


স্নিগ্ধা যেতে অস্বীকার করে। তখন ওর মা বলে, "ঠিক আছে, আমিই থাকি এখন কিছুদিন তোর কাছে।" বিতানকে ডেকে জিজ্ঞেস করে, "আমি থাকলে কোনো অসুবিধে নেই তো ? "


"কি যে বলছেন মা ? অসুবিধে কিসের ? আপনি থাকলে খুব ভালো হয়। আমি তো কবে থেকে ওকে বলেছি। " উত্তর দেয় বিতান।


পরের দিন বিতান অফিসে চলে গেলে স্নিগ্ধার মা মেয়ের কাছে এসে বলে ওঠেন ," বল তো এবার ! কি হয়েছে তোর ? তুই কি কিছু নিয়ে চিন্তা করছিস? ভাবছিস ? আমাকে বল ! আমি না তোর মা ? "


স্নিগ্ধা ধীরে ধীরে সব কিছু খুলে বলে , বলে বিতানের শারীরিক ভালোবাসায় অক্ষমতার কথা , বলে বিতানের সবসময় ওর পাশে থাকার কথা , বলে বিতানের প্রেমের কথা।


সব শুনে মা বলেন ,"ধুর পাগলী ! তুই বেশি আজেবাজে ভাবছিস। আমাদের জামাই তো কত ভালো, তোকে কত ভালোবাসে। একটা দিক না হয় একটু কমজোরি ! সে তো অনেকেরই হয়.....তুই কি ভেবেছিস , আমিও ওই দিক থেকে খুব সুখী ছিলাম? আমরা মেয়েরা কি হতে পারি এইভাবে সুখী ? ওরে, আসল হলো মন। মন দিয়ে সংসার কর ! আর এসব মাথা থেকে বের করে দে। বুঝেছিস ? স্বামীর মঙ্গলকামনা, বাচ্চার ভালোমন্দ , এইসবেই নারীর নারী জন্ম সার্থক। "


মা যে মুখ দিয়েও সেই একইরকম সব কথা শোনার পরে আরো ভেঙে পড়ে স্নিগ্ধা। বারেবারে নিজেকে প্রশ্ন করতে থাকে , তাহলে মানুষ হিসেবে আমার অস্তিত্ব কোথায় ? আজ যদি উল্টো ঘটনা ঘটতো বিতানের সাথে, ও কি করতো ? নাকি এই সমাজে একটা পুরুষ যা ইচ্ছে করতে পারে, কিন্তু একটা নারী, সে তার নিজের চাহিদার কথা - কামনা বাসনার কথা বললেই সেটা খারাপ?


কিন্তু মুখ ফুটে মা কে আর কিছু বলতে পারে না স্নিগ্ধা।


নির্দিষ্ট সময়ে একটি ছেলে জন্ম নেয় , স্নিগ্ধা ওর নাম রাখে শৌনক ! সারাদিন ওর দুস্টুমি, ওর পেছনে দৌড়োনো, ছেলের সাথে গল্প করা, ওর ন্যাপি চেঞ্জ করা , ওকে নিয়ে বেরোনো, এইসব করতে করতেই স্নিগ্ধার সময় কেটে যায়। কাজের জগৎ থেকে আবার একটু দূরে সরে আসে এই সময় স্নিগ্ধা। শৌনক এর যখন আড়াই বছর বয়স, হঠাৎ করে ওর পুরোনো ব্যান্ড মেম্বারদের একজন - মলয় ওর সাথে যোগাযোগ করে। ও একটা সিনেমার গান তৈরী করছে, আর ফিমেল লিড হিসেবে স্নিগ্ধা ওর প্রথম পছন্দ। বিতানকে গিয়ে জানায় স্নিগ্ধা। বিতান ভীষণ খুশি হয়।


বেশ কয়েকদিন ধরে ওর প্র্যাক্টিস চলে, আর সেই সময় বিতান অফিস থেকে ছুটি নিয়ে বাচ্চাটাকে সামলায় ! প্র্যাক্টিস এর শেষ দিনে স্নিগ্ধা যখন বেরিয়ে আসতে যায় , হঠাৎ দেখে সিনেমার প্রোডিউসার বাইরে মলয়ের সাথে কথা বলছে , মাঝে মাঝেই স্নিগ্ধাকে দেখিয়ে কিছু বলে যাচ্ছে আর মলয় হাত পা নেড়ে কিছু বোঝাতে চাইছে ওনাকে। একটু পরে প্রোডিউসার বেরিয়ে গেলে মলয় মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে পাশে রাখা চেয়ারে। স্নিগ্ধা মলয়ের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে ,"কি হলো ? কোনো প্রব্লেম ? "


"আর বলিস না। প্রোডিউসার বলছে ওর নিজের মেয়ে দিয়ে গান গাওয়াতে হবে তোর গানটা ! আমি জানি ওর মেয়ে গান গাইতে পারে না। আমি বললাম। সে আমাকে বলছে অটো টিউন আর সফটওয়্যার ব্যবহার করতে ! আজকাল এভাবেই সব হচ্ছে রে। আমি যে কি বলি তোকে। " চুপ করে যায় মলয়। 


স্নিগ্ধার ভেতরে ভেতরে একটা রাগ জমতে থাকে , অনেক কষ্টে সেটাকে দমিয়ে মলয়ের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে ,"কি আর করবে বলো ! এখন উনি টাকা ঢালছেন, ওনার ইচ্ছেতেই সব হবে। তবে এই কয়েকদিন প্র্যাক্টিস করে আমার নিজের অনেক উপকার হয়েছে। আবার সেই পুরোনো ভাইবটা ফিরে পাচ্ছি। আচ্ছা, আমি আসি তাহলে। "


বেরিয়ে আসার সময়ে স্নিগ্ধা শুনতে পায় মলয় চেঁচিয়ে বলছে ওর উদ্দেশ্যে ,"তুই চিন্তা করিস না। আমি পরে যেটা করবো, সেখানে তুই অবশ্যই গান করবি। আমি কথা দিচ্ছি। "


কোনো কথা না বলে গগলস টা চোখে লাগিয়ে বেরিয়ে আসে স্নিগ্ধা !


সেদিন বাড়িতে ফিরে আসার পরেই , বিতান ওর দিকে তাড়াতাড়ি হেঁটে আসে। বলে ওঠে,"এই স্নিগ্ধা ! কখন থেকে তোমার মোবাইল ট্রাই করছি। আমাকে তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে। ফ্যাক্টরিতে আগুন লেগেছে। শৌনক কাজের মেয়েটার কাছে আছে। আমি আসি। "



++++++++++



হঠাৎ সবকিছু কিরকম আগুনের মতো জ্বলতে থাকে স্নিগ্ধার সামনে , প্রচন্ড রাগে চেঁচিয়ে ওঠে স্নিগ্ধা ,"শয়তান, তুমি একটা শয়তান ! তোমার জন্যই আজ আমার এই অবস্থা। কোনো কিছুই হলো না আমার জীবনে। না ঠিক করে স্বামীর সোহাগ পেলাম, না কাজের কাজ কিছু হচ্ছে। তোমার আর কি, ঠিক নিজের মতো করে লাগিয়ে সুখ পাচ্ছ। একবার ও ভেবে দেখেছো আমার কথা ? সারাদিন এই বাচ্চার পেছনে আমার সবটুকু সময় দিয়ে আমি সব ভুলে থাকতে চেষ্টা করছি সব কিছু। কিন্তু তুমি ? শুধু গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছ ! পুরুষ, তাই না ? পুরুষ তো, তোমাদের জন্য সব মাফ, আর মেয়েদের যখন যেভাবে খুশি ব্যবহার করতে পারো তোমরা , তাই না ? আমাদের ইচ্ছে অনিচ্ছে বলে কিছু থাকতে নেই ! আমাদের চাহিদা , ভালোলাগা, খারাপ লাগা কিছু হতে নেই ? যাও, বেরিয়ে যাও আমার চোখের সামনে থেকে ! একটুক্ষন ছেলেকে রাখতে হয়েছে বলে বাবুর কি মেজাজ ! কে জন্ম দিয়েছিলো ওকে ? কেন সেদিন ভেতরে..."


তাড়াতাড়ি এগিয়ে আসে বিতান স্নিগ্ধার কাছে, ওর মুখে হাত দিয়ে চেপে বলে ওঠে ,"কি হয়েছে তোমার? এরকম করে কথা বলছো কেন ? প্র্যাকটিসে কিছু হয়েছে ? আর আমি কি কখনও বলেছি শৌনক কে রাখতে আমার কোনো অসুবিধে হচ্ছে ? ফ্যাক্টরিতে আগুন লেগে গেলো বলেই না আমাকে..."


জোর করে বিতানকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে ওকে লাথি মেরে বলে ওঠে স্নিগ্ধা ," না না ! তুমি তো মুখে কিছুই বলো না ! সব কাজে বুঝিয়ে দাও। সেটাই তো সমস্যা ! আর আমার হয়েছে জ্বালা , আমি মরি না কেন ? মরে গেলেই তো শান্তি ! " বিতানকে ঠেলে সরিয়ে ভেতরে চলে যায় স্নিগ্ধা ! কিছু বুঝতে না পেরে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে বিতান।             



++++++++++

 


সেই শুরু , বিতান আর স্নিগ্ধার জীবনে সৃষ্টি হয় একটা ফাটলের; শুধু ছোট একটা সুতো আটকে রাখে ওদের দুজনকে - সে হলো শৌনক। বাইরে থেকে দেখে বোঝা যেত না ওদের সম্পর্কের পরিণতি, উল্টে অনেকেই বিতান আর স্নিগ্ধাকে আদর্শ দম্পতি হিসেবে দেখতো - জানতো - মানতো! কিন্তু ভেতরে ভেতরে যে ঘুনপোকা লেগে সেটাকে কুরে কুরে শেষ করে দিচ্ছে, কেউ জানতো না।

 

গুমরে গুমরে ঘুরে বেড়াতো ওরা দুজনে, কোনো এক অলীক সুখের সন্ধানে বা মায়ামৃগের পেছনে ধাওয়া করে। ভেসে উঠতো ওদের সম্পর্কের পুড়ে যাওয়ার কটু গন্ধ - আকাশে বাতাসে।

 

মাঝে মাঝেই কথায় কথায় স্নিগ্ধা আর বিতানের ঝগড়া লেগেই থাকতো সেই দিনগুলোতে। তখন স্নিগ্ধার হাত উঠে আসতো বিতানের গায়ে। প্রথম প্রথম বিতান অসহায় ভাবে রেগে উঠতো, বুঝে উঠতে পারতো না কি করবে , নিজেও হাত তুলতো স্নিগ্ধার গায়ে। পরের দিকে বিতান চুপ করে সব সহ্য করতো, জড়িয়ে ধরতো স্নিগ্ধাকে জোরে, চেপে নিজের বুকের মাঝখানে। দুর্বল, মানসিকভাবে ক্ষত বিক্ষত স্নিগ্ধা হাত পা ছুঁড়ে, আস্ফালন করে,একটু পরে নিজেই ক্লান্ত হয়ে ভেঙে পড়তো কান্নায়।

 

বিতানকে জড়িয়ে ধরে অঝোর ধারায় বেরিয়ে আসতো চোখের জল।

 

বিতান ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলতো, "পাগলীর মতো কেন করছো তুমি ? কেন এতো রাগ তোমার আমার ওপরে ? "

 

স্নিগ্ধা কাঁদতে কাঁদতে,বিতানের বুকে মুখ ঘষতে ঘষতে বলে উঠতো ,"বোঝো না তুমি? বোঝো না ? তোমাকে আমি কত ভালোবাসি? আর তোমাকে এতো ভালোবাসি বলেই তো তোমার ওপরে আমার সব রাগ , অভিমান। আর কার ওপরে আমি রাগ দেখাবো? আমাদের ভাগ্যের ওপরে, ওই আকাশের ভেতরে লুকিয়ে থাকা ভীরু কাপুরুষ ভগবান নামের লোকটাকে? ও কেন তোমাকে সম্পূর্ণ ভাবে গড়ে তুলতে পারে নি? কেন? না কি তোমার পূর্বজন্মের কোনো পাপের ফল এইটা?

 

বিতান চেঁচিয়ে উঠতো ,"কি বলছো কি স্নিগ্ধা? পূর্বজন্ম ? ভগবান ?"

 

"আমি, আমি সব জানি বিতান। ভগবান ঈশ্বর এসব কিছুই হয় না। কিন্তু এইরকম সময়ে, কোথায় যাবো ?কি করবো, কিছুই তো মাথায় আসে না আমার। আমি , আমি কি যে করি , কোনো কিছুই হচ্ছে না আমার জীবনে। মনে হচ্ছে আমি যেন আটকে গেছি সবকিছুর মধ্যে। আমাদের বিয়ে - বিয়ের পরের জীবন - তারপর শৌনক - তোমার কাজ - আমার কোনো কিছু কাজ ঠিকভাবে না হওয়া, তার মাঝে আমার এই অপূর্ণতা, আমাদের, আমাদের একটা সুখী দম্পতি হয়ে ওঠার পথে কাঁটা হয়ে থাকা তোমার সমস্যা, মানসিকভাবে তোমার ভেঙে পড়া, তোমার কান্না....আমি আর পারছি না , হাঁপিয়ে উঠছি বিতান। আমাদের প্রেমের সময়টাই সব থেকে ভালো ছিলো ! কারোর কাছে কোনো এক্সপেক্টশন ছিলো না। শুধু ফোনে কথাবার্তা, মিষ্টি সুন্দর স্বপ্নের ভেলাতে ভাসতাম আমরা দুজনে তখন। আর এখন এই একঘেয়ে ঘ্যানঘ্যানে সংসারে আমি , আমি আর পারছি না। " বলে ওঠে স্নিগ্ধা।

 

"একটা কাজ করলে কেমন হয় স্নিগ্ধা ? চলো না, আমরা কোথাও থেকে ঘুরে আসি, একসাথে তিনজনে ? হয়তো ভালো লাগবে, হয়তো আবার সব কিছু আগের মতো করে আমরা ফিরে পাবো ? " উত্তর দেয় বিতান।

 

 

++++++++++

 

 

কয়েকদিন পরে, পুরীতে এসে হাজির হয় তিনজনেই। সামনে বিশাল সমুদ্র, ঘন নীল আকাশ। ওরা যে হোটেলে ছিলো, সেটা ছিলো সমুদ্রের একদম ধারে। হোটেলের রুমের বিশাল বারান্দা থেকে শোনা যাচ্ছিলো সমুদ্রের গর্জন, দেখা যাচ্ছিলো উত্তাল ঢেউয়ের ওঠা নামা। হোটেলে এসেই শৌনকের বায়না, "বাবা, সমুদ্রে স্নান করবো আজকে। তুমি আমাকে ধরে থাকবে , কেমন ?"


স্নিগ্ধা এসে বিতানকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করে ,"আজ আমাকে স্নান করিয়ে দেবে? সমুদ্রে? জানো, আমি না কোনোদিন সমুদ্র দেখিনি আগে। পাহাড়েই বড়ো হয়ে ওঠা, ওখানেই সব। সমুদ্রে এই প্রথমবার এলাম আমি। আমার যে কি ভালো লাগছে বিতান। "


বিতান হাসতে হাসতে কোলে তুলে নেয় শৌনককে, বলে ওঠে ,"ঠিক আছে। আজ মা আর ছা , দুটোকেই আমি সমুদ্রের জলে চুবিয়ে আনবো ! "


বালিতে জলে হুড়োহুড়ি করে কেটে গেলো সময়। বিকেলে ঘুম থেকে উঠে শৌনক খুব বায়না করছিলো বলে, ওকে কাঁধে চড়িয়ে বিতান নেমে আসে সমুদ্রের বালির ওপরে। স্নিগ্ধা বলে, "তোমরা যাও ! আমি একটু পরে আসছি। "


বিতান আর শৌনক খেলছিলো সমুদ্রে বালির ওপরে। শৌনক দৌড়োচ্ছিলো আগে আগে, বিতান ওকে ধরার চেষ্টা করছিলো, ইচ্ছে করেই বিতান বারবার পিছিয়ে পড়ছিলো, আর শৌনক হেসে উঠছিলো খিলখিল করে, ছোট্ট দুহাত ডানার মতো করে ছড়িয়ে দিয়েছিলো দুদিকে। হঠাৎ একটা মিষ্টি গন্ধে বিতান ঘুরে তাকায় পেছনের দিকে।


স্নিগ্ধা হেঁটে হেঁটে আসছে ওর দিকে, ওর পরনে ছিলো সেদিন সমুদ্র-ঘন নীলরংয়ের শাড়ি; মাথার চুলগুলো না বেঁধে উড়িয়ে দিয়েছিলো হাওয়ার সাথে, শাড়ির আঁচলও উড়ছিলো ওর হাঁটার ছন্দে, ওর সাথে সাথে। বিতান কিছু বলার আগেই শৌনক ছুটে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে। স্নিগ্ধা হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে ওর সামনে, ওকে আদর করে দেয়। ধীরে ধরিয়ে উঠে দাঁড়ায় স্নিগ্ধা, অবাক - বিস্মিত বিতানের কাছে এসে, বিতানের পাশ দিয়ে হেঁটে চলে যেতে যেতে ধীরে ধীরে ওর কানে বলে ,"কি হলো মশাই? একদিন চুপ করে কেন ? আমার হাত ধরে কে হাঁটবে এই গোধূলী বেলায় ? "


বিতান ঘোর থেকে বেরিয়ে এসে, দৌড়ে গিয়ে ধরে স্নিগ্ধার হাত, দুজনে হাঁটতে থাকে ধীরে ধীরে সমুদ্রের জলে পা ভিজিয়ে। আগে আগে হাঁটতে থাকে শৌনক।


সমুদ্রের ধারে, সমুদ্রের জলে পা ভিজিয়ে বসে, হাতে হাত রেখে গল্প শুরু করে দুজনে। কত যে কথা জমে গিয়েছিলো এই কয়েক বছরে, বিতান কখনও বুঝতেই পারে নি ! কত কথা, স্নিগ্ধা বলে যাচ্ছিলো, আর বিতান শুধুই হাঁ করে দেখছিলো স্নিগ্ধাকে, শুনছিলো ওর কথা। এর মাঝে দূরথেকে ভেসে আসে সন্ধ্যা আরতির ঘন্টার আওয়াজ। 


শৌনক ওদের দুজনের সামনে খেলছিলো বালি নিয়ে। বালি দিয়ে পাহাড় বানাতো, সমুদ্রের ঢেউ এসে ভেঙে দিতো সেই পাহাড়। ওই ভাঙা গড়ার খেলাটাই ওর কাছে ছিলো আনন্দের , মজার। ও লাফিয়ে খিলখিল করে হাসতো ওই সময়ে। বালির ক্যাসেল ভেঙে যাওয়ার পরে আবার নতুন উদ্যমে সৃষ্টির কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়তো শৌনক। 


সেই তিনদিন ভীষণ ভালো কাটে তিনজনের একসাথে। রাতে ঘুমোনোর সময়, স্নিগ্ধা নিজে থেকে বিতানকে টেনে নিয়েছিলো নিজের কাছে , বিতান পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে স্নিগ্ধাকে, স্নিগ্ধা ওর হাত টেনে নেয় নিজের বুকের ওপরে।


ফিরে আসার দিন, বিতান বুঝতে পারে, স্নিগ্ধাকে হয়তো সময় কম দিচ্ছে ও। আরো বেশি সময় ওর থাকা উচিত স্নিগ্ধার সাথে। ট্রেনে, রাতের অন্ধকারে, যখন স্নিগ্ধা আর শৌনক ঘুমিয়ে পড়েছিলো, বিতান উঠে বসে দেখছিলো স্নিগ্ধাকে অপলক দৃষ্টিতে। বারবার নিজেকে ধিক্কার দিচ্ছিলো, কেন কেন ওর সাথে ভগবান এই খেলাটা খেললো ? ওর নিজের ও তো একটা সুস্থ স্বাভাবিক জীবন হতে পারতো অন্য দম্পতিদের মতো।


ফিরে আসার পরে কিছুদিন বিতান আবার প্রচন্ড ব্যস্ততার মধ্যে থাকে। যে প্রমিস করেছিল নিজের কাছে, স্নিগ্ধা আর শৌনককে আরো সময় দেবে, সেই সময়টাই বের করতে পারছিলো না কিছুতেই।


এইসময়, এইসময় হঠাৎ করেই, একদিন খোলা বাতাসের মতো, স্নিগ্ধার জীবনে আসে পারভীন।


 

++++++++++

 

 

ব্যান্ড মেম্বার মলয়, স্নিগ্ধাকে একদিন সকালে ফোন করে। ফোনে বলে ,"তুই ঘন্টা দেড়েকের মধ্যে আসতে পারবি একবার আমার অফিসে ? একটা নতুন সিনেমার কথা হচ্ছে , আমি ওই সিনেমার সব গান তোকে দিয়েই গাওয়াবো ঠিক করেছি। "

 

স্নিগ্ধা কোনোকিছু প্রত্যাশা না রেখেই উত্তর দেয়, "কি হবে ? সেই তো প্র্যাক্টিস করবো, তারপরে শেষে এসে....."

 

"না না , সেরকম আর কিছু হবে না। আমি কনট্র্যাক্ট করিয়ে নিয়েছি। আমার কথাই শেষ কথা এখানে। আর সিনেমাতে হিরো কে জানিস ? পারভীন ! একবার এখানে সুযোগ হয়ে গেলে, তুই বুঝতে পারছিস ব্যাপারটা ? " মলয় ফোনে ওকে বুঝিয়ে দেয়, কিভাবে কোথায় আসতে হবে !

 

স্নিগ্ধা তাড়াতাড়ি করে সেজে, ঘরের সারাক্ষণের কাজের লোকটির হেফাজতে শৌনক কে রেখে বেরিয়ে আসে বাড়ি থেকে।

 

ভাবতে থাকে , পারভীনের সাথে কাজ ? সেই পারভীন, যাকে, আমি একসময়ে প্রচন্ড অপমান করে নিজের জীবন থেকে বের করে দিয়েছিলাম, সেই পারভীন, যাকে আবার, বিতানের সাথে বিয়ের সময় দেখেছিলাম, সেই পারভীন - যে এখন একজন সুপারস্টার ! দেখা যাক কি হয়।

 

নির্দিষ্ট সময়ে মলয়ের অফিসে আসার পরে, মলয় ওকে গানগুলো বুঝিয়ে দেয়। একটা রবীন্দ্রসংগীত , দুটো পার্টি সং, একটা লোকগীতি আর একটা ভীষণ মন কেমন করা গান - ঘনিষ্ঠতার গান, অন্তরঙ্গ হওয়ার গান রয়েছে সিনেমাটিতে।

 

মলয় বলে ওঠে, "সবার প্রথমে আমরা এই ইনটিমেট যে গানটা আছে, সেটাই রেকর্ড করবো। তোর গলায় একটা ব্যাপার আছে, একটা হাস্কি - ডাস্কি টোন আছে তোর গলায়। আর গানের মাঝে কিছু আওয়াজ, মানে মিলনের আকুতি, যৌনতা মেশানো কিছু পাঞ্চ তোকে দিতে হবে। "

 

স্নিগ্ধা বেশ কিছুক্ষণ পরে বলে ওঠে,"না মলয় ! আমি পারবো না এই গানটা করতে। এই গানের কথা, সুর, আর তুমি যে সব পাঞ্চের কথা বলছো - হবে না ! মানে আমার কিরকম একটা..."

 

 

++++++++++

 

 

"লজ্জা করছে ? কেন স্নিগ্ধা জি ? লজ্জার কি আছে ? মানে আপনি কি জানেন না এইসব কিছু , না কি হাসব্যান্ডের কাছ থেকে পারমিশন নিতে হবে ? "

 

চমকে ঘুরে পেছনে তাকায় স্নিগ্ধা। পেছনে দাঁড়িয়ে পারভীন। পারভীনকে দেখে মলয় এগিয়ে যায় , ওকে ভেতরে নিয়ে আসে। পারভীনের দুস্টুমি মাখা চোখ দেখে হঠাৎ যেন একটা জেদ চেপে যায় স্নিগ্ধার মধ্যে। ও দৃঢ় স্বরে বলে ,"ওকে , কবে রেকর্ড করতে হবে ? আর প্র্যাক্টিস কখন করবো ? রেকর্ডিংয়ের আগে, আমার পুরো গানটা চাই। "

 

সেই শুরু পারভীনের সাথে আবার নতুন করে জড়িয়ে পড়া।

 

 

++++++++++

 

 

মেহেক জিজ্ঞেস করে, "পারভীন ? আপনি কোন পারভীনের কথা বলছেন ? ওই সিনেমা করে ? " বিতান উত্তর দেয় ,"ঠিক ধরেছেন। আমি ওর কথাই বলছি। "

 

"সরি বিতান, আমি আসলে বুঝতে পারিনি প্রথমে। মানে, আমি সিনেমা দেখি না একদম। আমার না টাকা খরচ করে সিনেমা দেখতে একদম ইচ্ছে করে না। কেন জানেন ? আমার মনে হয় এই সব এক্টর এক্ট্রেসরা সিনেমা করে যে এতো এতো টাকা পয়সা কামায়, ওরা কি, তার সত্যি যোগ্য? এদিকে ওরা প্রোগ্রাম করছে, পূজোর সময় এসে ফিতে কাটছে , সিনেমা করছে , কোটি কোটি টাকা কামাচ্ছে , আর তারপরে বাইরে ঘুরতে যাচ্ছে , লাক্সারিয়াস লাইফ কাটাচ্ছে। কিন্তু সেটা কাদের টাকা পয়সায় ? আমাদের উপার্জিত , ঘাম ঝরানো টাকা পয়সায় ! অনেক কিছুই তো ওদের মেকি , ওদের পুরো জীবনটাই হয়তো এইরকম। আর আমরা ওদের কে নিয়ে উন্মাদনায় মেতে উঠি। কারোর কারোর নামে মন্দির তৈরী হচ্ছে, কাউকে দেখার জন্য লোকজন কোন ভোর থেকে হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকে তার বাড়ির সামনে। এগুলো আমি বুঝতে পারি না একদম। আমাদের মতো, ওরাও রক্ত মাংসের মানুষ। আমরা যেমন আমাদের বিভিন্ন রকম কাজ করে বেঁচে আছি, ওরাও ওদের যেটা প্রোফেশন, সেটাই করছে। সেটা নিয়ে এতো মাতামাতি - এইটাই আমার কাছে আশ্চর্যের। তাই আমি ঠিক খুব একটা সিনেমা দেখতে পছন্দ করি না। " উত্তর দেয় মেহেক। একটু পরে আবার মুচকি হেসে বলে ,"তবে এগুলো সব আমার মনের কথা। অন্যদের কথা আমি জানি না। "

 

হেসে ওঠে বিতান হা হা করে। একটু পরে মেহেকের হাতের ওপরে হাত রেখে বলে , "ঠিক আছে। আপনার কথার পেছনেও ভালোই যুক্তি আছে। তবে আমাদের গল্পটা সেটা নয় ! স্নিগ্ধা আর পারভীন কাজ করতে করতে খুব কাছাকাছি চলে এসেছিলো। সেটা কবে, কিভাবে, আমি জানি না ! হয়তো পারভীনের একটা সিনেমায় গান করার সময়েই। ওই সিনেমায় একটা ভীষণ ইন্টিমেট ধরণের গান ছিলো ! সেই গানটা গেয়ে আমাকে যখন শুনিয়েছিল স্নিগ্ধা পরে, আমি ওর চোখে অন্যরকম একটা ভাষা দেখতে পাই। সেই ভাষা, যেটা দিয়ে যে কোনো পুরুষকে নিমেষের মধ্যে আহত করা যায় ! হয়তো সেটাতেই পারভীন ও.....সেদিনের পর থেকে মাঝে মাঝেই রাতে বেরিয়ে যেত স্নিগ্ধা। বলতো রেকর্ডিং আছে, গানের। আমিও প্রথমে কিছুই বলতাম না। হাজার হোক, ওটাই ওর কাজ, ভালোলাগা। আমি কেন বাধা দেবো ? আর আমি শুনেছিলাম অধিকাংশ রেকর্ডিং স্টুডিও গুলো রাতেই গান রেকর্ড করে। এইভাবে কেটে যায় বেশ অনেকটা সময়। ওই সিনেমাটার গান গুলো বেশ হিট হয়েছিলো। ওর পরে বেশ কিছু ভালো হিট গান ও গায় স্নিগ্ধা সেই সময়, অন্য কিছু সিনেমার জন্য। ও এর-ই মাঝে, প্রোগ্রাম ফাংশন করা শুরু করে আবার। বিভিন্ন উৎসবে, ফাংশনে, প্রোগ্রামে ও গান করতে শুরু করে। আমার আজও মনে আছে সেই অভিশপ্ত দিনটা। " চুপ করে ওঠে বিতান। তাকিয়ে থাকে বাইরের দিকে।

 

মেহেক বুঝতে পারে বিতানের কষ্ট হচ্ছে এই কথাগুলো আবার মনে করতে। হৃদয়ের গভীর গোপন কুঠুরি থেকে সেই সব কথা খুঁড়ে বের করে আনতে গিয়ে নিজেই নিজেকে ক্ষত বিক্ষত করে চলেছে বিতান। ও চুপ করে থাকে। এখন কিছু বলা আর সাজে না। ও মনেপ্রাণে চাইছে বিতান যেন নিজেকে সম্পূর্ণ ভাবে উম্মুক্ত করে ওর সামনে , তাহলেই ও শান্তি পাবে। এতো বছর ধরে এইসব ভাবনা জোর করে কবর দিয়ে রেখেছিলো মনের গভীরে , নিজেকে অসুস্থ করে তুলেছে ও।

 

একটু পরে বিতান দীর্ঘ একটা শ্বাস নিয়ে ধীরে ধীরে বলে ওঠে , "একসপ্তাহ পরেই ছিলো শৌনকের জন্মদিন। সেদিন আমাদের একসাথে রাতে বেরোনোর কথা ছিলো ! আমি আর শৌনক অপেক্ষা করছিলাম বাড়িতে। তখন প্রায় সন্ধে সাড়ে আটটা। হঠাৎ বাইরে গাড়ির আওয়াজ। আমি দেখি পারভীনের কাঁধ জড়িয়ে নামছে স্নিগ্ধা। আগেই কানাঘুষো একটা খবর শুনেছিলাম , কিন্তু কখনও পাত্তা দিই নি। কিন্তু সেদিন আমি দেখলাম, ওই অন্ধকারের মধ্যে দিয়েও - গাড়ি থেকে নেমে পারভীনকে জড়িয়ে দুজন দুজনকে চুমু খেলো অনেকক্ষণ ধরে, ঠোঁটে ঠোঁট রেখে, ঠিক যেন নতুন প্রেমিক প্রেমিকা। স্নিগ্ধার শাড়ির ওপরে, ব্লাউজের ওপরে উঠে আসে পারভীনের হাত। আমার মাথা যেন কাজ করা বন্ধ করে গিয়েছিলো সেদিন। মানছি, আমি হয়তো স্নিগ্ধাকে সেই সুখ দিতে পারি নি। কিন্তু তা বলে এতটা, এতটা নিচে নেমে যাবে স্নিগ্ধা ? ও আমাকে ডিভোর্স দিয়ে যার সাথে, যা খুশি করতে পারতো , যেখানে খুশি থাকতে পারতো ! ওকে তো আমি কতবার বলেছিলাম আগে ! স্নিগ্ধা একটু পরে, পারভীনকে ছেড়ে, শাড়ি, আঁচল সব ঠিক করে ওপরে উঠে আসে। পারভীন গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যায়। আমাকে আর শৌনককে দেখেই হেসে বলে ওঠে , 'সরি। আমার একটু লেট হয়ে গেলো। তোমরা রেডি ? আমাকে একটু সময় দাও, আমি ফ্রেশ হয়ে, ফিরে আসছি। ' আমি শৌনককে ডেকে বললাম 'তুমি একটু তোমার রুমে যাও তো , খেলা করো তোমার টেডি নিয়ে।' স্নিগ্ধা বোধহয় বুঝতে পেরেছিলো যে আমি দেখেছি সব। ও আমার কাছে এসে বললো, শোনো, তুমি যা ভাবছো ওরকম কিছু নয় ! আমাদের এই ইন্ডাস্ট্রিতে এভাবেই লোকজন আরেকজনের সাথে মেলামেশা করে। এতে আমাদের কাজ পেতেও সুবিধে হয়। নাহলে আমাদের গানের লাইনে এতো কম্পিটিশন , বোঝোই তো। '



++++++++++



মেহেক উঠে দাঁড়ায়, জানালার পর্দাটা সরিয়ে তাকায় বাইরের দিকে। বাইরে ঘন অন্ধকার, স্ট্রিট লাইটগুলো ছড়িয়ে যাচ্ছে হলুদ মায়াবী আলো রাস্তার ওপরে। কালো রাস্তার ওপরে কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে কয়েকটা কুকুর, মাঝে মাঝে মুখ তুলে, কান দুটো খাড়া করে শোনার চেষ্টা করছে কিছু। দূর থেকে কেউ একজন হেঁটে আসছে টলতে টলতে! ওকে দেখেই হঠাৎ করে কুকুরগুলো গা নাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ায়, তীরবেগে দৌড়ে যায় লোকটির কাছে। লোকটি বসে পড়ে রাস্তার মাঝে, পকেট থেকে বিস্কিট বের করে ছড়িয়ে দেয় ওর আসে পাশে।


মেহেক পর্দা দিয়ে, ভেতরে ফিরে আসে আবার। বিতানের দিকে তাকায় ভালো করে। বিতানের দুচোখ ভর্তি এক অদ্ভুত বিষণ্ণতায়। বিতান জলের বোতলের দিকে হাত বাড়ায়। ওর হাতের কাছে জলের বোতল এগিয়ে দিয়ে মেহেক জিজ্ঞেস করে, " কোনোদিন তোমার ইচ্ছে করে নি জানতে? কেন স্নিগ্ধা এরকম করেছিলো তোমার সাথে ? আমার তো স্নিগ্ধার ওপরে রাগ হচ্ছে এখন। "


বিষাদমাখা একটা হাসি উপহার দেয় বিতান মেহেককে। সেদিন আমি, আমি শুধু স্নিগ্ধাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, "কেন স্নিগ্ধা ? আমার সাথেই কেন করলে এরকম ? " শৌনক তখনও দাঁড়িয়ে ওখানেই।



++++++++++



স্নিগ্ধা সেই রাতে, ভেতরে রুমের দিকে পা বাড়িয়েও আবার পিছিয়ে আসে আমার কাছে , রেগে ঘুরে চেঁচিয়ে, আমার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে, "কেন ? কেন? তুমি বুঝতে পারো না? নিজেকে তুমি পুরুষ বলো? লজ্জা করে না? পুরুষত্বহীন একটা প্রাণী , পৃথিবীর বোঝা বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছো ! আর তুমি আমাকে প্রশ্ন করছো ? আমি কিছু জানি না ভেবেছো? দিনের পর দিন, রাতের পর রাত এই যে অফিসে কাজ করার নামে নিজের সেক্রেটারির সাথে ঘুরে বেড়াও, তখন কিছু না? ভালো করে শুনে রাখো বিতান , এই শরীর আমার, এর ওপরে সব অধিকার আমার নিজের। সেটা আমি কাকে দেবো, কেন দেবো , সেটা নিয়ে কোনো কৈফিয়ত আমি তোমাকে দিতে বাধ্য নই!" 


আমার কাছে এগিয়ে এসে আমার জামার কলার ধরে চেঁচিয়ে ওঠে স্নিগ্ধা , "তুমি, তুমি সারাজীবন আমাকে উপোসী করে রাখবে, সেটাতো হতে পারে না , তাই না? তোমরা ছেলেরা বাইরে গিয়ে এর ওর সাথে শুয়ে আসবে, নিজেরা মজা করবে , ফ্লার্ট করবে তখন কিছু না ! আর আমরা মেয়েরা একটু রাত করে বাইরে থেকে এলে, তখন খুব অপরাধ হয়ে গেলো? "


ও রাগে কাঁপছিলো সেদিন প্রচন্ড।


আমি ধীর ধীরে বললাম,"তুমি যার কথা বলছো, সে কিন্তু আমার থেকে অনেকটাই বড়ো ! মারিয়া আমার সেক্রেটারি হলেও, ওকে আমি নিজের দিদির মতো শ্রদ্ধা করি। আমি কখনও এরকম কিছু ভাবিনি , শুধু মারিয়া কে নিয়ে কেন, অন্য কাউকে নিয়ে কখনও এরকম কোনো ভাবনাই আমার মাথায় আসে নি। আমার সারাটা জীবন জুড়ে শুধু তুমি আর আমাদের শৌনক ! "


আমার দিকে হেসে তাকিয়ে , কটাক্ষ করে স্নিগ্ধা বলে ওঠে ,"তাই ? শুধুই দিদির মতো; নিজের দিদি তো নয়! আর আমাকে শেখাতে এসো না কিছু। আর যদি কোনো কিছু না ও থাকে , সেটা তোমার প্রবলেম - আমার নয় ! কেন বুঝতে পারছো না বিতান, আমার তোমাকে নিয়ে কোনো সমস্যা নেই , আমি জানি তুমি আমাকে কত ভালোবাসো , আমার জন্য তুমি সব কিছু করতে পারবে। কিন্তু আমাকে তুমি সেই 'সুখ' কখনোই দিতে পারবে না। আমি কি করবো বিতান? কেন আমি সাফার করবো? আমার কাছে শরীর নিয়ে কোনো লজ্জা ঢাকগুড়গুড় কিছুই নেই। আমার শরীর কতদিন উপোসী ছিলো জানো? জানো তুমি? তাহলে? কেন আমাকে বাধা দিচ্ছ? আমি, আমার তো অন্য কোনো সম্পর্ক নেই পারভীনের সাথে। আমার ওর সাথে শুধুই....কোনো মনের মিল নেই আমাদের, নেই কোনো প্রেম ভালোবাসা। আমি অস্বীকার করি সেই ভাবনাকে, যেখানে বলা হয়, নিজের স্বামী ছাড়া অন্য কেউ আমার শরীর স্পর্শ করলে আমি নষ্ট মেয়ে হয়ে যাবো ! আমাদের সমাজ একটা নারী পুরুষের মধ্যে কেন বিয়ে দেয় জানো? যাতে একটা নারীর শরীর আর মন - কোনো পুরুষের সম্পত্তি হয়ে যায়! তুমি কি আমাকে সেইরকম মনে করো? তুমি কি মনে করো আমি তোমার সম্পত্তি? তুমিই তো বলো তোমার পাশে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলতে। তুমিই তো চাও যাতে আমি সবসময় ভালো থাকি, সব দিক থেকে, সব রকম ভাবে। তাহলে কেন এখন আমার দিকে আঙ্গুল তুলছো? আমি আমার জীবনের অসম্পূর্ণতাকে সম্পূর্ণ করেছি, করছি। খিদে পাওয়া, ঘুম আসার মতোই শরীরের ও চাহিদা থাকে। সেটাকে আমি কেন অস্বীকার করবো বলতে পারো? অনেকদিন তো বাঁচলাম আমি তোমাদের সবার কথা ভেবে। একটু নিজের কথাও ভাবি ! সেটা কি অন্যায় ? "



++++++++++



আমি কিছুই বলতে পারছিলাম না স্নিগ্ধার যুক্তির সামনে। ও যা বলেছে, তার মধ্যে আমি অন্যায় কিছু পাই নি। ও তো সব সত্যি কথাই বলেছে। ভীষণ রূঢ় বাস্তব। আর আমার নিজের ও তো সমস্যা ছিলো, আছে, থাকবেও। আমি তো এক রকম অপরাধী ওর জীবনে।


তবুও আমি, এই অসম্পূর্ন আমি, এই অক্ষম আমি, ওকেই যে ভালোবাসি।


আমি যে সহ্য করতে পারছি না অন্য কাউকে ওর জীবনে। আমি, আমি কিছু করতেও পারছি না। হয়তো আমার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে স্নিগ্ধাকে খুব মারতো, ঘর থেকে বের করে দিতো। কিন্তু আমি পারিনি, মেহেক। আমি সেসব কিছুই পারিনি।


আমি শুধুই ওকে বলেছিলাম, "স্নিগ্ধা, আমরা তো বিবাহিত। তুমি আমাদের বিয়ের সম্পর্কের মাঝে, আরেকজনকে কি করে নিয়ে এলে ? নাহয়, তুমি আমাকে ছেড়ে দিতে, ডিভোর্স দিয়ে দিতে। আমি সব মেনে নিতাম। কিন্তু এখন আমি এটা কিছুতেই মানতে পারছি না।"



++++++++++



মেহেক জিজ্ঞেস করে, "আর তুমি সব কথা মেনে নিলে? কোনো প্রতিবাদ করলে না? স্নিগ্ধা তোমার বিবাহিতা স্ত্রী ! সে তোমাকে অস্বীকার করে, নিজের ইচ্ছেতে যা খুশি করছিলো, এমনকি অন্য কারোর সাথে গিয়ে...."


বিতান হেসে উঠে দাঁড়ায়, প্যান্টের পকেটে দু হাত ঢুকিয়ে, আবার এক হাত বের করে এনে মাথার চুলে এলোমেলোভাবে চালিয়ে পায়চারি করতে থাকে ঘরের ভেতরে। ধীরে ধীরে বলে ওঠে ," আপনি কথাটা খুব একটা ভুল বলেন নি মেহেক। সেদিন আমার মাথাতেও এরকম চিন্তা এসেছিলো। আর তারপরেই আবার একটা অন্য চিন্তা এসে আমার ভাবনার জগৎকে পুরো দুলিয়ে দিলো। - হঠাৎ করে আমার মনে হলো, যদি এর উল্টোটা হতো? মানে আমি একদম সুস্থ , স্বাভাবিক, আর স্নিগ্ধার কোনো সমস্যা আছে যার জন্য ও কোনোরকমভাবে মিলিত হতে চায় না আমার সাথে ! কিন্তু আমাকে খুব ভালোবাসে ! তখন, তখন আমি কি করতাম? আমি তো একজন পুরুষ, কাজের সূত্রে এদিক ওদিক যেতেই হতো মাঝে মাঝে। আমি কি সুযোগ নিতাম না? নিজের জৈবিক চাহিদা মেটাতাম না অন্য কারোর সাথে ? দেখো, এইসব ভালোবাসা - প্রেম সবকিছুই মনের ব্যাপার, মানসিক শান্তির কথা। কিন্তু আমাদের এই শরীর? একটা কথা তো মানবেন আপনি মেহেক - আমাদের যেরকম খিদে, তেষ্টা পায়, একইরকম ভাবে শরীরের চাহিদাও জেগে ওঠে মাঝে মাঝে। আর জীবন আমাদের একটাই , সেটাকে কেন একজন মানুষ উপভোগ করবে না তার সবকিছু রূপ-রং-নির্যাস দিয়ে? আর যে মুহূর্তে আমার মনে এই ভাবনাটা এলো, আমি চুপ করে গেলাম সেদিন। কোনো কিছুই আর বলতে পারিনি। "


গলার কাছে একটা কষ্ট দলা পাকিয়ে ওঠে মেহেকের। কার জন্য ? কিসের জন্য ? বুঝতে পারে না। কোনোরকমে জিজ্ঞেস করে ,"তারপর? তারপরে কি হলো? "



++++++++++

   


"তারপরে? তার পরে আর কি ! আবার রেগে ওঠে স্নিগ্ধা। চিৎকার করে বলে ওঠে ,'এটাই, এটাই তোমাদের সমস্যা। পারভীন একদম ঠিক বলেছিলো। ইউ আর আ লুসার। আসলে তোমরা চাও না একটা মেয়ে নিজের মতো করে নিজের শর্তে বাঁচুক। তাকে কোনো না কোনো গন্ডীর মধ্যে, শেকল দিয়ে বেঁধে রাখতে চাও। কেন যে তোমাকে আমি বিয়ে করেছিলাম কে জানে। ' তখন, ঠিক সেই মুহূর্তে আমার মনে হলো, পারভীন? পারভীন এখানে কেন এলো? আমাকে নিয়ে কিছু বলার অধিকার কে দিয়েছে ওকে? তার মানে, তার মানে কি স্নিগ্ধা আমাদের সম্পর্কের কথা ওর সাথে শেয়ার করেছে? আমিও চেঁচিয়ে উঠলাম, 'তোমার, তোমার এতো বড়ো সাহস যে তুমি আমাদের কথা বাইরের লোকের সামনে বলেছো ? আমাদের মধ্যে যাই হোক না কেন, তুমি সেটার মধ্যে আরেকজনকে...' আমি কেঁদে উঠলাম, লজ্জায়, রাগে, অপমানে, স্নিগ্ধার নির্বুদ্ধিতায়।


শৌনক দাঁড়িয়েছিলো পাশেই, ও নিজেও কাঁদতে শুরু করে সব দেখে। ওর হাত টেনে ধরে ভেতরে নিয়ে চলে যায় স্নিগ্ধা, বলতে থাকে, তোর বাপ একটা অমানুষ , নোংরা লোক, ওর সাথে থাকা যায় না ! তোকে নিয়ে আমি চলে যাবো অনেক দূরে, আমার সাথে। শৌনকের রুমের দরজা বন্ধ করে বাইরে বেরিয়ে এসে আমাকে কাঁদতে দেখে বলে ওঠে স্নিগ্ধা , 'শোনো, অনেক নাটক হয়েছে। তোমার সাথে আমি আর থাকতে পারবো না। আমার ডিভোর্স চাই তোমার থেকে। অনেকদিন তোমাকে সহ্য করেছি, আর পারছি না। ' আমি ধীরে ধীরে জিজ্ঞেস করলাম, ' তোমার এইসব কথা, এই সব যুক্তি, এগুলো আসলে পারভীনের , তাই না ? এগুলো, এগুলো তো আমার স্নিগ্ধার....'


আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই দেওয়ালের ওপরে রাখা একটা বড়ো ফটো ফ্রেম ছুঁড়ে মেঝেতে মারে স্নিগ্ধা। হাতের সামনে একটা ফ্লাওয়ার ভাস ছিলো, সেটাকেও জোরে মেঝেতে ফেলে দেয়। তারপরে আমার কাছে এসে আমাকে প্রচন্ড ভাবে মারতে মারতে একসময় ক্লান্ত হয়ে ভেতরে চলে যায়। একটু পরে শৌনককে নিয়ে বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে। "


শৌনককে জোর করে হাত ধরে টেনে নিয়ে, বাইরে বেরোনোর দরজার দিকে যাচ্ছিলো স্নিগ্ধা ! আমি তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়ে ওদের সামনে দাঁড়াই গিয়ে। আমি শেষবারের মতো চেষ্টা করি , বলে উঠি , "স্নিগ্ধা , প্লিজ ! এরকম কোরো না। আমাদের মধ্যে যা হয়েছে, আমরা আলোচনা করি। এভাবে রাগারাগি করছো কেন ? আর, আমি, আমি তোমাকে ছেড়ে...কি করে ? কি করে থাকবো স্নিগ্ধা? আর শৌনক? ও কি দোষ করেছে ? ও তো আমাদের দুজনের সন্তান। আমাদের ছেলে ? ওর কথাটা ভাববে না তুমি? "


আমাকে ঠেলে সরিয়ে দেয় স্নিগ্ধা ওর রাস্তা থেকে। চেঁচিয়ে ওঠে, "তোমার মতো একটা লোককে বিয়ে করেই আমার সবথেকে বড়ো ভুল হয়েছে। তখন বয়স কম ছিলো, তোমার মিষ্টি কথায় ভুলে গিয়েছিলাম সব কিছু। শৌনক শুধু আমার ছেলে। ওকে আমি জন্ম দিয়েছি, ওর সব দায়িত্ব আমার। "


দরজা বন্ধ করে বাইরে বেরিয়ে যায় স্নিগ্ধা। আবার কয়েক সেকেন্ড পরে ভেতরে এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে, আমার চোখে চোখ রেখে বলে ওঠে ,"আমাকে ছাড়া তুমি থাকতে পারবে না ? সত্যি ? না কি আমাকে ছাড়া, আমার এই শরীরটাকে না জড়িয়ে ঘুমোলে তোমার রাতে ঘুম আসবে না ? কিন্তু তোমার তো......যাই হোক। তুমি তো ফ্রি এখন। রাস্তায় পথে ঘাটে কত মেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। নিয়ে এসো তাদের , রোজ রাতে ! যার সাথে ইচ্ছে হয় ঘুমোও , শুয়ে থাকো , যা খুশি করো। কেউ বাধা দেবে না তোমাকে। আর ওদের তো টাকার বিনিময়ে নিয়ে আসবে , তাই ওদের তোমার থেকে কোনো এক্সপেক্টশনস ও থাকবে না। সেটাই তো ভালো হবে, তাই না ?"


কোনো কথা না বলে , বাইরের দরজাটা দড়াম করে বন্ধ করে বেরিয়ে গিয়েছিলো স্নিগ্ধা সেই রাতে ।



++++++++++



আবার বিতানের চোখ ভরে উঠেছে জলে। মেহেক বিতানের পাশে বসে, ওর হাতের ওপরে হাত রেখে জিজ্ঞেস করে, "কেন এতদিন এইসব কথা চেপে রেখেছিলে? কাউকে কখনো বলতে পারো নি এইসব কথা তুমি, তাই না? কেন সব সহ্য করলে সেদিন? তোমার তো কোনো ভুল ছিলো না? তুমি তো তোমার দিক থেকে একদম ঠিক ছিলে ! "


কাঁদতে কাঁদতেই, বিতান বলে ওঠে ,"আমি কি সত্যিই ঠিক ছিলাম ? আমি, আমি ও যে ভুল করেছিলাম, একমাত্র স্নিগ্ধাকে -ই ভালোবেসে। কিন্তু আমি তো সুখী করতে পারিনি কখনও স্নিগ্ধাকে। সেদিন ও যা যা বলেছিলো, সেগুলো যে নির্মম সত্যি , সেটা আপনিও জানেন, মেহেক। "


দুজনেই চুপ করে বসে থাকে , কারোর মুখে কোনো কথা নেই। সময় রাত বারোটা।



++++++++++



টুং টাং করে বেজে ওঠে হাতের মুঠোর মধ্যে ধরে থাকা ছোট্ট ফোনটা। ফোনটা কানে লাগাতেই ওদিক থেকে ভেসে আসে পারভীনের গলা, "তোমার কি দেরি হবে , স্নিগ্ধা? এখন তো প্রায় বারোটা বাজে। "


স্নিগ্ধা তাড়াতাড়ি সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে বলে ,"আরে না না ! আসলে এই একটু বেরোতে গিয়ে দেরী হয়ে গিয়েছিলো। আমি আসছি, আর এই মিনিট পনেরো ! কেমন ?


গাড়িটা ড্রাইভ করে আবার শুরু করে যাত্রা , পারভীনের বাড়ির উদ্দেশ্যে। সত্যি, সেই সময় পারভীন এসে না দাঁড়ালে, ও সময় মতো না বোঝালে, আজকেও আমাকে ওই লোকটার সাথেই ঘর করতে হতো, আর প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত , একটু একটু করে মরতাম আমি, শেষ হয়ে যেতাম , ধীরে ধীরে বয়স এসে থাবা বসাতো শরীরে , দেখতে দেখতে শরীরটাই বার্ধক্যের জালে, ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত। একটাই তো জীবন, কেন আমি আমার মতো করে উপভোগ করবো না ? কেন শুধু একটা তপ্ত সম্ভাবনাকে ঠান্ডা বরফের মধ্যে ডুবিয়ে শেষ করে দেবো জীবনের সব রং রূপ কে ? পারভীন যে সেই ছোট বয়সে আমার করা প্রত্যাখ্যান, অপমান, সব কিছু ভুলে আবার আমার বন্ধু হয়ে পাশে দাঁড়াবে, আমাকে ভালো কাজের অফার দেবে, ভাবতে পারিনি কখনও। এই জন্যই বলে, ছোটবেলার বন্ধুরাই জানে - বন্ধুত্ব কথাটার মানে। 



++++++++++



পুল থেকে উঠে আসে পারভীন, পাশের বেঞ্চ থেকে টাওয়েলটা টেনে নিয়ে গা হাত পা মুছতে মুছতে ভেতরে আসে। আজ ভীষণ আনন্দ হচ্ছে মনের ভেতরে। জয়ের আনন্দ, জোর না করেও , স্নিগ্ধাকে নিজের কাছে টেনে আনার আনন্দ। রাতে যখন স্নিগ্ধা ফোন করে, ওর গলাতে ঝরে পড়ছিলো আকুতি - কাকুতি - মিনতি - নির্লজ্ব আকুলতা। তবে অপেক্ষা করতে হয়েছে তার জন্য অনেকদিন পারভীনকে। ধীরে ধীরে দক্ষ শিকারীর মতো অপেক্ষা করেছে, সুযোগ খুঁজে গেছে। এমনভাবে খেলাটা সাজিয়েছে, যাতে কেউ না বুঝতে পারে - স্নিগ্ধা নিজেও না। আর সেই পাতা ফাঁদে ধীরে ধীরে স্নিগ্ধাকে জড়িয়েছে , এমনভাবে ওকে সবকিছু বুঝিয়েছে , এমনভাবে ওর মনের ওপরে নিজের প্রভাব বিস্তার করেছে , সেটা থেকে বেরোতে পারার সব রাস্তা আজ বন্ধ ওর সামনে। আর আজ রাতেই সেই খেলা শেষ করতে হবে। আর টেনে নিয়ে যাওয়া যাবে না এই ব্যাপারটা। এমনিতেই স্নিগ্ধা মাঝে মাঝেই ফোন করে ওকে বিয়ের কথা বলছে।


বিয়ে, বিয়ে ? বিতানকে ছেড়ে দিয়ে চলে এসে আমাকে বিয়ে করতে চাইছে ও ? কিসের জন্য? সমাজ? সিকিউরিটি ? 


হাসি ফুটে ওঠে পারভীনের চোখে মুখে। ঐ মেয়ে একদিন ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলো আমাকে, আমার দেওয়া গোলাপটা পায়ের নিচে মাড়িয়ে চলে গিয়েছিলো, আজ সে, সেই স্নিগ্ধা নিজে ফিরে এসে আমার পায়ে পড়েছে। হাহাহাহা ! জোরে জোরে হেসে ওঠে পারভীন। ওপরে উঠে, একটা স্টোর রুমে গিয়ে, একটা অনেক পুরোনো ট্রাঙ্ক বের করে নিয়ে আসে পারভীন।



++++++++++

 


ট্রাঙ্ক এর ওপর থেকে ধুলো ঝেড়ে, হাতে মুখে ধুলো মেখে, ট্রাঙ্ক খুলে পারভীন চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ ! অনেক অনেক বছর পরে এই ট্রাঙ্ক খুলেছে ও। বের করে আনে ভেতর থেকে বেশ কিছু একটা ধূসর, হলুদ হয়ে যাওয়া ফটো, একটা ছেঁড়া ডায়রি , ডায়রির পাতার ভাঁজে শুকিয়ে যাওয়া, ছিঁড়ে ঝুরঝুরে হয়ে যাওয়া গোলাপের পাপড়ি। ধীরে ধীরে হাতে তুলে নেয় ফটোগুলো , সাবধানে, যত্নের সাথে। স্মৃতির সাথে মনটাও চলে যায় অনেক অনেকগুলো বছর আগে। ও যেন অবলোকন করতে থাকে ঘটনাপ্রবাহ, নিজের চোখের সামন......

 

একটা পাহাড়ী রাস্তা, একটু আগেই বৃষ্টিতে ভিজে চারদিক হয়ে উঠেছে শান্ত, পবিত্র, নির্মল। সবুজ গাছপালার মধ্যে, পাখীদের কলতান, পাতাগুলো দোলার মর্মর ধ্বনি ! লাল টুকটুকে সাইকেল চালিয়ে, বান্ধবীদের সাথে গল্প করতে করতে চলেছে মেয়েটি। ওদের হাসি, কথা বলা, সাইকেলের আওয়াজে, নিস্তব্ধ প্রকৃতিও নেচে উঠেছে আনন্দে। দূর থেকে, গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে একটি ছেলে। সাইকেল গুলো এগিয়ে আসার শব্দে চুপ করে দাঁড়িয়ে পড়ে ছেলেটি, হাতে একটা পুরোনো রোল ক্যামেরা। ধীরে ধীরে সন্তর্পণে , গাছের আড়াল দিয়ে মুখ বাড়িয়ে তোলে দুটো ফটো। মেয়েগুলো রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চলে যাচ্ছে , হঠাৎ লাল সাইকেলে বসা মেয়েটি পেছনে মুখ ঘুরিয়ে কি যেন একটা খুঁজতে থাকে। ছেলেটি তাড়াতড়ি মাথা নিচু করে বসে পড়ে , ভাবে, এই রে ! দেখে ফেললো না তো !

 

কলেজে গিয়ে লাঞ্চ এর সময়ে খেলা ছেড়ে, বন্ধু বান্ধবদের থেকে দূরে এসে, সামনের কনভেন্টের পেছনের বেড়া টপকে আসে ছেলেটি, একটি আড়ালে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে মেয়েটিকে। মেয়েটি তখন ওর বান্ধবীদের সাথে একটা জায়গাতে বসেছিলো, গান করছিলো। মন্ত্রমুগ্ধের মতো মেয়েটির গান শুনছিলো ছেলেটি। মনে হচ্ছিলো যেন হাওয়াতে ভাসছে ছেলেটি, পাশে মেয়েটিও ভাসছে, হাতে হাত রেখে। হঠাৎ লাঞ্চ শেষের ঘন্টা পড়ে , মেয়েটি বাকিদের সাথে ভেতরে ঢুকে যায় ! ছেলেটিও বেরিয়ে চলে আসে, ফিরে আসে কলেজের সামনে।

 

তখন ছেলেটি পড়ে ফার্স্ট ইয়ারে আর মেয়েটি ক্লাস ইলেভেন। কিছুদিন পরেই ছিলো ভ্যালেন্টাইন্স ডে ! অনেকটা সাহস সঞ্চয় করে ছেলেটি। হাতে একটি গোলাপ নিয়ে মেয়েটির সামনে এসে দাঁড়ায় ভ্যালেন্টাইন্স ডে র দিন সকালে। সেদিন ও পরেছিলো একটা গোলাপী রঙের হাঁটু পর্যন্ত স্কার্ট, আর ওপরে একটা সাদা টপ ; মাথায় ছিল আকাশী নীল রঙের উলের টুপি! সাথে ছিলো আরো কয়েকজন বান্ধবী। ছেলেটিকে দেখে, অন্যরা হাসতে হাসতে এ ওর গায়ে ঢলে পড়ে ; একটু পরে সবাই ওকে বাই বাই বলে চলে যায়। রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে শুধু ছেলেটি আর মেয়েটি। ছেলেটি প্রথমে পকেট থেকে বের করে আনে ওর হাতে তোলা ফটো গুলো, তুলে দেয় মেয়েটির হাতে। মেয়েটি কিছু না বলে ফটোগুলো তুলে নেয় হাতে, হাসি ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয় গাম্ভীর্যে। এর পরে ছেলেটি মেয়েটির দিকে বাড়িয়ে দেয় গোলাপ, প্রপোজ করে ওকে। জিজ্ঞেস করে ,"স্নিগ্ধা ! তুমি কি আমার ভ্যালেন্টাইন হবে ? শুধু আজকের জন্য নয়, বা কয়েক সপ্তাহের জন্য নয় ! সারা জীবনের জন্য ? আমি, আমি তোমার গান শুনেছি, তোমাকে দেখেছি , তোমাকে আমার ভালো লেগেছে। যদিও আমি জানি, তোমার তুলনায় আমি হয়তো কিছুই না , আমার মা বাবা নেই, মামার বাড়িতে মানুষ , পড়াশোনাতেও মোটামুটি। জানি না ভবিষ্যতে কি হবে, তবে তুমি পাশে থাকলে...."

 

স্নিগ্ধা হাত তুলে বাধা দেয় ছেলেটিকে। রাগের স্বরে বলে ওঠে, "তুমি ! তুমিই তো আমাকে ফলো করতে , তাই না? লজ্জা করে না , এইভাবে মেয়েদের পেছনে ঘুরে বেড়াতে? কি যেন বললে, তোমার মা বাবা নেই, মামার বাড়িতে মানুষ ? পড়াশোনাতেও মোটামুটি ? আমি কেন মেনে নেবো তোমাকে ? কি আছে তোমার মধ্যে ? দেখতেও তো এমন কিছু আহামরি নয় তোমাকে যে তোমাকে পাশে নিয়ে ঘুরলে সবাই অটোগ্রাফ নিতে আসবে ! আর এই যে, এই ফটোগুলো নিয়েছো , এগুলো নিয়ে যদি আমি পুলিশে যাই, কি হবে তোমার , সেটা জানো তো ? ডিসগাস্টিং। আমার সাথে আর কোনোদিন দেখা করার চেষ্টাও করবে না। আমি তোমাকে ভালোবাসি না, তোমাকে আমার পছন্দ হয় নি একদম। তোমার সাথে তো আমার কোনো ভবিষ্যৎ আমি দেখতে পাচ্ছি না। যাও যাও, সামনে থেকে সরে যাও ! একদিন যখন আমি গান গেয়ে অনেক ওপরে উঠবো, তখন না হয়, রেডিও তে বা ক্যাসেটে আমার গান শুনো ! যত্তসব। গোলাপটা রাস্তার ওপরে ছুঁড়ে ফেলে, পা দিয়ে মাড়িয়ে চলে যায় স্নিগ্ধা। ফটো গুলো উড়িয়ে দেয় হাওয়াতে। একটু পরেই ছেলেটা স্নিগ্ধার বাকি বান্ধবীদের গলা পায় , সবাই হাসছে ওকে নিয়ে, মজা করছে। কেউ কেউ বলে ওঠে জোরে জোরে , "বেশ করেছিস।"

"কি সাহস দেখ, আবার প্রপোজ করছে !

" "আবার ফটো ও তুলেছে "

 

সেদিন চোখের জলে ভেসে যায় ছেলেটি। সেই ছেলেটি আজকের পারভীন। আজ পারভীনের কাছে হাত পাততে হচ্ছে কাজের জন্য, শরীরের জন্য স্নিগ্ধাকে। সেদিন রাতে বারবার প্রার্থনা করেছিলো ভগবানের কাছে ছেলেটি , "আমাকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করো ভগবান, আর তারপরে আর একবার আমাকে আর ওকে সামনাসামনি এনে দিও। যে আমাকে এতো কাঁদিয়েছে, তাকে, তাকে..."

 

স্নিগ্ধাকে অনেকদিন পরে পারভীন দেখেছিলো, ওর আর বিতানের বিয়েতে। সেদিন, অনেকদিন পরে, আবার সেই পুরোনো অপমানের জ্বালাটা ফিরে আসে, দাউদাউ করে জ্বালাতে থাকে ওকে। মনে মনে হেসে ওঠে, তাহলে এভাবেও ফিরে আসা যায় ?

 

 

++++++++++



গানের রেকর্ডিং এর সূত্রে , মলয় স্নিগ্ধাকে নিয়ে আসে ওর সামনে। সেই শুরু। ধীরে ধীরে পারভীন স্নিগ্ধাকে নিজের কাছে নিয়ে আসে। কখনও কোনো ভাবে জোর করতে হয় নি ওকে , তবে বিতানের সমস্যাটা , কোনো একদিন, এক অসতর্ক মুহূর্তে স্নিগ্ধা বলে ফেলে পারভীনকে। আর পারভীন সেই থেকে স্নিগ্ধার কানের কাছে ধীরে ধীরে সময় আর সুযোগ বুঝে , বোঝাতে থাকে ওকে। বলে ও নারী হিসেবে সম্পূর্ণ নয় ! কেন এইরকম সম্পর্কে নিজেকে শেষ করে দিচ্ছে ও ? স্নিগ্ধা এতো ট্যালেন্টেড একজন সিঙ্গার, সারাক্ষণ মনের মধ্যে বিতান , বিতানের ভালোবাসা না পাওয়ার জ্বালা নিয়ে কেন নিজেকে কষ্ট দিচ্ছে ও ? নারী হিসেবে, একজন স্বাধীন মানুষ হিসেবে , স্নিগ্ধার নিজের ও পুরো স্বাধীনতা আছে নিজের শর্তে বাঁচার। শরীরটা জাস্ট একটা অজুহাত, সেটা দিয়েই সমাজ জোর করে বেঁধে রেখেছে নারী পুরুষের সম্পর্ক কে, বিয়ের মাধ্যমে। বিয়ে যদি না ও ভাঙতে চায় স্নিগ্ধা , তবুও তো ওর কাছে, ওর সামনে সুযোগ আছে। আগে নাহয়, ও কাজ করতো না। কিন্তু এখন তো কাজের সূত্রে বেরোচ্ছে বাইরে। আরো অনেক লোকজনের সাথে মেলা মেশা করতে হচ্ছে।

 

স্নিগ্ধা দুর্বল হতে থাকে।

 

 

++++++++++

 

 

মানসিকভাবে দুর্বল মানুষদের একটা সমস্যা আছে - সে যে সমস্যা নিয়ে চিন্তা করে, আর সেটা থেকে বেরিয়ে আসার কথা, যে বলে দিনের পর দিন, কানের সামনে, তার ওপরে সে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে তার অবচেতনে। ধীরে ধীরে সেই অবিচেতন গ্রাস করে চেতনার জগৎকে। ঠিক ভুল বুঝতে পারে না মানুষ। স্নিগ্ধাও ধীরে ধীরে পারভীনের দিকে এগিয়ে আসে , একদিন ভীষণভাবে কেঁদে ওঠে পারভীনের সামনে। নিজেকে মেলে ধরে সম্পূর্ণ ভাবে।

 

সেদিন রাতে, রেকর্ডিং বন্ধ করিয়ে, পারভীন স্নিগ্ধাকে নিয়ে এসেছিলো নিজের বাড়িতে। প্রথম দিকে জড়তা, সমাজ, লজ্জা, ভয় সবকিছু নিয়ে দ্বিধার মধ্যে ছিলো স্নিগ্ধা। পারভীন কোনো কিছু না বলে এগিয়ে এসে হঠাৎ করে ওর ঠোঁটের ওপরে রাখে নিজের ঠোঁট। আর পারে না স্নিগ্ধা নিজেকে আটকাতে। সম্পূর্ণ ভাবে উজাড় করে দেয় পারভীনের কাছে স্নিগ্ধা নিজেকে।

 

সেদিন প্রথমবার, স্নিগ্ধা চরম তৃপ্তিতে কেঁপে ওঠে বারে বারে ! শেষে কান্নায় ভেঙে পড়ে , পারভীনের নগ্ন বুকে মাথা রেখে নগ্ন স্নিগ্ধা চোখের জলে ভিজিয়ে দিতে থাকে পারভীনকে। ধীরে ধীরে জিজ্ঞেস করে, "এটা , এটা কি ঠিক হলো পারভীন ? আমি যে অন্য কারোর স্ত্রী, তার সন্তানের মা। আমি কেন এতো দুর্বল হয়ে পড়লাম পারভীন ? ছি, ছি ! তুমি আমাকে খুব খারাপ মেয়ে ভাবছো, তাই না ? আমি,এই আমিই তোমাকে একসময়....! "

 

পারভীন স্নিগ্ধার ঠোঁটের ওপরে আঙ্গুল চেপে বলে ওঠে ,"পুরোনো কথা ভুলে যাও স্নিগ্ধা ! আর তুমি শুধু একটা কথা ভাবো, কারো স্ত্রী বা কারোর মা হওয়ার আগেও, তুমি একজন নারী, একজন সম্পূর্ণ মানুষ। আমাদের শরীরের বেঁচে থাকার জন্য যেরকম জল, খাদ্যের প্রয়োজন, তেমনি মনের জন্য - শরীরের চাহিদা কামনা মেটানোটাও দরকার সময়ে সময়ে। তুমি খুব ভালো স্নিগ্ধা , তুমি জানো সেটা ? আমি এটাও জানি, তুমি বিতানকে খুব ভালোবাসো, আর সেটাই স্বাভাবিক। থাক না আমাদের এই সম্পর্ক সমাজের বেঁধে দেওয়া নিয়মের বাইরে , দিতে হবে না কোনো নাম এই সম্পর্কের। এটা শুধু এক বন্ধু আর বান্ধবীর সম্পর্ক , সেটা শুধু আমাদের মধ্যেই থাকবে , কেউ জানবে না ! "

 

গভীর রাতে, প্রায় আড়াইটের সময়ে ফিরে আসে স্নিগ্ধা। বিতান জানলো, ও রেকর্ডিং শেষ করে ফিরে এসেছে।

 

সেই শুরু, এর পর মাঝে মাঝেই দুজনে একসাথে থাকতো। এর বদলে, স্নিগ্ধা হঠাৎ করেই পারভীনের সব সিনেমার প্লে ব্যাক করার সুযোগ পেয়ে গেলো ধীরে ধীরে।          

 

 

++++++++++

 

 

ফটোগুলো হাতে নিয়ে, শুকিয়ে যাওয়া গোলাপের পাপড়ি যত্নে তুলে , বাইরে একটা নতুন ডায়রির ভেতরে ঢুকিয়ে, বিছানার পাশে রাখা সাইড টেবিলে রাখে পারভীন। স্টোর রুমটা বন্ধ করে নিচে নেমে আসে ও। একটা গাড়ির ভেতরে ঢোকার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। স্নিগ্ধা এলো মনে হয় !

 

 

++++++++++

 

 

স্নিগ্ধা আসার পরেই, দরজা খুলে দাঁড়ায় পারভীন নিজে। খালি গায়ে, শুধু একটা সাদা ট্রাউজার পরে বেরিয়ে আসে পারভীন। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় এখনো লেগে জলের ফোঁটা , নিজেকে সামলাতে পারে না স্নিগ্ধা। জোরে ঝাঁপিয়ে পড়ে পারভীনের ওপরে। পারভীনের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কুকুর দুটো, ঘেউ ঘেউ শব্দ করে ডেকে ওঠে ! ওদের কে ধমকে কিছু একটা বলে পারভীন, চুপ করে ভেতরে চলে যায় ওরা। স্নিগ্ধাকে তাড়াতাড়ি সম্পূর্ণ উম্মুক্ত করে, নিচের ঘরেই , সোফার ওপরে বসিয়ে, ওকে আদর করতে করতে নিচের দিকে নেমে আসে পারভীন। প্রবল আশ্লেষে স্নিগ্ধার চোখ যখন বন্ধ হয়ে আসে, ওকে কোলে তুলে নিয়ে ওপরে উঠে আসে পারভীন। পা দিয়ে বেডরুমের দরজা ঠেলে, ভেতরে ঢুকে , বিছানায় গড়িয়ে দেয় স্নিগ্ধাকে। বিছানার ওপরে উঠে বসে ইশারা করে পারভীনকে ডাকে স্নিগ্ধা এগিয়ে আসার জন্য, অপেক্ষা করে থাকে সেই মুহূর্তের, যার জন্য মনে হয় সারা বিশ্বসংসার মিথ্যে, সারা পৃথিবী মিথ্যে, সবার অস্তিত্ত্ব একটা বিরাট বড়ো ভ্রম। শুধু এই মুহূর্তটুকুই সত্যি, আর সত্যি নিজের শরীরের ওঠা নামা - শ্বাস প্রশ্বাস !

 

প্রায় মিনিট কুড়ি পরে ক্লান্ত দুটো নগ্ন শরীর, বিছানায় শুয়ে, একে অপরকে জড়িয়ে ! এইভাবেই আরো কিছুক্ষণ শুয়ে থাকে স্নিগ্ধা। একবার তাকিয়ে দেখে পারভীনের দিকে, বাচ্চা ছেলের মতো নরম হয়ে গেছে ওর মুখ, মাথার ঝাঁকড়া চুলে বয়সের রেখা , উপুড় হয়ে থাকা ঘর্মাক্ত পিঠের ওপর দিয়ে প্রতিফলিত হয়ে পিছলে আসছে আলো। পারভীনের কপালে আদর করে , ধীরে ধীরে উঠে আসে স্নিগ্ধা। পারভীন চুপ করে শুয়ে থাকে। লাগোয়া টয়লেটে গিয়ে , একটু পরে বেরিয়ে আসে স্নিগ্ধা। পারভীনের স্টোরেজে রাখা রাতপোশাকটা টেনে নিয়ে গায়ে জড়িয়ে এসে বসে বিছানার ওপরে। সাইড টেবিলে রাখা জলের বোতল টেনে নিয়ে ঢকঢক করে জল ঢালে গলায়। হঠাৎ চোখে পড়ে সাইড টেবিলে রাখা একটা ডায়রি ! কৌতূহল বশে হাতে টেনে নেয় ডায়রিটা।

 

ডায়রি থেকে কয়েকটা ফটো পড়ে যায় মেঝেতে। ফটো গুলো তুলেই প্রচন্ড চমকে ওঠে স্নিগ্ধা। এ তো, এগুলো তো সেই সব পুরোনো ফটো। অতদিন আগে তোলা ফটোগুলো আজ ও পারভীন রেখে দিয়েছে ? কেন ? আর ফটোগুলোর ওপরে বড়ো করে লাল পেন দিয়ে ক্রস করা কেন? একটা হাড় হিম করা স্রোত নেমে যায় স্নিগ্ধার মেরুদন্ড বেয়ে। হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে একটা অজানা আশঙ্কায়।

 

পারভীনের দিকে তাকিয়ে দেখে স্নিগ্ধা। এখনও একইভাবে শুয়ে আছে ও। ডায়রির পাতা ওল্টায় ও।

 

 

++++++++++

 

 

"আজ স্নিগ্ধাকে দেখলাম, ওর বিয়েতে। কি ভালোই না লাগছিলো ওকে। সেই প্রথম দিনের মতো। ওর পাশে, ওর স্বামী, বিতান, খুব ভালো মানিয়েছে দুজনকে। তবে ওদের দুজনের বয়সের পার্থক্যটা বেশ বেশি, তাই না ? "

 

"অনেকদিন হয়ে গেলো, স্নিগ্ধা কোনো কিছু কাজ করছে না। মাঝে কিছু ব্যান্ডের সাথে কাজ করছিলো। কেন ? ও কি কাজ পাচ্ছে না ? আমি দেখি একটু, যদি কিছু করা যায় ! "

 

"মলয়, আমার নতুন সিনেমার গানের রেকর্ডিং করার জন্য মুম্বাই থেকে একজনকে আনবে বলেছিলো। আমি ওকে স্নিগ্ধার নাম রেকমেন্ড করেছিলাম। আজ আবার আমার সামনে ছিলো স্নিগ্ধা। প্রচন্ড ইন্টিমেট গানটা রেকর্ড করবে না বলেছিলো প্রথমে। আমি একটু ছোট করে 'চিমটি' দিলাম ওকে। তাতেই কাজ হলো দেখলাম। কিন্তু ও ভালো করতে পারছে না গানটা। আমার একটা সন্দেহ জাগছে মনের ভেতরে। "

 

"ধীরে ধীরে স্নিগ্ধা অনেক স্বাভাবিক হয়েছে। আমি ওকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছি, যে পুরোনো কোনো কথা মনে রেখে, আমি মনের ভেতরে ওর জন্য কোনো রাগ পুষে রাখিনি। আমরা এখন খুব ভালো বন্ধু। মাঝে মাঝে তবে ও ভীষণ উদাস হয়ে থাকে। কেন বুঝতে পারি না। মাঝে এক দুবার আমি ওকে কাঁদতেও দেখেছি ভেতরে। কিন্তু এখনও জিজ্ঞেস করার সময় আসে নি। "

 

"আজ আমি অনেকটাই জানতে পারলাম। স্নিগ্ধা আর বিতানের সম্পর্ক নিয়ে, ওদের ভেতরের গোপন কথা, কেন স্নিগ্ধা মাঝে মাঝে এরকম আচরণ করে , কেন ও আইটেম গান বা ঘনিষ্ঠ দৃশ্যের গান করার সময় হারিয়ে যায় কোথাও। এই তো, আমি অবশেষে পেয়ে গেছি , সেই দুর্বল জায়গাটা। এটা নিয়েই আমাকে খুব সাবধানে....আমি, আমি এখনো ভুলতে পারি না সেই ছেলেটাকে স্নিগ্ধা , সেই সময়টাকে। "

 

"ওহ, কি আগুন , কি উদ্দামতা, কি পাগলামো। এতো এতো আগুন ও থাকতে পারে , কারোর মধ্যে ? আমি আবার পুড়তে চাই , সাথে তোমাকেও আমি পোড়াতে চাই স্নিগ্ধা। ঠিক সেইভাবে, যেভাবে আমি জ্বলেছি , দিনের পর দিন। "

 

"ইউ আর জাস্ট গ্রেট পারভীন, জাস্ট গ্রেট। স্নিগ্ধা অবশেষে, বিতানকে ছেড়ে, সবকিছু ছেড়ে বেরিয়ে গেছে ! ওদের সবকিছু ভেঙে চুরমার করে দিয়েছি আমি, আমি, হ্যাঁ আমি। স্নিগ্ধা বুঝতেও পারে নি কিছু । ও ভেবেছে ও নিজের কথা বলছে ? ও আসলে ওর মুখ দিয়ে আমার কথাগুলোই বলেছে। এটাকেই তো বলে, লোহা যখন গরম, তখন তাকে পেটাও। যখন স্নিগ্ধা প্রচন্ড দুর্বল হয়ে পড়েছিল, প্রতিমুহূর্তে, ফোন করে, দেখা করে, সামনে বসিয়ে আমি তো এগুলোই বলে এসেছি ওকে। সংসার কি ? সংসার তো জাস্ট একটা মায়া , সেখানে শুধু প্রেম ভালোবাসা দিয়ে কিছুই হয় না। যেখানে শরীর নেই, বিতানের শরীরের স্পর্শে জেগে ওঠে না স্নিগ্ধা, সেখানে স্নিগ্ধার থাকার ও কোনো দরকার নেই। এভাবে কি বেঁচে থাকা যায়? পুরো পৃথিবীটাই তো শরীর, আর শরীর সর্বস্ব, শরীরের জন্যই তো সব। হাহাহাহাহা....মূর্খ, আকাট মূর্খ। কোনোকিছু গড়ে তুলতে যত সময় লাগে, কয়েক সেকেন্ডে সেটাকে ভেঙে দেওয়া যায়। ঠিক যেরকম ভাবে আমাকে শেষ করে দিয়েছিলে তুমি, আমি প্রায় শেষ করে দিয়েছিলাম নিজেকে। মনে পড়ে স্নিগ্ধা ? মনে পড়ে ? " 



++++++++++



পারভীনের লেখা ডায়রিটা শেষ করে ভীষণ ভাবে চমকে ওঠে স্নিগ্ধা। হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে একটা আশঙ্কা, ভয়ে। এ আমি কি পড়লাম ? তাহলে, তাহলে আমি যা ভেবে এসেছি এতদিন ধরে, যা লালন করে এসেছি মনের মধ্যে, যা বিশ্বাস করে এসেছি, সবটাই কি ভুল ? আমি কি কোনোভাবে ভীষণ বড়ো একটা ভুল করে ফেলেছি ? নিজের প্রতি, বিতানের প্রতি , শৌনকের প্রতি? আর সবকিছুর মূলে রয়েছে এই, এই পারভীন? ও ধীরে ধীরে, প্ল্যান করে আমাকে, আমার জীবন - সংসার - স্বপ্ন সব ছারখার করে দিলো ? আর আমিও এমন অবুঝ, এমন পাগলী, শরীরের চাহিদায়, ভালোবাসা পাওয়ার তাগিদে, সব ছেড়েছুড়ে, সবকিছু নিজেই লাথি মেরে সব ধ্বংস করে, নষ্ট করে দিয়েছি ? শুধু নিজে সুখী হতে গিয়ে; হারিয়েছি বিতানের ভালোবাসাকে - নষ্ট করেছি শৌনকের ছেলেবেলা - কেড়ে নিয়েছি এক বাবাকে তার সন্তানের কাছ থেকে ! ছিঃ, ছিঃ , শুধু নিজের সুখের সন্ধানে, হারিয়ে ফেলেছি অনেক কিছু, সম্পর্কের মায়াজালে জড়িয়ে সুখের সন্ধানে ব্যস্ত 'আমি', তলিয়ে গেছি আরো গভীরে , অন্ধকারের মধ্যে।     

 

ডায়রিটা বন্ধ করে চুপ করে বসে স্নিগ্ধা, তাকায় বাইরের দিকে। আলো অন্ধকার - আবছা পরিবেশের ভেতরে, বাইরে থেকে আসছে আলো , ভারী পর্দায় ধাক্কা খেয়ে ভেতরে ঢুকতে পারছে না সেই আলো। সেদিকে তাকিয়ে স্নিগ্ধার চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটার পর একটা ঘটনা - মুহূর্ত ; বিতানের সাথে, শৌনকের সাথে কাটানো সুন্দর মুহূর্তগুলো, সেই দিনগুলি। ভেসে ওঠে চোখের সামনে সেই ব্যর্থতার দিনগুলি, সেই কান্নার সময়, সেই যন্ত্রনামুখর দিন রাতের সম্যক চিত্রগুলি। দৃঢ় - কঠিন হয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে সোজা হয়ে বসে স্নিগ্ধা।

 

কি ভুল করেছি আমি? কিসের ভুল? আমি একজন নারী, সেটাই আমার ভুল? আমি নিজের শর্তে বাঁচতে চেয়েছি, সেটাই আমার ভুল? আমি জানি, অনুভব করি রন্ধ্রে রন্ধ্রে - বিতানের ভালোবাসা। তবুও সেই ভালোবাসা উপেক্ষা করে আমি বেরিয়ে এসেছিলাম, সেটাই আমার ভুল? মানুষ হিসেবে - সবরকমভাবে আমি সুখী হতে চেয়েছি, সেটাই আমার ভুল? কারোর জীবনে যদি কোনোকিছুর অভাব থাকে, সেটার দায়ভার সারা জীবন কেন বয়ে নিয়ে যেতে হবে আর একজনকে ? আমার এই ভাবনাটা - এটাও কি ভুল ?

 

দীর্ঘ একটা শ্বাস বেরিয়ে আসে, ধীরে ধীরে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় স্নিগ্ধা।

 

 

++++++++++

 

 

বিছানার ওপরে উপুড় হয়ে শুয়ে পারভীন। স্নিগ্ধা তাকায় পারভীনের উম্মুক্ত, ঘৰ্মাক্ত খোলা পিঠের দিকে। সেই সব ঘামের বিন্দু যার জন্য একটু আগেও স্নিগ্ধা পাগল হয়ে গিয়েছিলো, নিজের সারা শরীরে মেখে নিয়েছিলো পারভীনের ঘাম, গন্ধ, সবরকম নির্যাস, কেঁপে কেঁপে উঠেছিল বারবার শিহরণে, এখন সেই শরীরটা দেখেই ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই আসছে না স্নিগ্ধার মনে। ভাবে, ঠিকই তো করেছে পারভীন ! পুরুষ না, তাই সুযোগটা নিলো, আমার দুর্বলতার সুযোগে আমাকে সম্পূর্ণভাবে নিজের করে এতো বড়ো বিশ্বাসঘাতকতা করলো আমার সাথে। অবশ্য, সুযোগটা আমিই করে দিয়েছিলাম ওকে। ঠিক-ই করেছে পারভীন।

 

পারভীন ধীরে ধীরে উঠে বসে। স্নিগ্ধার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে ,"কি হলো ? তোমার মুখ চোখ এরকম লাগছে কেন ? "

 

অজানা এক ক্রোধে, ঝাঁপিয়ে পড়ে স্নিগ্ধা পারভীনের ওপরে রাগে, ঘৃণায় ! চেঁচিয়ে ওঠে,"তুমি, তুমি আমার এতো বড়ো সর্বনাশ করতে পারলে ? এগুলো, এসব কি ?"

 

ডায়রিটা ছুঁড়ে মারে পারভীনের মুখের ওপরে স্নিগ্ধা। ডায়রিটা হাতে তুলে নিয়ে , শান্ত গলায় বলে ওঠে পারভীন ,"ওহ, তুমি তাহলে সব জেনে গেছো ? ভালোই হয়েছে , বুঝেছো। আমি ও আর পারছিলাম না খেলাটা চালাতে। তোমাকে আমার কিছু বলার নেই। তুমি জানো বাইরে বেরোনোর দরজাটা কোনদিকে। "

 

"তুমি, তুমি কি করে পারলে ? কেন আমাকে, আর বিতানকে আলাদা করে দিলে ?"

 

পারভীন ধীরে ধীরে বলে ওঠে,"একটা কথা জানো তো স্নিগ্ধা ! মানুষ নিজের ভুল না দেখে, সবসময় অন্যের দিকে আঙ্গুল তোলে। এটা আমার ভীষণ অপছন্দের। এইটা - তোমার জন্য এই হয়েছে ! বা, ওই মানুষটার জন্য আমার ক্ষতি হয়ে গেলো। কেন ? সবসময় কেন অজুহাত খোঁজার চেষ্টা করো ? যা হয়েছে, তোমার নিজের ইচ্ছেতে হয়েছে। আমি শুধু তোমাকে কিছু কথা বলেছিলাম, কিন্তু সে সব তো সত্যি কথা। ভালো করে ভেবেই দেখো না, আমার কথাগুলোর মধ্যে কি ভুল আছে ! এবার সেটা তুমি কিভাবে গ্রহণ করেছো, সেটা তোমার ব্যাপার। আমি এর জন্য কোনোভাবে দায়ী নই ! "

 

"রাগে কাঁপতে কাঁপতে চেঁচিয়ে ওঠে স্নিগ্ধা ,"আর আমার সাথে, আমার শরীর নিয়ে যখন তখন খেলা করা ? যখন তখন আমাকে ডাকা? সেটাও সব আমার দোষ, তাই না ? আমিই তার জন্য দায়ী ! তাই তো ? "

 

"অফকোর্স। ভালো করে ভেবে দেখো তো, তখন যদি আমি না থাকতাম, হতে পারতো অন্য কারোর কাছে তুমি যেতে। যেতে না ? তোমার তখন অবস্থা এমনটাই ছিলো, কেউ যদি তোমার সাথে একটু ভালোবেসে, হেসে কথা বলতো, কয়েকদিন পরে তুমি তার দিকেই ঝুঁকতে। ভালো করে নিজের মনকে প্রশ্ন করো। আমাকে নয়! তুমি তখন পালাতে চেয়েছিলে, ওই, ওই লোকটা, কি যেন নাম ? বিতান, বিতানের কাছ থেকে। কিন্তু বিতান যে তোমাকে প্রচন্ড ভালোবাসে, সেটাকে অস্বীকার করে তুমি বেরোতে পারছিলে না। আমি তো শুধু একটা অনুঘটক মাত্র। যাই হোক। আমার, আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। তুমি বরং এবার এসো। আর ভালো করে ভেবে দেখো। আর একটা কথা শোনো যাওয়ার আগে , একদিন একটা সময়ে আমি প্রচন্ড জ্বলেছি , তোমার জন্য, তোমার সেই, সবার সামনে আমাকে অপমানের পরে। একটু নিজেও জ্বলে দেখো। যদিও, যদিও আমি তোমাকে ভালোবাসি, আজ ও, কিন্তু তবুও আমি , আমি হাঁপিয়ে উঠেছি তোমাকে নিয়ে। জাস্ট গেট লস্ট। " 

 

 

++++++++++

 

 

ধীরে ধীরে মেঝের এক কোণে বসে পড়ে স্নিগ্ধা , মাথা দুই হাঁটুর মধ্যে গুঁজে কাঁদতে থাকে অঝোরে। মনের ভেতরে আবার, হাজার একটা প্রশ্ন এসে উঁকি দিয়ে চলে যায় ;

 

তাহলে কি সব কিছু মিথ্যে?


আমার চিন্তা ভাবনা মিথ্যে?


আমার চাহিদা , কামনা, বাসনা , সব মিথ্যের জাল?


আমার আগে এগিয়ে যাওয়ার চিন্তাটাও মিথ্যে?


শুধু কি ভালোবাসা দিয়েই সব কিছু ভোলা সম্ভব?


আমার নারী হয়ে ওঠার সার্থকতা কি শুধুই ত্যাগে, মুখ বুজে, সব ভুলে, স্বামী বাচ্চা নিয়ে সংসার ধর্ম পালনে?

 

কোনো প্রশ্নের-ই কোনোরকম উত্তর খুঁজে পায় না স্নিগ্ধা। একটু পরে চোখের জল মুছে চুপ করে বেরিয়ে আসে পারভীনের বাড়ি থেকে। কেঁদে কেঁদে, চোখের কাজল ঘেঁটে লেপ্টে গেছে চোখের চারদিকে, চোখের জল শুকিয়েছে গালের ওপরে। ফেস পাউডার, মেকআপ সব কিরকম ধেবড়ে গেছে এখন। মাথা কাজ করছে না একদম, সব যেন কিরকম অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে।

 

গাড়ির ড্রাইভারের সিটে বসে, বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠেছে, ধূসর ঘন সবুজ প্রেক্ষাপট, তার ওপরে টুকরো টুকরো কিছু ছবি ভেসে উঠেছে - একটি মেয়ে ভয়ে বিতানের হাতের মুঠোর মধ্যে নিজের হাত ঢুকিয়ে বাঁচতে চাইছে ; একটি মেয়ে বিতানের কাঁধে মাথা রেখে শুনছে বিতানের আবৃত্তি ; একটি মেয়ে বিতানের বুকের ওপরে শুয়ে রয়েছে; একটি মেয়ে ছোট্ট একরত্তি একটা ছেলেকে নিয়ে কোলে করে ঘোরাতে ঘোরাতে, বিতানের লেখা কবিতায় সুর করে গান গেয়ে শোনাচ্ছে !

 

আবার একটু পরে ঘন সবুজ , ধূসর মেঘের মতো প্রেক্ষাপট পরিবর্তিত হয়ে, চোখের সামনে নেমে এলো রক্তলাল এক পর্দা ; তার ওপরে ভেসে উঠছে একে একে অন্যরকম কিছু টুকরো টুকরো ছবি, - একটি মেয়ে গর্বে, দর্পে, পা দিয়ে গোলাপ মাড়িয়ে চলে যাচ্ছে ; একটি মেয়ে বিতানের গায়ের ওপরে হাত তুলছে; একটি মেয়ে বিতানকে লাথি মেরে সরিয়ে দিচ্ছে নিজের কাছ থেকে ; একটি মেয়ে রাতের অন্ধকারে নেমে, জানালার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বিতানকে দেখিয়ে টেনে নিচ্ছে পারভীনকে, মিশিয়ে দিচ্ছে নিজের ঠোঁট পারভীনের ঠোঁটের সাথে, টেনে নিচ্ছে পারভীনের লোলুপ হাত নিজের উদ্ধত ব্লাউজের ওপরে; একটি মেয়ে; একটি মেয়ে বিতানের দিকে ছুঁড়ে মারছে গ্লাস, ফ্লাওয়ার ভাস ; একটি মেয়ে রাতের পর রাত, শুধু নিজের সুখের জন্য ছেলেকে ছেড়ে, রেকর্ডিংয়ের নাম করে বাইরে রাত কাটিয়ে আসছে , জানতেও পারছে না মেয়েটি ওর ছেলে রাতে কি খেলো, কতটুকু খেলো।

 

সজোরে ব্রেক চেপে রাস্তার এক ধারে এসে দাঁড় করায় গাড়িতে স্নিগ্ধা। কাঁদতে কাঁদতে মাথা নেমে আসে স্টিয়ারিংয়ের ওপরে।

 

একটু পরে ধীরে ধীরে একটা পুলিশের জীপ পাশে এসে দাঁড়ায়। একজন অফিসার নেমে এসে জিজ্ঞেস করে স্নিগ্ধাকে , "ম্যাম , আর ইউ ওকে ? "

চমকে অফিসার এর দিকে তাকায় স্নিগ্ধা। অফিসার স্নিগ্ধাকে চিনতে পারে, তাড়াতাড়ি একটা ছোট কাগজের টুকরো, আর ওপরের বুকপকেট থেকে একটা পেন বের করে বাড়িয়ে দেয় ওর দিকে, অটোগ্রাফের জন্য। কোনোরকমে হেসে, নিজেকে ঠিক করে, ধীরে ধীরে গাড়ি ড্রাইভ করে ফিরে আসে স্নিগ্ধা। নিজেদের এপার্টমেন্টে। নিচে গাড়ি পার্ক করে ধীরে ধীরে লিফ্টে করে ওপরে আসে , ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে আসে। হাতঘড়ি দেখে, সময় এখন - রাত আড়াইটে।

 

 

++++++++++

 

 

কোনোরকমে টলতে টলতে, নিজের মৃত শরীরটাকে টেনে নিয়ে আসে ওপরে স্নিগ্ধা। সুপর্ণা দরজা খোলার আওয়াজে, চোখ রগড়াতে রগড়াতে উঠে আসে, শৌনকের রুম থেকে। স্নিগ্ধাকে সামনে দেখে জিজ্ঞেস করে ওঠে, "দিদি, এই এলে ? আজ খুব ক্লান্ত লাগছে তোমাকে। দাও, তোমার হাতের ব্যাগটা দাও আমাকে। "

 

স্নিগ্ধা হাত তুলে সুপর্ণাকে চুপ করিয়ে ভাঙা গলায়, ধীরে ধীরে জিজ্ঞেস করে ,"সোনু কোথায় রে ? ও খেয়েছে ? "

 

"দেখো না দিদি। ও রাতে আজ আর কিছু খেলোই না। সেই যে তুমি চলে গেলে, তোমার ওপরে রেগে গেলো, ওই নিজের টেডি নিয়ে খেলতে খেলতে ঘুমিয়ে পড়েছে। ও তোমার রুমেই শুয়ে পড়েছিলো তোমার ছেড়ে রাখা শাড়ির আঁচল জড়িয়ে। আমি তো আবার ওকে টেনে এনে, ওর রুমে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছি। ডেকে তুলবো ? তুমি কিছু খাইয়ে দেবে ওকে ? "ভেতরে স্নিগ্ধার রুমের দিকে যেতে যেতে সুপর্ণা জিজ্ঞেস করে।

 

কোনো উত্তর না পেয়ে সুপর্ণা পেছনে তাকায়, স্নিগ্ধা কে দেখতে পায় না। তাড়াতাড়ি শৌনকের রুমে ঢুকে আসে সুপর্ণা , দেখতে পায় এক অভাবনীয় অথচ অতি কাঙ্খিত দৃশ্য চোখের সামনে।

 

শৌনককে জড়িয়ে স্নিগ্ধা শুয়ে পড়েছে ওর পাশে, টেনে নিয়েছে শৌনককে নিজের বুকের মাঝে। শৌনক ঘুমের চোখে 'মা' বলে নিজের পা তুলে দিয়েছে স্নিগ্ধার গায়ের ওপরে, মুখে একটা শান্তির আভাস।  

 

এই দৃশ্য দেখার জন্য তিন তিনটে বছর সুপর্ণা অপেক্ষা করেছিলো , মাঝে মাঝেই প্রার্থনা করতো ঈশ্বরের কাছে, "হে ভগবান, মা আর ছেলেকে এক করে দাও। দিদিকে একটু বোঝাও, যাতে সময় থাকতে ছেলের কাছে ফিরে আসে, ওকে টেনে নেয় বুকে। চোখের কোণে চিকচিক করে ওঠে জল , সুপর্ণা দরজাটা ভেজিয়ে ধীরে ধীরে নেমে আসে নিচে, নিজের রুমে।

 

 

++++++++++

 

 

হঠাৎ দেওয়ালের ঘড়িটার দিকে চোখ পড়ে যায় বিতানের। প্রায় আড়াইটে ! তাড়াতাড়ি মেহেকের দিকে দেখে অপ্রস্তুতের হাসি হেসে বলে ওঠে ,"দেখুন দেখি মেহেক, এতটা সময় ধরে আমরা শুধু গল্পই করে গেলাম ! আপনার তো সাড়ে দশটায় চলে যাওয়ার কথা ছিলো, আর এখন তো মাঝ রাত ! আমার নিজের ওপরেই লজ্জা হচ্ছে এখন। "

 

মেহেক তাড়াতাড়ি বলে ওঠে ,"আরে এভাবে বোলো না ! প্লিজ বিতান। একটা কথা বলবে ? স্নিগ্ধা চলে যাওয়ার পরে, কার ও সাথে এইভাবে পুরো ব্যাপারটা নিয়ে কোনো কথা বলেছিলে ? আমি জানি, তুমি বলো নি। আর নিজেই নিজেকে দোষ দিয়ে এসেছো এতদিন ধরে। আরো আগে, কারোর কাছে খুলে বলতে পারলে, এতোটা অপরাধবোধ আসতো না তোমার মধ্যে। কিন্তু স্নিগ্ধা দিই বা কি ? এই তিন বছরে তোমার সাথে একবার ও দেখা করতে আসে নি ? আর তুমি শৌনকের সাথে প্রত্যেক তিন মাসে একবার দেখা করো ? এটা তো অন্যায় ! তুমি প্রতি মাসেই তো একবার করে দেখা করতে পারো। "

 

কখন কথা বলতে বলতে মেহেক যে বিতানকে 'নিজের', ভীষণ 'কাছের' করে নিয়েছে ও নিজেও জানে না।

 

বিতান বলে ওঠে, "আসলে, আমি শৌনকের সাথে থাকলেও স্নিগ্ধা অনেক ইস্যু করে। ওকে কিছু কিনে দিতে দেয় না, ওকে আলাদা করে আমাকে কিছু খাওয়াতে দেয় না। আমি নাকি ওর সাথে বেশিক্ষণ থাকলে , ওই একদিনে ওকে এতো আদর দিয়ে ফেলি, সেই আদরে ও নাকি বাঁদর হয়ে যায় , আরো কত কি ! এসব আমার আর ভালো লাগে না। এমনিতে তো জীবনের কাছে হেরেই গিয়েছি। থাকার মধ্যে আছে শুধু আমার নতুন ব্যবসা, সেটাকেই বড়ো করার চেষ্টা করছি। আপনি জানেন মেহেক ? আমি চাকরি ছেড়ে কেন ব্যবসা শুরু করেছি ? চাকরিতে থাকলে একটা নির্দিষ্ট সময় শেষে সেই তো ঘরে ফিরে আসতে হতো ! আর এই ফাঁকা শূন্য ঘর, আমাকে খেয়ে ফেলতো প্রতি রাতে। আমি যেন একটা হাহাকার শুনতে পেতাম সবসময়। মাঝে মাঝে এতো একা লাগতো, চেঁচাতে ইচ্ছে হতো। চেঁচিয়েছি জোরে , কিছু একটা বলে , ফাঁকা শূন্য ঘরে সেটাই আবার প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসতো। ভীষণ ভয় পেতাম আমি। ভীষণ। স্নিগ্ধা আর আমাদের সোনু, চলে যাওয়ার পরে, প্রথম কয়েক মাস, কত রাত আমি না ঘুমিয়ে কাটিয়েছি ! সে একটা সময় ছিলো। তারপরেই আমি চাকরি ছেড়ে ব্যবসা শুরু করি। ব্যবসা করতে গিয়ে সবকিছু নিজে সামলাতে চেষ্টা করি, মানে মার্কেটিং, ফাইন্যান্স, অপারেশন, এইচ আর , সব। আর সব কিছু দেখতে গিয়ে, কাজের মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে, নিজের মনকে আমি শান্ত করি ধীরে ধীরে , তার পরে নিজেকে। এতটাই ব্যস্ত হয়ে থাকতাম মাঝে মাঝে, যে কারোর কথা মনেই আসতো না। তবুও, মাঝে মাঝে, কোনো ছুটির দিনে, অলস বিকেলে যখন ভীষণ ভাবে কারোর সঙ্গ পেতে ইচ্ছে করতো, মনে হতো কাউকে জড়িয়ে ধরি, তখন আমি কিছু এজেন্সিতে ফোন করে আপনার মতোই কাউকে হায়ার করতাম। এই তিনবছরে, আপনাকে নিয়ে পাঁচবার এরকম করেছি। কিন্তু আপনাকে বলতে সঙ্কোচ বা লজ্জা নেই এখন - কারোর সাথেই আমি মিলিত হতে পারিনি, কখনও। হয়তো এটাই আমার অভিশাপ , আমার স্নিগ্ধাকে প্রচন্ডভাবে ভালোবাসার পরিণাম ! " একটু চুপ করে যায় বিতান। একটু পরে উঠে দাঁড়িয়ে, এগিয়ে গিয়ে লিভিং রুমের পাশে একটা রুমের দরজা খুলে দিয়ে ইশারা করে মেহেককে ডাকে বিতান।

 

মেহেক উঠে দাঁড়িয়ে রুমের ভেতরে আসে। বিতান বলে ওঠে,"অনেক রাত হয়ে গেলো মেহেক। এখন আর বেরিয়ে কাজ নেই, গাড়িও পাবেন না! আপনি এই রুমে শুয়ে পড়ুন, একটু ঘুমিয়ে নিন। কাল সকালে , আমার সাথে একটু চা বা কফি খাওয়ার পরে, আমি আপনাকে সামনে ছেড়ে আসবো ! "

 

মেহেক বলে ওঠে,"আপনাকে অনেক ধন্যবাদ বিতান ! তবে এসবের কি কোনো দরকার আছে ? "

 

মেহেককে চুপ করিয়ে দিয়ে বিতান বলে ওঠে ,"ধন্যবাদ তো আপনার প্রাপ্তি। আপনি জানেন না , আপনি আমার কি উপকার করেছেন। এতদিন পরে , আপনাকে সব কিছু বলতে পেরে, আমি, আমি ভীষণ হাল্কা অনুভব করছি। অনেকদিন ধরে ভেতরে বিভিন্ন কথা - প্রশ্ন - ভাবনা - চিন্তা জমতে জমতে, একটা বিশাল বড়ো কোনো পাথর যেন চেপে বসে গিয়েছিলো ! আর ওর নিচে আমি, আমার আমিত্বটাকে হারিয়ে ফেলেছিলাম। আজ অনেকদিন পরে , অনেক অনেক দিন পরে খুব ভালো লাগছে। আজ আমার আবার লিখতে ইচ্ছে হচ্ছে। আপনি শুয়ে পড়ুন, ঘুমিয়ে নিন। আমি এখন একটু লিখবো।" বিতান রুমের দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে বেরিয়ে আসে ! " অনেকদিন কোনো কবিতা লেখা হয় নি, অনেকদিন ! " বলতে বলতে ওর তৈরী করা ছোট লাইব্রেরিতে এসে ঢোকে বিতান, টেনে নেয় খাতা কলম !



++++++++++

 


স্নিগ্ধা চলে গেছে প্রায় ঘন্টা দেড়েক, এখন সময় চারটে ! ভোর চারটে !

 

আগে, অনেক আগে এই সময় থেকেই ধীরে ধীরে ফুটে উঠতো দিনের আলো, পাখিদের দল শুরু করে দিতো কিচিরমিচির, রাস্তায় ঘড়ঘড় শব্দ করে চলতে শুরু করতো ভারী কিছু গাড়ী, দূরে কোথাও রাস্তার ধারের জলের কলের সামনে পড়তো লাইন , কেউ কাপড় কাচতে বসতো, কেউ বা স্নানে ব্যস্ত ! আরো একটু পরে, সাইকেল নিয়ে পেপার ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিতো বিভিন্ন বাড়ির বারান্দায় পেপার বিক্রেতারা। অনেক বাড়িতেই ছোট ছোট কচি কাঁচাগুলো ঘুম থেকে উঠে শুরু করতো গলা সাধতে। সেই সময়গুলো যে কোথায় হারিয়ে গেলো বড়ো হওয়ার সাথে সাথে !

 

যতই বড়ো হয়েছি, ততই নিজের চেনা পরিচিত জীবনের গন্ডী ছোট হয়ে এসেছে। আগে সারা পৃথিবীটাই ছিলো খেলার জগৎ, এখন নিজের জন্য এক চিলতে আকাশও খুঁজে পাওয়া যায় না। কিরকম স্বার্থপর হয়ে গেছি আমরা, কোনো কিছুতেই কিছু যায় আসে না আর।

 

এই যেমন স্নিগ্ধাকে এক ধাক্কায় দূরে সরিয়ে দিলাম আমি, আমার কাছ থেকে। তার মানে কি ওর প্রতি আমার যে মোহ ছিলো, সেটা ভেঙে গেছে বলেই আমি ওকে সরিয়ে দিয়েছি? ওর প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে বলেই আমি ওকে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম আমার জীবন থেকে? অথচ একসময়, এই আমিই তো কি ভীষণ রকম পাগল হয়ে গিয়েছিলাম আমি ওর জন্য। যদিও সেটা ছিলো আমার কৈশোরে , তবুও ভালোবেসেছিলাম ওকে আমি।

 

আমার প্রথম প্রেম। আজ ও ভুলতে পারিনি সেটা , তারপরে তো কত মেয়ে এলো জীবনে, শরীর দেওয়া নেওয়ার খেলা কত খেললাম সবার সাথে। কিন্তু, কারোর সাথে তো আমি কখনো মানসিক ভাবে এক হতে পারলাম না কোনোদিন !

 

সেটাই হয়তো আমার অক্ষমতা। জানি না।

 

 

++++++++++

 

 

নগ্ন পারভীন দাঁড়িয়ে একটা বিশাল বড়ো কাঁচের আয়নার সামনে। নিজেই নিজের প্রতিফলনের সাথে কথা বলছে এখন। যে কেউ দেখলে ভাববে, পারভীন সত্যি পাগল হয়ে গেছে। কিন্তু....

 

নিজের প্রতিফলনের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে পারভীন ,"আসলে কি জানিস তো পারভীন ? তুই ভীষণ একা, সারা জীবনে তুই স্নিগ্ধা ছাড়া অন্য কাউকে ভালোবাসতে পারিস নি , অন্য কাউকে মন থেকে চাস নি ! "

 

"তাহলে, তাহলে আমি কেন ওকে এতো কষ্ট দিলাম ? কেন ওর সবকিছু নষ্ট করে দিলাম ? কেন ? কেউ কাউকে ভালোবাসলে, তার সুখেই সে নিজেও সুখী হয়, খুশি হয়। সেটাই তো জানি আমি। "    

 

"কিন্তু তুই কি করেছিস ? তুই তো স্নিগ্ধার জীবন ছারখার করে দিয়েছিস। কেন ওর জীবনে আবার গেলি তুই ? কেন একজন তৃতীয় ব্যক্তি হয়ে দুজনের মাঝে ঢুকতে গেলি ? কেন জানিস ? তোর অবচেতনে, তুই ওকে প্রচন্ড ঘৃণা করতিস ! সেই কৈশোরের, সেই অপমানের জন্য। তুই চাইতিস ওকে শেষ করে দিতে। আর এতো বছর পরে ওকে সামনে পেয়ে, তুই , তোর অবচতন মন, তোর নিজের চেতনাকে ছাপিয়ে ওপরে উঠে এসেছিলো ! "

 

"তবুও, আমি তো ওর ভালো চেয়েছিলাম ! ওর অসুখী মনকে শান্ত করতে চেয়েছিলাম। ওকে তো পুরোপুরি ভাবে নিজের করতে চেয়েছিলাম। "

 

"ভুল ! তুই সেটা নিজেকে বোঝাচ্ছিস, সান্ত্বনা দিচ্ছিস। নারীর স্বাধীনতা, নারীর নিজের ইচ্ছে নিয়ে তুই স্নিগ্ধাকে যা বলেছিস, যা বুঝিয়েছিস , সেটা হয়তো নিজের জায়গাতে ঠিক। সেটাই হওয়া উচিত। কিন্তু আমাদের সমাজ, এখনও সেই জায়গাতে পৌঁছয় নি। আমাদের সমাজ আসলে তৈরী করেছে, তোদের মতো পুরুষেরা, তারাই এইসব পুরোনো বিধান দিয়ে গেছে, জগ জগ ধরে সেটাকেই সবাই মেনে এসেছে। হয়তো পরিবর্তন আসবে, আসছে খুব ধীরে ধীরে, তবুও সবাই সেটা মানতে পারছে না। তাই তো একটা পুরুষ, বিবাহিত হয়েও হাজার একটা সম্পর্ক বাইরে করতে পারে , গোপনে, সবার অগোচরে। যদি কখনও ধরা পড়ে, সমাজের চোখে কে দোষী হয় তখন? সে নিজে? বেশির ক্ষেত্রেই - তার স্ত্রী বা তার সঙ্গিনী, কারণ সে তার পুরুষকে ধরে রাখতে পারে নি। কিন্তু একটা নারী যদি পুরুষের অক্ষমতার জন্য বা অন্য কোনো কারণে, কারোর সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে , তখন তাকে বলা হয় লাইনে দাঁড়ানো মেয়ে, বেশ্যা আরো কত কি। একটা বৈবাহিক সম্পর্কে, প্রকৃত ভালোবাসার বন্ধনে থাকে একটা বিশ্বাস, পরস্পরের মধ্যে ভরসা। সেটা কেউ-ই ভাঙতে চায় না ! তবুও মানুষের মন তো , কখন কার দিকে ঝুঁকে পড়ে। কিন্তু পারভীন, তুই এটা কি করলি ? বিতান তো স্নিগ্ধাকে ভালোবাসতো, স্নিগ্ধা নিজেও বিতানকে। তুই জোর করে ওদের মাঝে ঢুকে, বিতানের দুর্বলতার সুযোগ আর স্নিগ্ধার অশান্ত মন - শরীর , সেই সব কিছুর সুযোগ নিয়ে, সব শেষ করে দিলি ? শুধু নিজের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য ? আর তুই বলছিস, তুই নাকি ওকে ভালোবাসিস ? ছিঃ ! "

 

"তাহলে? তাহলে, কি করবো আমি ? কি করবো? আমি কখনো হারতে শিখিনি জীবনে। আমাকে শুধুই ওপরে উঠতে হবে, আরো ওপরে। আর যারা আমাকে ছোট করতে চেয়েছে, আমি তাদের সবাইকে দমিয়ে, শেষ করে দেব , যেরকম ভাবেই হোক। সে যেই হোক। "

 

ধীরে ধীরে পারভীনের সামনে আয়নার প্রতিফলনটা হারিয়ে যেতে থাকে, মিশে যেতে থাকে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে আয়নার কাঁচের মধ্যে। চেঁচিয়ে ওঠে পারভীন, "কি হলো ? কোথায় ছেড়ে যাচ্ছ আমাকে ? আমাকে ছেড়ে যেও না ! "

 

প্রতিফলনের মুখটা ধীরে ধীরে বলে ওঠে,"আর তোর সাথে থাকার আমার কোনো দরকার নেই। তুই কলুষিত, তোর আত্মা আজ মৃত, তোর শরীরটাই শুধু বেঁচে থাকবে এখনকার এই পৃথিবীতে। মন - হৃদয় বলে তোর আর কিছুই অবশিষ্ট নেই আজ। এখনো সময় আছে....."

 

পারভীন নগ্ন অবস্থায় ছুটে যায় রান্নাঘরের দিকে , মনে মনে বলতে থাকে, সময় আছে, সময় আছে। আমাকে মরতেই হবে, মরতেই হবে। আমার মরণে যদি কিছু ঠিক হয়......কুকুরদুটো মালিকের সাথে দৌড়ে যায় রান্নাঘরের দিকে। পারভীন রান্নাঘরে গিয়ে ড্রয়ার ঘেঁটে বের করে আনে মাংস কাটার বড়ো ছুরি, চেপে ধরে নিজের গলার ওপরে.....

 

 

++++++++++

 

 

সময় এখন সকাল নটা।

 

কবিতা লিখতে লিখতে কখন যে বিতান ঘুমিয়ে পড়েছিলো টেবিলের ওপরে ! হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় ওর, তাড়াতাড়ি উঠে বসে সোজা হয়ে। মনে পড়ে যায় রাতের কথা। তাড়াতাড়ি ছুটে যায় মেহেক রাতে যে রুমে ছিলো সেখানে। কাউকে দেখতে না পেয়ে একটু অবাক হয় ও। রান্নাঘর থেকে ভেসে আসা কিছু আওয়াজে , কিচেনের দিকে পা বাড়ায় বিতান।

 

মেহেক চা বানাচ্ছে দুজনের জন্য। ওকে দেখে হেসে মেহেক বলে ওঠে," গুড মর্নিং। তুমি ঘুমোচ্ছ দেখে, আর ডাকি নি তোমাকে, ভাবলাম চা টা তৈরী করে নিয়ে তারপরে ডাকবো। "

 

বিতান লজ্জায় পড়ে যায়, একটু হেসে বলে, "আরে, চা তো আমার তৈরী করার কথা ছিলো ! ঠিক আছে, আপনি যখন করছেন, আমি তাহলে একটু চোখে মুখে জল দিয়ে আসি , তারপরে একসাথে বসে চা খেয়ে আপনাকে ছেড়ে দিয়ে আসবো ! "

 

ভেতরে এসে চোখে মুখে জল দেয় ভালো করে বিতান। ব্রাশ করে বাইরে আসে। মেহেক আজ ওর সবকটা ঘরের জানালা খুলে দিয়েছে। অনেকদিন পরে হু হু করে বাইরের সব আলো একসাথে ভেসে এসেছে ভেতরে। এতদিন রুদ্ধদ্বার দেখে যে সব আলোর কণা ভেতরে ঢুকতে পারেনি, আজ খোলা হাওয়ার সাথে, তারাও এসে ভিড় জমিয়েছে, আলোকিত করে তুলেছে ভেতরের সব আসবাবপত্র, টেবিল, পর্দা, বিছানার চাদর - সবাইকে।

 

বিতানের মনটা আনন্দে ভরে ওঠে। কতদিন পরে এইরকম একটা দিন ও প্রত্যক্ষ করছে , নিজেও মনে করতে পারছে না ভালো করে। সেই স্নিগ্ধা যখন ছিলো....

 

"এসে গেছি। " মেহেকের গলার স্বরে ঘোর থেকে বাইরে বেরিয়ে এলো বিতান। মেহেক দু কাপ চা নিয়ে এসে বাইরের ঘরের সেন্টার টেবিলের ওপরে রেখেছে। বিতান ওকে বসতে বলে, ভেতর থেকে বিস্কিট নিয়ে আসে। দুজনে মিলে চা খেতে খেতে, বিতান জিজ্ঞেস করে ওঠে মেহেক কে ,"আচ্ছা মেহেক ! আপনি কাল রাতে, আমাকে আপনার কথাও বলেছিলেন , আপনার ভাই, মা, বাবার কথাও উল্লেখ করেছিলেন। যদি কিছু মনে না করেন, আপনার ভাই কে আমার সাথে দেখা করতে বলবেন ? আজ সাড়ে বারোটার দিকে ? আমি আমার ব্যবসা বাড়ানোর জন্য আরো কিছু ছেলে খুঁজছি। আর আপনার ভাই তো গ্র্যাজুয়েশন করে নিয়েছে। ওর একটা ছোট ইন্টারভিউ নিয়ে, যদি দেখি ও ফিট করে যাচ্ছে...."

 

"না না বিতান, আপনি এভাবে দয়া করবেন না আমাকে। " বলে ওঠে মেহেক।

 

"দয়া ? দয়া নয় মেহেক , ও যদি আমার ইন্টারভিউ ক্র্যাক করতে পারে, তবেই ওকে নেবো। সেটা আমার ওপরে ছেড়ে দিন ! আর আমাকে এখন কাউকে হায়ার করতে হলে, পেপারে বিজ্ঞাপন দিতে হবে, জব সাইট গুলোতে পোস্ট করতে হবে। অনেকটা সময় চলে যাবে। তার থেকে যদি চেনা কন্ট্যাক্ট এর মাধ্যমে হয়ে যায় , ক্ষতি কি ? তাই না ? " টেবিলের ওপরে রাখা একটা পেপারের নিচ থেকে নিজের বিজনেস কার্ডটা বের করে মেহেকের হাতে তুলে দিয়ে বলে ওঠে বিতান, "এই যে, এইটা আমার অফিসের ঠিকানা। আপনি কথা বলে নিন আপনার ভাইয়ের সাথে, যদি ও রাজি থাকে, ওকে অবশ্যই সাড়ে বারোটার সময়ে আসতে বলবেন। সাড়ে বারোটা থেকে এক মিনিট ও যদি দেরি হয়, আমি কিন্তু ওকে পাঠিয়ে দেবো। "

 

একটু পরে বাইরে বেরিয়ে আসে দুজনেই। মেহেককে একটা গাড়িতে তুলে দিয়ে ফিরে আসে বিতান। বিতান সুইচ অফ থাকা ফোনটা অন করে। ফোনটা অন করতেই একের পর এক মিসড কল এলার্ট আসতে থাকে ফোনের স্ক্রিনে। বিতান স্তব্ধ হয়ে বসে পড়ে সোফার ওপরে , বারোটা মিস কল - সবকটাই স্নিগ্ধার নম্বর থেকে !

 

কেন? এতদিন পরে, কি চায় স্নিগ্ধা ? ও কি, ও কি ফিরে আসতে চাইছে ? হঠাৎ একটা অজানা আশঙ্কায় মন কেঁপে ওঠে বিতানের। শৌনকের কিছু হলো না তো ? ও ভালো আছে তো ?

 

তাড়াতাড়ি স্নিগ্ধাার নম্বর ডায়াল করে বিতান।

 

 

++++++++++ 


 

আজ বেশ সকালেই ঘুম ভেঙেগেছে শৌনকের। ঘুম ভেঙে পাশে শুয়ে থাকা মা কে দেখে ভীষণ অবাক হয়ে ওঠে ও। সেই কত ছোট বয়সেই মা ওকে আলাদা করে দিয়েছিলো, ওকে বাধ্য করেছিলো একা একা শুতে , অন্য একটা ঘরে। তখন কতই বা বয়স শৌনকের ? চার ? মা বলেছিলো, "শৌনক, তুমি এখন বড়ো হয়ে গেছো, আর বড়োরা একা, আলাদা ঘুমোয় !"

 

ও মা কে বলেছিলো, "কিন্তু তুমি আর বাবা তো একসাথে ঘুমোয় , তোমরাও তো বড়ো ! তাহলে ? "

 

"আমাদের ব্যাপারটা আলাদা , আর বাবার তো খুব ভূতের ভয়। আমি পাশে না ঘুমোলে, বাবা যদি চেঁচিয়ে ওঠে মাঝ রাত্তিরে ? তাহলে ? কিন্তু আমার সোনু তো ভীষণ স্ট্রং আর বাহাদুর, তাই না ? ও তো একা শুতে ভয় পাবে না। আর আমরা তো পাশের রুমেই আছি। কোনো ভয় নেই ! "

 

একা একা ঘুমোতে, প্রথম প্রথম খুব ভয় করতো শৌনকের , কিন্তু মা যে বলেছে ও স্ট্রং আর বাহাদুর ! ও ভয় পাবে না একদম।

 

কিন্তু খুব, খুব মিস করতো বাবা আর মায়ের মাঝে ঘুমোনোটা ও। রাতে একবার বাবাকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়তো, আবার কখনো বা মায়ের বুকের ভেতরে মুখ গুঁজে। এখানে, এই নতুন জায়গায় আসার পরে তো মা মাঝে মাঝেই রাতে কাজের জন্য বেরিয়ে যেত। সুপর্ণাদির কাছে থাকতে হতো। সুপর্ণাদি রাতে খাইয়ে দিতো ওকে। আজ হঠাৎ কি হয়েছে মায়ের ? আর মায়ের চোখের নিচে, বিছানা এরকম ভেজা কেন ? মায়ের চোখে কিছু হয়েছে ?

 

শৌনক ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি মাকে ঠেলে ওঠায় , "মা ? ও মা ? ওঠো না ! কি হয়েছে তোমার ? "

 

ধড়ফড় করে উঠে বসে স্নিগ্ধা। এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না গত রাতের সব ঘটনা। সব যেন কোনো এক ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন ! চোখের সামনে শৌনককে দেখে বুঝতে পারে, সবটাই সত্যি, কঠোর বাস্তব।

 

তাড়াতাড়ি শৌনককে জড়িয়ে ধরে নিজের বুকের মাঝে, আদরে, চুমুতে ভরিয়ে দেয় ওর মুখ। বার বার বলতে থাকে স্নিগ্ধা , "সোনু, তোকে আমি অনেক কষ্ট দিয়েছি , তাই না ? তোর মা, ভীষণ ভীষণ খারাপ ! খুব খারাপ। আর তোকে আমি কোনো কষ্ট দেবো না ! কাউকে আর আমার জন্য কোনো কষ্ট পেতে হবে না। "

 

অনেকদিন পরে, মায়ের গায়ের চেনা গন্ধটা পেলো শৌনক। ও নিজেও কাঁদতে শুরু করে মাকে জড়িয়ে ধরে। আজ আর ইচ্ছে করছে না কোথাও যেতে, খালি মনে হচ্ছে মাকে জড়িয়ে বসে থাকি, মায়ের কোলে মাথা রেখে চুপ করে শুয়ে থাকি, মা গান শোনাবে আমাকে, মাথায় চুলে বিলি কেটে দেবে , মাঝে মাঝে আদর করবে আমায়। "

 

কাঁদতে কাঁদতেই শৌনক বলে ওঠে,"মা ! মা ! খুব খিদে পেয়েছে। "

 

বাস্তবের মাটিতে ফিরে আসে স্নিগ্ধা। কপট রাগ দেখিয়ে, ছেলেকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। একটু রাগী রাগী স্বরে বলে ওঠে ,"খিদে তো পাবেই। কাল রাতে না ঘুমিয়ে খুব শুয়ে পড়া হয়েছিলো, তাই না ? আমাকে সুপর্ণা সব বলেছে। এবার ওঠো, যাও, বাথরুমে যাও। ব্রাশ করে ফ্রেশ হয়ে আয়। আজ আমি তোকে নিজের হাতে ব্রেকফাস্ট বানিয়ে খাওয়াবো। আজ আমরা লুচি আর আলুভাজা খাবো। কেমন ? "

 

শৌনক নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না , লুচি ? মা নিজে রান্না করবে ? কতদিন মায়ের হাতের রান্না খাইনি। সুপর্ণাদি রেডি করে দিতো, তাও কর্নফ্লেক্স বা ওটস, বা নুডলস ! মা বলতো, লুচি ছোটোলোকেরা খায় , আর ঐসব আজেবাজে তেলেভাজা খেলে শরীর খারাপ করে। ও আরো একবার জিজ্ঞেস করলো , "সত্যি ? সত্যি আজ আমরা লুচি খাবো ? " মাথা নাড়ে স্নিগ্ধা। ও চেঁচিয়ে ওঠে আনন্দে। তারপরে বলে,"মা, বলছি লুচি আর সাথে আলুর দম করো না ! আলু ভাজা বাবা ভালো করতো, কিন্তু তুমি কি ভালো আলুর দম করতে , মনে আছে তোমার ? প্লিজ ! প্লিজ ! "

 

হেসে ওঠে স্নিগ্ধা। "ঠিক আছে, ঠিক আছে। লুচি আলুর দম-ই হবে। এবার ওঠ, আর ভাগ বাথরুমে। "

 

শৌনক বাথরুমে চলে গেলে, তাড়াতাড়ি নিজের হাতে পুরো বিছানা করে ফেলে স্নিগ্ধা। ও মনে মনে ভাবে, আজ কেন জানি না, ঘরের এইসব কাজ করতে এতো ভালো লাগছে। আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম এই সব কাজের কথা , সুপর্ণা-ই সব কিছু করে দিতো।

 

স্নিগ্ধা বেরিয়ে আসে শৌনকের রুম থেকে। নিজের রুমের দিকে যেতে যেতে, চেঁচিয়ে ডাকে সুপর্ণা কে, সুপর্ণা নিচের থেকে মুখ বাড়ালে, স্নিগ্ধা বলে ,"তুই কয়েকটা আলু নিয়ে একটু সেদ্ধ করতে বসা, আর ময়দা মেখে দে। আজ আমরা সবাই লুচি আলুর দম খাবো। আর আমি করবো। বাকিটা একটু ফ্রেশ হয়ে, জামা কাপড় চেঞ্জ করে নিচে আসছি। সোনু নিচে এলে, ওকে একগ্লাস দুধ দিয়ে দিস ! "

 

নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায় স্নিগ্ধা।

 

নিচ থেকে সুপর্ণা ভাবে, "কি হলো দিদির ?" কিচেনের দিকে যেতে যেতে হেসে ওঠে নিজের মনে ,"যা হয়েছে ভালোর জন্যই হয়েছে তবে। "

 

নিজের রুমে এসে স্নিগ্ধা ঘড়ি দেখে। সাতটা বাজে। টাওয়েল নিয়ে বাথরুমের দিকে যেতে যেতে হঠাৎ কি মনে করে , পার্স থেকে মোবাইলবের করে আনে স্নিগ্ধা। তাড়াতাড়ি বিতানের নম্বর বের করে এনে , চুপ করে দেখতে থাকে স্ক্রীনটা। একটু পরে মনে হলো স্নিগ্ধার, কেউ যেন ওর আঙুলগুলোকে ঠেলে দিচ্ছে বিতানের নম্বর ডায়াল করার দিকে, কিছু বুঝে ওঠার আগেই নম্বর ডায়াল হয়ে যায়। ওদিক থেকে ভেসে আসছে যান্ত্রিক একটা শব্দ, - 'এই নম্বরটি এখন সুইচ অফ করে রাখা আছে। '

 

আবার ফোন করে স্নিগ্ধা , আবার...আবার....আজ কথা যে বলতেই হবে বিতানের সাথে।



++++++++++ 



এখন সময়, প্রায় সাড়ে নটা। দিনের আলোতে চেনা শহরটাও কিরকম অচেনা লাগে, সবাই ছুটছে।

 

কিসের উদ্দেশ্যে ? কার জন্য ? সব-ই তো এই পাপী পেটের জন্য !

 

মাঝে মাঝে খুব মনে হয়, ইস্স , সত্যি যদি প্রোফেসর শংকু থাকতেন এই বাস্তবের পৃথিবীতে, সত্যিই যদি উনি সেই ট্যাবলেট আবিষ্কার করে সবার হাতে হাতে তুলে দিতেন যেটা সারাদিনে একবার খেলেই মিটে যেত পেটের সব খিদে, তাহলেও কি মানুষ এইভাবে গরু গাধার মতো রোদে ঘামতে ঘামতে, বৃষ্টিতে ভিজে, ভিড় ঠেলে, এ ওর সাথে মারামারি - চুলোচুলি করে সারাদিন ধরে শুধু দৌড়েই যেত ?

 

কত মানুষ আছে যারা দৌড়োচ্ছে উদ্দেশ্যহীন ভাবে, কোনো লক্ষ্য ছাড়াই। তারা নিজেরাও জানেনা জীবনে তারা কি পেতে চায়, কি অর্জন করতে চায় ! এদের মধ্যে হয়তো আছে কত কবি, লেখক, আর্টিস্ট, পেন্টার, গায়ক - সবাই নিজেদের সব স্বপ্ন ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে নর্দমায়, ছুটে চলেছে কিছু গান্ধী মুখ লাগানো কাগজের তোড়া নিজের পকেটে ভরতে - তাহলেই চলবে তার সংসার , জীবন যাপনের চাকা ঘুরতে থাকবে।

 

আমিও তো, তাই করে বেড়াচ্ছি , তবে আমার ছোটা রাতের অন্ধকারে , সবার চোখের আড়ালে। ভাবতে অবাক লাগে, যেটা না হলে মানুষের চলে না, যার অভাবে যুদ্ধ লেগে যেতে পারে, যে চাহিদাকে বিসর্জন করে, ভুলে থাকা প্রায় অসম্ভব, তাকেই আমাদের এই সমাজ বলে - খারাপ !

 

 

++++++++++ 

 


অবজ্ঞার একটা হাসি ফুটে ওঠে মেহেকের মুখে। পার্ক স্ট্রীটের ঠিকানা বলে, বিতানকে হাত নেড়ে টা টা করবে বলে তাকায় মেহেক। বিতান পেছন ঘুরে রাস্তা ক্রস করে চলে গেছে।

 

একবার, আর একবার ও কি ও তাকাবে না আমার দিকে ? ওর রাতের বন্ধুর দিকে ?

 

মানুষ আসলে এইরকম-ই , রাতের ঘরের চার দেওয়ালের ভেতরের খবর যেন বাইরে কেউ না জানতে পারে ! মনে পড়ে বিতানের কথা , ভাইকে ফোন করতে হবে তাড়াতাড়ি।

 

ফোনটা বের করে মায়াঙ্ক এর নম্বরে ডায়াল করে মেহেক। মায়াঙ্ক একটু পরে ফোন রিসিভ করে ,"বল দিদি ! কেমন আছিস ? "

 

"তুই আমার কথা ছাড় ! শোন ভালো করে আমার কথা.............. বুঝেছিস তো ? এখন প্রায় দশটা , তোর কাছে আরও আড়াই ঘন্টা সময় আছে। তাড়াতাড়ি, তোর ফাইল রেডি করে, সিভি প্রিন্ট আউট নিয়ে , ভালো করে শেভ করে আর চুল কেটে, চলে যা এই অফিসে। তোর ইন্টারভিউ কিন্তু ঠিক সাড়ে বারোটায় , আমাকে বিতান বারবার বলে দিয়েছে , লেট হলে , কোনো চান্স নেই। আজ তোর কাছে একটা ভালো সুযোগ আসতে চলেছে ভাই। এটাকে নষ্ট করিস না। কেমন ? আমি এখন রাখছি, তুই রেডি হয়ে, ইন্টারভিউ দিয়ে , তারপরে আমাকে ফোন করিস। অল দা বেস্ট ভাই। " এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে যায় মেহেক।

 

মায়াঙ্ক কিছুক্ষণ চুপ করে , বলে ওঠে , "আজ কি হচ্ছে বলতো দিদি ? আজ আমার সাথে এসব কি হচ্ছে ?"

 

"মানে ?"

 

"আরে আমি তো তোকেই ফোন করতে যাচ্ছিলাম। সকালে সাড়ে নটার সময়ে আমার একটা মেল আসে। তোর মনে আছে কিনা জানিনা, দু মাস আগে আমি একটা ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম। একটা মার্কেট রিসার্চ কোম্পানির জন্য, 'ডেটা কালেক্টর এন্ড অডিটর' পজিশনের জন্য। ওরা আমাকে কনফার্ম করেছে আর মেল-এ; এপয়েন্টমেন্ট লেটার ও পাঠিয়ে দিয়েছে। সোমবার থেকে জয়েন করতে হবে। স্যালারি চোদ্দহাজার করে, সাথে যে কদিন ফিল্ডে থাকতে হবে, তার জন্য প্রতিদিন সাড়ে তিনশো করে এক্সট্রা। এছাড়া কিসব প্রভিডেন্ট ফান্ড, হেলথ পলিসি আরো অনেক কিছু আছে। আমার সেদিন শুনেই খুব ভালো লেগেছিলো প্রোফাইলটা। " বলে ওঠে মায়াঙ্ক।

 

"তাহলে ? কি করবি তুই ? তুই কি যাবি বিতানের অফিসে ? "জিজ্ঞেস করে মেহেক।

 

"কি লাভ বলতো? একটা জায়গাতে হয়েই তো গেছে, আর আমার পুরো প্রোফাইলটা খুব পছন্দ হয়েছে রে। " মায়াঙ্ক আবার চুপ করে যায়। একটু পরে বলে ওঠে ,"দিদি, একটা কথা বলবো তোকে ? রাগ করবি না তো ?"

 

"বল না !"

 

"তোকে একটা মেয়ের কথা বলেছিলাম কয়েকদিন আগে, মনে আছে ? " জিজ্ঞেস করে মায়াঙ্ক।

 

মনে পড়ে যাই মেহেকের ; বেশ কিছুদিন আগে মেহেক ওকে জিজ্ঞেস করেছিলো, " তুই কি প্রেম করছিস নাকি রে ? আজকাল মাঝে মাঝেই তোর ফোন ব্যস্ত থাকে ! আগে তো এরকম ছিলো না !"

 

সেদিন মায়াঙ্ক বাচ্চাদের মতো হেসে, লজ্জা পেয়ে, মাথা চুলকে, এদিক ওদিক তাকিয়ে বলেছিলো ,"ওই আর কি। আছে একজন রে। দেখা যাক কি হয়। " মেহেক আর বেশি কিছু জিজ্ঞেস করে নি সেদিন ওকে।

 

মেহেক জিজ্ঞেস করে ,"হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়েছে , তুই তো সব চেপে গেলি সেদিন। কি হয়েছে ? "

 

মায়াঙ্ক ধীরে ধীরে বলে ওঠে ,"ওর নাম, সুপর্ণা। আজ আমি ওর সাথে দেখা করবো, ওর ফ্ল্যাটে। আর সকালে সবার আগে ভাবলাম ওকেই খবরটা দেবো। তারপরে ভাবলাম , থাক - সারপ্রাইজ দেবো ওকে। দিদি, আমরা দুজন দুজনকে না খুব ভালোবেসেফেলেছি আর এতদিন আমার সেরকম কোনো চাকরি হচ্ছিলো না বলে , আমি কিছু বলতে পারি নি। আজ ভাবছি বলেই দিই। কি বলিস ? "

 

"জানিস মেয়েটা কি করে ? কতদূর পড়াশোনা ? তোর সাথে ঠিকঠাক ভাবে হাঁটতে পারবে তো ? দেখ ভাই, এখন প্রেম করছিস ওর সাথে, খুব ভালো কথা। কিন্তু জীবনটা অনেক কঠিন, আর প্রতি পদক্ষেপে, এই জীবন - তোর, তোদের সামনে ছুঁড়ে দেবে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ। সেগুলো একসাথে মোকাবিলা করতে পারবি তো ? তাই যা করবি ভেবেশুনে করিস , এইটুকুই আমি বলবো তোকে। "

 

হেসে ওঠে মায়াঙ্ক, "আমি জানি রে দিদি, আমি জানি। বাবা চলে যাওয়ার পরে, যে লড়াই তুই রোজ করে যাচ্ছিস, আমাদের ভালো রাখার জন্য , সবকিছু টিকিয়ে রাখার জন্য, আমি সব জানি। তুই, তোর যা কাজ , সেটাও আমি অল্প বিস্তর আন্দাজ করতে পারি এখন। কিন্তু সেটা নিয়ে তোর লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই , হয়তো এরকম কিছু না হলে আমরা সবাই না খেতে পেয়ে মরে যেতাম এতদিনে। তবে, একটা কথা বলবো তোকে ? এই কাজটা ছেড়ে দে। আমিও তো চাকরি শুরু করলাম। আমি ঠিক সামলিয়ে নেবো। "

 

কেঁপে ওঠে মেহেক ভেতরে ভেতরে ! মায়াঙ্ক, ভাই, ও কি করে জানলো ? ওর তো জানার কথা নয় ! তাহলে কি মা ও বুঝে গেছে ? জেনে গেছে ? কি করে আমি দাঁড়াবো ওদের সামনে গিয়ে ? মেহেক কিছু বলার আগেই, মায়াঙ্ক ফোনের অন্যদিক থেকে কোনোভাবে বুঝে যায় দিদির মনের ভেতরের দ্বন্দ, হতাশা, ভয়, খবর।

 

ও তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, "না রে ! মা কিছুই জানে না। সেদিন তুই আমাকে বকেছিলিস, মনে আছে ? তোর ব্যাগ ঘাঁটার জন্য। সেদিন ওখানে একটা কার্ড পাই আমি। সেখানে একটা কিছু নাম লেখা ছিল। তখন আমি ওদেরকে নিয়ে ইন্টারনেটে সার্চ করি, জানতে পারি তোদের 'কাজের ধরণ'। আমি তো জানি, তুই নিজের ইচ্ছেতে এই জীবন বেছে নিস নি। বাবা-ই তো এই সব কিছুর জন্য দায়ী। নিজে চলে গেলো অসময়ে, আমাদের জন্য কোনো কিছু ছেড়ে গেলো না , আর সব দায়িত্ব তোর ওপরে , তোর মাথায় এসে পড়ে। তবে সেদিন আমার খুব রাগ হয়েছিলো রে , ইচ্ছে হচ্ছিলো সব ভেঙে দিই, ধ্বংস করে দিই। ধীরে ধীরে, পরে মাথা ঠান্ডা হলে যখন ভাবি, তখন বুঝতে পারি, তুই এভাবে না দাঁড়ালে, আমরা, আমাদের তিনজনের অস্তিত্ব সব নষ্ট হয়ে যেত, মা - মাকেও আর বাঁচানো যেতো না হয়তো। এখন তোর ওপরে আমার শ্রদ্ধা আরো বেড়ে গেছে রে। "

 

"ভাইটা আমার অনেক বড়ো হয়ে গেছে তো। " কান্না চেপে কোনোরকমে ফোনে বলে ওঠে মেহেক। ফোনটা কেটে দেয়।

 

 

++++++++++ 

 


হলুদ কালো ট্যাক্সির খোলা জানালা দিয়ে হাওয়াতে ভাসিয়ে দেয় সব দুঃখ, গ্লানি, চোখের জল । মনে মনে হেসে ওঠে, বিস্বাদের সেই হাসি হাসতে হাসতে নিজেই নিজেকে বলে মেহেক, একদিন না একদিন , হয়তো মা ও জানবে আমি কি করি, কিভাবে টাকা রোজগার করছি। কি হবে তখন ? মা ও কি মেনে নেবে ভাইয়ের মতো। না কি মা আমাকে, মায়ের জীবন থেকে বের করে দেবে? আমাকেও নোংরা মেয়ে, লাইনের মেয়ে বলে অপমান করে মেরে, দূরে সরিয়ে দেবে?

 

দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলে নিজেকে সান্ত্বনা দেয় মেহেক , যখন হবে, তখন বুঝে নেবো। তার আগে পর্যন্ত আমি আমার ভাই, আমার মা, আমাদের তিনজনের সংসার বাঁচাতে যা করতে হয়, সব করবো। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি, যাতে ভাই ভালোভাবে এই চাকরিটা করে, আরো উন্নতি করে, সুপর্ণার সাথে একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ে ওঠে ওর। ও পায়ে দাঁড়িয়ে গেলে, আমিও ছেড়ে দেবো আমার এইসব কাজ। শুধু আর কিছু, টাকা, ততদিনে জমিয়ে নিই ! এই শহরে, নিজের একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই পেতেই হবে। তারপর হয়তো, হয়তো কাউকে পাবো নিজের জীবনে, যার হাত ধরে আমিও হাঁটবো , আমার ও একটা সংসার হবে, ছোট বাচ্চা.....শ্বাসটা দীর্ঘ থেকে হতে থাকে আরো দীর্ঘ.....তর !

 

 

++++++++++ 

 


মায়াঙ্ক দিদির ফোনটা কেটে যাওয়ার পরে, একটুক্ষণ তাকিয়ে থাকে ফোনের দিকে অবাক চোখে। সত্যিই তো, দিদি আমাদের জন্য এতো চেষ্টা করছে, আবার উল্টে আমার ইন্টারভিউর জন্য ব্যবস্থা করে দিয়েছে, আর আমি কিনা , দিদিকে সন্দেহ করছি ? সেই দিদি, যাকে ছোটবেলায় না জড়িয়ে শুলে আমার ঘুম আসতো না ? সেই দিদি, যে গরমের দুপুরগুলোতে, আসে পাশের আমবাগান থেকে আম চুরি করে এনে , কাঁচা লঙ্কা আর তেল দিয়ে ভালো করে মাখিয়ে , আমাকে আগে ডেকে, খাইয়ে তারপরে নিজে খেতো ? সেই দিদি, যে আমাকে কতবার বাবার মারের হাত থেকে রক্ষা করেছিলো ? যে মাছ খেতে গিয়ে, মাছের কাঁটাগুলোও আমাকে দিয়ে দিতো, আমি ভালোবাসতাম বলে ? দিদিতো আমাকে আর মাকে ফেলে চলে যেতেই পারতো, মুম্বাইতে নিজের কেরিয়ার তৈরী করতে পারতো। কিন্তু এখানেই থেকে, আরো দুজনের সাথে একটা রুম শেয়ার করে থেকে টাকা পয়সা বাঁচিয়ে , সেটা থেকে আমাদের পুরো সংসার দাঁড় করিয়ে রেখেছে, মায়ের ট্রিটমেন্টের সব খরচ সেখান থেকেই আসছে। আর আমি এতো বড়ো হয়েও, কোনো কিছু না করে, ছিলাম পাইলট হওয়ার স্বপ্নে মশগুল ! ছিঃ !

 

 

++++++++++ 

 


কিছু কিছু স্বপ্ন - হয়তো স্বপ্নই থেকে যায় !  


 

++++++++++ 

 


তাড়াতাড়ি স্নান সেরে, রান্না বসিয়ে, মাকে ওষুধ দিয়ে, মাকে সব বুঝিয়ে , নিজে খেয়ে, মায়ের খাওয়ার ঢাকা দিয়ে বেরিয়ে আসে। স্টেশনের কাছে এসে চেনা দোকানে ঢুকে শেভ করে, চুল কেটে, নিজেকে ঠিকঠাক করে ওঠে ট্রেনে। সময় তখন সাড়ে এগারোটা। তাড়াতাড়ি ফোন বের করে সুপর্ণার নম্বরে ফোন করে মায়াঙ্ক।

 

ফোন রিং হয়ে যাচ্ছে। সুপর্ণা ফোনটা ধরো ! সুপর্ণা উত্তর দেওয়ার আগেই ফোন কেটে যায়। আবার ডায়াল করে মায়াঙ্ক। প্রায় বার পাঁচেক রিং হওয়ার পরে, মায়াঙ্ক যখন প্রায় আশা ছেড়ে দেয়, সুপর্ণা এসে ফোন ধরে।

 

"হ্যালো, মায়াঙ্ক ? সেই কখন থেকে তোমার ফোনের জন্য অপেক্ষা করে আছি ! আসছো তো ? দিদি তো ছেলেকে নিয়ে বেরিয়ে গেছে ঘন্টাখানেক।আমাকে বলে গেছে ফিরতে ফিরতে প্রায় দশটা বেজে যাবে ! এই শোনো, তোমাকে দিদি আর দাদার কথা বলেছিলাম, মনে আছে ? ওদের মধ্যে মনে হয় সব ঠিক হয়ে যাবে, বা গেছে। আমার যে কি ভালো লাগছে , কি বলবো তোমাকে। " বলে ওঠে সুপর্ণা।

 

সুপর্ণাকে হঠাৎ করে থামিয়ে মায়াঙ্ক বলে ,"এই সুপর্ণা , আরে, একটু চুপ করে আমার কথা শোনো। আমি তোমার ওখানে আসছি , হয়তো সাড়ে বারোটা বেজে যাবে। তবে, আমি তোমার ফ্ল্যাটে ঢুকবো না। "

 

"কেন ? কেন আসবে না ? " কৌতুকের স্বরে জিজ্ঞেস করে সুপর্ণা।

 

"না , তোমার ফ্ল্যাটে তোমার দিদি বা দিদির ছেলে কেউ নেই এখন। তুমি একাই থাকবে। আমার কিরকম একটা অস্বস্তি হচ্ছে। মানে যদি কিছু হয়ে যায়? যদি আমরা নিজেদের কন্ট্রোল না করতে পারি ? তুমি রেডি হয়ে থাকো, আমরা বাইরে ঘুরবো, একসাথে , পাশাপাশি, হাতে হাত রেখে। " বলে ওঠে মায়াঙ্ক।

 

হাসতে হাসতে সুপর্ণা বলে ওঠে ,"আচ্ছা, তাই হবে তাহলে। "

 

সুপর্ণা ফোন কেটে দেয় ! একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে - যাক সব ছেলেরা সমান নয় তাহলে। মনটা একটা ভালো লাগায় ভরে ওঠে হঠাৎ করেই সুপর্ণার। যদিও মনের ভেতরে একটা ভয় এখনও খচখচ করে কাঁটার মতো বিঁধে রয়েছে , আমার অতীত যখন জানবে, কি করবে মায়াঙ্ক ? সেটা সহ্য করতে পারবে তো ? পারবে আমাকে মেনে নিতে ?

 

 

++++++++++ 

 


সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরেই মনটা ভীষণ ভালো হয়ে গিয়েছিলো সুপর্ণার। প্রতিদিনের মতো, সকালে ঘুম থেকে উঠে শৌনক কে ডেকে তুলতে গিয়ে, দিদিকে শৌনকের পাশে, ওকে জড়িয়ে ঘুমোতে দেখে ভীষণ অবাক হয়ে যায় সুপর্ণা। তিন বছরের মধ্যে এই প্রথম মা আর ছেলেকে এইভাবে দেখে আনন্দে চোখে জল চলে আসে ওর। ওদেরকে আর না ডেকে নিচে চলে আসে সুপর্ণা। দিদি তো আজ সোনুকে নিয়ে বেরোবে বলেছিলো , আর মায়াঙ্ককে ও ডেকেছে ও। আজ সব বলতেই হবে মায়াঙ্ককে। তারপরে ভাবা যাবে ওদের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে। আমি যেরকম, আমার অতীত যেটা, সেটাকে লুকিয়ে আর কতদিন রাখবো ? কেনই বা লুকিয়ে রাখবো? একদিন না একদিন তো জানাতেই হবে মায়াঙ্ক কে। সেটা জানার পরে, যদি মায়াঙ্ক আমার সাথে কোনো সম্পর্ক না রাখতে চায়, তাই হোক তবে।

 

যেটা হয়েছিলো, যা ঘটেছে - সেটাতো আমার নিজের ইচ্ছেতে হয় নি কখনও।

 

যারা ওখানে আসতো, সেই ভদ্রসমাজের লোকজনেরা , তাদেরই তো লজ্জা হওয়ার কথা, ভয় পাওয়ার কথা তো তাদেরই । তাই তো তারা রাতের অন্ধকারে, নিজেদের কালো কাঁচের গাড়িতে, লুকিয়ে মুখ ঢেকে আসতো আমাদের কাছে। কিন্তু দিনের আলোতে, তারাই বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়, আর যত দোষ হয়ে যায় আমাদের মতো মেয়েদের।

 

এটাই কি সমাজ?

 

জানি না। জানি না মায়াঙ্ক সব শুনে কি বলবে, কি করবে। ও আমাকে কতবার ফোনে বলেছে, ও আমাকে খুব ভালোবাসে, আমাকে নিয়ে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছে ও। ওর দিদি মেহেকের সাথে একদিন পরিচয় করিয়ে দেবে বলেছে। সব কিছুর আগে, ওকে আমার পুরোটা জানাতেই হবে। তারপরেও যদি ও আমার সাথে থাকতে পারে, আমি বুঝবো, এখনও পৃথিবীতে মানুষ - তার মনুষ্যত্ব হারায় নি। জানি না কি হবে !

 

একটা ভয়ে, শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে যায় নীচের দিকে। হাত পা ঘামতে শুরু করে সুপর্ণার। হঠাৎ ওপর থেকে দিদির গলার আওয়াজ ভেসে আসে।

 

স্নিগ্ধাদি, আজ লুচি আলুর দম করবে, নিজের হাতে ! ভাবা যাচ্ছে না একদম। আজ দিদি যেন পুরো অন্যমানুষ একটা। হলো কি স্নিগ্ধাদির ? এই সুখী পরিবারের স্বপ্নটাই তো সব জায়গায় দেখায় , সেটাই তো এখানে এতদিন ছিলো না ! দিদি কাল রাত থেকে ফেরার পরেই যেন কিরকম একটা আচরণ করছে। সব কিছু ঠিক আছে তো ? ভাবতে ভাবতে আলুর দমের আলু মাইক্রোওয়েভে সেদ্ধ করতে দিয়ে ময়দা মাখতে থাকে সুপর্ণা।

 

 

++++++++++ 

 


স্নিগ্ধা বেশ কিছুক্ষণ পরে নেমে আসে শৌনককে কোলে করে। সুপর্ণা শৌনককে স্নিগ্ধার কোলে দেখে অবাক হয়ে ওঠে আরো। ও তাড়াতাড়ি কিচেন থেকে বেরিয়ে আসে, "দিদি, লেগে যাবে তোমার। আমাদের সোনু কি আর ছোট্ট টি আছে ? নামিয়ে দাও ওকে কোল থেকে ! নামিয়ে দাও।"

 

শৌনক রেগে চেঁচিয়ে ওঠে স্নিগ্ধার কোল থেকে, "এই সুপু মাসী ! একদম কিছু বলবে না। আজ আমি মায়ের কোলে চড়ে ঘুরে বেড়াবো। আমার খুব ভালো লাগছে। খুব বাবার কথা মনে পড়ছে। বাবা ও এইরকম ভাবে..."

 

:"এই তো, মা আছে তো তোর সাথে সোনু। " শৌনকের কথা শেষ করতে না দিয়েই বলে ওঠে স্নিগ্ধা। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এসে শৌনককে টেবিলের সামনে চেয়ারে বসিয়ে সুপর্ণার উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করে, "দুধ রেডি ? তাহলে ওকে এক গ্লাস দুধ দিয়ে দে দেখি। আর আমি এবার কিচেনে ঢুকছি। তুই সোনুর পাশে গিয়ে বোস। তোর জন্যও আমি ছটা লুচি ভাজছি, তোকেই খেতে হবে কিন্তু সুপর্ণা। " কিচেনে ঢুকে গেলো স্নিগ্ধা।

 

একটু পরেই একবাটি ভাজা লুচি আর আলুর দম নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে স্নিগ্ধা। সুপর্ণা তাড়াতাড়ি করে তিনটে প্লেট আর বাটি নিয়ে আসে। স্নিগ্ধা একটা প্লেট আর বাটি সরিয়ে রেখে, একটায় সুপর্ণাকে লুচি আর আলুর দম দিয়ে বসিয়ে, নিজে শৌনকের পাশে বসে। একটা প্লেট টেনে নিয়ে, বেশ কয়েকটা লুচি তুলে , নিজের হাতে শৌনককে খাইয়ে দিতে থাকে স্নিগ্ধা পরম মমতায়। শৌনক খেতে খেতে, হঠাৎ করেই জড়িয়ে ধরে মাকে। মুখ ভর্তি লুচি নিয়ে কোনোরকমে বলে ওঠে ,"মা, খুব ভালো হয়েছে। " লুচির টুকরো গুলো গিলে নিয়ে একটু পরে ধীরে ধীরে বলে, "মা, এভাবেই আবার খাওয়াবে তো আমাকে ? আমার খুব খুউউউউউউউব ভালো লাগছে তোমার হাতে খেতে। "

 

চোখ থেকে বেরিয়ে আসা জলের ফোঁটাগুলো কোনোরকমে সামলে, স্নিগ্ধা বলে ওঠে ,"হ্যাঁ রে সোনু। আমি এবার থেকে তোকে নিজে হাতে রান্না করে খাইয়ে দেবো। " অন্যদিকে ঘুরে ধীরে ধীরে বলে ওঠে স্নিগ্ধা ,"অনেক কিছু ভুল হয়ে গেছে, তোর দিকে দেখার ও সময় ছিলো না আমার। সব ধীরে ধীরে ঠিক করতে হবে আমাকে। "

 

শৌনক আনন্দে চেঁচিয়ে ওঠে ,"কি মজা ! মা আমাকে খাইয়ে দেবে ,আর আমাকে এই সুপু মাসীর হাতে খেতে হবে না। তুমি জানো মা ? এই সুপু মাসী না একদম আমাকে খাওয়াতে পারে না। আমাকে খাওয়াতে গিয়ে না , আমাকে স্নান করিয়ে দিতো তরকারিতে , আমার সারা মুখে, চোখে লাগিয়ে দিতো সব। বেশ হয়েছে। "

 

সুপর্ণা চোখদুটো গোলগোল করে, রাগী রাগী মুখ করে বলে ওঠে ,"তাই ? কবে আমি এরকম করেছি সোনু ? আমার বিরুদ্ধে নালিশ ? এই আমি আড়ি করলাম তোর সাথে। "

 

"মা দেখো না , আমার সাথে আড়ি করে দিয়েছে। " স্নিগ্ধার কোলে মুখ গুঁজে তাকায় স্নিগ্ধার মুখের দিকে।

 

হেসে ওঠে স্নিগ্ধা। "তোরা থামবি দুটোতে ? সুপর্ণা, ও তো বাচ্চা, তুই ও বাচ্চাদের মতো হয়ে যাবি ? আর পারি না বাবা তোদেরকে নিয়ে। "

 

তিনজনেই হেসে ওঠে একসাথে। আজ কতদিন পরে একটা সুস্থ স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরে এসেছে এই ঘরে ! খোলা জানালা আর বারান্দা দিয়ে ঘরে ঢুকে আসছে হাসির আলো, শান্তির হাওয়া , বেরিয়ে যাচ্ছে দমবন্ধ করে রাখা ঘন কালো দৈত্যগুলো।

 

কিচেনে রাখা স্নিগ্ধার মোবাইল ফোনটা হঠাৎ বেজে ওঠে। স্নিগ্ধা খেতে খেতেই ইশারা করে সুপর্ণাকে ফোনটা এগিয়ে দিতে ওর দিকে। সুপর্ণা কিচেনে গিয়ে ফোনটা রিসিভ করে , "স্নিগ্ধা ? আমি বিতান বলছি। তোমার অনেকগুলো মিস কল দেখলাম। এনি প্রবলেম ? "  

 

আনন্দে নেচে ওঠে সুপর্ণার মন , বিতান - দা ! দিদিকে ফোন করছে ? আর দিদি সকাল থেকে অনেকবার বিতানদা কে ফোন করেছে ? তাহলে কি , তাহলে কি , স্নিগ্ধাদি আর বিতানদা, আবার......

 

সুপর্ণা ফোনটা এগিয়ে দেয় স্নিগ্ধার হাতে। স্নিগ্ধা ফোনটা কানে লাগিয়ে, সুপর্ণাকে ইশারায় বলে সোনুকে বাকি লুচি গুলো খাইয়ে দিতে, নিজে বেরিয়ে আসে বারান্দায়।



++++++++++


 

বিতানের গলা শুনতে পায় স্নিগ্ধা , সেই একইরকম গলা, একটু কি ভারাক্রান্ত ? মন খারাপের গলা ? গলায় একটা অস্বস্তিও যেন ফুটে উঠেছে ওর। বিতান আবার জিজ্ঞেস করে, "হ্যালো ! স্নিগ্ধা ? শুনতে পাচ্ছ ? হ্যালো ? "

 

স্নিগ্ধা বারান্দায় বেরিয়ে আসে তাড়াতাড়ি, কোনোরকমে ফোনটা কানের ওপরে চেপে ধরে, বলতে যায় হ্যালো, কিন্তু একি ? কান্নার শব্দ কেন বেরিয়ে আসছে মুখ থেকে ? কেন সামলাতে পারছে না নিজেকে ও আজ ? এতদিন , এতো মাস, এতগুলো বছর পেরিয়ে, আজ ও কেন দুর্বল হয়ে যাচ্ছি আমি ? কোনোরকমে নিজেকে সামলে নেয় স্নিগ্ধা , কেটে যায় প্রায় মিনিট তিনেক।

 

বিতান কি কিছু বুঝতে পেরেছে ফোনের ওদিক দিয়ে ? ও চুপ করে কেন আছে? কিছু বলছে না কেন ? চোখের জল মুছে, স্নিগ্ধা ধীরস্বরে জিজ্ঞেস করে, "কেমন আছো বিতান ? " নিজেকে সামলাতে চাইছে স্নিগ্ধা, তবুও গলা কেঁপে উঠলো। 'বিতান' কথাটা উচ্চারণের সময় গলাতে আকুতি ফুটে ওঠে।

 

বিতান চুপ করে থাকে। বেশ কিছু সেকেন্ড সময় নিয়ে জিজ্ঞেস করে, "তুমি কাঁদছো স্নিগ্ধা ? "

 

এখনও বিতান বুঝতে পারে আমার সুবিধে অসুবিধে, ফোনের অন্য প্রান্ত থেকেও ? বারান্দার দরজা বাইরে থেকে ভেজিয়ে মেঝেতে বসে পড়ে স্নিগ্ধা, দেওয়ালে হেলান দিয়ে।

 

বলে ওঠে,"তুমি, তুমি একটা....পাষন্ড, খারাপ লোক, শুওর, ইতর.....বিতান। তবুও, তবুও আমি যে তোমাকেই ভালোবাসি , তোমাকে ছাড়া আমি কেন কাউকে ভালোবাসতে পারছি না ? কেন আমাকে আমাকে অন্যের দরজায় দরজায় ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে , বলতে পারো ? কি অভিশাপ দিয়েছো তুমি আমাকে ? কেন তুমি সেদিন জোরে জোরে আমাকে ঠাস ঠাস করে মেরে আটকালে না ?"

 

"শান্ত হও স্নিগ্ধা , শান্তি নেমে আসুক তোমার জীবনে, মনে। এটাই তো আমি সবসময় চেয়ে এসেছি। আমি কি তোমার খারাপ চাইতে পারি কখনও ? আমি তোমাকে সেদিন আটকাই নি; কেন জানো ? আমি তো তোমাকে সবসময় সুখী, খুশি দেখতে চেয়েছি। তোমার সুখেই যে আমার সুখ। " একটু থেমে বিতান আবার বলে ওঠে ,"যাক গে, যা হওয়ার হয়ে গেছে, তাকে আর টেনে কি লাভ। বলো , কেন ফোন করেছো ? "

 

আর্তির স্বরে স্নিগ্ধা বলে ওঠে,"আমি ফিরতে চাই, বিতান। আমি তোমার কাছে ফিরতে চাই। আমার ছেলে, আমাদের ছেলে, আমাদের দুজনকে ছাড়া সম্পূর্ণ নয়। আমি ভেবেছিলাম আমি একাই সব সামলে নেবো। কিন্তু পারিনি বিতান। তোমাকে দরকার, আমাদের দুজনেরই। আজ, আজ বিকেলে দেখা করতে পারবে ? একবার......প্লিজ ? আমি জানি, আমি যা করেছি তোমার সাথে, তারপরে তোমার আমার ওপরে রাগ, ঘৃণা, বিতৃষ্ণা সব কিছু করার অধিকার আছে তোমার, তবুও, আমি, আমি আর শৌনক...."

 

কথা শেষ করতে না দিয়েই বিতান জিজ্ঞেস করে, "স্নিগ্ধা, তোমার সাথে, আমাদের ছেলের সাথে সময় কাটানোর জন্য, একসাথে থাকার জন্য আমি সব কিছু করতে পারি। সেটা তুমি খুব ভালো করেই জানো। আজ আমার কিছু ইম্পর্ট্যান্ট কাজ আছে, দুপুরে দুটো নাগাদ শেষ হয়ে করতে পারবো। তারপরে, আড়াইটের সময়, আমরা একসাথে লাঞ্চ করতে পারি! তখন আমরা কথা বলি একসাথে? আমি অপেক্ষা করবো তোমার জন্য....আর শৌনকের তো কয়েকদিন পরে জন্মদিন, ওর তো চাইনিজ পছন্দ ভীষণ, তাই না? আমি অপেক্ষা করবো...."

 

রেস্টুরেন্টের নাম ঠিকানা দিয়ে দেয় বিতান। ফোন কেটে দেয় স্নিগ্ধা। কাঁদতে কাঁদতে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায় সামনের দিকে তাকিয়ে। বারান্দায় ওর চোখের ওপরে এসে পড়ছে সূর্যের আলো, মুখ হয়েছে লাল , চোখের জল ঝরছে অঝোর ধারায়। ইচ্ছে করছে, ইচ্ছে করছে বিতানকে দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরতে, ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে ওর কাছে,ওর বুকের মাঝে । যে রাস্তা একদিন নিজেই বন্ধ করে দিয়েছিলো স্নিগ্ধা, যে সম্পর্কের মাঝে তুলে দিয়েছিলো একটা সুবিশাল প্রাচীর, আজ তাকেই ভেঙে ফেলে, তছনছ করে আবার নতুন করে সবকিছু গড়তে মন চাইছে খুব। কিন্তু বিতান, ও কি মেনে নেবে ? ও কি এতো কিছু সহ্য করার পরেও টেনে নেবে আমাকে, শৌনক কে ওর বুকে !

 

 

++++++++++ 

 


একরাশ দ্বিধা আর দ্বন্দ্বের মাঝে দাঁড়িয়ে স্নিগ্ধা, দুপুরের অপেক্ষা।

 

 

++++++++++ 

 


একটু পরে বারান্দার দরজা ঠেলে সুপর্ণা এসে দাঁড়ায় পাশে , স্নিগ্ধার উদ্দেশ্যে বলে , "দিদি , বলছি সোনুর খাওয়া হয়ে গেছে। তোমরা তো আজ বাইরে যাবে, তাই না ? "

 

স্নিগ্ধা নিজেকে সামলে , চোখের জল মুছে নেয় হাতের পাতায়। কোনোরকমে হেসে বলে ওঠে ,"হ্যাঁ রে। আজ তো যেতেই হবে। আজ না গেলে আর হয়তো...." ভেতরে ঢুকে আসে স্নিগ্ধা।

 

সুপর্ণা ভেতরে ঢুকতে যাওয়া স্নিগ্ধাকে আটকিয়ে, হঠাৎ বলে ওঠে,"দিদি, তোমাদের মধ্যে যা হয়েছে সব মিটিয়ে নাও না ! তোমরা তো এখনও কত ভালোবাসো দুজনকে, তাহলে ?" স্নিগ্ধা হেসে সুপর্ণার গালে টোকা দিয়ে বলে ওঠে ,"বুড়িমা আমার। যা তো ! তোকে আর পাকামি করতে হবে না। আচ্ছা শোন, আজ ফিরতে দেরী হবে আমাদের। হয়তো রাত ও হতে পারে। আমার জন্য অপেক্ষা করিস না , কেমন ? "

 

শৌনককে ডেকে দরজার দিকে এগিয়ে যায় স্নিগ্ধা। সুপর্ণা পেছন থেকে এসে স্নিগ্ধার হাতে গাড়ির চাবি আর জলের বোতল তুলে দেয়। সুপর্ণা হঠাৎ জিজ্ঞেস করে স্নিগ্ধাকে, "দিদি, একটা কথা বলা হয় নি তোমাকে। আজ আমি একজন বন্ধুকে আসতে বলেছি এখানে। তো, মানে...." আমতা আমতা করতে থাকে সুপর্ণা।

 

স্নিগ্ধা জিজ্ঞেস করে ,"কোনো স্পেশাল বন্ধু ? এটা কি সেই ছেলেটা যার সাথে রোজ রাতে তুই কথা বলিস? ইসসস, আমিও যদি দেখা করতে পারতাম ওর সাথে। ঠিক আছে, আসুক না। তবে, কোনো কিছু...মানে বেশি এগোতে যাস না এখনই , দিদি হিসেবে শুধু এইটুকুই বললাম তোকে। ঠিক আছে ? সাবধানে থাকিস। "

 

বেরিয়ে যায় স্নিগ্ধা একটু পরে গাড়ি নিয়ে।

 

 

++++++++++ 

 


সময় ঠিক এগারোটা । বিতান এসে হাজির হয় অফিসে। সবাইকে গুড মর্নিং বলে ভেতরে ঢোকে ও। নিজের কেবিনে গিয়ে জল চেয়ে পাঠায়। আরো আগেই চলে আসতো অফিসে, কিন্তু স্নিগ্ধার ফোনটা আসার পরে সব কিরকম একটা ঘেঁটে গেলো। সারা রাস্তা শুধু স্নিগ্ধার ফোন, ওদের দুজনের কথা বার্তাই ওর মনের ভেতরে ঘুরছে। জল খাওয়ার পরে, মনটাকে কাজের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য বাইরে বেরিয়ে আসে বিতান।

 

প্রায় জনা কুড়ি কি পঁচিশজন ছেলে মেয়ে কাজ করে চলেছে বাইরের ফ্লোরে , সবাই কম্পিউটারের সামনে বসে কিছু না কিছু করছে। দুটো কনফারেন্স রুম, সেখানেও কয়েকজন কিছু প্রেসেন্টেশন দেখাচ্ছে কাউকে, সেটা নিয়ে ওরা নিজেদের মধ্যে কথা বলে চলেছে এক নাগাড়ে। এক দিকের দেওয়ালে একটা বড়ো টিভি স্ক্রিন লাগানো, সেখানে কোনো কিছু ট্রেন্ড দেখানো হচ্ছে লাইন চার্টের মাধ্যমে , একজন কানে লাগানো হেডসেটের মাইক্রোফোনে কিছু বলছে, আর চার্ট চেঞ্জ হয়ে যাচ্ছে নিজের থেকে। অন্যদিকে দেওয়ালের মাঝে লাগানো পাঁচটা বড়ো ঘড়ি, সেখানে কোনোটার পাশে লেখা 'সি এস টি'; কোনোটার পাশে লেখা 'মেক্সিকো', কোনোটার পাশে লেখা 'লন্ডন', আরেকটার পাশে লেখা 'হংকং' , আর একদম শেষেরটিতে পাশে লেখা 'ইন্ডিয়া'।

 

কয়েকবছর আগে কোম্পানিটা শুরু করে বিতান, তখন শুধুমাত্র স্থানীয় কোম্পানিগুলোকে নিয়ে কাজ শুরু করেছিলো ও। আজ ওর কোম্পানি ছড়িয়ে পড়েছে বিদেশের মাটিতেও। বিতান নিজের কেরিয়ার শুরু করেছিলো সেলস এ। ধীরে ধীরে ও বুঝতে পারে, সেলস তো হচ্ছে, কিন্তু তার রিপোর্টিং ব্যবস্থা ভীষণ খারাপ, অনেক সময় দেরি হয়ে যায়, এক সপ্তাহ বা আরো বেশি , আর এতে ক্লায়েন্টরা অনেকসময় ওদের প্রোডাক্ট আর সার্ভিসের পারফরম্যান্স বুঝতে পারে না। সেটাকেই মাথায় রেখে, ও শুরু করেছিলো নিজের এই কোম্পানি। এখন প্রায় প্রতি ঘন্টায় ঘন্টায় ওদের কোম্পানির ক্লায়েন্টরা যাবতীয় সেলস ট্র্যাক করতে থাকে - ওদের কোম্পানির বানানো অটোমেটেড সিস্টেম। সেটা ক্লায়েন্টরাও নিজেদের অফিস থেকে দেখতে পায়। কোনো প্রশ্ন থাকলে , সেটা নিয়ে যোগাযোগ করে বিতান বা ওর টিমের সাথে।

 

বিতানের কলকাতার অফিসে এখন কাজ করে তিরিশ জন। তাদের মধ্যে পাঁচ বছরের বেশি এক্সপেরিয়েন্স আছে মাত্র চারজনের। আর বাকি সবাইয়ের দেড় কি দুই বছর , আর সেটাও এখানেই। বিতান আসলে বিশ্বাস করে ইয়ং ব্লাড কে। ও জানে আর মানে , ইয়ং ব্লাড যদি ঠিক মতো তার উদ্দেশ্য খুঁজে পায়, কেউ তাকে আটকাতে পারবে না। অনেক সময় অনেক নতুন ক্লায়েন্ট এসে কথায় কথায় বিতানকে জিজ্ঞেস করে, এদের এক্সপেরিয়েন্স নেই, এরা পারবে তো কাজ করতে ? বিতান ওদের সবাইয়ের উদ্দেশ্যে একটা কথাই বলে, "এক্সপেরিয়েন্স তো কাজ করতে করতেই আসবে। সবাই যদি এক্সপেরিয়েন্স লোকজন খোঁজে, তাহলে যারা নতুন তারা এক্সপেরিয়েন্সটা পাবে কোথা থেকে ? "

 

কিন্তু বাইরে বেরিয়ে এসব ভাবতে ভাবতেও বার বার মন চলে যাচ্ছে স্নিগ্ধা আর শৌনকের দিকে। কিছুতেই স্থির থাকতে পারছে না বিতান। আবার ভেতরে ঢুকে আসে ও।

 

 

++++++++++ 

 


বিতান ভাবতে ভাবতেই আনমনে ফোনটা টেনে নিয়ে হঠাৎ করে মেহেক কে ফোন করে। একটু পরে মেহেক ঘুম ঘুম চোখে জড়ানো গলায় বলে ওঠে ,"হ্যালো ! "

 

বিতান ভাবে ফোনটা কেটে দেবে , তবুও বলে ওঠে ,"মেহেক , আমি বিতান বলছি। "

 

"ও বিতান ! আই এম সো সরি। তোমার, ওই ইন্টারভিউর কথা আমি ভাই কে বলেছিলাম। " বিতানের মনে পড়ে যায় ইন্টারভিউর কথা। স্নিগ্ধার ফোন আসার পরে সব এমনভাবে ঘোঁট পাকিয়ে গেছে, যে সব কিছু মাথা থেকে বেরিয়েই গেছে। সময় দেখে বিতান, সময় প্রায় বারোটা। আর তো আধঘন্টা পরে মায়াঙ্কের আসার কথা। কিন্তু মনের যা অবস্থা, কোনো কিছুই আজ করতে ইচ্ছে করছে না আজ। বিতান বলে ওঠে ,"উমমম, মেহেক, আজকে থাক ! তোমার ভাইকে বোলো, সোমবার আসতে। "

 

"সেটাই তো বলছিলাম আমি, আসলে আমি যখন মায়াঙ্ককে সকালে বললাম ইন্টারভিউর কথা, ও আমাকে জানালো, ও অন্য একটা জায়গাতে পেয়ে গেছে, আর সেখানেই জয়েন করবে সোমবার থেকে। ও নিজেও আজ সকালেই খবরটা পেয়েছে। তোমাকে জানাবো ভাবলাম, কিন্তু এতো ক্লান্ত লাগছিলো, এসে ঘুমিয়ে পড়েছি। সরি , ভেরি সরি বিতান। "

 

"না না ! সরি কিসের। এতো ভালো খবর, যে মায়াঙ্ক নিজের পছন্দের চাকরি পেয়ে গেছে। আসলে কি জানেন মেহেক, নিজের মনের মতো কাজ পেলে, অন্য সবকিছু ভুলে যাওয়া যায় - খাওয়া দাওয়া , ঘুম। খুব কম-জনই এরকম ভাগ্য করে আসে। আমি তবে আপনাকে সেজন্য ফোন করিনি। মেহেক, আপনার সাথে কি একটু কথা বলা যাবে ? আপনি ঘুমোচ্ছিলেন, আর আমি উঠিয়ে দিলাম, তবুও। আসলে এমন একটা ঘটনা ঘটে গেলো আপনার চলে যাওয়ার পরে, আমি , আমি ভীষণ কনফিউজ হয়ে গেছি। কি যে করবো, বুঝতে পারছি না। হয়তো আপনি ভাববেন...."

 

"আমি কিছু ভাববো কেন বিতান ? আমি না তোমার বন্ধু ? বন্ধুদের সাথে তো সব কথা শেয়ার করাই যায় , তাই না ? এই গতকাল রাতে, যদি তুমি সবকিছু আমাকে না বলতে পারতে, তাহলে কি আবার কবিতা লিখতে পারতে? আমাকে বলে, তুমি তো মনের দিক থেকে শান্তি পেয়েছো ! তাই তো আবার আমাকে ফোন করে কথা বলতে চাইছো । তাই না ? " বলে ওঠে মেহেক।

 

যদিও মেহেকের প্রফেশনে, একবার সার্ভিস দেওয়া হয়ে গেলে ক্লায়েন্টদের সাথে কথা বলা, ভাব বাড়ানো প্রোটোকলের বাইরে, তবুও মেহেক পারছে না নিজেকে সরিয়ে রাখতে বিতানের কাছ থেকে। কিভাবে, কখন, কেন যে বিতানকে মনের গভীরে এক টুকরো মূল্যবান জায়গা দিয়ে দিয়েছে, ও নিজেও বুঝতে পারছে না। এভাবে ক্লায়েন্টদের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লে, ওদের প্রফেশনে সেটা খারাপ এফেক্ট করে। অনেক সময় অনেক ক্লায়েন্ট এরকম করে অন্য মেয়েদের সাথে, তাদের ভালোবাসার জালে জড়িয়ে, প্রেমের ফাঁদে ফেলে, দিনের পর দিন তাদের সাথে এদিক ওদিক ঘুরতে যায় , রাত কাটায় ; আর একদম শেষে নিজের জীবন থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। বোকা মেয়েগুলো তখন না পায় পরিশ্রমের মূল্য, না পায় সেই ভালোবাসা।

 

কিন্তু, বিতান, বিতান তো সম্পূর্ণ অন্যরকম। ও তো এখনও স্নিগ্ধকেই ভালোবাসে ; স্নিগ্ধা ছাড়া অন্য কোনো মেয়ে নেই ওর জীবনে , ও ভাবতেও পারে না কাউকে। আর মেহেক কিনা এইরকম ই একজনের প্রেমে পড়ে গেলো ? নিজের ওপরে নিজেই ভীষণ আশ্চর্য হয়ে ওঠে মেহেক।

 

 

++++++++++ 

 


বিতান একটু পরে বলে ওঠে , "আপনি, আপনি চলে যাওয়ার পরে , ঘরে ফিরে এসে দেখি স্নিগ্ধা আমাকে ফোন করেছে। একবার নয়, অনেকবার। ওর সাথে কথা হলো আমার। ও, ও ফিরে আসতে চাইছে। আবার সব কিছু নতুন ভাবে শুরু করতে চাইছে। "

 

মেহেক সোজা হয়ে উঠে বসলো বিছানার ওপরে। চোখের পাতায় লেগে থাকা ঘুমগুলো যেন হঠাৎ করেই কোথাও চলে গেলো উড়ে। অযাচিত একটা যন্ত্রনা হচ্ছে বুকের ভেতরে , মনে হচ্ছে কিছু একটা ইচ্ছে, জোর করে কেউ পাথরের নিচে চাপা দিয়ে মেরে দিচ্ছে। ধীরে ধীরে, সতর্ক স্বরে মেহেক বলে ওঠে ,"তাহলে? ভালোই তো। খুব ভালো খবর ! আর তুমি কি করছো এখনও ? তোমার তো তখনই ছুটে যাওয়া উচিত ছিলো স্নিগ্ধার কাছে, তোমার ছেলের কাছে ! কিসের জন্য অপেক্ষা করছো ? "

 

"জানি না মেহেক , জানি না কিসের জন্য অপেক্ষা করছি। হয়তো অপেক্ষা করছি, পুরো ব্যাপারটা ভালো করে বোঝার জন্য। এটাতো আমি কোনোদিন ভাবতে পারিনি, যদিও মনে মনে সবসময় চাই, যে ওরা ফিরে আসুক, আবার আমরা আগের মতো এক হয়ে যাই। কিন্তু, কিন্তু তবুও যেন একটা কোনো বাধা , আটকে দিচ্ছে আমাকে। আমি তো বলেছি দুপুরে আড়াইটের সময় দেখা করবো ওর সাথে,..........এই চাইনিজ রেস্টুরেন্টে। আসলে শৌনকের চাইনিজ ভীষণ পছন্দের। তখন আমি আর স্নিগ্ধা ভালো করে কথা বলবো একসাথে। জানো ? প্রায় তিনবছর পরে, আবার আমরা মুখোমুখি। এতদিন ও সবসময় আমার থেকে দূরে থেকেছে। আমাকে সহ্য করতে পারতো না , নিজেই দূরে ঠেলে সরিয়ে দিয়েছিলো আমাকে। আজ হঠাৎ, কি এমন হলো, যে আবার ফিরে আসতে চাইছে ? আমি কিছু বুঝতে পারছি না ! " বলে ওঠে বিতান।

 

"ক্ষমা করে দাও বিতান , ভুলে যাও সব কিছু। নতুন করে সবকিছু শুরু করো তোমরা তিনজনে আবার। মানুষমাত্রেই ভুল করে, ভুল থেকে শিক্ষা নেয়, আবার নতুন করে সব কিছু শুরু করতে চায়। একটাই তো জীবন, কি হবে এই রাগ - ঘৃণা মনের মধ্যে পুষে রেখে ? এই জীবন যতক্ষন আছে, ভালোবাসার মানুষের সাথে, পরিবারের সাথে উপভোগ করো। একবার জীবন চলে গেলে, সব শেষ। আমাদের মধ্যে এই অহং, রাগ, ঘৃণা, প্রেম - ভালোবাসা সবকিছুর অস্তিত্ত্ব ধুয়ে মুছে বিলীন যায় আমাদের সাথেই। তাই না ? " বলে ওঠে মেহেক।

 

"আমি জানি , আমি বুঝি সবকিছু মেহেক। তবুও কেন একটা কিছু আমাকে বারবার আটকাচ্ছে ? বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে সেই আগের ঘটনাগুলো, সেই অপমানের দিন রাতগুলো কেন ভেসে উঠছে চোখের সামনে ? একটা কথা কি জানেন মেহেক ? আমাদের মানুষের সম্পর্ক গুলো আসলে সুসজ্জিত কাঁচের তৈরী একটা মূর্তির মতো। যত্ন করে, সাজিয়ে, মুছে, ধুয়ে রাখতে হয়, পরিষ্কার করতে হয় সময়ে সময়ে , আর রাখতে হয় এমনভাবে, যাতে উঁচু কোনো জায়গা থেকে পড়ে ভেঙে না যায় ! একবার যদি পড়ে ভেঙে যায়, তাকে আপনি দুনিয়ার সবথেকে ভালো গাম - আঠা দিয়ে যতই জোড়া লাগান না কেন, চিড় থেকেই যায় ওর মধ্যে। সেটা কিছুতেই সরানো যায় না। আমাদের সম্পর্কের খাতাতেও সবকিছু লেখা হয়েছিলো সোনার জলে , হঠাৎ করে সেখানে কিছু আঁচড় - কালো কালির মোটা দাগের আঁচড় টেনে দিয়েছিলাম আমরা দুজনেই। সেই আঁচড় আর তুলে ফেলে দেওয়া যাচ্ছে না আমাদের সম্পর্কের খাতার ওপর থেকে। আসলে , আসলে আমি খুব দুর্বল মেহেক। একবার আমি স্নিগ্ধার চলে যাওয়া কোনোরকমে সামলে নিয়েছি। কে বলতে পারে, ভবিষ্যতে আবার এরকম কিছু হবে না? আবার ও আমাকে ছেড়ে চলে যাবে না ? সেই একই কারণে, বা অন্যকিছু অজুহাতে? " কাঁপতে থাকে বিতানের গলা।

 

মেহেক চুপ করে যায়, বুঝে উঠতে পারে না কি বলবে। উঠে দাঁড়ায় বিছানা থেকে, উঠে বেরিয়ে আসে ওর রুমের সাথে লাগোয়া বারান্দায়। বাইরে একের পর এক গাড়ির সারি, সব চলেছে নিজেদের উদ্দেশ্যে, কেউ বা চলেছে অফিসে, কেউ বা ফিরে যাচ্ছে বাড়িতে। সবারই কিছু না কিছু গন্তব্য রয়েছে। পাশে ফুটপাথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে মানুষের দল , কেউ বা ছুটছে , আবার কেউ বা দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছে কারোর সাথে। একটা পাগল ওদের মাঝে দাঁড়িয়ে রুক্ষ শুষ্ক মাথাটা চুলকে যাচ্ছে আর ঘুরে ঘুরে তাকিয়ে চলেছে চারদিকে , যেন খুঁজছে বাঁচার মানে।

 

মেহেক ধীরে ধীরে বলে ওঠে , "ভবিষ্যৎ কে দেখেছে বিতান ? কেউ কি জানে, কি হবে ? কেউ জানে না। তাই ভবিষ্যৎ কে ছেড়ে দাও , বর্তমান নিয়ে বাঁচো। বর্তমান পরিস্থিতি তোমাদের দুজনকেই আবার সুযোগ দিয়েছে আবার একসাথে থাকার, ফিরে আসার। সেটাকে জড়িয়ে ধরো তোমরা দুজনেই। এটাই আমি বলবো তোমাকে। " চুপ করে থাকে দুজনেই। একটু পরে মেহেক আবার বলে ওঠে ,"তোমার ওপরে আমার হিংসে হচ্ছে খুব বিতান, খুব। আর স্নিগ্ধার ওপরে রাগ। কি করে এতো ভালোবাসতে পারো তুমি ? স্নিগ্ধা যদি এভাবে ফিরে না আসতো, আমি, আমি হয়তো তোমার কাছে...."

 

মেহেকের কথা শেষ হওয়ার আগেই বিতান বলে ওঠে ,"জানি মেহেক। আমি জানি ! গতকাল রাতেই আমি সেটা অনুভব করেছি। কিন্তু সেটাতো হওয়ার নয় কখনও, মেহেক। আমি, আমার মন, আমার শরীর, আমার পুরো সত্ত্বা যে অন্য কারোর ভালোবাসার কাছে বাধা পড়ে আছে। "

 

"সেই জন্যই তো তোমাকে হিংসে হচ্ছে। এতটাও ভালোবাসা যায় ?" জিজ্ঞেস করে মেহেক।

 

বিতান বলে ওঠে কিছুক্ষণ পরে , "মেহেক, মনে হয়, ভবিষ্যতে - আমাদের আর কথা বলা, বা দেখা করা উচিত নয় ! "

 

চুপ করে যায় মেহেক। অনেক কষ্টে চোখের জলকে সংযত করে বলে ওঠে ধীরে ধীরে, "ঠিক, ঠিক কথা বলেছেন বিতান আপনি। আপনি রেডি হোন, আপনার জন্য স্নিগ্ধা, শৌনক অপেক্ষা করছে। অপেক্ষা করছে একটা নতুন জীবন। " ফোনটা কেটে দিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে মেহেক।



++++++++++


 

সময় এখন, দুপুর দুটো। বাইরে বেশ ঠান্ডা মিষ্টি রোদ রয়েছে আজকে। গতকাল, আসে পাশে কোথাও বৃষ্টি হয়েছে , তাই হয়তো শহরের বুকেও, কড়া রোদের জায়গায় এখন একটা অদ্ভুত - সুন্দর - মন কেমন করা পরিবেশ। শহরের এই জায়গাটায়, লোকজনের আনাগোনা একটু কম। বেশ কিছু অফিস রয়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে, রয়েছে একটা বড়ো শপিং মল রাস্তার একদিকে, রাস্তার উল্টোদিকে রয়েছে একটা বিখ্যাত চাইনিজ রেস্টুরেন্ট।

 

কালো পিচের রাস্তাটাও, বেশ চওড়া। মাঝখানে রয়েছে প্রায় দু ফিট চওড়া ডিভাইডার ; দুদিকেই রয়েছে দুটো করে লেন। ডিভাইডারের ওপরে বিক্ষিপ্ত ভাবে লাগানো গাছগুলো জলের অভাবে শুকিয়ে যেতে বসেছে। আছে অনেক পায়রা, রয়েছে বসে অলস ভাবে, কেউ কেউ উড়ে বেড়াচ্ছে ফড়ফড় করে। একের পর এক গাড়ি - বাস - বাইক পেরিয়ে যাচ্ছে দুদিক দিয়েই। প্রশস্ত ফুটপাথে, কোথাও রয়েছে মুচি, কোথাও বা চায়ের দোকান, এর মাঝে আবার বিড়ি - সিগারেট এর আড্ডা। আর একটু দূরে বসে রয়েছে এক পেপার বিক্রেতা। সামনে ঝুলিয়ে রেখেছে কিছু বই। লোকজন রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে , মাঝে মাঝে থেমে যাচ্ছে, দাঁড়িয়ে কেউ একটু চা নিয়ে গলা ভিজিয়ে, এগোচ্ছে আবার , কেউ বা বইগুলো উল্টেপাল্টে দেখে বেরিয়ে যাচ্ছে ।

 

শপিং মলের সামনে বেশ ভিড় , অনেক লোকজন আজ এসেছে এখানে। আজ রবিবার যে। রবিবারের দুপুরে, সবাই যাচ্ছে সিনেমা দেখতে মাল্টিপ্লেক্সে, কেউ বা যাচ্ছে ফুড কোর্টে খেতে, কেউ বা বন্ধুদের অপেক্ষায়, কেউ আবার প্রেমিক বা প্রেমিকার পথ চেয়ে দাঁড়িয়ে। বাচ্চারা মলের সামনের খোলা জায়গাতে দৌড়ে বেড়াচ্ছে, বিভিন্ন রাইডে চড়ার জন্য বায়নায়- কান্নায় ব্যাতিব্যস্ত করে তুলেছে মা বাবাদের।

 

ঠিক এইরকম একটা মুহূর্তে, শপিং মল থেকে হাত ধরাধরি করে বেরিয়ে আসে বাইরে সুপর্ণা আর মায়াঙ্ক। সুপর্ণা আজ ভীষণ খুশি, মায়াঙ্ক ওকে নিয়ে সারা শপিং মল ঘুরে বেড়িয়েছে , ভবিষ্যতের কত প্ল্যানিং সেরে ফেলেছে ! নিজেদের যখন বাড়ি বা ফ্ল্যাট হবে, তার রং কি হবে, কোথায় বিছানা থাকবে, কিরকম আলমারি হবে, কতগুলো চেয়ারের ডাইনিং টেবিল শোভা পাবে লিভিং রুমে - এইসব স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে দুজনে একসাথে। মায়াঙ্ক আর সুপর্ণা দুফুড কোর্টে বসে পিজ্জা খেয়েছে। আগেও কতবার পিজ্জা খেয়েছে সুপর্ণা , কিন্তু কখনও তো এতো ভালো লাগে নি। আজ এতো ভালো লেগেছিলো যে, মায়াঙ্কের থেকেও ভাগ বসিয়েছিলো !

 

মলের গেট দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসে, সামনের ফাঁকা জায়গাতে বসে ওরা দুজনেই। ধীরে ধীরে সুপর্ণা সাহস সঞ্চয় করে। খুব ধীর পদক্ষেপে, অবশেষে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। মায়াঙ্কের হাতটা টেনে নেয় নিজের দিকে সুপর্ণা। মায়াঙ্ক তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলো বাচ্চাগুলোর হাসি মাখা মুখ, দেখছিলো ওদের বায়না করা। মনে মনে ভাবছিলো, একদিন আমার আর সুপর্ণারও এইরকম কেউ আসবে ! সুপর্ণার হাতের স্পর্শে চমকে ওঠে মায়াঙ্ক। কি ভীষণ ঠান্ডা হাত ওর , আর ঘর্মাক্ত ! তাকায় সুপর্ণার দিকে। সুপর্ণা নিজেও অল্প অল্প ঘামছে, কপালে জমছে বিন্দু বিন্দু ঘাম।

 

মায়াঙ্ক জিজ্ঞেস করে, "কি হয়েছে ? কি হয়েছে তোমার ? এরকম ভাবে ঘামছো কেন? "

 

মায়াঙ্কের চোখে চোখ রেখে বলে ওঠে সুপর্ণা ,"তোমাকে, তোমাকে আমি একটা কথা বলিনি মায়াঙ্ক। আমি আগে অনেক চেষ্টা করেছি বলতে ফোনে কথা বলার সময়ে , কিন্তু বলতে পারিনি। কিন্তু আমি তোমাকে আর অন্ধকারে রাখতে চাই না মায়াঙ্ক। আমাকে আজ বলতেই হবে। কিন্তু সেটা শোনার পরে, কি হবে, বা হবে না, সেটা নিয়ে প্রচন্ড একটা চাপা ভয় চলছে আমার মধ্যে। “

 

মায়াঙ্ক কিছু একটা বলতে যায়, ওকে থামিয়ে সুপর্ণা সামনের দিকে, খেলতে থাকা বাচ্চাগুলোর দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে ,"না মায়াঙ্ক। আগে আমার কথাটা শোনো ভালো করে। জানো, ওই যে মেয়েটা ওখানে খেলছে , বা ওই যে বাচ্চাটাকে ওর বাবা ওপরে ছুঁড়ে আবার লুফে নিচ্ছে নিচের দিকে ; আমার ও ছোটবেলাটা এইরকমই ছিল। আমিও ভীষণ সুখী ছিলাম, খুশি ছিলাম , যতদিন বাবা বেঁচে ছিলো। জানো ? আমার না পড়াশোনা করার খুব শখ ছিলো। দাদাদের দেখতাম, ওরা কত কিছু পড়তো , স্লেটের ওপরে চক দিয়ে কত কিছু লিখতো, জোরে জোরে ডেকে ডেকে নামতা পড়তো, দুয়ারে বসে। ওদের সামনে একটা হ্যারিকেন জ্বলতো দপদপ করে , আর আমি ওদের পাশে, একটু অন্ধকারে বসে, সব শুনতাম। খুব ভালো লাগতো আমার। আর বাবা একটু দূরে বসে, তালপাতার পাখাগুলো নিয়ে হাওয়া খেত , মাঝে মাঝে ওর পেছনের যে ডান্ডাটা থাকতো, সেটা দিয়ে পিঠ ঘষতো , ঘামাচি মারতো। আমিও দাদাদের পড়া শুনে শুনে অনেকটাই শিখে ফেলেছিলাম। আর তারপর, তারপর একদিন, বাবাটা মরে গেলো। আমার তখন খুব অল্প বয়স ছিলো। আমাকে বেচে দেওয়া হলো, একটা পল্লীতে , একটা পাড়াতে। যাকে ভদ্রলোকের ভাষায় বলে নিষিদ্ধ পল্লী।" ধীরে ধীরে সুপর্ণা ওর অতীতটা তুলে ধরে মায়াঙ্কের সামনে। বলতে বলতে ওর চোখে জল চলে আসে , মায়াঙ্ক কখন ওর হাত ছেড়ে দিয়েছে , বুঝতে পারে না ও।

 

একটু পরে সুপর্ণা বলে ওঠে ,"সেদিন যদি স্নিগ্ধাদির মা বাবা না থাকতো, যদি আমাকে হোম থেকে তুমি নিয়ে না আসতো , আমি হয়তো কোথায় ভেসে যেতাম। ওরা আমাকে ওদের বাড়িতে শুধু আশ্রয়টাই দেয় নি, আমাকে ওদের সংসারের আরেকজন করে নিয়েছিলো। অনেকদিন সময় লেগেছিলো আমার সবকিছু ভুলতে। মাঝে মাঝে রাতে ঘুম ভেঙে যেত, ভয়ে আমি ঘরের এক কোণে গিয়ে লুকিয়ে বসে থাকতাম , এই বুঝি কেউ এলো, আমাকে জোর করে টেনে নিয়ে গেলো বিছানায় ধস্তাধস্তি করার জন্য। ধীরে ধীরে আমি ওদের সবার ভালোবাসায়, স্নেহে, আমিও ওদেরই একজন হয়ে গেলাম। আমাকে লেখা পড়া শেখালো কাকু কাকীমা। পরে স্নিগ্ধাদি বিয়ে করে চলে গেলে, আমাকে আরো জোরে আঁকড়ে ধরলো ওরা। ওদের সব কাজ আমি করে দিতাম , ওদের নিজের মেয়ের মতো করে। আর তারপরের সব ঘটনা তো তুমি জানো ! "

 

মায়াঙ্ক এর দিকে তাকিয়ে দেখে সুপর্ণা, মুখের ওপরে দুহাত দিয়ে ঢেকে পাশে বসে আছে মায়াঙ্ক। সারা শরীরটা ঝুঁকে পড়েছে সামনের দিকে। আসে পাশের মানুষেরা ওদেরকে এই অবস্থায় দেখে অনেকেই বিভিন্ন রকম কথা বলাবলি করছে। ওদেরকে পাত্তা না দিয়ে মায়াঙ্কের পিঠে হাত দিয়ে বলে ওঠে সুপর্ণা ,"দেখো মায়াঙ্ক, আমি জানি তোমার হয়তো কষ্ট হচ্ছে সব কথা শুনে, হয়তো প্রচন্ড ঘৃণা হচ্ছে আমার ওপরে , হয়তো ভাবছো, কেন এই মেয়ের সাথে আমি সম্পর্কে জড়ালাম। তুমি যদি যেতে চাও, আমাকে ছেড়ে , আমি কাঁদবো না , কষ্ট ... কষ্ট পাবো , অবশ্যই। আসলে ভালোবাসা, প্রেম এইসব কিছু না পেয়ে পেয়ে, আমি ভালোবাসার কাঙাল হয়ে গিয়েছিলাম, তাই তোমার কাছ থেকে এতদিন সব লুকিয়ে রেখেছিলাম। পারলে, আমাকে ক্ষমা কোরো ! " উঠে দাঁড়ায় সুপর্ণা, একা একা বাইরে বেরোনোর জন্য পা বাড়ায়।

 

হঠাৎ পেছন থেকে এসে মায়াঙ্ক টেনে ধরে ওকে , জোর করে পাশে বসিয়ে দেয়। একটু গলা তুলে বলে, "তুমি, তুমি একটা পাগলী ! তুমি কি করে ভাবলে তোমাকে ছেড়ে আমি চলে যাবো ? ভালোবেসেছি যে তোমাকে। আর যা হয়েছে, সে সব কিছুই অতীত। সেসব ভুলে , তুমি শুধু ভাবো সামনের কথা, আমাদের আগামী দিনগুলোর কথা। আমাকে, আমাকে একটু সময় দাও, ছয় মাস। আমি নিজে তোমার কাকু কাকীমার কাছে এসে, তোমার স্নিগ্ধাদির কাছ থেকে , তোমাকে চেয়ে নেবো। তখন কিন্তু তোমাকে আসতে হবে আমার সাথে। "

 

"মায়াঙ্ক, বোঝার চেষ্টা করো একটু। তোমার হয়তো খুব ভালো লাগছে এইসব কথা বলতে, হয়তো ভাবছো কোনো মহান কাজ করতে চলেছো। কিন্তু রাতে যখন তুমি আমার পাশে শুয়ে আমাকে স্পর্শ করতে যাবে, তখন তোমার মনে হবে না তো , আমার স্ত্রীকে দিনের পর দিন রেপ্ড হতে হয়েছে ? একসময় সে নিষিদ্ধ পল্লীতে কাটিয়ে এসেছে ? আর ঘৃণা করে, বিদ্বেষে আমাকে ছুঁড়ে ফেলে দেবে না তো ? " 

 

"ওহ, জাস্ট শাট আপ ! আমি, অনেকদিন আগেই বুঝেছি , প্রেম ভালোবাসার কি মানে, কিভাবে সবকিছু বাঁচিয়ে রাখার জন্য, আমাদের সমাজে আজ ও মেয়েদেরকে কিভাবে ব্যবহৃত হতে হয়। তাই আজকের আমি, আমার অতীতের আমি-র থেকে কিছুটা হলেও আলাদা হতে পেরেছি হয়তো। আর তাই তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা, প্রেম আরো, আরো বেড়ে গেছে। বুঝেছো ? " চেঁচিয়ে ওঠে মায়াঙ্ক।

 

কোনোকিছু না ভেবে, স্থান কাল, সময় অগ্রাহ্য করে, মায়াঙ্কের বুকের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে সুপর্ণা , বের হয়ে যায় কালো দুঃস্বপ্নের রাতের ভয় - আতঙ্ক , চোখের জল হয়ে।

 

 

++++++++++ 

 


সেই কখন থেকে ঘুরে যাচ্ছি, ছেলেটার জন্য ভালো একটা গিফ্ট জোগাড় করতে পারছি না ? মলগুলোতে কি সব যে রাখে, আর এতো এতো দাম ! বিরক্তিকর। এই জন্যই মল থেকে আমার শপিং করতে একদম ভালো লাগে না। তাও ছেলেটার জন্য কিছু তো কিনবোই আমি। আচ্ছা , শৌনক তো ক্রিকেট খেলতে খুব ভালোবাসে, কিনে নেবো ওর জন্য একসেট ব্যাট, বল, হেলমেট, প্যাড ? আর সাথে কিছু বই ? দেখি , তাই কিনি বরং। আজ আর নিশ্চয়ই স্নিগ্ধা আমাকে আটকাবে না। কতদিন দেখিনি ছেলেটাকে , কত বড়ো হয়ে গেলো। ভীষণ মনে পড়ছে সেই ছোটবেলার কথাগুলো , কিভাবে হামা দিয়ে সারা মেঝেতে ঘুরে বেড়াতো, তারপরে টেবিলের পায়া গুলো ধরে ওর সেই উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা, ধুপ করে আবার বসে পড়া , খিলখিল করে হাসি। তখন ওর চোখ দুটোও যেন কথা বলতো ! হাঁটতে শেখার পরে, তারপর আমার দুহাত ধরে ওর সেই বাইরে বেরিয়ে হাঁটা , হাত ছেড়ে দিলে টলমল করতে করতে নিজে থেকে এগিয়ে যাওয়া, পড়ে যাওয়া, আবার উঠে দাঁড়ানো , আবার পড়ে যাওয়া....এই করতে করতে একদিন ছেলেটা দৌড়োতে শুরু করলো, আমার সাথে রেস করতো ! ওহ, কি মিষ্টি মধুর সেই দিনগুলো। কেন যে হারিয়ে গেলো।

 

মেহেক হয়তো ঠিক ই বলেছে, আমার, আমাদের সব কিছু ভুলে আবার নতুন করে শুরু করাই উচিত। সম্পর্কের খাতার আঁচড়টাও তো আজ হয়েছে মলিন, ধূসর , হয়তো সেটা এবার সম্পূর্ণ ভাবে মিলিয়ে যাবে। ভবিষ্যৎকে যদি আমি কোনো সুযোগ না দিই, তাহলে কিভাবে চিনবো তাকে?

 

হাতঘড়ি দেখে বিতান, আরিব্বাস, ঘড়ির কাঁটা তো ছুটে চলেছে। এই তো একটু আগেই ছিলো দেড়টা, আর এখন পঁয়তাল্লিশ মিনিট হয়ে গেছে ? তাড়াতাড়ি ক্যাশ কাউন্টারে গিয়ে পেমেন্ট করে বেরিয়ে আসে বিতান। বাইরে বেরিয়ে হঠাৎ দেখতে পায় একটি অভাবনীয় দৃশ্য , একটি ছেলে আর মেয়ে বসে আছে পাশাপাশি, কিছু হয়েছে মনে হয় ওদের মধ্যে , মেয়েটি কিসব বলে যাচ্ছে, ছেলেটি দু হাতে মুখ ঢেকে বসে আছে পাশে। ওদের চারদিকে , বেশ কিছুটা দূরত্ব রেখে অনেকগুলি কৌতূহলী চোখ। কৌতূহলে, বিতান ও দেখতে থাকে ওদের দূর থেকে। একটু পরে হঠাৎ মেয়েটি উঠে দাঁড়ায়, ছেলেটিও উঠে দাঁড়িয়ে মেয়েটিকে টেনে বসিয়ে নেয় পাশে। ছেলেটিও কি সব বলে চলেছে, মেয়েটি কাঁদছে অঝোর ধারায় !

 

উহ্হ , আজকালের সব ছেলে মেয়েরা এতো অস্থির, কেন যে এতো ভুল বোঝাবুঝি। ওদের দিকে না তাকিয়ে সামনে চাইনিজ রেস্টুরেন্টের দিকে তাকায় বিতান। স্নিগ্ধা কি চলে এসেছে ? ওর গাড়িতো দেখতে পাচ্ছি না এখনও। মল থেকে বেরোনোর রাস্তার দিকে পা বাড়ায় বিতান। আবার হঠাৎ অনেকের গুঞ্জনে ,আনন্দের স্বরে ও পেছন ঘুরে দেখে, ছেলেটা মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরেছে , মলের সামনেই।

 

বিতান স্বগতোক্তি করে ওঠে, "আজকালের ছেলে মেয়েরা এইসব ব্যাপারে বেশ ভালো , কোনো লুকোছাপা নেই। প্রেম বা ভালোবাসা, সবার সামনে দেখাতেও ওদের নেই কোনো লজ্জা। এটাই তো হওয়া উচিত , যেটাই স্বাভাবিক, সেটা কেন লুকিয়ে রাখা ?

 

একটা আকাশী নীল রঙের বড়ো গাড়ি এসে দাঁড়ালো রেস্টুরেন্টের সামনে। ওই তো স্নিগ্ধা, আর ওই তো পাশে বসে শৌনক। উত্তেজনায়, পা চালায় বিতান , রাস্তা অতিক্রম করে যেতে হবে উল্টোদিকে।

 

আবার একবার পেছনে ঘুরে তাকায় বিতান , পেছনে ছেলেটা আর ওকে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে ভাবে , মেয়েটাকে খুব চেনা চেনা লাগছে। কোথায় দেখেছি ওকে?

 

 

++++++++++ 

 


শৌনক আজ প্রচন্ড খুশি , কতদিন পরে মায়ের সাথে ঘুরতে বেরিয়েছে, আর মা বলেছে আজ বাবা আসবে। ওরা সবাই একসাথে চাইনিজ খাবে।

বাবা আসবে ? সত্যি ? কতদিন, কত মাস কেটে গেছে, বাবা কে দেখিনি। বাবা কি গিফ্ট আনবে ? মা তো আমাকে বাবার কাছ থেকে কিছু নিতেই দেয় না। সেই সকাল থেকে দেখছি, মা কিরকম একটা অন্যরকম হয়ে গেছে, খুব ভালো হয়ে গেছে মা। আগে কিরকম দূরে দূরে থাকতো সবসময়, মায়ের কাছে আসতেও ভয় হতো। সুপর্ণাদির কাছেই সব আবদার, বায়না। আজ মা সারাটা গাড়ি আমাকে পাশে বসিয়ে, আমাকে গল্প বলতে বলতে ড্রাইভ করেছে। আমরা সকালে কত ঘুরলাম, আমাকে নিয়ে পার্কে গেলো, আমরা একসাথে ড্রাগন রাইডে উঠলাম, কখনো উঠলাম, আবার পরেই হুহু করে নিচে নেমে এলাম !

 

কি ভয় লাগছিলো, আর মাকে শক্ত করে ধরেছিলাম আমি। মা ও আমাকে ধরে রেখেছিলো হাত দিয়ে, দুজনে খুব চিৎকার করলাম যখন ড্রাগনটা জোরে জোরে নিচের দিকে নেমে এলো। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে গলা চিরে গেলো ! আজ মা চোখ থেকে সানগ্লাসটা খুলে , মাথার চুল থেকে ক্লিপ সরিয়ে দিয়েছিলো। হাওয়াতে ভাসছিলো মায়ের মাথার চুল গুলো, ঠিক যেন প্রজাপতি ডানা মেলেছে কতদিন পরে। আজ মা নিজেও জিন্স আর টি-শার্ট পরেছে। মনে হচ্ছে মা যেন আমার বন্ধু , আমার সাথে খেলতে এসেছে। কতদিন, কতদিন এইভাবে মা কে পাই নি।

 

ওহ গড, মাকে তুমি এইরকম-ই রেখে দাও , আজ আমার প্রচন্ড আনন্দের দিন একটা। প্রত্যেকটা দিন যেন এইরকম হয়ে ওঠে।

 

 

++++++++++

 

 

স্নিগ্ধা গাড়ি চালাতে চালাতে ছেলের দিকে তাকায় , শৌনক, খোলা জানালা দিয়ে তাকিয়ে বাইরের দিকে। ওর মাথার চুলে হাত দিয়ে, চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে সামনে রাস্তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে ,"কি রে ? কি ভাবছিস সোনু ? "

 

"কিছু না , এমনি, বাইরে দেখছিলাম। কত গাড়ি আর বাস ! " স্নিগ্ধার দিকে ঘুরে জিজ্ঞেস করে, "মা, আজ বাবা আসবে তো ? "

 

"আসবে, আসবে। আমি সকালেই ফোন করে দিয়েছি না ! " বলে ওঠে স্নিগ্ধা। মনে মনে ভাবে, আসতেই হবে তোমাকে বিতান, আজ প্লিজ, প্লিজ এসো , আমাকে হারিয়ে যাওয়া থেকে বাঁচাও; ডুবে যাচ্ছি আমি কোনো অতল গভীরে, আমাকে টেনে তুলে আনো ! তোমার অপেক্ষায় আছি আমি। প্লিজ, প্লিজ।

 

"মা, তুমি কাঁদছো ? " স্নিগ্ধার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে শৌনক। তাড়াতাড়ি চোখের কোণ থেকে বেরিয়ে আসা জলের ফোঁটা , মুছে নিয়ে হেসে বলে ওঠে স্নিগ্ধা ,"না তো ! কিছু মনে হয়, চোখের মধ্যে...." শৌনক, মায়ের হাতের ওপরে হাত রেখে ধীরে ধীরে বলে ওঠে, "তুমি একদম চিন্তা করবে না , বাবা ঠিক আসবে। দেখো ! তারপর আমরা সবাই মিলে, আবার আগের মতো একসাথে থাকবো, খুব মজা করবো। তাই না ? "

 

কোনো কিছু না বলে স্নিগ্ধা, গাড়ির এফ এম টা অন করে।

 

 

++++++++++ 

 


গাড়ির অডিও সিস্টেম থেকে ভেসে আসে সঞ্চালকের গলা ;

 

- গুড মর্নিং , সুপ্রভাত, এখন আপনারা শুনছেন রেডিও ধামাকা ; আর , আজ আমাদের সাথে রয়েছেন, বিখ্যাত, (কারোর কারোর মতে আবার কুখ্যাত ) সুপারস্টার, মেগাস্টার, নায়ক, গায়ক পারভীন।

 

ভেসে ওঠে পারভীনের গলা ,

- গায়ক ? আমি আর গান ? কে বললো তোমাকে ?

 

- আমাদের কাছে খবর আছে, আপনার নেক্সট সিনেমাতে আপনি গান করবেন। তাই না ?

 

হেসে ওঠে পারভীন ,

- ঠিক বলেছো। আসলে আমার নেক্সট সিনেমার গল্পটা এতো অন্যরকম যে , আমাকে গানটা করতেই হলো।

 

- একটু কি জানাবেন আমাদের দর্শককে , আপনার নেক্সট সিনেমা নিয়ে ?

 

- এটা, আসলে সম্পর্কের গল্প ; আমরা ছোট থেকে বড়ো হই, প্রথমে থাকে মা বাবা, তারপরে ভাই, বোন, দিদি, স্কুলের বন্ধু বান্ধবেরা আমাদের সাথে, তারপরে প্রেমিক প্রেমিকা, তাদের মধ্যে কেউ কেউ সারা জীবন মনে দাগ কেটে দেয় , তারপরে আরো পরে, সংসার , স্বামী বা স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে , শ্বশুর শাশুড়ি , ননদ, ভাসুর, শালা, শালী.....এতগুলো সম্পর্কের মধ্যে, একটা মানুষ, সে কি নিজেকে হারিয়ে ফেলে ? তার নিজস্বতা, অস্তিত্ব, চাওয়া পাওয়া, চাহিদা, কামনা বাসনা, কোথায় থাকে লুকিয়ে? সেগুলো কি হারিয়ে যায় ? এটা নিয়েই আমার এই সিনেমা....

 

রেডিও অফ করে দেয় স্নিগ্ধা। অস্ফুটে গলা দিয়ে বেরিয়ে যায় – ‘ফাক অফ’।

 

তাড়াতাড়ি পাশে দেখে ছেলের দিকে, ছেলে আবার বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে , দেখছে ক্রমশঃ পরিবর্তিত হতে থাকা দৃশ্যপট।

 

 

++++++++++ 

 


অনেকক্ষন হলো দাঁড়িয়ে আছি এই একজায়গাতে। পথচলতি লোকজন দেখছে আমাকে, হয়তো ভাবছে দিনে দুপুরেই রাস্তায় দাঁড়িয়ে ? কিন্তু কি করবো ? আমি যে পারলাম না নিজেকে আটকাতে। বিতান আমাকে বললো, আর যেন আমরা কথা না বলি, বা দেখা না করি কখনও। তবুও আটকাতে পারলাম কই নিজেকে ? আমার যে খুব ইচ্ছে করছে, দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখতে একটা সুখী পরিবারের ছবি , যে ছবিতে বিতান আর স্নিগ্ধা পাশাপাশি হেঁটে রাস্তা পেরোচ্ছে, বিতান আর এক হাতে শক্ত করে ধরে আছে শৌনকের ছোট্ট হাতটা। স্নিগ্ধা আর বিতানের মুখে হাসি, শৌনক আনন্দে লাফাতে লাফাতে চলেছে ওদের সাথে।

 

মনের অনেক গভীরে , আমি আরো একটা স্বপ্ন দেখেছিলাম, হঠাৎ করেই , গতকাল রাতে, ঘুমোতে গিয়ে। কোনোদিন সেটা কেউ জানবে না , আমার সাথেই তার হবে মৃত্যু।

 

স্বপ্নে আমি বিতানের হাতে হাত রেখে দাঁড়িয়ে একটা পাহাড় চূড়োয়, সামনে দিয়ে ধীরে ধীরে সূর্যোদয় হচ্ছে , পাখী গুলো উড়ে যাচ্ছে বাসা ছেড়ে, খাওয়ারের সন্ধানে। বিতানের ঠোঁট নেমে আসছে আমার ঠোঁটের ওপরে, আমি জড়িয়ে ধরছি আরো জোরে , আমার বিতানকে।

 

'আমার বিতান'? আমার ? ভাবনাটাতেই হাসি পেলো। বিতান কোনোদিন আমার ছিলো না , ও শুধুই তো স্নিগ্ধার, সে স্নিগ্ধা যতই ওকে দূর দূর করে তাড়াক ! কিন্তু বিতান যে অন্য কাউকে ভালোবাসতে পারে না, পারবে না কোনোদিন। আমি শুধু দূর থেকেই ওকে ভালোবেসে যাবো। কিন্তু আজ আমাকে দেখতেই হবে, সুখী, খুশি বিতানকে। আর , তাই আমি দেখতে এসেছি ওদের ! দেখতে এসেছি বিতানকে , আমার বিতানকে - সুখী, খুশি, আনন্দিত বিতানকে। আমিও চাই, সব কিছু ঠিক হয়ে যেন যায় ওদের মধ্যে, ভুল বোঝাবুঝিগুলো যেন বেরিয়ে যায় ওদের জীবন থেকে।

 

দূরে চাইনিজ রেস্টুরেন্টের দিকে তাকায় মেহেক। একটা আকাশি নীল রঙের গাড়ি এগিয়ে এসে থামলো ধীরে ধীরে। রাস্তার উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে বিতান, ওর চোখদুটো যেন খুঁজছে কিছু। বিতানের পেছনে...পেছনে ওরা কারা ? ভাই ? মায়াঙ্ক এখানে ? ও কাকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে ? এর কথাই তাহলে ও বলেছিলো আমাকে ? যাবো ওদের কাছে ? না থাক......দুজনকে খুব সুন্দর মানিয়েছে। পরে কোনোদিন ওদের জন্য সময় বের করবো, আজ আমি শুধু বিতান, বিতানের মুখে হাসি দেখতে চাই। 

 

ডিভাইডারের ওপরে, ঘন রুক্ষ শুষ্ক গাছ পালার মাঝে দাঁড়িয়ে মেহেক দেখতে থাকে বিতানকে।     

 

মনে মনে বলে ওঠে, বিতান আমাকে ভালোবাসুক বা না বাসুক , আমি শুধু গেয়ে যাবো 'রুদ্র' র সেই গান....শুধু বিতানের জন্য....

 

"ভাল আছি, ভালো থেকো,

আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো

দিও তোমার মালাখানি,

বাউলের এই মনটা রে।

 

আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে

আছো তুমি হৃদয় জুড়ে।"

 

 

++++++++++ 

 


আর একটু রাস্তাই বাকি, চাইনিজ রেস্টুরেন্টটার সামনে নেমে বিতানকে একবার ফোন করতে হবে। হঠাৎ ট্রাফিক সিগন্যাল সবুজ থেকে প্রথমে হলুদ, তার চার সেকেন্ড পরে হয়ে যায় লাল। সামনের টাইমারে দেখাচ্ছে একশো কুড়ি সেকেন্ড অপেক্ষা করতে হবে। স্নিগ্ধা গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করে দাঁড়িয়ে পড়ে। সামনের দিকে, লাল হয়ে জ্বলতে থাকা লাইটের দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে চুপ করে, আমি কি বিতানকে ভালোবাসতে পেরেছি কখনও ? আমি কি ওর ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য? ও যখন আমার জন্য, আমাদের সন্তানের জন্য, এতো পরিশ্রম করছিলো, দিন রাত এক করে দিয়েছিলো, আমাদের সবরকম ভাবে ভালো রাখার চেষ্টা করছিলো, নিজের অক্ষমতার কথা পাশে রেখে আমাকে সবসময় খুশি রাখার প্রচেষ্টায় নিমজ্জিত করেছিলো , তখনই আমি ধীরে ধীরে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছিলাম ওর কাছ থেকে। চরম অপমান করেছি, ওর গায়ে হাত পর্যন্ত তুলেছি। আমাকেও তো মারধোর করতে পারতো বিতান ! কোনোদিন সেটা করেনি, উল্টে আমার রাগ, আমার ক্রোধ, আমার হাত পা ছোঁড়াছুঁড়ির সামনে, চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকেছে , সহ্য করে গেছে দিনের পর দিন সবকিছু।

 

ওকে দেখিয়ে দেখিয়ে পারভীনের সাথে আমার প্রেমের নাটকটাও দেখে আমার ওপরে আক্রমণ করেনি। ও কি মানুষ ? মানুষ হলে তো রাগ হবে, ক্রোধের আগুনে সব পুড়িয়ে ছারখার করে দেবে ? নাকি, এটাই বিতানের ভালোবাসা? যে ভালোবাসা দিয়ে ও আমাকে, আমার সবকিছুকে মেনে নিয়েছিলো ? যদি কিছুদিন পরে, আবার সেই একই কারণে আমার বিতানের ওপরে রাগ হয় ? আবার যদি, যদি অন্য কারোর সাথে আমি সম্পর্কে লিপ্ত হই ? আমার কাছে কি আমার নিজের সুখটাই সব থেকে বেশি ? আর আমার ছেলে, বিতান ? ওদের কথা, ওদের কি কোনো মূল্য নেই আমার কাছে ? আমি, আমি নিজেও একটা মানুষ ? নাকি আমি শুধু শরীর সর্বস্ব একটি নারী , যে জানেনা কোনোকিছুর সাথেই নিজেকে মানিয়ে নিতে ; শুধুই ভাবে নিজের শরীরের সুখের কথা, ভাবে নিজের ইচ্ছে অনিচ্ছের কথা , ভাবে নিজের চাওয়া পাওয়ার কথা........!

 

সামনের লাল সিগন্যাল সবুজ হয়ে গেছে , পেছন থেকে অন্য গাড়িগুলো হর্ন দিতে শুরু করেছে। তাড়াতাড়ি ঘোর থেকে ফিরে এসে, ইঞ্জিন স্টার্ট করে সামনে এগোতে থাকে গাড়িটা। স্নিগ্ধা ভাবতে থাকে, বিতান, ও আমাকে স্বীকার করে নেবে তো ? মেনে নেবে তো আবার ? প্লিজ ভগবান, তোমার কাছে প্ৰাৰ্থনা করছি, আমাকে, আমাকে আবার ফিরে আসতে দাও ওর জীবনে। আমি, সব কিছু ঠিক করে দেবো। নতুন করে সাজিয়ে তুলবো আমাদের সম্পর্ক, আর সেখানে যাতে কোনোদিন কোনো ফাটল না সৃষ্টি হয় , তারজন্য আমি সবকিছু করতে রাজি আছি। প্লিজ, প্লিজ।

 

 

++++++++++ 

 


এই তো রেস্টুরেন্টটা, এটার কথাই তো বলেছিলো বিতান।

 

ধীরে ধীরে পোর্টিকোর নিচে গাড়ি দাঁড় করায় স্নিগ্ধা। বাইরে বেরিয়ে আসে স্নিগ্ধা, তাড়াতাড়ি অন্যদিকে গিয়ে সিটবেল্ট খুলে দেয় শৌনকের। শৌনক নেমে আসে গাড়ি থেকে। রিসেপশন থেকে একজন দৌড়ে বেরিয়ে আসে, স্নিগ্ধার হাত থেকে গাড়ির চাবি নিয়ে, গাড়িটাকে পার্কিং এ নিয়ে চলে যায়।

 

একটু এদিক ওদিক তাকায় স্নিগ্ধা। সময় দেখে ঘড়িতে, দুটো বেজে কুড়ি মিনিট। এখনও কি আসে নি বিতান ? ও তো সবসময় সময়ের আগে এসে আমার জন্য অপেক্ষা করতো ! ফোন করবো একটা ? ভাবতে ভাবতে স্নিগ্ধা হ্যান্ডব্যাগ খুলে ফোন বের করে।

 

শৌনক হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠে, "মা, ওই তো বাবা দাঁড়িয়ে। ওই দেখো। "

 

"কোথায় ? কোথায় রে সোনু ? "

 

"আরে ওই তো, রাস্তার ওপাশে , ওই দেখো না সবুজ রঙের চেক শার্ট পরে। " অবশেষে স্নিগ্ধা দেখতে পায় বিতানকে। এই শার্টটা স্নিগ্ধা নিজে পছন্দ করে কিনে এনেছিলো বিতানের জন্য , বছর চার আগে। হাত ছাড়িয়ে শৌনক চেঁচিয়ে ওঠে বিতানের দিকে তাকিয়ে ,"বাবা , বাআআআআ বাআআ " হাত দিয়ে ইশারা করে। বিতান ও এদিকেই তাকিয়ে। ও রাস্তা ক্রস করার জন্য অপেক্ষা করছে।

 

স্নিগ্ধা শৌনকের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,"ওই তো, তোর বাবা দেখতে পেয়েছে আমাদের...." নিচের দিকে শৌনককে দেখতে না পেয়ে উদ্বিগ্ন স্নিগ্ধা চেঁচিয়ে ওঠে, "সোনু ? সোনু ? "

 

 

++++++++++ 

 


শৌনক মায়ের হাত ছাড়িয়ে দৌড়োচ্ছে বিতানের দিকে। রাস্তায় একের পর এক গাড়ি ছুটে আসছে, আসছে বাস। জোরে জোরে হর্ন বাজিয়ে চলেছে গাড়িগুলো এমনভাবে, কানে তালা লেগে যাওয়ার জোগাড়। এসব কিছুর মধ্যে একটি ছোট ছেলে দৌড়োচ্ছে, দৌড়োচ্ছে তার বাবার কাছে যাওয়ার জন্য, দৌড়োচ্ছে গিয়ে বাবার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য। স্নিগ্ধাও দেখতে পেয়েছে শৌনক কে , স্নিগ্ধাও দৌড়ে ধাওয়া করলো ওর পেছনে, চিৎকার করছে ও "সোনু , শৌনক দাঁড়া , দাঁড়িয়ে যা ! "

 

 

++++++++++ 

 

 

 মেহেক বেশ কিছুক্ষণ আগেই দেখেছে বিতানের চোখ আকাশি নীল রঙের গাড়ির দিকে। ও বুঝেছে, এটাতেই আছে স্নিগ্ধা আর ওদের ছেলে শৌনক। ও গাড়ির দিকে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করলো ওদেরকে। হঠাৎ সবকিছু কেমন যেন দুলে উঠলো ওর সামনে। একটা বাচ্চা ছেলে, তীরের বেগে দৌড়ে যাচ্ছে বিতানের দিকে, রাস্তার ট্রাফিক সব অগ্রাহ্য করে 'বাবা', 'বাবা' বলে বিতানের দিকে ছুটে চলেছে। এই তাহলে শৌনক ? আর পেছনের ভদ্রমহিলা স্নিগ্ধা ? কেমন মা , ছেলের হাত ধরে রাখতেও পারে না ? এই ভিড় রাস্তায় যদি কিছু হয়ে যায় ? ঠিক-ই আছে, নিজের স্বামীকেও যে ঠেলে ফেলে....কিন্তু , আর তো দেরি করা যাবে না , যে কোনো মুহূর্তে পেছনের দানবের মতো স্পিডে আসা বাস চলে যেতে পারে শৌনকের ছোট্ট শরীরের ওপর দিয়ে !

 

 

++++++++++ 

 

 

বিতান দূর থেকে দেখতে পায় স্নিগ্ধাকে, দেখতে পায় শৌনককে। ও তাড়াতাড়ি রাস্তা ক্রস করতে যায়, কিন্তু একের পর এক গাড়ি ওর সামনে দিয়ে স্পিড তুলে এগোতে থাকে রাস্তা দিয়ে। দাঁড়িয়ে যায় বিতান, অপেক্ষা করে ভিড় হালকা হওয়ার জন্য। সামনে তাকায় স্নিগ্ধার দিকে। কি হয়েছে ওর ? শৌনক , সোনু কোথায় গেলো ? ও দৌড়ে বেরিয়ে আসছে কেন রেস্টুরেন্টের পোর্টিকো থেকে ? স্নিগ্ধার দৃষ্টি অনুসরণ করে রাস্তার দিকে তাকায় বিতান।

 

সোনু ছুটে ছুটে আসছে আমার কাছে ? এই ভিড়ের মধ্যে দিয়ে ? রাস্তার ওদিক থেকে একটা বিশাল বড়ো বাস প্রচন্ড স্পিডে এগিয়ে আসছে দানবের মতো হুঙ্কার দিতে দিতে , শৌনকের দিকে! বুকের ভেতরটা হঠাৎ কেঁপে ওঠে ভীষণ জোরে বিতানের! 

 হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে অনাগত অবশ্যম্ভাবী বিপদের সম্ভাবনায়।  

 

 

++++++++++ 

 

 

শৌনক কিছু বুঝে ওঠার আগেই কেউ যেন ওকে জোরে ছুঁড়ে ফেলে দেয় রাস্তার অন্যদিকে। প্রচন্ড জোরে ব্রেক দিয়ে গাড়ি, বাস গুলো দাঁড়িয়ে পড়ে রাস্তার ওপরে। একটা দুটো গাড়ি ধাক্কা মারে সামনের অন্য কোনো গাড়ির সাথে , ভেঙে পড়ে গাড়ির কাঁচের জানালাগুলো, হেডলাইটগুলো টুকরো হয়ে যেতে থাকে। কয়েক সেকেন্ড পরে, বিশৃঙ্খলার মধ্যে, সব বাস - গাড়ি - বাইকের হর্ণের কানফাটানো শব্দের মধ্যে, একে একে বেরিয়ে আসে ড্রাইভারেরা , গাড়ির অন্য প্যাসেঞ্জারেরা।

 

শৌনক ডিভাইডারের ওপরে শুয়ে আছে উপুড় হয়ে, হাঁটুর কাছে ছড়ে গেছে, হাতের ওপরে লেগেছে ধাক্কা। সেই অবস্থায় ও কোনোরকমে উঠে বসে। আসে পাশে সবকিছু দেখে ভয়ে কেঁদে ওঠে। মুহূর্তের মধ্যে বিতান আর স্নিগ্ধা দুজনেই এসে পড়ে ওর কাছে , বসে ওর পাশে। স্নিগ্ধা তাড়াতাড়ি শৌনককে দাঁড় করিয়ে ভালো করে দেখে নেয় ওকে ,জিজ্ঞেস করে ,"সোনু, তোর লেগেছে ? কোথায় লেগেছে ? বল না আমাকে, কোথায় লেগেছে ? "

 

বিতানের চোখ তখন দুটো গাড়ির মাঝে চিঁড়ে়ে চ্যাপ্টা হয়ে পড়ে থাকা অবয়বের দিকে - মেহেক !

 

মেহেক কাতরাচ্ছে প্রচন্ড ব্যথায়, যন্ত্রনায়, ওর মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছে রক্ত , কোনোরকমে হাত দিয়ে একটা গাড়ির বনেটের ওপরে ভর দিয়ে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে চলেছে মেহেক। তাড়াতাড়ি বিতান স্নিগ্ধা আর শৌনককে ওখানেই বসতে বলে এগিয়ে আসে মেহেকের দিকে। ওকে মেহেকের দিকে দৌড়ে যেতে দেখে, গাড়ির ড্রাইভার, তাড়াতাড়ি ভেতরে গিয়ে গাড়িতে উঠে খুব ধীরে ব্যাক গিয়ারে গাড়িটা পিছিয়ে আনে কয়েক ইঞ্চি। মেহেক মাটিতে পড়ে যাওয়ার আগেই বিতান ধরে ফেলে ওকে ।

 

বিতানের গাল বেয়ে কয়েকফোঁটা জল এসে পড়ে মেহেকের মুখের ওপরে। কোনোরকমে চোখ খুলে বিতানের কোলে নিজেকে দেখে , হাসি ফোটে ওর মুখে। রক্তমাখা ছিল সেই হাসি।

 

বিতানের গালের ওপরে নিজের রক্তাক্ত হাত রেখে ধীরে ধীরে বলে ওঠে মেহেক ,"তোমরা...ভালো....." মেহেকের হাতটা বিতানের বুক বেয়ে পড়ে যায় নিচে। চোখ দুটো হয়ে যায় বন্ধ, চিরদিনের জন্য।

 

হঠাৎ পেছন থেকে ভিড়ের মধ্যে দিয়ে একজন চেঁচিয়ে ওঠে ,"দিদি , দিদি কি হয়েছে তোর ? " মায়াঙ্ককে সবাই রাস্তা ছেড়ে দেয়। ও এসে বসে পড়ে মেহেকের নিথর শরীরের পাশে। কান্নায় ভেঙে পড়ে মায়াঙ্ক। বিতান মেহেকের নিষ্প্রাণ শরীরটা মায়াঙ্কের কোলে রেখে উঠে আসে ধীরে ধীরে। ফিরে আসে স্নিগ্ধা , আর শৌনকের কাছে। ওদের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে, দুজনকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে বিতান।

 


++++++++++ 

 

 

স্নিগ্ধা ও বিতানকে জড়িয়ে কাঁদতে থাকে অঝোরে , আজ এতদিন পরে সব রাগ অভিমান ধুয়ে মুছে যাচ্ছে একটু একটু করে মনের গভীর থেকে। একটু পরে স্নিগ্ধা জিজ্ঞেস করে ওঠে বিতানকে ,"কে ওই মেয়েটা ? আমাদের ছেলেটাকে বাঁচাতে গিয়ে, নিজেই নিজেকে শেষ করে দিলো ! "

 

বিতান স্নিগ্ধা আর শৌনককে আরো জোরে চেপে ধরে, কাঁপতে থাকা গলায়, ধীরে ধীরে বলে ওঠে ,"সি, সি ওয়াজ এন এঞ্জেল ! নিজে মরে, বাঁচিয়ে দিয়ে গেলো আমাদের, আমাদের ভালো থাকার রাস্তাটা, দেখিয়ে দিয়ে গেলো। " একটু চুপ করে , মেহেকের নিথর শরীরের দিকে তাকিয়ে, ধীরে ধীরে কান্না ভেজা গলায় বিতান বলে ওঠে আবার...

 

 

++++++++++ 

 


"এন্ড আই লাভড হার"


 

++++++++++


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract