শেষের শুরু - অধ্যায় ১
শেষের শুরু - অধ্যায় ১


অমাবস্যার এক কৃষ্ণঘন অন্ধকার রাত্রে একদিন বীরভদ্র ও তাঁর ‘বাঁদর’ সেনা ঘিরে ধরল ‘নালক’ নামক সামরিক শিবিরটিকে চারিদিক থেকে।
মহাদেব শুলিনের পরামর্শগুলি মাথায় রেখেছিলেন বীরভদ্র। সেই অনুযায়ী ঘুঁটি সাজান তিনি। মূল স্তম্ভ ও তাকে ঘিরে দুদিকে অর্ধচন্দ্রাকৃতি আকারে যে দুটি শিবির রয়েছে তাতে সরাসরি আক্রমণ করলে তা হবে আত্মহত্যার নামান্তর। কাজেই সরাসরি আক্রমণের পরিকল্পনা প্রথমেই বাতিল করা হয়েছে।
এই দুটি শিবিরের তিনদিক ঘিরে রয়েছে আরও চারটি শত্রুশিবির। মূল স্তম্ভকে ঘিরে যে দুটি শিবির রয়েছে তারা হল ‘বিরারুচি’ও ‘দন্তীদূর্গ’। দুটি শিবিরই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সর্বোৎকৃষ্ট নমুনা! এরা কোন সেনা-ছাউনি নয়, পাকা প্রতিরক্ষা কেন্দ্র যা প্রতিরক্ষা করে মূল স্তম্ভটিকে।
এই শিবিরের অনতিদূরেই এদের সঙ্গে একই সমান্তরালে রয়েছে ‘কালনেমি’সেনা শিবির। এই শিবিরের গতিপ্রকৃতি লম্বাটে; একটি সরলরেখার মত এটি অবস্থান করছে দুটি শিবিরেই ডানা ছড়িয়ে। এর কাজ মূলতঃ ‘বিরারুচি’ ও ‘দন্তীদূর্গ’-কে ক্রমাণ্বয়ে সৈন্য ও অন্যান্য দরকারি রসদ সরবরাহ করা। এই শিবিরের সৈন্যসমাবেশ সর্বাধিক; দুইশত পংক্তির একটু বেশি।
এরপর প্রায় তিনক্রোশ তফাৎে রয়েছে দ্বিতীয় সৈন্যশিবির ‘শতভিষা’। শত পংক্তির সৈন্যদল অবস্থান করে এই শিবিরে। এদের কাজ, ‘কালনেমি’ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলির সুরক্ষা সাধন। রসদ সরবরাহে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এই শিবিরটি।
এরপরের সামরিক শিবির হল ‘কুম্ভ’। এদের কাজ ‘শতভিষা’-কে সৈন্য সরবরাহ। তবে এই শিবিরের সঙ্গে সংযোগ সাধন থাকে মূল সরবরাহকারী দলের যাদের মাধ্যমে রসদ ও সৈন্য অপরাপর অংশগুলিতে ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাছাড়া, এটি সেই শিবির যেখানে সৈন্যদের পদবিধান করা হয়। নতুন ও তাজা সৈন্য সমাবেশ হয় প্রথমে এখানেই; নিজ নিজ পদ বুঝে নিয়ে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, ছড়িয়ে পড়ে বাকি তিনটি শিবিরে। মূল স্তম্ভ প্রতিরক্ষাকারী দুটি শিবিরের সৈন্যও ধার্য হয় এখান থেকেই।
শেষ গন্তব্য – ‘নালক’। এটি কোন সৈন্যশিবির নয়, এটি সামরিক প্রতিরক্ষা কেন্দ্র। রাক্ষসদের সমস্ত আধুনিক প্রতিরক্ষা সংবলিত একটি সামরিক অঞ্চল যাতে রয়েছে স্বয়ংক্রিয় স্থলশকট, কৃত্রিম বুদ্ধিসম্পন্ন বা রাক্ষসচালিত উড়নযান, রাক্ষসদের প্রতিরক্ষা কবচ ও যন্ত্রবর্ম এবং অসংখ্য আলোকবর্তৃকা। একে ঘিরে যে উঁচু প্রাকার তাতে জায়গায় জায়গায় বসানো ‘পাশবাস্ত্র’,যার সাহায্যে আকাশের যেকোন শত্রুকে এরা সহজেই মাটিতে নামাতে পারবে। এছাড়াও রয়েছে স্বয়ংক্রিয় সন্ধানী ক্ষেপনাস্ত্র, অজস্র ধারাবর্ষী আগ্নেয়াস্ত্র, দুইটি অন্তরীক্ষ যান, শক্তিশেল এবং ‘কেশবাস্ত্র’; এর কাজ প্রতিপলে সাতটি করে ক্ষেপনাস্ত্র প্রয়োগে যেকোন শত্রুযান ধ্বংস করা। এছাড়াও এদের সঙ্গে রয়েছে ‘শক্তি’- রাক্ষসদের নিজ আবিষ্কৃত বিস্ফোরক কন্দুক, যা আকাশ থেকে উড়নযানের সাহায্যে মাটিতে বা মাটি থেকে উৎক্ষেপকের সাহায্যে আকাশে সমান দক্ষতায় নিক্ষেপ করা যায়। মোট কথা, পদাতিক ও উড়নযান, দুটির জন্যই যথেষ্ট খারাপ সংবাদ!
-“কিন্তু এত উন্নত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে মোকাবিলা করবার মত সরঞ্জাম আমাদের কাছে কোথায়? আমরা তো স্রেফ পিষে যাব! এ তো আমাদের কাছে আত্মহত্যার নামান্তর!”যুদ্ধ শুরুর আগের অধিবেশনে কথাটা তুলেছিলেন লক্ষণ, সকলের সামনে।
-“’নালক’-এর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে দেবতাদের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে। ভালো করে দেখ মিতে, এখানে কিন্তু পুরো প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আকাশকেন্দ্রীক হয়ে দাঁড়িয়ে। এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কোনটাই আমাদের ক্ষেত্রে খাটবে না যদি আমরা প্রথমেই প্রাকার লঙ্ঘণ করে ফেলতে পারি। দেবতাদের জনসংখ্যা কম, ফলে ওঁদের নির্ভর করতে হয় উড়নযানের ওপর, কৃত্রিম বুদ্ধিসম্পন্ন চালকবিহীন বা চালকযুক্ত উড়োযান, যাই হোক না কেন। পদাতিক সৈন্যের অস্তিত্ব প্রায় নেই। নালকের প্রতিরক্ষাও সামঞ্জস্য মিলিয়ে উড়োজাহাজ বা স্বয়ংক্রিয় ধ্বংসাত্মক ক্ষেপণাস্ত্রের ওপর নির্ভরশীল। দুটোর কোনটিতেই আমাদের ক্ষতিসাধন হবে না, যেহেতু আমরা যাব পদাতিক সৈন্য হিসেবে। তবে আমাদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে ক্ষতিকারক হতে পারে ওদের ধারাবর্ষী আগ্নেয়াস্ত্র যা প্রতি মুহূর্তে তিনশতাধিক শর নিক্ষেপ করতে পারে।“ উত্তর দিলেন বীরভদ্র।
-“সেটাও তো ভয়ংকর দাদা! আমাদের এই প্রায় নিরস্ত্র, আদিম সৈন্য ওদের ‘অগ্নিবর্ষী’র সামনে পড়লে তো কচুকাটা হয়ে যাবে!”
-“সেটা তখনই হবে যখন আমরা আগে থাকতে ওদের ‘অগ্নিবর্ষী’র অবস্থান না জেনে ওর সামনে গিয়ে পড়ব। সেজন্যই আগে দরকার ছিল ওদের অস্ত্রগুলির অবস্থান জানা। কয়েকদিন ধরেই আমরা হনুমন্তকে ওখানে ক্রমাণ্বয়ে প্রেরণ করেছিলাম; একজন সাধারণ আদিম বাঁদর হিসেবেই ও গেছিল ওখানে, বাঁদরদের মতই আচরণ করেছে ও ওখানে। ওর দায়িত্ব ছিল খুঁটিনাটি সব দেখা এবং বুঝে আসা। ওঁর স্মরণশক্তির ওপর ভরসা করে আমরা ওর মৌখিক বিবরণ থেকে একটা রৈখিক মানচিত্র এঁকে নিয়েছি। এই যে সেই মানচিত্র। তবে অভিনেতা হিসেবে হনুমন্ত এককথায় অনবদ্য!”
-“ওদের কয়েকজন দয়াপরবশ হয়ে আমায় কলা খেতে দিয়েছে। কয়েকজন লাথি মারতে এসেছিল; দাঁতমুখ খিঁচিয়ে সরে গেছি ওখান থেকে। দারুণ এক অভিজ্ঞতা হল বটে!”বললেন হনুমন্ত।
-“যাই হোক, এই সেই মানচিত্র। এই মানচিত্র অনুযায়ী, এই বহির্প্রাকারটি প্রায় ছয় গন্ধর্ব উঁচু। ছয়জন গন্ধর্বকে ওপর-নীচ করে দাঁড় করালে যতটা উচ্চতা হয়, ঠিক ততটা। প্রাচীরটি চতুষ্কোণী। এই প্রাচীরের অন্তর্গত বর্গক্ষেত্রের মধ্যে রয়েছে শষ্যাগার, অস্ত্রাগার, উপাসনাগৃহ, সমবেত কক্ষ, অভ্যাসকেন্দ্র, উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ, সৈন্যদের থাকবার পাকা ছাউনি; এছাড়া দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিকদের জন্য অট্টালিকা, সতর্কবার্তা দেওয়ার জন্য ঘন্টাঘর – আরও কত কি!
প্রাচীরের ওপর বিভিন্ন স্থানে রয়েছে তোরণ,তাতে বসানো বিভিন্ন জাতের ক্ষেপণাস্ত্র। উল্লম্ব খিলানগুলি, যেগুলি বিভিন্নক্ষেত্রে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেগুলি প্রকৃতপক্ষে নজরদারি কেন্দ্র। প্রাচীর সংলগ্ন একটা বেশ বড় অঞ্চলের জমি ফাঁকা করে রাখা আছে প্রতিরক্ষার উদ্দেশ্যে। কাজেই সাধারণ ক্ষেত্রে নজরদারদের চোখ এড়িয়ে কখনোই ওখানে যাওয়া যাবে না,বিশেষ করে তুই আর আমি ওখানে আগ বাড়িয়ে গেলেই বিপদ মিতে; ধরাও পড়ে যাব, পুরো পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে।
লালচিহ্ন দেওয়া এই অংশগুলি হল ‘অগ্নিবর্ষী’র প্রস্তাবিত অবস্থান। এখানে আমাদের সবাইকে মূলতঃ সতর্ক থাকতে হবে। হুট করে সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেই হবে না। এছাড়া ওদের উড়োযানকেন্দ্রগুলি মূলত দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব ঘেঁষে। তাই ওগুলিকেও সমানতালে ধ্বংসের উদ্যোগ নিতে হবে নাহলে ওখান থেকে ওরা সাহায্য পেতে পারে।...