Debdutta Banerjee

Classics

3  

Debdutta Banerjee

Classics

শিকড় ছেঁড়ার স্বাদ

শিকড় ছেঁড়ার স্বাদ

14 mins
925


কাচের জানালার উপর বৃষ্টির জলের আলপোনা দেখছিল রুহি। ট্রেনটা কারশেডের কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মেঘলা আকাশের বুকে হাওড়া ব্রিজের চুড়া জেগে রয়েছে।ওপারে তার স্বপ্নের শহর কলকাতা। এখনি প্লাটফর্ম ছোঁবে এই সর্পিল যান। যাত্রীদের মধ্যে যাত্রা শেষের ব্যস্ততা তুঙ্গে। সাইড লোয়ার বার্থে শুয়ে রুহি আপনমনে ভাবে এত বড় মহানগরের বুকে একা সে ঠিক কোথা থেকে সে শুরু করবে তার খোঁজ!!

মায়ের সাথে তিনবার কলকাতা এলেও এ শহর এখনো অচেনা রুহির কাছে। শেষ এসেছিল পাঁচ বছর আগে। পাহাড় আর চা বাগানের বুকে বড় হয়েছে যে মেয়ে এ শহর তার কাছে গোলক ধাঁধা। কিন্তু এই গোলক ধাঁধার মাঝেই লুকিয়ে রয়েছে তার সব প্রশ্নর উত্তর।

নিজের ছোট ট্রলিটা নিয়ে নেমে পড়ে রুহি। বৃষ্টি কমলেও বাতাসে ভেজা ভাব। শীতের আমেজ এখনো যায় নি, ফাল্গুনের শুরু, অসময়ের বৃষ্টিতে একটা শিরশিরে আমেজ। জনস্রোতের সাথে পাতাল প্রবেশ করে রুহি, আর একটু পরেই প্রবল জন জোয়ার আছড়ে পড়ে মহানগরীর বুকে। কল্লোলিনী তিলোত্তমার বুকে জনপ্লাবন নেমেছে যেন। রুহির কেমন যেন সব গুলিয়ে যায়। হঠাৎ মনে হয় সবটাই স্বপ্ন, এখনি ঘুম ভেঙ্গে দেখবে সে শুয়ে রয়েছে নিজের পরিচিত ঘরে, নিরাপত্তার গণ্ডিতে ঘেরা জীবনের চেনা ছন্দে আবর্তিত হবে ওর জীবন।

-''আরে মরনা হ‍্যায় তো ওর কোই নেহি মিলা ক‍্যাঁয়া ?'' আনমনা রুহি রাস্তা পার হতে গিয়ে অবাঙালি ড্রাইভারের চিৎকারে সম্বিত ফিরে পায়। জীবন যুদ্ধ বড্ড কঠিন। আর এই জীবন যুদ্ধে পিছু ফেরা যায় না। নিজের মনকে শক্ত করে সে এগিয়ে চলে।

এত বড় মহানগরের বুকে একটা একা মেয়েকে কেউ হোটেলে ঘর দিতে রাজি নয়। ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে পড়ে রুহি। অভুক্ত শরীর কয়েক দিনের ঝড়ঝাপটায় এমনিতেই ক্লান্ত। শিয়ালদা ষ্টেশন বা বড় বাজার এলাকায় হোটেল না পেয়ে রুহি ভাবছিল এবার কি করবে ? মা বলেছিল বেহালায় এক মাসি রয়েছে তার বাড়ি যেতে। মৌলালী মোড়ের কাছে আরেকটা হোটেলে ঢোকে রুহি। না: , এরাও ও একা শুনে বলে দেয় ঘর নেই।

ফোনে মায়ের দেওয়া ঠিকানা আর নম্বর রয়েছে, যদিও রুহি ভেবেছিল একাই সব সামলাতে পারবে, কারো সাহায্য লাগবে না, কিন্তু... মায়ের সাথে যখন এসেছিল এসব ঝামেলা হয় নি।

-''এভাবে সারাদিন ঘুরলেও ঘর পাবে না !! '' একটা সরু মেয়েলি গলায় ফিরে তাকায় রুহি, সিল্কের চকমকে চুড়িদার পরা মেয়েটাকে শিয়ালদাতেও দেখেছিল যেন। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে মেয়েটা ওর দিকে তাকিয়ে ছুড়ে দিয়েছে কথা গুলো।

-''আমায় বলছেন ?'' রুহির প্রশ্নে মেয়েটা এগিয়ে আসে। চোখ মটকে বলে -''কেসটা কি ? পালিয়ে এসেছ ? প্রেমিকের খোঁজে নাকি প্রেমে ধোঁকা?''

রুহি কি উত্তর দেবে ভেবে পায় না। -''ঘর লাগলে এই করিনাই পারবে তা দিতে। এসো আমার সাথে। ''

মহানগরের বুকে রয়েছে প্রচুর অন্ধকার জগত রুহি জানে। তবুও কেনো যেন মেয়েটাকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে। মেয়েটার মধ্যে যেমন একটা আলগা চটক রয়েছে তেমনি ওর মুখটা বড্ড মিষ্টি। রুহি বলে -''রুম তো লাগবে ভাই। কেউ দিতে চাইছে না। ''

-''কদিনের জন্য ?''

-''এখনি বলতে পারছি না, তবে দশ বারো দিন হবে। "

মেয়েটা ওকে নিয়ে যায় এন্টালির দিকে। একটা সরু গলির ভেতর ঢুকে পরে। একটু ইতস্তত করে রুহি ওর পিছু নেয়।

একটা মাঝারি মানের হোটেলে ঢোকে মেয়েটা, কাউন্টারের আধ বুড়ো লোকটাকে বলে , -''দোতলার কোনের ঘরটা চাই, সপ্তাহ খানেক থাকবে, আমার লোক। ''

লোকটা রুহির আপাদ মস্তক দেখে, তারপর পান খাওয়া লাল দাঁত বার করে বলে -''ফিরসে কোই ঝামেলা উঠা লায়া তু ?''

-''কৌন ঝামেলা !! তু ঘর দিখা দিদি কো। '' একটু জোরেই বলে করিনা।

লোকটা একটা চাবি ঠক করে নামিয়ে বলে -''এক হপ্তা কা এডভান্স !! আটশো করকে রোজ....''

চাবিটা তুলে করিনা বলে -''টাকা না দিয়ে থাকবে বলেছে কি ? আগে ঘর দেখুক। তারপর দাম ''

করিনার ইশারায় সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসে রুহি। দেওয়ালে পানের পিক আর ঝুলের আলপোনা, করিডোরের কোনে মদের বোতল আর বাসি খাবারের প্লেট নামানো। এমন পরিবেশে রুহি থাকে নি কখনো। একবার মনে হয় ছুটে পালাবে। কিন্তু আপাতত এই শহরে মাথা গোঁজার একটা জায়গা চাই।

কোনের ঘরটা সাথে একটা বারান্দা, ওধারে রেল লাইন চোখে পড়ে। একটা ছোট খাটে সস্তার চাদর পাতা, টেবিলে একটা জগ আর গ্লাস, দেওয়ার আয়নার পাশে ছোট আলমারি, দুটো টুল, একটা ছোট টিভিও রয়েছে ঘরে।

ঝপ করে খাটে বসে করিনা বলে -''চলবে , দেখে নাও। ''

কি উত্তর দেবে রুহি ভাবে। ওর শুকনো মুখ দেখে করিনা বলে -''এর চেয়ে ভালো নেই আপাতত। এবার বলো কি কেস?''

-''একজনের খোঁজে এসেছি। তবে তুমি যা ভাবছ তা নয়। তাছাড়া কয়েকটা চাকরীর ইন্টার্ভিউ দেবো। '' সাইড ব্যাগ থেকে জলের বোতল বের করে জল খায় রুহি। বলে -''এই হোটেল টা সেফ তো ?''

-''মেয়েদের জন্য কোন জায়গাটা সেফ বলো তো? নিজের বাড়ি, নিজের লোকেরাও সব সময় সেফ হয় না জানো তো!! ঘর পছন্দ হলে চলো, নাম লিখে টাকা দিয়ে আসতে হবে। আর সামনের ভাতের হোটেলে বলে দিলে দু বেলা খাবার দিয়ে যাবে। ''

-''আচ্ছা গড়িয়া হাট কতো দূর গো ?''

-''খুব বেশি না? কেনাকাটা করবে কি ? তবে নিউমার্কেট যাও। হেঁটে যাওয়া যায়। দামেও সস্তা। ''

-''না, একজনের বাড়ি, ফার্ন রোডে...''

-''প্রচুর বাস যায়, বলে দেবো । আমার নম্বরটা নিয়ে নাও '' ঘর বন্ধ করে ওরা নেমে আসে।

*****

দূর থেকে বাড়িটার দিকে তাকিয়েছিল রুহি। কচি কলাপাতা রঙটা নতুন করা হয়েছে। বাড়িটা বেশ পুরানো, এ পাড়ায় সব বনেদী বাড়ি। ঝিম ধরা অলস বিকেলের শেষ আলো গায়ে মেখে এক বৃদ্ধা দোতলার বারান্দায় বসে বই পড়ছেন। একটা নীল সেন্ট্রো করে একটি আঠারো উনিশ বছরের মেয়ে বেরিয়ে গেল ওর সামনে দিয়ে। বৃদ্ধা হাত নাড়ল মেয়েটিকে দেখে। বাড়ির নামটা আরেকবার মিলিয়ে দেখে রুহি, 'আশালতা'। কিন্তু এতদূর এসে কে যেন ওর পা দুটো মাটিতে গেঁথে দিয়েছে অদৃশ্য কিছু দিয়ে। বারো ফুটের রাস্তাটা পার হয়ে ও প্রবেশ করতে পারে না ঐ বাড়িতে। দাবী করতে পারে না নিজের অধিকার।

কতক্ষণ দাঁড়িয়েছিল ও জানে না, একে একে রাস্তার আলো গুলো জ্বলে উঠতেই ও ফেরার পথ ধরে। সন্ধ্যার সাজে সেজে উঠছে ব্যস্ত শহর। এই সময় ওদের মফঃস্বলের ছোট টাউনে সব ছেলে মেয়ে পড়তে বসে, কোন কোন বাড়িতে হারমোনিয়াম নিয়ে গলা সাধতে বসে কেউ কেউ। পাড়ার লাইব্রেরীর সামনে অফিস ফেরত কিছু কাকু জেঠুর আড্ডা বসে। আগে রুহিও গান গাইত এ সময়। শেষ তিন মাস মাকে নিয়েই ও ব্যস্ত ছিল। মা যে এভাবে ওকে ফেলে চলে যাবে কখনো ভাবে নি ও। আর তার চেয়েও বড় আঘাত পেয়েছিল মায়ের শেষ কথা গুলোয়। আজন্ম মাকেই ও ওর সব বলে জেনে এসেছে। বাবা শব্দটার গুরুত্ব ছিল না ওর কাছে। বাবার নামটাও কখনো জানতে চায়নি ও। সিঙ্গেল মাদার হিসাবে মায়ের কঠিন লড়াইটা ও খুব কাছ থেকে দেখেছিল, আর খুব ছোটবেলাই বুঝতে শিখেছিল কিছু প্রশ্ন করতে নেই।

সেই মা চলে যাওয়ার সময় ওকে জানিয়ে দিয়ে গেছিল সেই অজানা প্রশ্নের উত্তর গুলো যার থেকে দূরে থাকতেই ও বরাবর ভালো বাসত।

রঙ চটা কালো ডাইরিটা মা ওর হাতে তুলে দিয়েছিল শেষ সময়। তারপর দু দিন মায়ের হুঁশ ছিল না। কর্কট রোগের শেষ যন্ত্রণা মরফিন ইনজেকশন আর ফিনাইলের গন্ধ মিলিয়ে যেতেই মনে পড়ে ধূপের গন্ধ আর ফুলের মালায় সাজানো মায়ের ফটো। কালো ডাইরিটা রুহি খুলেছিল মা মারা যাওয়ার দু দিন আগেই। সেই রাতটা ও জেগেই কাটিয়েছিল। বিন্তি পিসি ওদের বহুদিনের সর্বক্ষণের কাজের লোক, আর সারু দিদি ওদের রাঁধুনি, দু জনেই পাশের ঘরে শুতো। কুড়ি বছরের রুহি টাটকা ফোটা ফুলের মতো তাজা ও সুন্দর। কিন্তু এই ডাইরি এক রাতেই ওকে দাঁড় করিয়েছিল এক চরম সত্যির সামনে।

করিনা বলেছিল রাত আটটার থেকে সকাল সাতটা খুব প্রয়োজন না পড়লে ওকে ফোন করতে না। ও ব্যস্ত থাকে। এই অচেনা শহরে মেয়েটা ওকে সাহায্য না করলে ও কোথায় থাকত কে জানে ?

রাতের খাবার খেয়ে হোটেলে ঢুকতেই ও বুঝেছিল এখানে থাকতে পারবে না ও। এর চেয়ে হাওড়া স্টেশনে বসে রাত কাটানো ভালো। দু তিনটে উৎসাহী চোখের সামনে দিয়ে হেঁটে ও নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে। কোন ঘর থেকে ভেসে আসছে চটুল হিন্দি গান, অথবা কাচের গ্লাসের শব্দ। কি মনে করে টেবিল টা টেনে এনে দরজার গায়ে লাগায়। ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় ফেলে ডুকরে কেঁদে ওঠে বিধ্বস্ত মেয়েটা, ব্যাগ থেকে কালো ডাইরিটা বার করে ও। চোখ মুছে আবার খোলে ওর বারবার পড়া ডাইরিটা। প্রথম পাতায় লেখা 'আরফা কে এক রাশ ভালোবাসা সহ অনিক'।

একটা শুকনো গোলাপ পরের পাতায় আটকানো, কালের নিয়মে ভেঙ্গে পড়তে চায় গুড়ো হয়ে। রুহি পাতা ওলটায়। একটা ঝাপসা ফটো, এক অষ্টাদশীর সাথে এক যুবক গঙ্গার ধারে।

এরপর কয়েকটা প্রেমের কবিতা। কয়েক পাতা বাদ দিয়ে এবার শুরু লেখা, না রোজ নামচা নয়, গল্পের মত করে কিছু কথা।লেখিকা আরফা সুলতানা ছোট করে লিখেছে নিজের জীবনী নিজের আত্মজায় জন্য।

লেখাটার উপর হাত বোলায় রুহি। প্রথমেই লেখা -''আমার ভেতর যে ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে তার জন্য... "

"আমি আরফা, মুর্শিদাবাদের গঙ্গার ধারে বেড়ে ওঠা মেয়ে পড়তে এসেছিলাম কলকাতায়, হোস্টেলে আমার প্রথম বন্ধু তিয়াসা। দু জনেই ইংরেজি অনার্স, দু জনেই এ শহরের বুকে নতুন। বোধহয় আগের জন্মে ও আমার বোন ছিল। ওর বাবা নেই , মা ছিলেন মালদায় একটা স্কুলের টিচার। সুন্দর ছিল সেই দিন গুলো।

আমাদের এক বছরের সিনিয়র অনিকেত দা দারুণ কবিতা লিখত ও আবৃতি করত। কি করে যেন আমি জড়িয়ে গেছিলাম অনিকেত দার সাথে এক অচ্ছেদ্য বন্ধনে। তিয়াসা সবটাই জানত। ধর্ম সমাজ পরিবার সব ভুলে দুটি হৃদয় দ্রুত এক হয়ে উঠেছিল। দেখতে দেখতে তিন বছর শেষ। অনিক তখন ইউনিভার্সিটির উজ্জ্বল ছাত্র। আমায় ফিরতে হবে বাড়ি। আব্বু আর পড়াতে চায় না। হয়তো কলকাতায় মেয়েকে আর রাখতে চাইছিল না। তিয়াসা আব্বুকে অনেক বুঝিয়ে আম্মিকে রাজি করিয়ে আমায় আরও কয়েক বছর কলকাতায় থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। একটা ঘর ভাড়া নিয়ে দু জনেই থাকতাম আর পড়তাম ইউনিভার্সিটিতে। অনিকের সাথে সম্পর্কটা দৃঢ় হচ্ছিল আরও। তিয়াসাই ছিল আমাদের আশা ভরসা, অনিক বনেদী বাড়ির এক মাত্র ছেলে, নিঃসন্তান দুই জেঠুর চোখের মনি। ওদের বিশাল সোনার ব‍্যবসায় যোগ দিয়েছে ও ততদিনে। আমায় যতই চোখে হারাক বাড়িতে বলতে পারছিল না এ সম্পর্কের কথা। ওদের বংশ কৌলীন্য ও গোঁড়ামির কথা আগে ভাবে নি ও কখনো। অন্য দিকে আম্মি আর আব্বু আমার নিকাহের ব্যবস্থা করে ফেলেছে প্রায়। ফিরোজ আম্মির দূরের বোনের ছেলে। কলকাতায় এলেই আমায় দেখে যায়।

আমি আর অনিক অনেক ভেবেও পথ পাই নি। ভরসা দিত শুধুই তিয়াসা। বলত একটা রাস্তা ঠিক হবে। পড়া প্রায় শেষ, হঠাৎ এক দুর্ঘটনায় তিয়াসার মা মারা গেছিল। ও বাড়ি গেছিল সে সময়। সামনে তখন পরীক্ষা।আমি একাই পড়ায় ব্যস্ত।এ দিকে অনিক এক বছরের জন্য বিদেশ যাচ্ছে একটা ম‍্যানেজম‍্যান্টের পড়া করতে। এক জল ঝড়ের রাতে ভেজা কাক হয়ে অনিকের সাথে বাড়ি ফিরলাম। পাড়া জুড়ে লোডশেডিং। ঘরে মোম নেই, অত রাতে বৃষ্টিতে দোকান বন্ধ। আমার অন্ধকারে বড় ভয়। ওদিকে তিয়াসা নেই। আমি অনিককে যেতে দেই নি ফিরে। বাজের আওয়াজ বিদ্যুতের চমক ঐ রকম উথালপাথাল বৃষ্টি আর দুই যুবক যুবতী। পরিণাম ....

পরদিন যখন সব ঝড় কমেছিল আমায় দু হাতে জড়িয়ে কানে কানে অনিক বলেছিল "ভরসা রেখো। তুমি শুধুই আমার । কথা দিচ্ছি, ফিরেই বিয়ে করবো।"

সে বিশ্বাস আমারও ছিল। তিয়াসাও জানত আমরা এক হবো।

কিন্তু ঐ ঝড় আমাদের তিনজনের জীবন ওলট পালট করে দিয়েছিল। অনিক কয়েক দিন পর চলে গেল বিদেশ, পরের মাসে তিয়াসা পুরুলিয়া চলে গেল একটা মিশনারি স্কুলের চাকরি নিয়ে। আব্বু আম্মি আর আমাকে কলকাতাতে থাকতে দিতে রাজি হয় নি। পরের মাসে পরীক্ষা শেষ হতেই আমাকে বাড়ি ফিরতে হল, অনিকের সাথে যোগাযোগের কোন উপায় নেই। ওর ঠিকানা বা ফোন নাম্বার জানি না, তিয়াসার ঠিকানা তবু জানতাম, ওর সাথে ফোনে কথা হতো। বাড়িতে বিয়ের তোড়জোড় চলছিল, পরের মাসে আমি হটাৎ টের পেলাম সেই ঝড়ের রাতে পরিণাম কি হয়েছিল।তখন আরেক জন বেড়ে উঠছে আমার ভিতর, আমার ভালোবাসার পুরস্কার। আমি একা নই। এক ভয় মিশ্রিত আনন্দ আমাকে গ্রাস করল, মনে হয়েছিল আর কেউ অনিক আর আমাকে আলাদা করতে পারবে না। ও আমায় ফিরেই নিজের করে নেবে, কিন্তু ওর যে ফিরতে তখন অনেক দেরি, যোগাযোগের কোন উপায় নেই। এদিকে বাড়িতে নিকাহর দিন প্রায় ঠিক। আরও একটা মাস চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে কাটল। অতি কষ্টে নিজের শারীরিক পরিবর্তন গুলো লুকিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু এভাবে আর কতদিন? তিয়াসা কে একদিন ফোনে সব খুলে বললাম বাধ্য হয়ে, ও ছুটে গেছিল অনিকের খবর আনতে ওদের বাড়ি। কিন্ত অনেক চেষ্টা করেও ওর সাথে যোগাযোগ করতে পারে নি। অনিকের একটা মেইল আইডি ছিল, ও মেইল করে সব লিখেছিল। কিন্তু না:। অনিকের সাথে যোগাযোগ হয় নি।

এরপর আমার আর কিছু করার ছিল না, একদিন কাউকে কিছু না জানিয়ে পালিয়ে এলাম তিয়াসার কাছে পুরুলিয়া। এই কয় মাসের অনিয়ম আর জীবন যুদ্ধে সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়েছিলাম আমি, তার সাথে ছিল ধরা পরার ভয়, তিয়াসা আমাকে আগলে রেখেছে নিজের সবটুকু দিয়ে। না, আব্বু আম্মি আমাকে খুঁজে পায় নি এখনো, ওঁরা কলকাতায় খুঁজেছিল। তিয়াসার ঠিকানা কেউ জানত না। কিন্তু আমার মনোবল ভেঙ্গে পড়ছে ধীরেধীরে। তিয়াসা বাকুড়ার এক গ্রামে বদলি হয়েছে। আমাকে নিয়ে ও চলে যেতে চায়। কিন্তু আজকাল শরীরটা সাথ দিচ্ছে না। জানি না আর তাকে দেখতে পাবো কি না, জানি না যে আসছে তাকে সুস্থ ভাবে পৃথিবীর আলো দেখাতে পারবো কি না, জীবন শক্তি যেন ফুরিয়ে আসছে। কত কথা মনে পড়ছে, অনিকের সাথে কাটানো সুন্দর মুহূর্ত গুলো আজকাল খুব মনে পড়ে। তিয়াসাকে বলেছি আমার কিছু হয়ে গেলে এই ডাইরি আর অনিকের সন্তান কে ওর কাছে পৌঁছে দিতে।"

রুহির মনে পড়ে পরদিন মা খুব আস্তে আস্তে বলেছিল তার বান্ধবী সন্তানের জন্ম দিয়েই চোখ বুজেছিল। আর ছোট্ট পুতুলটাকে কাপড়ে মুরে ডাক্তার তুলে দিয়েছিল মায়ের হাতে। এভাবেই তিয়াসা তার মা হয়ে উঠেছিল। অনিকের অনেক খোঁজ করেও তিয়াসা যোগাযোগ করতে পারে নি। ততদিনে মায়া পড়ে গেছিল রুহির উপর। দেড় বছরের রুহি তখন আদো আদো কথা বলে, মা বলে গলা জড়িয়ে ধরে। তিয়াসার আর কেউ ছিল না রুহি ছাড়া। অনিকের খোঁজ না পেয়ে মেয়েকে নিয়ে ও চলে যায় উত্তরবঙ্গে। আলিপুরের কাছে ভুটান পাহাড়ের কাছে এক মিশনের স্কুলে চাকরী নিয়ে থাকতে শুরু করে মা মেয়ে। কিন্তু ভগবান যে রুহির থেকেও একদিন তিয়াসাকে কেড়ে নেবে সে বোঝে নি। যখন টের পেল অনেক দেরি হয়ে গেছিল।

রুহির হাতে ডাইরিটা দিয়ে তিয়াসা বলেছিল কলকাতায় চৌধুরী জুয়েলার্সের পরিবারের একমাত্র ছেলে অনিকেত চৌধুরীর কাছে যেতে। ডাইরিটা তাকে দিতে। সময় হাতে থাকলে তিয়াসা নিজেই পৌঁছে দিত ওকে ওর বাবার কাছে। কিন্তু এর কয়েকদিনের ভেতর তিয়াসা চোখ বুজেছিল।

সকালের মিষ্টি রোদ এসে পড়েছিল জানালা দিয়ে। ঠাণ্ডাটাও কমে গেছে। রুহি রেডি হয়ে বেরিয়ে আসে। করিনার সাথে দেখা হয় রাস্তার মোরে। হেসে সে জিজ্ঞেস করে অসুবিধার কথা। বলে একটা ভালো হোটেলের খোঁজ পেয়েছে। পরদিন ওকে নিয়ে যাবে সেখানে।

একটা ট‍্যাক্সি নিয়ে বৌবাজারে চৌধুরী জুয়েলার্সের সামনে নামে রুহি। বেশ বড় শোরুম। বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে নিজেকে গুছিয়ে নেয় ও। আজ তাকে পারতেই হবে। তারপর কাচের দরজা ঠেলে ঢুকতেই একটি ছেলে এগিয়ে আসে, ওকে ওধারে বসার জায়গা দেখিয়ে দেয়। আট দশটা ওর বয়সী মেয়ে অপেক্ষা করছে। রুহি ওর আসার উদ্দেশ্য বলতে গিয়েও বলতে পারে না। একটু পরে পাশের মেয়েটা খুব আস্তে ওকে বলে -" এরা মায়না কেমন দেবে ? কত জন কে নেবে, কিছু জানো ?"

তক্ষুনি আরেকটি সুন্দরী মেয়ে এসে একটা কাগজ এগিয়ে দেয় রুহিকে, বলে -''নাম লিখে দিন , বায়োডাটা আছে তো সাথে ?''

বুদ্ধিমতী রুহি বোঝে ইন্টার্ভিউ চলছে। নিজের নামটা লিখে দেয় ও কাগজে আঠারো নম্বরে। কলকাতায় আসার আগে বায়োডাটা বানিয়েছিল। কয়েকটা চাকরীর ইন্টার্ভিউ দেবে ভেবেই এসেছিল। ব্যাগ থেকে বার করে দেয় একটা কাগজ। এরপর নিজেকে গুছিয়ে নেয় আরেকবার।

বেশ কিছুক্ষণ পর রুহির ডাক আসে। দুরু দুরু বক্ষে কাচের দরজা ঠেলে রুহি গিয়ে ঢোকে ও ঘরে। ঘরে রয়েছেন দু জন সচিব সহ কোম্পানির হেড অনিকেত চৌধুরী। টুকটাক প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিল ও। হঠাৎ অনিকেত চৌধুরী ওকে বলে -'' উত্তরবঙ্গ থেকে কোলকাতায় চাকরী করতে এসেছ কেনো ? "

-"হয়তো এই শহরটাকে ভালোবেসে ফেলেছি, মহানগর যে,তাই। ''

চমকে ওঠে অনিক, ইন্টার্ভিউ দিতে আসা শ্যামলা মেয়েটা এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ভীষণ চেনা মনে হয় মেয়েটাকে এবং উত্তরটাও, বহু বছর আগে এই উত্তর কে যেন দিয়েছিল। বায়োডাটায় চোখ বুলায় অনিক। সিনিয়র ম্যানেজার প্রশ্ন করে -''গহনার ইন্ডাস্ট্রিতে কোনও অভিজ্ঞতা আছে কি ?''

-''কাজ করলেই অভিজ্ঞতা হবে। কাজটা করতে চাই। ''

অনিক আবার তাকায়, বলে -''নিজের সম্পর্কে কিছু বলো, পড়াশোনার বাইরে কিছুই লেখো নি এখানে।''

-'' সবে পড়াশোনা শেষ করেছি, এবার নিজেকে তৈরি করার জীবন যুদ্ধ। নিজেকে খুঁজতেই তো এই শহরে এসেছি। যদি নিজের পরিচয় তৈরি করতে পারি সেদিন না হয় বলব !!"

-''বায়োডাটায় বাবার নাম নেই ... মা ....''

-''আমার বাবা আমার জন্মের আগে থেকেই নেই, সাদা কাগজে একটা নাম শুধু লিখে কি হবে? মা আমায় একা বড় করতে করতে ক্লান্ত হয়ে সব মায়া কাটিয়ে চলে গেছে। একটা মিশনারি স্কুলে কাজ করত আমার মা। '' শত চেষ্টা করেও আর কিছু বলতে পারে না রুহি। তিনজনে নিচু স্বরে কিছু আলোচনা করছিল এরপর। রুহিকে ইশারায় বাইরে অপেক্ষা করতে বলা হয়।

একটা সোফায় বসে রুহি ভাবছিল মায়ের বলা বাকি কথা গুলো, মা বলেছিল -''আমি গেছিলাম ফার্ন রোডের বাড়িতে। অনিকের ঠাকুমা আশালতা দেবীর নামে বড় বাড়ি ওদের। তবে ওর বড় জেঠিমার কথাই বাড়িতে শেষ কথা, অনেক অনুনয়েও উনি অনিকের নম্বর দেন নি। আমায় অপমান করে বার করে দিয়েছিলেন। ''

পাঁচ বছর আগে একবার মায়ের সাথে কলকাতা এসেছিল রুহি, মনে আছে মা এই দোকানের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়েছিল অনেকক্ষণ। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে এগিয়ে গেছিল। রুহির ইচ্ছা ছিল ও কলকাতার কলেজে পড়বে। মা রাজি হয় নি।

কালো ডাইরিটার শেষ পাতায় একটা চিঠি পেয়েছিল রুহি। এই হাতের লেখা তার বহু পরিচিত।

ওর মনে ডাইরি পড়ে যে প্রশ্ন জেগেছিল তার উত্তর ছিল ঐ চিঠিতে।

স্নেহের রুহি,

জানিনা কখনো আমায় ক্ষমা করতে পারবি কি না। আরফার কথা মতো তোকে পৌঁছে দিতে পারিনি তোর বাবার কাছে। আসলে তিনবছর পর যখন অনিকের খোঁজ পেলাম তখন ও বিয়ে করে সংসারী। আর তিনবছর ধরে যে পুতুলটাকে মানুষ করেছিলাম সে আমাকেই মা ডাকত। আমায় ঘিরেই তার জগত। অনিক তিয়াসা বা আরফার খোঁজ করেছিল কিনা জানি না, তবে দূর থেকে যে টুকু খবর পেয়েছিলাম কয়েক বছর পর ওর একটি মেয়ে হয়েছিল।

তিন বার গেছিলাম তোকে নিয়ে , তোর নিজের লোকেদের কাছে দিয়ে আসবো বলে। কিন্তু বিশ্বাস কর সাহস পাই নি। তোর যত্নে আমি কোনও ত্রুটি রাখি নি। আমি তোকে নিয়েই বাঁচতে চেয়েছিলাম। ঐ পরিবারে তোর অবহেলাই হত মনে হয়েছিল। হয়তো তোকে ওরা স্বীকার করত না অথবা কোনও হোমে দিয়ে দিত। তাই সব ভুলে তোকে নিয়েই থেকেছি। হয়তো অন্যায় করেছি সত্য গোপন করে তাই ভগবান এই শাস্তি দিল আমায়। আজ তোকে একা রেখে আমি চলে যাচ্ছি। তাই তোকে জানিয়ে গেলাম তোর পরিচয়। যদি শেকড়ের টানে মহানগরের বুকে যাস একাই তোকে যেতে হবে। তবে আমার কাছে তুই আমার মেয়ে আমার আরুহি। সব তো রেখে গেলাম তোর জন্য। ভালো থাকিস মা আমার।

ইতি তোর এক অভাগী মা

রুহি বিলিং কাউন্টারের পাশে বড় করে বাঁধানো ছবি গুলো দেখছিল। একটা ছবিতে নতুন শোরুম উদ্বোধন হচ্ছে, একটায় অনিকেত বাবুর সাথে এক সুন্দরী মহিলা ও একটি কিশোরী, এই মেয়েটাকেই বোধহয় সেন্ট্রোতে দেখেছিল ও আগের দিন। পারিবারিক ছবি ছাড়াও শোরুমের কর্মচারীদের ছবি।

চোখটা কেমন জ্বালা করে ওঠে রুহির। নিজেকে কেমন বেমানান মনে হয় এখানে। মফঃস্বলে বেড়ে ওঠা মেয়েটার গত দু দিনের এই শহরের অভিজ্ঞতায় দম বন্ধ হয়ে আসে।

হঠাৎ মনে হয় তার জন্মদাত্রী এই শহরে এসে ভালোবাসার জালে জড়িয়ে পরেছিল। সেই ভালোবাসার মোহে মেয়ের জন্ম দিয়েই সে মায়া ত্যাগ করেছিল। আর তার মা সেই ভালোবাসার চিহ্ন কে দু হাতে আগলে কুড়িটা বছর কাটিয়ে দিল এই শহর থেকে বহু দূরে। নিজের জীবনেও কাউকে আসতে দেয় নি মেয়ের কথা ভেবে। তবে সে কেনো পারবে না দুই মায়ের মতো এই শহর কে ভুলে, এই লোকটাকে ভুলে নিজের মতো বাঁচতে। এই দু দিনে সে অনেক কিছুই দেখল, জানল, বুঝল। এই অভিজ্ঞতাই থাক তার ঝুলিতে। অনিকেত চৌধুরীর পরিচয় ছাড়াই যখন এত বড় হয়েছে না হয় সেভাবেই বাকি জীবনটা কাটাবে। তিয়াসা মায়ের মেয়ে হয়েই থেকে যাবে ঐ উত্তর বঙ্গের ছোট্ট টাউনে।

কাচের দরজা খুলে পথে নামে রুহি, পিছনে মনে হয় কেউ ডাকছে, ও আর তাকায় না সেদিকে। আকাশটা লাল, ধুলোর ঝড় উঠেছে। একটা বড় ঝড় আসছে মনে হয়। একটা ট্যাক্সি নিয়ে ফিরে যায় ও হোটেলের দিকে। আজ রাতের ট্রেনেই ফিরে যাবে ও। মহানগরের বুকে ঝড় উঠুক, ও ফিরবে ওর শান্তির নীড়ে।

স্মৃতিতে থাকবে শুধু করিনার কথা গুলো, পরিবার ও সব সময় নিরাপত্তা দিতে পারে না। ওর ছোট্ট টাউনে ঐ দু কামরার বাড়িতেই ও ফিরে যাবে আবার। ডাইরিটা ছিঁড়ে ট্যাক্সির জানালা দিয়ে ও বাইরে ফেলে দেয়। পৃষ্ঠা গুলো উড়ে যায় ঝড়ো হাওয়ার টানে। নিজেকে বড্ড হালকা লাগে। বড় বড় ফোটায় বৃষ্টি নামে মহানগরের বুকে। অসময়ের বৃষ্টি।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics