STORYMIRROR

Manab Mondal

Abstract Fantasy Inspirational

3  

Manab Mondal

Abstract Fantasy Inspirational

শীতালা মঙ্গল

শীতালা মঙ্গল

5 mins
168


সমাজতান্ত্রিক দেশে এক বৈশিষ্ট্য আমাদের জীবন শিরা উপশিরা রাজনৈতিক নেতাদের দ্বারা প্রভাবিত।এরা নতুন নতুন তত্ত্ব আমদানি করে নিজেদের স্বার্থে।মাঝে মাঝে শোনা যায় বহিরাগত জন্য বাংলা ও বাঙালি সমাজ ধংসের মুখে। আসলে বহিরাগতরা এর জন্য বোধহয় দায়ী নয়। শহরের ভাষাটি খিচুড়ি ভাষায় পরিনত হয়েছে এর জন্য পেটের দায়ে এ বাংলায় কাজ করতে আসা মানুষ গুলো দায়ি নয়। ভারত বর্ষের বাহিরে বহু শহরে কাজের বাজার এখন বাঙালিদের দখলে এবং ক্ষুদ্র ব্যাবসা গুলো ও বাঙালির দখলে তাবলে সেই দেশ ও শহর থেকে তাদের ভাষা সংস্কৃতি কে হারিয়ে ফেলে নি। বাংলা ভাষার বিপদে মুখে পড়ে আছে এই মন্তব্যটি আসলে কোলকাতা ও তার শহরতলী অঞ্চলের ছবি দেখে বলতে পারেন। আসলে ভাষায় নদীর মতো এতে বহু শব্দ এসে যুক্ত হয়। বাংলার শব্দ গুলো বিশ্লেষণ করুন, বহু শতাব্দী ধরে এখানে অনেক শব্দ আছে যা বাংলার নয়।


তবে একটা বিপদ এসেছে। বিশ্বায়নের ফলে বহির সংস্কৃতির দ্বারা আমরা বড় প্রভাবিত হয়ে নিজেদের সংস্কৃতি হারিয়ে ফেলেছি। বিশেষ করে লোক সংস্কৃতি প্রতি আমদের বিশেষ যত্নবান হওয়া উচিত। লোক সংস্কৃতি আসলে শুধু পূজা পার্বণ নয়। এদের ব্রত কথা, পাঁচালী, গান আমাদের অতীত সমাজ ব্যবস্থার ছবিও তুলে ধরে। যা আমাদের জাতীর ঐতিহাসিক দলিল হতে পারে। কারণ বাঙালি জাতি তার ইতিহাস পায় শশাঙ্ক থেকে অথচো মহাভারতে এর উল্লেখ রয়েছে। তাই আমি মতো ছোট মানুষের মাথায় একটা প্রশ্ন বার বার ওঠে বাঙালি জাতি তার সম্পূর্ণ ইতিহাস বোধহয় জানে না। আমরা যে উন্নত সভ্যতার উত্তরাধিকারী সেটা জানলে হয়তো এ জাতি একটু আত্মবিশ্বাসী হতো। কারণ সবাই বলে বাঙালিরা ব্যবসা করতে জানে না। অথচ মঙ্গল কাব্য গুলো দেখায় বাঙালি বানিজ্য তরী নিয়ে ব্যবসা করতে যেতো বিদেশে।


এটা বৈশাখ মাস। বাংলা হারিয়ে যাওয়া এক লোক সংস্কৃতির কথা তাই মনে পরে গেলো।শীতলামঙ্গল বা শীতলার গানের কথা বলতে চাই ছি ।গ্রামঘরে বলা হয়'মায়ের গান' শুনতে যাওয়া'। যদিও আমার পরিচিত এক সমাজ সংস্কৃতি পর্যবেক্ষক লোক শিল্প সংগ্রহক সৌমেন নাথ লেখা একটি অংশ তুলে ধরলে বোঝা যাবে এই শীতলা গান কলকাতায় প্রচলিত ছিলো বা হয়তো আছে।


সৌমেন বাবু লিখেছেন একটি গোষ্ঠীর উদ্দেশ্য"এটা বৈশাখ মাস । কলকাতার অনেক পাড়ায় এখন শীতলা গান আর শীতলাপালা হয় । Specifically তিনটে জায়গা আমি জানি..... (১) কলেজ স্ট্রীট বাটার রাস্তায় , (২) ডাক্তার লেন ( মৌলালি থেকে তালতলার দিকে যেতে ত্রান ভবনের উল্টোদিকে) আর (৩) কালীঘাটে পটুয়াপাড়ায় । কলেজস্ট্রীট এর পুজোটা বেশ মজার, শীতলার গড়ন অদ্ভুত।এখন কথা হল , এটা আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ কেন ? গুরুত্বপূর্ণ একারণে যে কলকাতার আদি বাসিন্দাদের জনবিন্যাসের কিছু ছবি আমরা বুঝতে পারি । যেমন, ডাক্তার লেনের ঐ পাড়ার আদি নাম হাড়িপাড়া , বা কালীঘাটের ঐ পাড়া পটুয়াপাড়া । সমাজের প্রান্তিক মানুষদের মধ্যে এখনও টিকে থাকা এই পুজোগুলো খুব-ই প্রাচীন। "


প্রচার না আসা লোক সংস্কৃতি বিষয়ক পত্রিকার সম্পাদক গৌতম বাবুও এ প্রসঙ্গে লিখেছেন "গ্রামের সাধারণ মানুষের মধ্যে এখনও লৌকিক দেবদেবীর প্রতি বিশ্বাস অটুট। কেবল মন্দিরের প্রতিমা নয়, এক পুরুষ শিল্পী দেবতা সেজেছেন, সব জেনেও তাঁকে দেবতা হিসেবে ভক্তি নিবেদন করছেন সাধারণ মানুষ।"


লোক সংস্কৃতি গবেষক সঞ্জয় ঘোষ এমন কিছু বলছেন।তার কথা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় এক আসর থেকে অন্য আসর এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যাতায়াত করে চৈত্র মাসের শেষ পাঁচ দিন নারী বেশী পুরুষ গাজন শিল্পিরা।গান গেয়ে/অভিনয় করে চলেছে অন্য আসরে।গ্রাম বাংলার খেটে খাওয়া অবহেলিত মানুষের অভিনয় গান নাট্য পরিচালনার লুকিয়ে থাকা প্রতিভার স্ফুরন ঘটে এই কদিন। সারা বছরের গ্রামে রাজ্যে বা বিশ্বে ঘটে যাওয়া বড় ছোট ঘটনার প্রতিক্রিয়া প্রকাশ ঘটে গাজন , শীতলার পালার আসরে।


দেবী শীতালা নিয়ে সংক্ষেপে কিছু কথা বলে নিই।শীতের পর ঋতু পরিবর্তন পর গ্রাম বাংলার তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলে এই সময় বাংলায় আসে বসন্ত রোগ।গ্রাম বাংলায় বসন্ত রোগকে মায়ের দোয়া বলা হয়। হিন্দু ধর্ম বিশ্বাস অনুসারে আদ্যাশক্তি দেবী দুর্গার অবতার , মা শীতলা এই বসন্ত রোগ থেকে উদ্ধার করেন। লৌকিক বিশ্বাস বসন্ত রোগ হলে মার পূজা দিলে মা সন্তুষ্ট হন ও রোগ মুক্তি হয় । শীতলা মাতা মুলত অনার্য দেবী । তবে প্রাচীন রামায়ণ ও মহাভারতে ও এই পূজার উল্লেখ পাওয়া যায়। বিরাট রাজ্যে একবার বসন্ত দেখা দিলে বিরাট রাজাও মত শীতলা পুজো করে রাজ্যকে ব্যাধি মুক্ত করেছিলেন। তবে এই বিরাট রাজ্য বোধহয় আধুনিক বাংলা।


বিভিন্ন সূত্রে দেখেছি বর্ধমান গ্রামগুলিতে শিব ও শীতলা আছেই। অথবা দুটি তিনটি গ্রামের একটিই শীতলা ও শিব। ঘাটাল মহকুমা জুড়েই চৈত্র-বৈশাখ মাসের মঙ্গল বা শনিবার হয় 'দেশ পুজো'। দেশ পুজো নামকরণ এর কারণ বসন্তের মারণ কামড় থেকে এই দেবীর আরাধনা দেশ সুদ্ধ গ্রাম সব লোককেই করতে হত বলে। তবে খেয়াল করলে দেখবেন অধিকাংশ লৌকিক দেবদেবী সর্বজনীন বা বিশেষ গোষ্ঠীর পূজা হয়ে থাকে । যেমন, মাকাল পূজা করে জেলেরা মাছ ধরার জন্য।


শীতলা গান মানে জাগরণ গান, মূল পুজো, যোগিনী পুজো আর শিবায়ন ।"শীতলামঙ্গল" গান মানে আসলে"বোধ মানসিক " মনস্কামনা পূরণের জন্য মঙ্গলগান করা । বসন্ত রোগের নিরাময়েরজন্য অনেকে মা শীতলার কাছে মানত করাকেই "বোধ মানসিক” বলাহয় । এই পূজোর দিনে মেয়েরা কেউ মায়ের ঘট নদী বা পুকুর থেকে জল ভরে মাথায় করে নিয়ে আসেন। ঐ ঘটকে কুলো তে বসিয়ে বরণডালা সাজাতে হয়। পাঁচ বাড়ি থেকে "মাঙন" সংগ্রহ করে নিয়ে ঘট স্থাপন করা হয়।শীতলা পুজোর এক বিশেষ রীতি হলো “মাঙন" । বিভিন্ন বাড়ি থেকে ভিক্ষা নিয়েই পুজো হয়।প্রতি বাড়ি থেকে একমুঠি করে ধান নিয়ে আসা হয়। ঐ ধান ঢেকিতে কুটে চাল তৈরী করে তার নৈবেদ্য হতো।


শীতলার নামে শোলা ও রাংতা দিয়ে বিশেষ চালচিত্র তৈরী করা হয় মা । সেই চাল চিত্রের সামনে ঘট বসিয়ে পুজো করা হয়। শীতলা পুজোর বিশেষ উপাচার হলো,,, তেল ও সিন্দুর।মায়ের ঘট স্থাপন না হওয়া পর্যন্ত ওই অঞ্চলের কোনবাড়ি তে রান্নাবসে না। চলে অরন্ধন ।রাতে হয় "শীতলামঙ্গল গান”। মূল গায়ক হাতে চামর নিয়ে কথক মতো মঙ্গলগান শুরু করেন ।দোহার ধ্রুবপদ গান | সারারাত ধরে এই গান চলে ।শীতলা দেবীর মহিমা প্রচারে জন্য এই কাব্যগান প্রচলন । খোল , মন্দিরা ও নুপুরের তালে এই গান গাও হয় । তবে গাজন পালা সাথে এর একটা পার্থক্য দেখা যায়।সাধারণত 'শীতলা পণ্ডিত' নামক এক সম্প্রদায় শীতলার গান গেয়ে থাকেন।


আধুনিক মানুষেরা বলবেন মায়ের বন্দনাগানের আসর বসিয়ে কোনো রোগব‍্যধির হাত থেকে রক্ষা পাওয়া রায় না। অনন্ত দক্ষিন২৪পরগনায় এটি গ্রামীন অন‍্যতম উৎসবগুলির মধ‍্যে একটি, এটি এক মিলনমেলা। যেখানে সবাই আসেন, উচ্চ নীচ, ধনী দরিদ্র, শিক্ষিত অল্প-শিক্ষিত। যে সব ছেলেরা বাধ্য হয়ে জীবিকার তাড়নায় ভিন্ রাজ‍্যে বা দূরবর্তী শহরে পারি দিয়েছেন তারাও অনেকে ঐসময় আসেন। সবার সঙ্গে কুশল বিনিময়, একটু একান্তে সময় কাটানো - হিসেবে উৎসব গুলো অন্তত বেঁচে থাকুক।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract