স্বাবলম্বী
স্বাবলম্বী


সেদিন আসন্ন সন্ধ্যায় দেবিকা ব্যারাকপুরের নিজস্ব ছোট্ট বাড়ির উঠোনের ফুলের বাগানে একটা চেয়ারে বসে আশাপূর্না দেবীর লেখা একটা গল্পের বই পড়ছিল। এই আসন্ন সন্ধ্যায় পাখিদের ঘরে ফেরার সময় তাদের কিচিরমিচির আওয়াজে দেবীকার মন এক অজানা আনন্দে ভরে ওঠে। সারাদিনের একাকিত্বটাকে যেন ভুলিয়ে দেয়। সেদিনও পাখিদের ওই কল- কাকলিতে যেন হারিয়ে গিয়েছিল দেবিকা। বুকের উপর গল্পের বইটা নিয়ে, সামনের বড়ো গাছটায় দলে-দলে ফিরে আসা পাখিদের দেখতে দেখতে আর তাদের কল কাকলির মাঝে হঠাৎ যেন ঘোর ভাঙে --- ফোন বাজল কি? নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে। তারপর উঠে যায় ঘরের ভেতর। হ্যাঁ, ফোন বাজছে। ঘরে গিয়ে ফোনটা তুলে 'হ্যালো' বলতেই ও পাশ থেকে মিষ্টি সুরে আট বছরের নাতনি দিয়ার অভিযোগ -- 'কখন থেকে ফোন করছি। কোথায় ছিলে তুমি?'
-- আমি তো বাগানে ছিলাম, তাই ফোনটা তুলতে দেরী হ'ল। তুমি কেমন আছো?
-- আমি ভালো আছি। আগামী মাসে আমার জন্মদিন, তোমার মনে আছে তো?
-- সেটা কি ভুলতে পারি দিদিভাই?
-- তাহলে আমার জন্মদিনে তুমি আসছ তো?
-- না দিদিভাই, আমার পায়ের ব্যাথাটা বড় বেড়েছে। এই ব্যাথা নিয়ে অতদূরে যাই কি করে?
-- তাহলে আমার জন্মদিনের উপহার টা?
-- রাখা থাকবে। তোমরা যখন আসবে, তখন পেয়ে যাবে।
-- না, তা হবে না। দাদাভাইকে ওর জন্মদিনের দিনই ওর পছন্দের মাউথঅর্গান দিয়েছ। আমাকেও আমার জন্মদিনের দিনই আমার পছন্দের কানের দুলটা দিতে হবে।
পেছন থেকে কেউ একজন দিয়াকে ডাকল। ফোনে দেবিকার কানে সেই আওয়াজটাও ভেসে এল। ও পাশ থেকে দিয়া 'আমি রাখছি ঠাম্মা' বলে ফোনটা রেখে দিল।
ব্যারাকপুরের বাড়িতে দেবিকা একাই থাকে। বছর দুয়েক আগে তার স্বামী মারা গেছেন। যাবার সময় এই বাড়িটা ছাড়া আর কিছুই রেখে যাননি। তবে রাজার, মানে দেবিকার স্বামীর একটা এল,আই,সি পলিসি ছিল। সেখান থেকে যা সামান্য কিছু টাকা পাওয়া গেছে, দেবিকার ছেলে আর্য সেই টাকা দেবিকার নামে ব্যাংকে ফিক্সড করে দেয়। প্রতি মাসে সেখান থেকে সামান্য ইন্টারেস্ট দেবিকার হাতে আসে। এছাড়া ছেলে আর্য প্রতি মাসেই মাকে নিয়মিত টাকা পাঠায়। যদিও দেবিকা কোনদিনই কোন প্রয়োজনেই ছেলের কছে টাকা চায়নি।
আর্য চাকরিসূত্রে স্বপরিবারে পূণায় থাকে। দেবিকা নিজের জায়গা ছেড়ে পূণায় গিয়ে থাকতে রাজি হয়নি। তাই সে তার একাকিত্বের জন্য কারোকে দায়ী করে না। অন্যদিকে আর্য প্রতি বছর বাচ্চাদের স্কুলের ছুটিতে অর্থাৎ গরমে, স্বপরিবারে মা'র কাছে আসে। আর এই গরমেই তার ছেলে রাণার জন্মদিন। তাই প্রতিবছর নাতির জন্মদিন টা দেবিকা ভালোই উপভোগ করে।
এ বছর হঠাৎ দেবিকা, তার অল্প অল্প করে জমানো টাকা থেকে নাতির জন্মদিনে নাতির পছন্দের একটা উপহার তাকে কিনে দেয়। দাদাভাই এর উপহার দেখে নাতনি দিয়া আব্দার করে তাকেও তার জন্মদিনে তার পছন্দের উপহার ঠাম্মাকে দিতে হবে। শুধু তাই নয়, পরদিন ঠাম্মাকে নিয়ে বাড়ির পাশেই এক গয়নার দোকানে গিয়ে একটা কানের দুল পছন্দ করে বলে, 'এই দুলটাই আমার জন্মদিনে চাই।'
নাতির জন্মদিনের দুইমাস পরেই নাতনির জন্মদিন। এই সামান্য সময়ে সোনার কানের দুল কেনার মত টাকা তো জমেনি। অথচ জন্মদিনে দুলটা পাঠাতেই হবে। নাতনির আব্দার বলে কথা। কিন্তু কি করবে, কোথায় টাকা পাবে, কিছুই বুঝে উঠতে পারছিল না দেবিকা। তাই পরদিন যখন ছেলে ফোন করে তখন বাধ্য হয়েই ছেলেকে বলে, 'আমায় হাজার দুয়েক টাকা পাঠাতে পারবি?'
আর্য একটু অবাকই হয়, সাথে খুশিও।কারন, এই প্রথম মা তার কাছে মুখ ফুটে কিছু চেয়েছে। তাই খুশি হয়েই বলে, 'নিশ্চয়ই '। তারপর কৌতুহলবশতঃ বলে ফেলে, 'কি করবে?'
'কি করবে?' প্রশ্নটা টাকার হিসাব চাইবার জন্য ছিল না। ছিল নেহাতই কৌতুহল। কিন্তু এই কথাটাই দেবিকার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল। দেবিকার মনে আঘাত লাগলো। ভাবলো, ছেলের কাছে টাকা চেয়েছি, তাই সে কৈফিয়ৎ চাইল !
কখন কোন কথা কাকে কি ভাবে আঘাত করে তা কেউই বলতে পারে না।দেবিকা মনস্থির করে নেয় যে, সে আর কোনদিনই ছেলের টাকায় হাত দেবে না। ছেলে যা টাকা পাঠাবে তা অমনিই ব্যাংকে থাকবে। তার এই সিদ্ধান্তের কথাও সে ছেলেকে জানাবে না।অনেকক্ষণ বসে বসে দেবিকা অনেক কিছু ভাবে। তারপর একসময় উঠে আলমারি খুলে নিজের গয়নার বাক্স বার করে। নিজের পুরানো গয়নাগুলো নাড়াচাড়া করতে করতে একটা গয়না হাতে তুলে নেয়।গয়নাটা প্রথম বিবাহবার্ষিকীতে তার স্বামী রাজা তাকে উপহার দিয়েছিল।সেই মূহুর্তগুলো যেন দেবিকার চোখের সামনে প্রজ্বলিত হয়ে উঠল। দেবিকা কিছুটা ইমশোনাল হয়ে পড়ে, পর মূহুর্তেই সে নিজেকে সামলে নিয়ে ওই গয়নাটা বাইরে রেখে বাকি গয়নাগুলো বাক্সে ভরে আলমারিতে তুলে রাখে। এরপর এক মূহুর্তও দেরি না করে গয়নাটা নিয়ে সোনার দোকানে পৌঁছে যায়। পুরানো গয়নার পরিবর্তে দিয়ার পছন্দ করা দুলটা কেনার পরও তার হাতে কিছু টাকা থেকে যায়। দোকানিকে আর্যর ঠিকানাটা দিয়ে দুলটা ওই ঠিকানায় পার্সেল করে দিতে বলে ঘরে ফিরে আসে।
এবার? ছেলের টাকা আর সে নেবেনা এটা তো মনস্থির হয়ে গেছে। কিন্তু এরপর তার চলবে কিভাবে? ব্যাংক থেকে যে সামান্য টাকা ইন্টারেষ্ট-স্বরূপ হাতে আসে, তাতে তো তার মাস চলবে না। তাহলে এখন সে কি করবে? এই চিন্তায় দিন দুয়েক তার ভালো করে ঘুম হয় না। এক ভয়ানক অস্থিরতার মধ্যে দিন কাটে। তার খুব রাগ হয় নিজের ওপর। জীবনের মূল্যবান সময়গুলো যে কিভাবে নষ্ট করেছে, সেটা আজ সে উপলব্ধি করতে পারছে।
জীবনের ৬৫ বছর পার করে এসে আজ যেন তার নতুন করে জাগরণ হ'ল---- 'কেন আমি অন্যের উপর নির্ভরশীল? আমি নিজেও তো কিছু করতে পারি। এমন কিছু যাতে সবাই আমার নামেই আমাকে চিনবে। আমার বাবা, স্বামী বা ছেলের নামে নয়।
কিন্তু কী কাজ করবে সে এই বয়সে? কোথায় যাবে? কে তাকে কাজ দেবে? এই চিন্তায় যখন সে অস্থির, তখন ওপরওয়ালা যেন তার সমস্যার সমাধান করতে পাশের বাড়ির রমলাকে তার কাছে পাঠিয়ে দিলেন।
এর আগেও একবার রমলা দেবিকাকে বলেছিল তার দুই ছেলের পড়াটা যেন দেবিকা দেখিয়ে দেয়। তখন দেবিকা রাজি হয়নি। এবার রমলার আর্জিটাও জোরদার ছিল, আর দেবিকারও প্রয়োজন ছিল। রমলা এসে দেবিকাকে বলে, 'দিদি, এবার তুমি আর না বলতে পারবে না। আমার দুই ছেলেকে আমি অন্য কারো কাছে দিয়ে শান্তি পাবো না।একমাত্র তুমি ছাড়া আর কেউ ওদের সামলাতে পারে না। এতদিন আমি ওদের পড়াশোনা দেখে নিয়েছি, কিন্তু এখন আমি একটা চাকরি পেয়েছি, তাই ওদের পড়াশোনার জন্য ঠিকমতো সময় দিয়ে উঠতে পারবো না। তোমাকে ওদের পড়াশোনার দায়িত্বটা নিতেই হবে।'
দেবিকা যেন হাতে স্বর্গ পেল, সাথে মনে বল - ও। কিছু তো একটা কাজ পাওয়া গেল। এটা নিয়েই এগিয়ে যাওয়া যাবে। এই ভেবে শুরু হ'ল তার নতুন যাত্রা--- রমলার দুই ছেলেকে নিয়ে। এরপর ধীরে ধীরে কতগুলো বছর পেরিয়ে গেছে তা দেবিকার নিজেরই হিসেব নেই।
আজ সে 'দেবিকা ম্যাডাম' নামে পরিচিত। শুধু তাই নয়, তার সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে বেশ কিছু বয়স্কা মহিলা নিজের উপযুক্ত কিছু না কিছু কাজ করে নিজেরা স্বাবলম্বী হতে সফল হয়েছে।
আজ আর দেবিকার ছেলের প্রতি কোন রাগ বা অভিমান নেই। আজ তার এই সাফল্যের জন্য সে তার ছেলের কাছে কৃতজ্ঞ। সেদিন ছেলের 'কি করবে' প্রশ্নটাই আজ তাকে স্বাবলম্বী হতে সাহায্য করেছে। তাই আজ সে নিজের পরিচয়ে 'দেবিকা ম্যাডাম ' নামে পরিচিত।