সেই রাতে...রাত ছিলো...
সেই রাতে...রাত ছিলো...
ঘর অন্ধকার করে ব্যলকনিতে বসে ছিলাম আমি। এই ছোট্ট শান্ত গ্ৰামের সংস্কৃতিতেও লেগেছে শহুরে ছোঁওয়া। বর্ষ শেষের এই রাত বাজির শব্দে আর হিন্দি গানে ভরপুর। এর হাত থেকে বাঁচতেই শহর ছেড়ে প্রতিবার পালিয়ে আসি কোনো ছোট জায়গায়। বাধ্য হয়ে বেড রুমে ঢুকে হাল্কা নীল আলোটা জ্বালিয়ে বিছানায় এসে বসলাম। মিলন ফোনে ব্যস্ত । আমায় দেখে বলল - "এবার শুয়ে পড়ো।"
আমি ঘড়িতে দেখলাম - পৌনে বারোটা, ফোনটা প্রতিবারের মত অফ রেখেছি। কোনো শুভেচ্ছা বার্তা আমার পছন্দ নয়। মিলন সবটাই জানে। বহুদিন ধরে ও আমার কাউন্সিলিং করেছে। ওর জন্যই আস্তে আস্তে ঠিক হচ্ছিলাম। আজ পাঁচ বছর ধরে আমার এ পাগলামি ও একাই সামলাচ্ছে। তার আগে আমার বাবা আমায় নিয়ে এভাবেই গ্ৰামের বাড়ি চলে যেত। কয়েকটা দিন নিজেকে গৃহবন্দী করে রাখতাম আমি। কিন্তু ফিরে আসার পর স্বাভাবিক হতে লাগতো আরো বেশ কিছুদিন।
এখনো ভাবতে অবাক লাগে একটা ছোট্ট ভুল মানুষের জীবনকে কেমন বদলে দেয়। যদি সেই রাতে আমি ঘুরে দাঁড়াতাম, যদি প্রতিবাদ করতাম ...!! হয়তো এভাবে সারাটা জীবন বিবেকের কাছে ছোট হয়ে থাকতে হতো না। যদি সেদিন ঋষির কথা না শুনতাম, হয়তো আমার জীবন আরো পাঁচটা মেয়ের মত স্বাভাবিক হত। পরদিন সব জানার পরেও ঋষি আর বাবার কথা ভেবে সামনে আসতে পারিনি আমি। বারবার মনে হয়েছিল আমার প্রতিবাদ করা উচিত। আমার এগিয়ে গিয়ে সাক্ষী দেওয়া উচিত। কিন্তু বাবা আর ঋষি বলেছিল তাতে হিতে বিপরিত হবে। কাদা ছোড়াছুড়ি হবে। পেপার আর টিভিতে রগরগে গল্প তৈরি হবে। ঋষি সে সময় বিদেশে যাওয়ার অফার পেয়েছে। কোনো ঝামেলায় জড়াতে চায়নি। সেসময় ওর কথাই ছিল আমার কাছে বেদ বাক্য।
বাবার আর ওর সন্মানের কথা চিন্তা করেই সেদিন...তাছাড়া যে মানুষটার জন্য এতকিছু সে তো চলেই গেছিল।
সারাটা দিন টিভির দিকে তাকিয়ে থাকতাম, পেপারগুলো খুটিয়ে পড়তাম। তদন্ত সঠিক পথেই যাচ্ছিল। আমি সামনে এলে আলাদা কি কিছু হত? জানি না। তবে আমি সামনে এলে চ্যানেল গুলোর টিআরপি বাড়ত আর মুখরোচক গল্প তৈরি হত এটা ঠিক।
অবশ্য আমি প্রকাশ্যে না আসায় গল্প কিছু কম তৈরি হয়নি। হয়তো সামনে যাইনি বলেই শয়তান গুলো কঠিন সাজা পেয়েছে। আমায় কোর্টে তুলতে পারলে আমার সাজ পোশাক, পেশা , চরিত্র সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে হয়তো ওদের সাজা কিছুটা কমাতে পারত ওদের উকিল। হয়তো বলত আমিই উত্যক্ত করেছিলাম ওদের।
এসব ভেবেই আজ এত গুলো বছর নিজেকে শান্তনা দিয়ে আসছি। কিন্তু যখনি একা বিবেকের সামনে এসেছি নিজের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারিনি। ক্ষত বিক্ষত হয়েছে মন।
ঋষির শত বারণ সত্তেও গেছিলাম ওনাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে ভিড়ের মধ্যে মিশে। ওনার স্ত্রী আর ছেলের দিকে তাকাতে পারিনি। বারবার মনে হচ্ছিল সবাই কি আমায় চিনতে পারছে? কিন্তু সেই রাতের মেয়েটার আর আমার মধ্যে এই কয়দিনেই ঘটে গেছিল আমুল পরিবর্তন। পরিচিতরাই অবাক হয়েছিল।
এরপর ধীরে ধীরে সবাই সব ভুলে গেলো, ভুললাম না আমি। প্রতিবছর এই বর্ষশেষের রাতে এক ভয়, অন্যায়বোধ, লজ্জা এসে আমায় গ্ৰাস করে। অথচ আমার তো কোনো দোষ ছিল না।
ঋষিদের বাড়ি ছিল কট্টর, সেকেলে, রক্ষণশীল। তাই বাড়িতে আমাদের কথা জানায়নি ও। আর আমার বাড়িতে জানত বন্ধুদের পিকনিক হচ্ছে এক বন্ধুর ফ্ল্যাটে। মধ্যবিত্ত বাঙালী বাবা মা কখনো মেয়ে নাইট আউটে যাচ্ছে এসব মানবে না। তাই ঐ টুকুই মিথ্যার আশ্রয়। কিন্তু ঐ একটা মিথ্যা যে আমার জীবনে আমুল পরিবর্তণ বয়ে আনবে তখন জানতাম না।
আর সবার মত আমিও বর্ষ শেষের রাতের আনন্দে মেতে উঠেছিলাম। একটু বেশি রাত করেই ঋষির সাথে ফিরছিলাম । হলুদ ট্যাক্সিটা পিছু নিয়েছিল বেশ কিছুক্ষণ। কটুক্তি আর উত্তেজক কথাবার্তা, চটুল মন্তব্য এড়িয়ে এগিয়ে চলছিলাম। হঠাৎ সিগন্যালে দাঁড়াতেই হাত ধরে টানাটানি শুরু করল। ঘাবরে গেছিলাম। ঠিক তক্ষুনি আরেকটা সাদা গাড়ি এসে ওদের বাধা দিল। এক ঝলক দেখেছিলাম তাকে। দু দলের মধ্যে হাতাহাতি শুরু হতেই ঋষি আর দাঁড়ায়নি। ভাবতেও পারিনি কি ঘটতে চলেছে। ওরা যে সবাই পুলিশ তাও জানতাম না। পরদিন সকালে যখন সবটা জানতে পারি ভয় পেয়ে গেছিলাম। বাড়িতে তখনো বলতে পারিনি কিছুই।
ঋষি সবটাই চেপে যেতে বলেছিল। বলেছিল ভদ্রলোক সার্জেন্ট, ওনার পুলিশ বন্ধুরা ঠিক সাক্ষী দেবে। আমাদের না গেলেও চলবে। লোক জানাজানি হলে ওর বিদেশ যাওয়া আটকে যেতে পারে, ওর পরিবার এসব শুনলে আমায় মেনে নেবে না, তাছাড়া মধ্যবিত্ত পরিবারে এসব কেচ্ছা রঙ চঙ চড়িয়ে বড় আকার নেয়। প্রতিটা মুহূর্ত একটা আতঙ্কের মধ্যে কাটছিল। দরজা আওয়াজে মনে হত এই বোধহয় পুলিশ এলো; সবার চোখে সন্দেহ, এক প্রবল মানসিক চাপ, স্নায়ুর এই লড়াই আর নিতে পারছিলাম না।
এরপর যখন খবর এল আমার পরিত্রাতা আর নেই, ছুটে গেছিলাম একবার শেষ দেখা দেখতে। বাড়ি ফিরে সেদিন বাবাকে খুলে বলেছিলাম ঘটনাটা। কিন্তু বিচক্ষণ বাবাও ঋষির মত করেই বুঝিয়েছিল। আমায় অন্য শহরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল এরপর। ট্রমাটা কাটিয়ে উঠতে সময় লাগছিল। ঋষি বিদেশ চলে গেছিল যথারীতি। আমার খোঁজ খবর বিশেষ নিত না আর। ও বোধহয় ঘটনাটা ভুলতে চাইছিল, আর আমাকেও ঝেরে ফেলতে চাইছিল।
অনেকগুলো বছর কেটে গেলো। কিন্তু বছর শেষের দিনটা আসলেই আমার মধ্যে একটা পরিবর্তণ আসত। আমি যেন সব দেখতে পেতাম। আতঙ্কে জ্ঞান হারাতাম। ভুলভাল বকতাম।
এত গুলো বছর পরেও সেই রাতের স্মৃতি পিছু ছাড়ে নি। প্রথম প্রথম বাবা আমায় নিয়ে গ্রামে চলে যেত। চিকিৎসাও করিয়েছিল। এরপর এল মিলন। ওকে খুলে বলেছিলাম সবটা। শক্ত করে আমার হাতটা ধরেছিল ও। ভালো বন্ধু বোধহয় একেই বলে। ঋষি চলে যাওয়ায় যে বিশ্বাস হারিয়েছিল তা আবার ফিরে পাচ্ছিলাম একটু একটু করে।
কিন্তু বছরের শেষ দিনটা আসলেই পাগল পাগল লাগত। নিজের অপরাধ বোধ জেগে উঠত। মিলন আমায় নিয়ে বনে জঙ্গলে কোনো ছোট্ট অখ্যাত জায়গায় চলে আসত। আগলে রাখত। তবুও ....
জানিনা আর কত বছর, কত যুগ এই বিবেক দংশন সহ্য করতে হবে আমায়। এখনো বছরের এই বিশেষ দিনে অনেকেই প্রশ্ন তোলে সেই অজ্ঞাত মেয়েটার ব্যাপারে। কেউ জানে না আমিই সেই মেয়ে। আমি ভালো নেই। আমি শান্তিতে নেই। জানি না আর কতদিন এভাবে লুকিয়ে থাকতে হবে। যে অপরাধ করছি তার সাজা হয়তো এ ভাবেই পেয়ে যাবো সারা জীবন!! হয়তো এটাই আমার প্রাপ্য!!