Rima Goswami

Tragedy Fantasy

3  

Rima Goswami

Tragedy Fantasy

শতাব্দী

শতাব্দী

4 mins
210


মানুষ মাত্রেই স্বাধীন , সত্যি কি তাই ? না স্বাধীনতা শব্দটা অতও সহজলভ্য নয় । আমি , তুমি , সবাই কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে বন্দি । কেউ সংসারে , কেউ দায়বদ্ধতাতে , কেউ অপরাধবোধ নিয়ে , কেউ যন্ত্রণা নিয়ে ... ভিন্ন ভিন্ন রূপে পৃথিবীতে সকলেই বন্দি । জন্ম নেবার পর আমাদের বৃদ্ধি হয় , শারীরিক ও মানসিকভাবে । আবার একটু একটু করে আমরা মৃত্যুর দিকেও এগিয়ে যাই । মরণকে সকলের ভয় , তবুও আমরা মরণের ভয়কে ভুলে বাঁচি । ভুলে যাবার কারণ আমাদের ব্যস্ততা ও বন্দি জীবন । প্রতি জন্মদিনে এক একটা নম্বর ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিয়ে আমরা নিজেদের জীবন প্রদীপ গুলোকেও এক এক করে নিভিয়ে দি , জ্ঞানত । তার পরেও হ্যাপি বার্থডে উইস গুলো আমাদের মৃত্যুর দিকে এক পা এক পা এগিয়ে যাবার ভয়কে ভুলিয়ে দেয় , আমাদের বাঁচতে শেখায় ।


আমাদের লোভ , আকাঙ্ক্ষা , জেতার নেশা , স্নেহ সব কিছু আমাদের ভুলিয়ে রাখে আসন্ন মৃত্যুকে ।


শতাব্দীর সাথে আমার আলাপ সেই স্কুল লাইফ থেকে । আমরা একই ক্লাসে পড়েছি প্রায় বছর দশেক , অর্থাৎ ক্লাস ওয়ান থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত । তারপরেও আমাদের মধ্যে সে ভাবে সখ্যতা গড়ে ওঠেনি কোনদিন । শতাব্দী দেখতে বেশ সুন্দরী , পড়াশোনাতে বেশ ভালো ছিলো । আমার সাথে ওর বন্ধুত্ব না গড়ে ওঠার কারণ ছিল এক অদৃশ্য দেওয়াল ..... যার নাম অহংকার । শতাব্দীর বাবা সরকারি চাকুরে ছিলেন , মাস গেলে মোটা টাকাই বেতন পেতেন । আমার বাবার ছিল ছোট ব্যবসা , আবার সেটাও এক দিন দুম করে বন্ধ হয়ে গেল পুঁজির অভাবে । বাবা ও চাকুরিজীবী হলেন , তবে বেসরকারী ছোট সংস্থা । বাবার সারা বছরের বেতন সমান ছিলো হয়ত শতাব্দীর বাবার দুই তিন মাসের বেতন । যার ফলে আমাদের লাইফস্টাইলে ছিলো আকাশ পাতাল পার্থক্য । এর জন্য আমার মনে কোন খেদ ছিলোনা । না থাকারই কথা , যার যেমন ক্ষমতা ... আর আমাদের গার্লস স্কুলের সব মেয়েদের মধ্যে অনেকেই ছিল বড়লোকের মেয়ে আবার অনেকেরই ছিলো যারা আমার থেকেও গরীব মানুষ । এই অর্থনৈতিক পার্থক্য আমাদের বন্ধুত্বের মধ্যে কোনদিনই প্রাচীর হয়ে দাঁড়ায়নি । আমরা সকলে একে অপরের টিফিন ভাগ করে খেয়েছি , খেলা করেছি , কৈশোরের ভালোলাগা নিয়ে খোলামেলা গল্প করেছি । তার পরেও একজন কে আমার মনে হয়েছিল পরাধীন .... সে বন্দি .... সে অহংকারের বন্দি , শতাব্দী ।


ওর কথোপকথনে বারবার উঠে এসেছে ওদের বাড়ি , গাড়ির কথা । ভবিষ্যত প্ল্যানিং এর কথা । ঝালমুড়িআলার কাছে কেনা আলুকাবলি যা আমরা একে অপরের কাছ থেকে কেড়ে কুরে খেয়েনিতাম , ওর সেই আলুকাবলিকে ঘেন্নার চোখে দেখা সত্যি আমাকে অবাক করে দিতো । আমাদের কাছে তৎকালীন সময়ে প্রচলিত লেডি বার্ড সাইকেল ছিলো স্বপ্নের মতো । আর শতাব্দীর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলো চারচাকা .... মানে কার । আমাদের স্বপ্ন গুলো ছিলো ছোট ছোট ... একটু একটু জিনিস আমাদের ভীষণ আনন্দ দিতে পারত । ও ছিলো ভীষণ আলাদা । আমরা তো নতুন , পুরোনো যে কোন একটা চার চাকাতে একটু সময়ের জন্য চাপতে পেলেই ধন্য হয়ে যেতাম । না ডিজেল গাড়ি বা পেট্রোল গাড়ি সেটা আমরা খোঁজ নিতাম না , কি মডেলের গাড়ি তা জানারও আগ্রহ ছিলনা । শতাব্দী বলতো ডিজেল গাড়িতে নাকি ওর বমি পায় , ডিলাক্স গাড়ি না হলে নাকি ও লং জার্নি করতে কমফোর্ট ফিল করে না । আমরা ছাতার মাথা ওসবের কিছুই বুঝতাম না ।


ঝিমলি ছিল শতাব্দীর বাবার বসের মেয়ে ... স্বাভাবিক ঝিমলির পরিবারের আর্থিক সঙ্গতি অনেক বেশি ছিলো তারপরেও ঝিমলি কিন্তু এর পাঁচটা মেয়ের মতোই স্বাভাবিক ছিলো । ওর আর আমাদের চাহিদার মধ্যে কোন পার্থক্য ছিলো না । এর মানে আজ স্পষ্ট , আর্থিক সঙ্গতি নয় ... শতাব্দীর মধ্যে কৈশোরের ছেলেমানুষির অভাব ছিল । অহংকারের অদৃশ্য শেকলে বন্দি ছিল ওর জীবনটা । তারপর অনেক সময় কেটে গেছে , শতাব্দী বা আমি সকলেই বিবাহিত ও সন্তানের জননী । ওর কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম । সদিন সকালে ঝিমলির ফোনটা এলো ... আমি ভাবলাম হয়ত গল্প করতে ফোন করেছে । তার পর ফোন ধরে যেটা শুনলাম .... আমার নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না । আগেরদিন দোল পূর্ণিমা ছিলো , আর শতাব্দী আর তার একমাত্র আট বছরের ছেলের মৃত্যু হয়েছে কার অ্যাক্সিডেন্ট এ । ঝিমলি আমাকে বললো , চল যাবি একবার শেষ দেখে আসি শতাব্দীকে । আমি কিছুই না উত্তর দিয়ে ফোনটা কেটে দিলাম । থাকনা আমার স্মৃতির মণিকোঠায় সেই শতাব্দী যার গ্রীবা অহংকারে উঁচু হয়ে থাকতো ... মৃত্যুর কাছে হেরে যাওয়া শতাব্দীকে আমি মনে রাখতে চাইনা । দশ বছর কম সময় তো নয় ... একটু হলেও ভালোবেসে ছিলাম যাকে তাকে মৃত্যুর কাছে হেরে যেতে দেখতে ভালো লাগবে না ।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy