শ্রী
শ্রী
মহাদেব হালদার একজন পেশাদার দর্জি।নিজের তিরিশ বছর উপার্জন কালে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন।
নিজে বিয়ে করেছেন।একটা মোটামুটি ধরণের একতলা পাঁকা বাড়ি বানিয়েছেন।
যমজ দুটো মেয়েকে কলেজ অব্দি পড়িয়ে বিয়ে দিয়েছেন।
কিছুটা সঞ্চয়ও করেছেন।
আজো এই বয়েসে একদম বসে থাকেন না। বাড়িতে বসেই ভাঙা চশ্মার লেন্স দিয়ে যতটুকু সাধ্য সেলাই করেন।
স্ত্রী নির্মলাদেবী স্বামীকে পাশে থেকে অনেক রকম সাহায্য করেছেন।
বোতাম লাগানো,হুক লাগানো তাছাড়া ইস্ত্রী করা,কাপড় ধোয়া এরকম আনুসঙ্গিক অনেক কাজে হাত লাগিয়েছেন।
স্বামীকে সময় মত খাবার খাইয়ে সুস্থও রেখেছেন।শুধুমাত্র অন্ধকার থেকে গেছে প্রদীপের তলাটিতে।নিজে আজ বাতের রুগী হয়ে স্বামীর সেবা নিচ্ছেন।
এক সময় বাড়িটায় খুশি উছলে পড়ত।অর্চনা আর মূর্ছনা যখন একসাথে হারমোনিয়াম নিয়ে বসত।
রবীন্দ্র আর নজরুলগীতির মিষ্টি সুর, জানালার পাল্লা ভেদ করে আম,পারুলের বাতাসে লুটোপুটি খেত।
তাদের দুই বোনের হাসির শব্দে ঘরের অভাবী বাতাসটা জমে উঠতে পারত না।
মহাদেব হালদার নিজেকে একজন সম্রাটের থেকে কম ভাবতেন নাকি?
হাতে তার দু,দুটো মানিক।যতই পরের হাতে তুলে দিক।দাতা হিসেবে কম গর্ব কী ?
তবে এই সুখ চিত্রের মাঝে ঈশ্বরও বুঝি বড় নিঁপুন হাতে খুঁতখানা ছেড়ে গেছেন!
অর্চনা আর মূর্ছনার মধ্যে সম্পর্ক যতই গভীর থাকুক না কেন....চোখের কোনে এক ফালি বৈষম্যের রোদ ঠিক চিকচিক করে উঠত।
সেটা মহাদেব হালদার খালি চোখেও টের পেতেন।যদিও সে কথা মুখ ফুটে আজ অব্দি তিনি কাউকে বলেননি।
শুধু মনটাকেই বুঝিয়েছেন।
এমনকি নির্মলাদেবীকেও না।হয়ত তার চোখেও ধরেছে ব্যাপারটা।কোনদিন জানতে চাননি সে কথা।
আজ দুটি মেয়েই পূর্ণ সংসারী।তবু ঈশ্বরের সেই খুঁতটা আজো লক্ষ্য করেন।
অপূর্ণতার সেই খেদটুকু এক চোখ থেকে অন্য চোখে বদল ঘটেছে মাত্র!
কিন্তু শেষ হয়নি।
সব তারই মায়া!
সৃষ্টিকর্তার অরূপ সৃষ্টি!!
তার হাতে তো কিছু নেই।তবু মন তো।মানে না।নিজের আত্মজাদ্বয়ের প্রতি বিধাতার এই কঠোরতটা ঠিক মেনে নিতে পারেন না।
জন্মের সময় হাসপাতালের বেডে প্রথম দেখাতেই মহাদেব হালদার বুঝে নিয়েছিলেন।তার এক মেয়ে কৃষ্ণ বর্ণা অন্যটি গৌর বর্ণা হবে।
তাদের বড় হওয়ার সাথে,সাথে বিধাতার সেই বৈষম্যও ক্রমে প্রকট হতে থাকল।
যখন তারা ছোট ছিল।তখন দুজনের কারো মনে কোনরকম খেদ ছিল না।
মানুষের জ্ঞানটাও একটা অদ্ভূত জিনিস!
না হলে একজন ছেলে কুড়িটা বছর যে ভাঙা বাড়ির উঠোনে হাসল,খেলল।ভেদজ্ঞানী সেই ছেলেই একদিন ক্ষোভ উগরে বলে ওঠে,বাবা হয়ে দিয়েছ কী?...একরত্তি ভাঙা ছাদ আর নড়বড়ে উঠোন?...তখন পিতার মনে অনেক প্রশ্ন জেগে ওঠে।
ঠিক মহাদেব হালদারের মত।
ঋতুমতী হওয়ার পর থেকেই অর্চনার চোখের চাউনি বদলে যেতে শুরু করল।মূর্ছনার উজ্বল রঙের ছটায়।
একসাথে ঘোরা,ফেরা পড়তে যাওয়া,বাড়িতে আড্ডা দেওয়া।অথচ এরই মাঝে অভাবের ছুরিটা ঠিক তার কাজ করে ফেলত।নিঃশব্দে।মনের দেওয়ালে।
রাস্তায় ছেলেগুলোর নজর অর্চনাও পড়তে পারত।তারা ঠিক কার দিকে এমন বিভোরভাবে তাকিয়ে আছে!
ইস্কুল,কলেজের ছেলেগুলো হুমড়ি খেয়ে পড়ত মূর্ছনার গায়ের দিকে।শত সিটি আর চুক,চুক শব্দগুলো সব মূর্ছনার দিকেই ধেয়ে যেত।অথচ তার একদম পাশেয় হাত ধরে সেও পথ চলত।তবু নিজেকে বড্ড অসহায় আর একা লাগত।
মূর্ছনা, গরবের উপচে পড়া হাসি হাত দিয়ে ঢেকে রাখার চেষ্টা করত।
আর অর্চনার মনে তখন ঈর্ষার আগুনটা ধিকি,ধিকি জ্বলে উঠত।
এক ঘন্টার হলেও তো সে বড়।সুতরাং দিদি।নিজের বোনের গর্বে,গরবিনী হওয়া উচিত।মনকে অনেকবার বুঝিয়েছে।তবু এক,দু সময় মনটা,যুক্তি ভেঙে বিদ্রোহ করে উঠত।
ইচ্ছাকৃতভাবে একসাথে যেতে চাইত না। নানা রকম অজুহাত দেখিয়ে পাশ কেটে যেত।
মূর্ছনাও বুঝত।দিদির কষ্টটা ঠিক কোথায়?
কিন্তু এতে তার দোষ কী?
চরম মুহূর্ত তাদের জীবনেও একদিন উপস্থিত হল।
মহাদেব হালদার মনে,মনে ঠিক করেই রেখেছিলেন।কষ্ট যতই হোক।তিনি দুটো মেয়েকে একই ছাদনা তলা থেকে বিদায় জানাবেন।
সেইমত ছেলে খুঁজছিলেন।ঘটক ঠাকুর সন্ধান এনে দিলেন।
তার বড় মেয়ে অর্চনার জন্য একটা সাধারণ টিউশন পড়া ছেলে।ঘরদ্বোর ভাল।তার বাবা এক সময় কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে মোটা মাইনের চাকরী করতেন।জৈষ্ঠ্য পুত্র ব্যবসা করেন।এটি তার কনিষ্ঠ পুত্র।জমানো রাশি দুই পুত্রের মধ্যে বিভাজন হলেও,লাখ খানেক তো পাবেই।
কালো মেয়ের জন্য এরথেকে ভাল সম্বন্ধ বোধ হয় পাওয়া দুষ্কর।সেই ভেবে রাজি হয়ে গেলেন।
ওদিকে ছোট মেয়ে মূর্ছনার জন্য ছেলের পিতা নিজেই গাড়ি হাকিয়ে একদিন সপরিবারে চলে এলেন।
মূর্ছনাকে তাদের একমাত্র ছেলের বউ করার আকুতি নিয়ে।ছেলে সরকারি আয়কর বিভাগের একজন পদস্থ অফিসার।
মাইনের কথা জিজ্ঞেস করা এক্ষেত্রে লজ্জা দেওয়া ছাড়া কিচ্ছু নয়।একজন মূর্খ মানুষও জানে।উপর,নিচ দিয়ে কত আসে?
বিদায় বেলায় দুটো মেয়ের চোখের জল মহাদেব হালদার নিজের হাতে মুছিয়ে ছিলেন।তখনি টের পেয়েছিলেন।অশ্রুরও একটা নিজস্ব জাত থাকে।না হলে আলাদা করে বোঝা যায় কী করে?
অর্চনার চোখের ধারায় মূর্ছনার থেকে অনেক বেশি উত্তাপ ছিল।
মহাদেববাবুর হৃদয়,সেই উত্তাপে আজো ঠিক একই রকম পুড়ছে!!
শুধু সেই আগুনটা আজ অর্চনার চোখ থেকে সরে মূর্ছনার চোখে ঠাঁই নিয়েছে।
ঈশ্বরের শাস্তিটা হয়ত জীবদ্দশায় আর শেষ হওয়ার নয়।
দশ বছর পেরিয়ে গেছে।অর্চনা আর মূর্ছনার বিয়ে হওয়া।
অর্চনার বড় মেয়ে আপার নার্সারিতে ভাল রকম রেজাল্ট করেছে।
এখন থেকেই বোঝা যায় মেয়েটা বড় হয়ে কত ভয়ানক সুন্দরী হবে?গায়ের রঙটা ঠিক তার বিপরীতটা পেয়েছে।দুধে,আলতা মেশানো।
ভেবেই তো অর্চনার মাতৃহৃদয় সমুদ্রের উত্তাল টেউ-এর মত ফুলে ওঠে।
তার মেয়ে রূপে,গুনে,শিক্ষায় সকলকে টপকে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে।
আর ছেলেটা সবে তিন বছরের।এই জানুয়ারিতে ভর্তি করবে।সেও একটি যন্ত্র!
এই বয়েসে এক কিলে সকলকে বাপ মনে করিয়ে দেয়।সিংহ শাবকের মত বলীয়ান।
ভূতের ভয় দেখালে সে প্যান্ট খুলে ওই জায়গায় ছিরছির করে মূতে দিয়ে আসে।
অদ্ভূত ছেলের আচরণ!
তবে মা হিসেবে সন্তানের এসকল দস্যিপনা কতটা গর্বের? সেটা একজন মাই ভাল করে জানেন।
তাই আজ আর অর্চনার মনে কোথাও সেদিনের আগুনটার ছাই,পাসও বেঁচে নেই।
ঈশ্বরের কী লীলাখেলা!
না হলে অর্চনার মনের আগুনটা আজ মূর্ছনার বুকে বাসা বাঁধে?
বলতে গেলে বিয়ের পরের বছর থেকেই তারা স্বামী,স্ত্রী মিলে চেষ্টা করে চলেছে।একটা যাতে সন্তান আসে।
সমস্ত রকম চিকিৎসা করিয়েছে।দোষ কম,বেশি দুজনেরই আছে।
তবে বেশিরভাগটা মূর্ছনার।ডিম্ব নিষিক্ত ঠিক মত হয় না। ওদিকে তার স্বামীরও বীর্যে জীবিত শুক্রকীটের পরিমাণ সাধারণ থেকে কম।সুতরাং একদম দৈবাৎ যোগ না হলে ভ্রূণ গঠন হওয়া অসম্ভব ব্যাপার ।
ডাক্তার আশা দেখিয়ে চলেছেন।তাই তারা সন্তান দত্তক নিতেও চাইছে না।
এদিকে দিন,দিন ঘরগুলোর আয়তন যেন চুয়িংগামের মত বড় হয়ে যাচ্ছ।
ডিভানটা মরুভূমি মনে হয়।
আসলে মনের ভিতর শূন্যতা বিরাজ করলে প্রকৃতির কোন রঙই চোখে লাগে না।
অথচ নতুন যখন বিয়ে হয়ে মূর্ছনা এই ঘরে পা রেখেছিল।
মনে হয়ে ছিল রাজমহল!
বাড়িটা আজো একই বৈভব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তবু তার মনে হয় এটা একটা পোড়ো বাড়ি।
অনবরত হাহাকারের ডাক শুনতে পায়।
আগে বছরে অন্তত দুবার বাপের বাড়ি গিয়ে দিন দশেকের মত থেকে আসত।
দিদি অর্চনাও আসত।
মেয়েটাকে সঙ্গে নিয়ে।ভালই লাগত।মা,মাসি পেয়ে মেয়েটাও খুব নাচত।
ওর ওই দুষ্টু পায়ের ছন্দে কোন সময় মূর্ছনার বুকে ভূমিকম্প শুরু হয়ে গেল। কি জানি!!
মনের অন্ধকূপ থেকে দুঃখটা কখন আগুন হয়ে চোখের কোণে ঝরে পড়ল,মূর্ছনা আজো ভেবে পায় না।
আসলে সব তার অপূর্ণ নারী হৃদয়ের প্রকাশ।
......তারপর যখন খবর এল অর্চনা আবার গর্ভবতী।তখন থেকে বাপের বাড়ি একরকম যাওয়াই ছেড়ে দিল।শুধু,শুধু অন্তরটাকে অন্যের সুখের কাঠে জ্বালিয়ে লাভ কী?
মাঝে,মাঝে ফোনে খবর নেয়।
ওদিকে ভর্তি সংসারের কোলাহল, এদিকে তার শূন্য মাতৃ হৃদয়ের নিস্তব্ধতা!
বড় বেমানান লাগে।
ঈশ্বরের কাছে কৈফিয়ত চেয়েও পায়নি।
সেদিনের উচ্ছল মূর্ছনার সুর হৃদয়ের কংক্রিটে ধাক্কা খেতে,খেতে আজ বড় অসহায় কান্নার মত লাগে!!
মহাদেব হালদার রাতে রোজ কিছুক্ষণ কামরার উজ্বল আলোটা জ্বেলে দেওয়ালে টাঙানো ফটোটার দিকে চেয়ে থাকেন।একটা ফ্রেমে বাঁধানো দুই মেয়ের ছোটবেলার ফটো।
অর্চনা আর মূর্ছনা ।
চোখে,মুখে এমন কী মনের ভেতরেও কোন রকম দাগ দেখতে পান না।
একদম স্বচ্ছ জলের মত পরিস্কার দুটি বোনের সম্পর্ক ।
আজ সময় সবকিছু ঘোলাটে করে দিয়েছে।মন,সম্পর্ক এমন কী চোখের নজরটাকেও।
এক সময় চশ্মাটা খুলে আলোটা নিভিয়ে চোখদুটো ভালমত মুছে নেন।তারপর স্ত্রীর ঠিক পাশটায় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শুয়ে পড়েন।