স্বর্গলাভের আশায়
স্বর্গলাভের আশায়
কিছুদিন যাবৎ অরুণবাবুর বাড়িতে অশান্তি লেগেই রয়েছে। বাড়ি নামেই, আসলে তো দু'কামরার ফ্ল্যাট। নিজেই উনি বলেন 'পায়রার খোপ'। তা সেই পায়রার খোপে পাঁচটি প্রাণীর বাস। কোনোরকমে স্থান সঙ্কুলান হয়। তার মধ্যে কী আর ব্যক্তিগত বলে কিছু থাকে ! একটি কামরায় বাবা-মা আর দশ বছরের মেয়ে, আরেকটিতে ঠাকুমা আর ১৮ বছরের নাতি। তো সেই নাতি এবার স্কুল পেরিয়ে কলেজে পৌঁছেছে। তার দাবী নিজস্ব একটা ঘর তার চাই। অরুণবাবু পড়েছেন মহা সমস্যায়। এ তো তার নিজের জমির ওপর বাড়ি নয়, এ যে ফ্ল্যাট। এখানে ঘরের সংখ্যা বাড়াবেন তিনি কেমন করে? আরেকটা ফ্ল্যাট কেনাও সম্ভব নয় ছাপোষা মানুষটির পক্ষে। এই নিয়েই বাড়িতে নিত্য অশান্তি। উঠতি বয়সের ছেলে, রক্ত গরম। কোনও কথাই সে বুঝতে চায় না, কারো অসুবিধেটাই সে বুঝবে না। সে বোঝে কেবল নিজের অসুবিধে। বন্ধু-বান্ধবের বাড়িতে যায়, সেখানে তাদের নিজের নিজের ঘরে বন্ধুরা মিলে গল্পগুজব করে অথচ তার বাড়িতে তার নিজস্ব ঘর না থাকায় কোনদিন সে বন্ধুদের ডাকতে পারে না। লজ্জায় তার মাথা মাটিতে মিশিয়ে যায়। মা বোঝান, সে বোঝে না।
বাবা বিরক্ত হন, নিজের আর্থিক সামর্থ্যহীনতায় অবসাদে ভোগেন। ঠাকুমা কেবল চুপ থাকেন। চুপ করে সব শোনেন। কোনও কথা বলেন না। একদিন এক অবসরে নাতির অনুপস্থিতিতে ছেলের কাছে গিয়ে তিনি বলেন, "বাবা অরুণ, তোর কাছে আমার একটা আর্জি আছে।" অরুণবাবু ভীত, উদ্বিগ্ন চোখে মায়ের দিকে তাকান। ছেলের চাহিদা পূরণ করতে না পেরে তিনি এমনিতেই বড় অশান্তিতে থাকেন, এখন মা আবার কী চান? মা তো, ছেলের চোখের ভাষা তিনি ঠিকই পড়তে পারেন, বলেন, "ঘাবড়াস না বাবা, তোকে বেকায়দায় আমি ফেলব না। তোর বাবা চলে গেছেন অনেকদিন হল, সেই ইস্তক আমার বড় ইচ্ছা কাশীবাসী হব। মনের ইচ্ছা মনে চেপে রেখে ছিলাম এতদিন কারণ মরবার বয়স তখন হয়নি আমার। মৃত্যু তখনও অনেক দূরে কিন্তু এখন বয়স হয়েছে, রোগে শরীর জর্জরিত, তার ওপর সেদিন টিভি সিরিয়াল দেখার সময় কাশীর গঙ্গার ঘাট দেখে মন আমার বড় উচাটন। আমায় কাশীবাসের ব্যবস্থা করে দে বাবা।" অরুণবাবু অবাক বিস্ময়ে মায়ের মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন কিছুক্ষণ। তারপর বলেন, "বুঝেছি, বুঝেছি, আমি সব বুঝেছি। আমাকে অত বোকা পাওনি। তুমি খোকার জন্য ঘর ছেড়ে দিয়ে চলে যেতে চাইছো। তুমি চলে গেলে একটা নিজের ঘর ও পেয়ে যাবে। আর তাহলেই বাড়ির রোজের অশান্তিটা কমবে।" মা বলেন, "আমায় ভুল বুঝিস না বাবা। এমনিতেই বয়স হয়েছে, আর কতদিনই বা বাঁচব। শেষ বয়সটা কাশীতে গঙ্গার চান করে গঙ্গাতীরে থাকতে চাই যাতে মৃত্যুর পর আমার স্বর্গলাভ হয়।"
