শ্বেত করবী
শ্বেত করবী
আজ আবার বাড়ির মালিক ঘর ছেড়ে দিতে বললেন। এক সপ্তাহ সময় দিয়েছেন। অসহায় বৃদ্ধা সবিতা দেবী বিছানায় শোয়া পক্ষাঘাতে পঙ্গু বাদল বাবুর শীর্ণ দেহটার দিকে তাকিয়ে চোখের জল মোছেন। নিজের হাঁটুর ব্যাথাটাও বেড়েছে কদিন থেকে। ডাক্তার আগের বার এক্স-রে করতে বলেছিল। আর ডাক্তার দেখানো হয়নি। এসব এখন বিলাসিতা! সব কষ্ট মুখ বুজে সইবার অভ্যাস হয়ে গেছে এখন।
উনি আশেপাশে খোঁজ করেছেন, কোনো ফাঁকা বাড়ির খবর নেই। আর ওঁর পক্ষে এভাবে বাড়ি বদলানো প্রায় অসম্ভব। আজকাল ভাড়াও বেড়েছে। জিনিসের দাম বাড়ছে প্রতিনিয়ত ।রোজগার তো বাড়েনি!!
একমাত্র মেয়ে শ্রেয়া বিদেশে থাকে। চার বছর আগে শেষ একবার এসেছিল। ওর বিয়ে দিতে গিয়েই ফ্ল্যাটটাও বিক্রি করে দিয়েছিলেন বাদল বাবু। বলতেন -"মেয়ে তো আর এদেশে ফিরবে না, আমরা আর কদিন? ভাড়া বাড়িতেই শেষ দিন কটা কেটে যাবে।"
গত দু বছর থেকে বিছানা নিয়েছেন উনি। চিকিৎসা করাতে গিয়ে অল্প যা জমা পুঁজি পুরোটাই শেষ প্রায় । এদিকে সুদের হার কমায় ওষুধও কিনতে পারেননি সবিতাদেবী এই মাসে। অল্প কটা টাকার পেনশন পান, সেটাই শেষ ভরসা।
অসহায় সবিতা দেবী বারান্দায় এসে দাঁড়ান। গতবার বাবা অসুস্থ জানতে পেরেও মেয়ে আসেনি। দশহাজার টাকা পাঠিয়ে বলেছিল নতুন বাড়ি কিনেছে। তাই এই মুহূর্তে আসা সম্ভব নয়, বেশি টাকাও দিতে পারবে না। জামাই ফোনেই খোঁজ নিয়েছিল।ওদের নতুন বাড়ির ফটো পাঠিয়েছিল। এই মেয়েকে পড়িয়ে মানুষ করে বিয়ে দিতেই বাদলবাবু সব জমানো টাকা শেষ করে ফেলেছিলেন। বাগানে ফুলে ফুলে সেজে ওঠা করবী গাছটার উপর দিয়ে এক ঝলক রোদ্দুর এসে পড়েছে সবিতা দেবীর গায়ে। করবী গাছটার দিকে তাকিয়ে একসময় বোটানির ছাত্রী সবিতা দেবির চোখ দুটো জ্বলে ওঠে।
ওয়াস করে পেটের প্রায় পুরো বিষটাই বার করে ফেলেছিল শুভ্র। এখন দুজনেই সুস্থ। শ্বেত করবীর বীজ চায়ের সঙ্গে মিশিয়ে খেয়ে
ছিল দুজন। কাল সন্ধ্যায় বৃষ্টির মধ্যে কেবলের টাকা নিতে গিয়ে পাড়ার একটি ছেলে প্রথম দেখে। তারপর ক্লাবের ছেলেরা ওঁদের দুজনকে নিয়ে এসেছিল হাসপাতালে। নাম শুনে ও মুখ দেখে চমকে উঠেছিল শুভ্র। আজ সকালে রাউন্ডে যেতেই বৃদ্ধার অভিযোগ কেন তাদের বাঁচানো হল!! গরীবদের বেঁচে থাকার অধিকারই নেই।
শুভ্র হেসে বলে এটাই যে তার ধর্ম। বৃদ্ধ শুভ্রকে দেখে হঠাৎ নড়ে ওঠেন। কিছু বলতে চাইছেন। একটা হাত তুলে শুভ্রর দিকে ইশারা করে কিছু বলতে চেষ্টা করেন। কিন্তু পক্ষাঘাতে পঙ্গু বৃদ্ধের জড়ানো কথা শুভ্র বুঝতে পারে না। বাইরে বেরিয়ে আসে। পাড়ার ছেলেরা বলেছে গরীব পরিবারটাকে ঘর ছাড়তে বলেছে মালিক। বাড়িটা প্রমোটারকে বিক্রি করে দিয়েছে। শুভ্র মনে মনে ভাবে আপাতত একটা পরিচিত বৃদ্ধাশ্রমে ফোন করে দুটো সিটের ব্যবস্থা করতে হবে । বাদল বাবু যে তাকে চিনতে পেরেছেন দেখে মনটা কেমন হয়ে গেলো।
একদিন শুধু দাস পদবী আর গরীব হওয়ার অপরাধে তার ভালবাসা স্বীকৃতি পায়নি। শ্রেয়ার বাবা বাড়ি বয়ে শুভ্রর মা কে অপমান করে গিয়েছিলেন। ব্যথাটা মা শেষ দিন পর্যন্ত ভোলেনি। শুভ্র তখন মেডিকেলের ছাত্র। খুব কষ্ট করে মা পড়াচ্ছিল। ওদিকে এক বছরের মধ্যে এনআরআই পাত্র দেখে উনি শ্রেয়ার বিদেশে বিয়ে দিয়েছিলেন । শ্রেয়া অবশ্য একবার পালাতে চেয়েছিল কিন্তু মায়ের কথা ভেবে শুভ্র রাজি হয়নি সেদিন। চোখের জল মুছে বিয়ের পিড়িতে বসেছিল শ্রেয়া। তবে বিদেশে গিয়ে সব ভুলে গেছে। ওর হাসিখুশি ফটো ফেসবুকে মাঝে মধ্যেই চোখে পড়ে। খুব খুশি নিজের নতুন সংসারে, নতুন বাড়ি কিনেছে, মনের মত করে সাজিয়েছে।
আজ ওর বাবা মায়ের জীবন ফিরিয়ে দিতে পেরে শুভ্রর খুব ভালো লাগছে। মা এর সেদিনের অপমানের জবাব আজ ও দিতে পেরেছে। মা নিশ্চয়ই আজ খুশি হবে ওর কাজে। ফোনটা হাতে নিয়ে পরিচিত একটা বৃদ্ধাশ্রমে ফোন করে শুভ্র। ওঁদের মাথা গোঁজার একটা আশ্রয় খুব দরকার।