শিক্ষা
শিক্ষা
রোজকার মতনই অফিসে অফিসে ঘুরে চাকরি না পাওয়ার ব্যর্থতা নিয়ে ভিড় বাসে বাড়ি ফিরছিলাম; হঠাৎ করেই চোখে পড়লো আমার সামনের সীটে বসে থাকা মানুষটির দিকে। প্রাথমিকভাবে খুব চেনা মনে হলেও নাম-ধাম, পুরানো সাক্ষাতের অবস্থান কিছুই মনে আসছিল না; আর তারসাথে ঐ বাসের ধাক্কাধাক্কিতে চিন্তা করাটাও বেশ দুরূহ ব্যাপার বলা যেতে পারে। যাইহোক্ ঘটনাচক্রে মনে এল, ইনি আমার বাবার সহকর্মী রমেশ মুখার্জি, আমার ছোটবেলার রমেশ কাকু। আগে আমাদের বাড়িতে বেশ ভালো যাতায়াত থাকলেও ক্রমাগত তা কমতে কমতে আজ একেবারে শূন্যতে এসে ঠেকেছে। তারপর রিটায়ারমেন্টের পর তো ওনাদের মধ্যেও যোগাযোগ কমেছে। আগে দশটা-পাঁচটার এক গতানুগতিক জীবন ছিল; একসাথে অফিসে কাজ-আড্ডা-ক্যান্টিনে খাওয়া এসব গল্প তো বাবার মুখে শুনেই বড়ো হয়েছি। খানিক ইতস্তত করে আমিই বললাম, 'আপনি, রমেশ কাকু না? মানে রমেশ মুখার্জি?' কন্ঠে বয়সের ছাপ স্পষ্ট; বললেন, 'হ্যাঁ, তবে তোমাকে তো ঠিক চিনলাম না?' নিজেই তারপর চশমাটা আরেকটু চোখের উপর তুলে তাকালেন বটে, তবে এরকম মানসিক বিধ্বস্ত প্রাণীটিকে চেনা, তাও এবার এতদিন পর, বেশ দুঃসাধ্য।
'আমি প্রবীর বাবুর ছেলে, কাকু। আপনি আর আমার বাবা একসাথে অফিসে চাকরি করতেন, মনে পড়েছে এরপর'? বেশ তারপর কাকু ভাইপোর আসর জমে উঠল। দুঃখ-কষ্ট তো সবার ভেতরেই থাকে, তবুও আমরা দিব্যি গুছিয়ে হাসিটা হাসতে পারি বলেই তো শ্রেষ্ঠ জীবের তকমা আদায় করতে পেরেছি। যতটুকু আমি জানতাম ওনার বাড়ি আমাদের বাড়ি পেরিয়ে যেতে হয়; তো সেভাবেই বললাম, কাকু আপনি মার্কনীতে নামবেন তো? এই প্রথম ওনার মধ্যে একটা কিন্তু কিন্তু দেখতে পেলাম, বুঝতে পারলাম না কি হল ব্যাপারটা। আমিও আর বেশী না ঘাটিয়ে মনে মনে ভাবলাম, ঠিক আছে পিছনে গিয়ে বরং দেখব কি হয়েছে আসলে। কারণ যে মানুষটিকে ছোট থেকে এত খোশমেজাজে গল্প করতে দেখেছি, এমনকি একটু আগেও যিনি আমার সারাদিনের ব্যর্থতার চাপকেও খানিক হালকা করে দিলেন, তিনি হঠাৎ এরকমভাবে কথাটা এড়িয়ে যাবেন-আমার বোধগম্যের বাইরেই ছিল। কিছুক্ষণ পরেই এডিসন স্টপেজে তিনি নেমে পড়লেন; আমাকে বিদায়টাও জানালেন না সেভাবে। সন্দেহ আরও ঘনীভূত হল আমার মনের আকশে। ওনার চোখের আড়ালে আমিও নেমে পড়লাম বাস থেকে; দেখতে তো আমাকে হবেই রহস্যটা কি। কারণ রমেশকাকুর মতো ব্যক্তির এরকম হঠাৎ পাল্টে যাওয়া আচরণ মেনে নেওয়া খুব কঠিন। শুরু হল এবার অনুসরণ করা; রক্তে তো ফেলুদা, ব্যোমকেশ মিশে রয়েছে। সত্যের উদঘাটন করতেই হবে আমাকে। খানিকটা এগিয়ে দেখলাম উনি রাস্তা ক্রশ করে ডানদিকের একটা গলিতে ঢুকে পড়লেন; গলিটা বেশ শুনশান, লোকজন তেমন নেই বললেই চলে প্রায়। অগত্যা আমাকেও যেতে হব; কারণ একবার যখন ভেবে নিয়েছি তখন সরে তো আসা যাবে না কোনোভাবেই। গলিটার মধ্যে ঢুকে খানিক এগোতেই চোখে পড়ল, সামনে বোর্ডে জ্বলজ্বল করছে, 'সমাপ্তি', বুঝতে পারলাম না আমি ঠিক কোথায় এসে পৌঁছালাম; গলিটার শেষে নাকি জীবনের? রমেশ কাকুও এতক্ষণে বুঝতে পেরে গেছেন যে আমি ওনার পেছন পেছন এগিয়ে এসেছি; যতই হোক্ সব কালো চুল তো আর রোদে সাদা হয়ে যায় নি। হঠাৎই তিনি ফিরে আমার দিকে এগিয়ে এসে বললেন, 'এসো ভেতরে, যখন এতটা চলেই এলে তাহলে আর উপসংহারটুকু বাকি থাকে কেন বলো; ওটাও না হয় শুনে যাও।' আমার কিছু বুঝে ওঠার আগেই উনি আমাকে হাত ধরে ভেতরে নিয়ে গেলেন। পরিবেশটা বেশ অদ্ভুত তবে মনোরম; চারিপাশে গাছপালাতে ভর্তি, আম-জাম-কাঁঠাল থেকে শুরু করে কাজু অব্দি সব রয়েছে। তার চারপাশে সারি দিয়ে সাজানো কয়েকটা ঘর; একপাশে একটা ছোট্ট মন্দির
; বিশ্বাস করুন এত শান্তস্নিগ্ধ পরিবেশ আগে কখনো কোথাও উপলব্ধি করতেই পারিনি। মণিমাসী বলে একজন ছিলেন ওখানে; কাকু ওনাকে বললেন দু'কাপ চা দিয়ে যেতে। এত বড় বাগানে বসার কোনো অসুবিধা নেই, চেয়ার নামানো আছে কয়েকটা, বেদীও রয়েছে- ইচ্ছে মতন বসো, গল্প করো, আড্ডা দাও, স্মৃতিচারণ করো সব। আমি আর কাকুও তারপর গিয়ে বসলাম একটা বেদীতে; ঐ সীমানার ভেতরেই রয়েছে একটা ছোট্ট পুকুর, শুনলাম ওখানে কর্তৃপক্ষ মাছ চাষ করেন একটুআধটু, সেসব তুলেই খাওয়া হয় মাঝেসাঝে। ইতিমধ্যে চা-টাও উপস্থিত, মুখোমুখি আমি আর কাকু। বললেন, 'চা নাও; তোমাকে আমার জার্নিটা বলি এরপর। দীপেশকে তোমার মনে আছে?' আমি বললাম, হ্যাঁ তো কাকু; আপনার ছেলে, দুজনে তো আমরা ছোটবেলায় কতবার একসাথে খেলাধূলা করেছি। নিতান্তই বাচ্চাসুলভ ভাবে বলে বসলাম, 'দীপেশ আপনাকে এখানে রেখে গেছে?' 'না! আমাকে কেউ কোথাও রাখতে আসেনি; হ্যাঁ তাকে আমার সমস্যার কথা জানাতে নিষেধ করেছে, এটা ঠিক।' যখন জানতে পারলেন আমি স্নাতকোত্তর পাশ করে চাকরির চেষ্টা করছি, সামান্য কয়েকটা টিউশন পড়িয়ে নিজের হাতখরচ তুলি, আর বাড়তি থাকলে মায়ের হাতে দিয়ে দিই; ততক্ষণে কাকুর চোখের জলের ধারা গাল বেয়ে নেমে পড়েছে। নিজের পকেট থেকে রুমালটা এগিয়ে দিলাম কাকুর দিকে; ধীরেধীরে গল্পটা আমার সামনে পরিস্কার হতে শুধু করেছে। আমি তো তথাকথিত সাদামাটাভাবে ইংরেজি বিষয়ে স্নাতকোত্তর হয়েছি বাড়ির খেয়ে ; কিন্তু দীপেশ তো ছোট থেকেই বেশ পড়ুয়া স্বভাবের তাই সে আজ সুপ্রতিষ্ঠিত লন্ডনে। দীপেশ শেষ পর্যন্ত এরকম করল? - কিছুতেই আমি মেনে নিতে পারছিলাম না। কথা বলতে বলতে জানতে পারলাম, কাকীমা গত হয়েছেন প্রায় পাঁচ মাস; এমনকি তখনও দীপেশ ফোনের ওপার থেকে একবার কথা বলেই কর্তব্য সেরে ফেলেছে।
সমস্ত কাজ কোনোক্রমে শেষ হওয়ার পর কাকু আর কোনোকিছু বুঝতে না পেরে ঘরবাড়ি বিক্রি করে এসে উঠেছেন এই সমাপ্তিতে। এখানে প্রচুর কাকু-কাকীমা, দাদু-ঠাকুমা রয়েছেন যারা সবাই নিজের মতন করে বাঁচতে শিখছেন আরেকবার; বুঝলাম আমার শুধু একটা চাকরি হয়নি কিন্তু পরিবার আছে একটা গোটা, যেখানে আমি মা-বাবা দিনের শেষে প্রাণখুলে হাসতে পারি, কথা বলতে পারি, একে অপরের খারাপলাগাগুলোর অংশীদার হতে জানি। এবার রমেশ কাকুকে বিদায় জানানোর পালা। আবার আসব আমি এখানেই, পারলে প্রতি সপ্তাহে একবার করে দেখা করতে আসব সকলের সাথে - এই কথা দিয়েই সেদিনের মতন বেদীটা ছাড়লাম। বেরোনোর সময় কাকু কাঁধে হাত রেখে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, 'তুমি মানুষ হয়েছ; আর আমার ছেলেটা শিক্ষিত'। কথাটা ভারী ছিল; আমিও ঘাড় নেড়ে রাস্তায় হেঁটে আসতে আসতে ভাবলাম, সমাজের চোখে তো আমি বেকার অপদার্থ; আমার ডিগ্রী কম তবে দিনের শেষে মা-বাবার সাথে রাতের খাবারটা একটা টেবিলে খেতে পারি। আসলে শিক্ষা আর ডিগ্রী-দুটো কখনো একসাথে যায় না যে; দীপেশের ডিগ্রী থাক্ আর আমার নাহয় শিক্ষা। বাড়ির গেটে তখন মা দাঁড়িয়ে সন্তানের অপেক্ষায় বুকে জড়াবে বলে...