ANURADHA BHATTACHARYA

Abstract Inspirational Others

4.0  

ANURADHA BHATTACHARYA

Abstract Inspirational Others

" অধিকার "

" অধিকার "

25 mins
311



 গল্পটা টক, ঝাল , মিষ্টি সম্পর্কের তিন প্রজন্মের এক সুন্দর পরিবার। পরিবারে ঠাকুমা নিতান্তই পুরানো দিনের মানসিকতার মানুষ। আজকের প্রজন্মের মেয়ে , নাত বৌ এর পোষাক , কাজ কর্ম, কথা- বার্তা কিছুই তার পছন্দ নয়। যদিও বর্তমান প্রজন্মের চাকুরীরতা নাত বৌ এর ঠাকুমার কোন কথা অথবা ব্যবহারে কিছু যায় আসে না। আর সে পুরানো মানসিকতার ঠাকুমাকে কোনভাবে অশ্রদ্ধা ও করে না। অন্যদিকে দাদু ততটাই রসিক প্রকৃতির এবং নাত বৌ এর সাথে দাদুর সম্পর্ক বেশ মিষ্টি মধুর।মাঝখানে মা , অর্থাৎ একজনের বৌমা , অন্য জনের শাশুড়ি মা , দুই বিরাট ব্যবধান প্রজন্মের মাঝখানে দাঁড়িয়ে , সবকিছু সামঞ্জস্য বজায় রাখতে একা হাতে  হাল ধরে সংসারের তরী বেয়ে চলেছেন ।    চলুন , এই তিন প্রজন্মের পরিবারের টক, ঝাল, মিষ্টি সম্পর্ক গুলো উঁকি দিয়ে দেখে একটু উপভোগ করা যাক।


     বিকেলের পড়ন্ত রোদে, বারান্দায় আরাম কেদারায় বসে দাদু একটা গল্পের বই পড়ছিলেন। রমলা , মানে ওনার ছেলের বৌ , বিকেলের চা নিয়ে এসে শ্বশুর মশাই কে দিতেই , তিনি উঠে বসলেন। চা নিয়েই আরাম কেদারার হাতলে চায়ের কাপটা রেখে জিজ্ঞেস করলেন , " তোমার শাশুড়ি কি এখনও ঘুমাচ্ছে ?"

--- না , মা উঠে পড়েছেন। এই তো চা দিয়ে এলাম।

--- আর আমাদের ছোট গিন্নি ? আজ অফিস ছুটি , তাই খুব ঘুমাচ্ছে বুঝি ! এই অফিস কাছারি করা মেয়েরা যে কি করে এত অলস হয় !

রমলা কিছু বলার আগেই ," কে অলস দাদু?" বলতে বলতে , ট্রক স্যুট, টি সার্ট পরিহিত নাত বৌ সীমা চা খেতে খেতে দাদুর পাশে এসে দাঁড়ায়। দাদু বেশ আয়েশ করে চায়ে এক চুমুক দিয়ে --- "ঐ এক চৌধুরী বাড়ির নাত-বৌ।"


সীমা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে , " চৌ - ধু - রী বাড়ির , - - - কোথাকার , কোন চৌধুরী বাড়ি ! ?" রমলা হাসি আড়াল করতে না পেরে নিজেকে সামলাতে তাড়াতাড়ি ঐ ঘর থেকে চলে যায়। হঠাৎ ই সীমার খেয়াল হয় , আর সাথে সাথে , " দাদু ভালো হবে না বলছি । আমি অলস ! আর নিজে কি ? নিজে তো সারাদিন একটা বই মুখের সামনে নিয়ে পড়ার ছল করে বসে বসে ঘুমাও । তার বেলা ?" 

---- তা আর কি করব বলো , তোমার মতো তো মুখে , চোখে আলু , শশা লাগিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা শুয়ে - বসে থাকতে পারিনা । আবার ঐ আঙ্গুলে কিসব লাগাও আর মুছে ফেল , ওসব ও পারিনা ।

সীমা কপট ধমক দিয়ে বলে , " হয়েছে হয়েছে । আমার অনেক গুনগান করেছ , এবার ওঠো , হাঁটতে যাবে না ? তাড়াতাড়ি চা শেষ করে ওঠো দেখি।চলো , হাটতে যাবে।"

----- চলো মানে ! তুমি ও যাবে নাকি আমার সাথে ?

 ----- কেন , গেলে খুব অসুবিধা হবে বুঝি ? তাহলে আমি জেনে যাব যে তুমি সত্যি সত্যিই হাঁটতে যাও নাকি পার্কে সুন্দরী মেয়েদের সাথে বসে বসে গল্প কর ।

----- কি ব্যাপার বলতো , তোমার ঠাকুমা কি তোমায় টিকটিকি নিযুক্ত করেছে নাকি ?

সীমা হাসতে হাসতে বলে , কেন ঠাকুমাকে ভয় পাও নাকি ?

---- তা একটু একটু পাই বই কি । বলে দুজনেই একসাথে হাসতে থাকে। 

 বলি ভর সন্ধ্যে বেলায় এত হাসাহাসির ঘটা কিসের ? আনন্দের বন্যা বইছে ! বলতে বলতে কত্তা মা , মানে বাড়ির মাথা ,ঠাকুমা এসে সোফায় বসে ,----- " মেয়ে মানুষের , বিশেষ করে বাড়ির বৌ এর , এত জোড়ে জোড়ে হাসা শোভা দেয় না। আজকালকার মেয়েদের সহবৎ শিক্ষা বলে কিছুই নেই। দু পাতা পড়াশোনা করে আর দুটো টাকা রোজগার করে যেন সবার মাথা কিনে নিয়েছে।"

কথাগুলো যে নাত -বৌ কে উদ্দেশ্য করে , সেটা বুঝতে কারুর ই বাকি থাকে না।তবু নাত- বৌ কোন উত্তর না দিয়ে , দাদুর কানের কাছে খুব ধীরে " শুরু হোল " বলে মৃদু হেসে ধীর গতিতে ঘর থেকে বেড়িয়ে যায় । নাত -বৌ বেড়িয়ে যেতেই দাদু , ঠাকুমার দিকে ফিরে --- "দুপুরের ঘুমটা ঠিক ঠাক হয়নি বুঝি?"

----- না , ঘুম ভালোই হয়েছে । হঠাৎ এ প্রশ্ন  কেন করলে ?

------ আমাদের হাসিতে যেভাবে তোমার মেজাজ বিগড়ে গেল , তাতে মনে হলো তোমার ঘুমটা আমাদের হাসির আওয়াজে ভেঙে গেছে ।

----- না , ঘুম আমার অনেক আগেই ভেঙেছে । তারপর একটু শুয়েই ছিলাম।

----- তা মেয়েটার উপর অমন রেগে গেলে কেন ? আমি ই তো ওর সাথে একটু মজা করছিলাম।

----- ওর ঐ জামা-কাপড় পড়ার ছিরি দেখলে আমার মাথা গরম হয়ে যায়। বেহায়া মেয়েছেলে । শাড়ি তো পড়েই না , দিনরাত দাদুভাই এর জামা কাপড় পড়ে বসে থাকে ।কেন , ওর কি নিজের কোন জামা কাপড় নেই?

    রান্না ঘর থেকে বেড়িয়ে এসে চায়ের খালি কাপ গুলো নিতে নিতে রমলা শান্ত স্বরে বলে , ওগুলো আপনার দাদুভাই এর জামা কাপড় নয়। ওগুলো ওর ই।

---- "ওগুলো ওর ই ! " --- কেন , বাড়ির বৌ, শাড়ি পড়তে পারে না ? যত্তসব । তোমাকেও বলিহারি যাই বৌমা , তুমি তোমার বৌ কে কিছু বলতে পার না ? 

" তুমি ভেতরে যাও বৌমা , তোমার কাজ করগে।" -- বলে ,দাদু বৌমাকে ভেতরে পাঠিয়ে দিয়ে , ---- " আজকাল কার মেয়েরা শাড়ি সামলাতে পারেনা, তাই পড়েনা। তুমি ও তো আজকাল শাড়ি সামলাতে পারছোনা। এদিক ওদিক দিয়ে বার বার খুলে যায়। তুমি ও তো ঐ সব জামাকাপড় পড়তে পার।"

---- মরণদশা , আমি শার্ট প্যান্ট পড়ব!

---- আহা, শার্ট প্যান্ট পড়বে কেন ? ঐ যে ওপর থেকে নীচে পর্যন্ত ঢোলো ঢোলা জামা পড়ে না?। ট্যাক্সি না ম্যাক্সি, কিসব বলে যেন ওগুলো কে ।

-----  আ মোলো যা । বুড়ো বয়সে ভীমরতি হয়েছে !

----- আরে ওগুলো পড়লে হাঁটতে চলতে অনেক সুবিধা হবে। এখন তো প্রায় ই কাপড় পায়ে আটকে হোঁচট খেয়ে পড়ে যাও।

------ ঠাকুমা বেশ রেগে গিয়ে , " হাঁ, তাই তো , আমি হোঁচট খেয়ে পড়ে যাই ! তাই না? আমার হাঁটুর ব্যাথাটা বাড়লে তখন আমার হাঁটতে কষ্ট হয় ।তখন কখনো সখনো পড়ে যাই।

----- আহা হা, রাগ করো কেন গিন্নি ? আমি তো তোমার ভালোর জন্যই - - -

--- একি দাদু , তুমি এসময় ঘরে! আজ হাঁটতে যাওনি ? ----- বাইরে থেকে আড্ডা দিয়ে ফিরে ঘরে পা রেখেই নাতি দিব্য দাদুকে ঘরে দেখে অবাক হয়ে যায়।

----- হাঁটতে যাইনি বলেই তো এখন আমায় ঘরে দেখতে পাচ্ছ ।

----- কি ব্যাপার ! শরীর ভালো তো ?

----- হুঁ উউ। একদম ঠিক। তা তুমি এখন কোথা থেকে রাজত্ব জয় করে এলে শুনি ?

---- এই বন্ধু দের সাথে একটু আড্ডা মেরে এলাম ।

ঠাকুমা অবাক হয়ে বলে , " আজ তো রবিবার নয় ! আজ তোদের অফিস ছুটি ছিল?

---- হাঁ, শুধু আমার নয় , আজ সবার অফিস ই ছুটি।

----- তোর বউ এর অফিস ও ছুটি ছিল ?

----- হাঁ , কেন ?

---- তাকে বিকেলে নীচে দেখে আমি ভাবলাম সে আজ অফিস থেকে তাড়াতাড়ি চলে এসেছে ।তার অফিস ছুটি ছিল অথচ তাকে তো সকাল থেকে একবার ও নীচে দেখলাম না ?

----- তোমার তার সাথে কোন স্পেশাল কাজ আছে নাকি ? তাহলে ওকে নীচে পাঠিয়ে দিচ্ছি। বলে ঠাকুমার গালদুটো ধরে আদর করে ওপরে চলে যায়। কিন্তু তাতে ঠাকুমার মন গলে না। চিৎকার করে ডাকে , "বৌমা- -" রমলা তাড়াতাড়ি ছুটে আসে ।" মা ডাকলেন?"

---- ডেকেছি সেই শুনেই তো এলে বাছা । আবার প্রশ্ন করা হচ্ছে --"ডাকলেন ?" বলি তোমার ছেলের বৌ আর কতদিন এমন পাটরানী হয়ে থাকবেন শুনি ?

---- কেন মা ! কি হয়েছে ?

----- বলি , আজ তার অফিস ছুটি ছিল ।অথচ সারাটা দিন নীচে তার টিকিটাও দেখা যায়নি।তা তুমি কি তোমার বৌমাকে এমন শো কেসেই সারাটা জীবন সাজিয়ে রাখবে ! নাকি সংসারের কাজ কর্ম কিছু শেখাবে , করাবে ?

---- সংসারের কাজ তো ও করে মা !

----- সংসারের কোন রাজ কাজটা সে করে শুনি ? আজ অফিস ছুটি ছিল। তিনি সারাদিন বাড়ির কোন কাজটা করলেন শুনি ? বাড়ির বৌ , একটা দিন তো রান্না ঘরে ঢুকতে ও দেখিনা ।আদৌ রান্না- বাড়ি করতে জানে কিনা কে জানে ! অফিস করে যেন উদ্ধার করছে।

----- মা , আজকের মুড়ো ঘন্টটা তো আপনার খুব ভালো লেগেছে বললেন। ওটা কিন্তু আপনার নাত -বৌ রেঁধেছে।

ঠাকুমা চোখ বড় বড় করে রমলার দিকে তাকিয়ে , সে আবার নীচে নামলো কখন ,যে রান্না করল? তুমি কি আমায় বোকা পেয়েছ ?

রমলা মৃদু হেসে , " আপনি ভেতরের ঘরে টিভি দেখছিলেন , তাই টের পাননি।

----- ঠিক আছে , হয়েছে হয়েছে। এবার থেকে একটু শক্ত হও।ওকে দিয়ে সংসারের কাজকর্ম করাও। শুধু অফিস করলেই হবেনা , সংসার টাও তো বুঝতে হবে , জানতে হবে।

এরই মধ্যে দিব্য আর সীমা সেজেগুজে নীচে আসে ।ওরা কোথাও বেরুচ্ছে।সীমা তার শাশুড়ির উদ্দেশ্য " মা , আমরা আসছি ।"

বেশ অসন্তুষ্ট হয়ে ঠাকুমা , " আমরা আসছি ! বলি ভর সন্ধ্যে বেলায় কোথায় যাওয়া হচ্ছে শুনি ?" সাথে সাথে দাদু , " ওরা স্বামী স্ত্রী কোথায় যাচ্ছে , তা দিয়ে তোমার কি দরকার ? তুমি যাবে ওদের সাথে ?" তারপর , নাতি, নাত বৌ কে --- "তোমরা দাঁড়িয়ে রইলে কেন ? তোমরা এস ।" দিব্য আর সীমা বেড়িয়ে গেলেই ঠাকুমা হঠাৎ করে , --- " আচ্ছা বৌমা , খোকা আর দাদু ভাই এর রোজগারে আমাদের সংসার চলে না ?" রমলা আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করে , " কেন মা ! হঠাৎ এ প্রশ্ন ?"

--- না , তাহলে নাতবৌ এর চাকরী করার কি দরকার ? ঘরের বৌ , ঘরে থাকবে, ঘরের কাজ করবে তা নয় , দিনরাত ঘরের বাইরে।

----- মা , সীমা আজকের যুগের মেয়ে। এখনকার মেয়েরা কেউই ঘরে বসে থাকে না। এখন সব মেয়েরাই নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য কিছু না কিছু কাজ কর্ম করেই। দেখছেন না , পাশের বাড়ির মিতাকে , মাধ্যমিক পাশ করে আর পড়াশোনা করলনা । অথচ ও তো ঘরে বসে নেই। সেলাই করতে ভালোবাসে , তাই বুটিক খুলে কেমন রোজগার করছে । সাথে সাথে আরো দুটো মেয়েকেও কাজ দিয়েছে। আর আপনার নাতবৌ তো কতদূর পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে , সেটা কি শুধু ঘরে বসে রান্না করে নষ্ট করবে !

----- "তুমি ওদের মতো রোজগার করতে পারো না বলে আফশোষ হয় বুঝি? "। দাদু এতক্ষন চুপচাপ বসে শুনছিল , এবার আর চুপ থাকতে পারলো না । বলে উঠল---- "আফশোষ হতেই পারে । তুমি ওর বিয়ের পর জোর করে ওর চাকরী ছাড়িয়ে দিয়ে ওকে ঘরে বসিয়ে দিয়েছ । সেদিন ও তোমাকে  মর্যাদা দিতে চাকরী ছেড়ে দিয়ে শুধু সংসার নিয়ে পড়ে রয়েছে । তাই বলে মনে করোনা যে ও তোমার এই মতামত কে মন থেকে মেনে নিতে পেরেছে । আর মেনে নিতে না পারাটাই স্বাভাবিক। এখন চাইছ নাতবৌ ও চাকরী ছেড়ে ঘরে বসে তোমাদের মতো শুধু ঘর সংসার নিয়ে পড়ে থাকুক।সে আজকালকার মেয়ে । তোমার এই অন্যায় আবদার সে কখনো ই মেনে নেবেনা।আর সেটার চেষ্টা ও কোর না।" ঠাকুমা বেশ অসন্তুষ্ট হলেও বুঝতে পারল যে এ ব্যাপারে তার মতামত আর খাটবে না।


পরদিন সকালে অফিস যাওয়ার ব্যস্ততা। দাদু যথারীতি তাঁর আরাম কেদারায় বসে খবরের কাগজ পড়ছেন ।ঠাকুমা ও তার পানের ডাব্বা নিয়ে সোফায় বসে মৌজ করে পান সাজছেন। রমলা রান্না করতে করতে বাইরের ঘরের দোর গোড়ায় এসে দুধ ওয়ালার থেকে দুধ নিচ্ছে , ঠিক , এমন সময়ই ভেতরের ঘর থেকে রমলার স্বামী শোভনের চিৎকার , " রমলা , আমার অফিসের দেরী হয়ে যাচ্ছে , এই সময়টা তুমি কোথায় থাকো ? আমার রুমাল , মোজা কিছুই তো দেখতে পাচ্ছি না ।" রমলা দুধ নিতে নিতে আওয়াজ দেয় --- "সবই তো খাটের উপর রেখে এসেছি ।" তারপর মনে পড়ে , রোজ যেখানে রাখে আজ সেখানে না রেখে অন্যদিকে রেখেছে । তাই একটু জোড়ে বলে ---" তাকিয়ে দেখ ওখানেই পেয়ে যাবে ।" বলে দুধ নিয়ে রান্না ঘরে চলে যায়। ইতিমধ্যে দিব্য আর সীমা ও অফিস যাবার প্রস্তুতি নিয়ে ওপর থেকে নীচে নেমে আসে। দিব্য সীমাকে জিজ্ঞাসা করে , " আমার এটিএম কার্ড গুলো কাল বাইরে বার করে রেখেছিলাম , তুমি ওগুলো আমার পার্সে ভরে দিয়েছ তো ?"

----- হাঁ , দিয়েছি ।

----- আর আমার অফিসের ফাইলগুলো ?

---- ওগুলোও তোমার অফিসের ব্যাগে দিয়ে দিয়েছি । আচ্ছা , নিজের কাজগুলো নিজে গুছিয়ে করে নিতে পারনা ?একগাল হেসে দিব্য বলে , " তাহলে তুমি আছ কি করতে ?"

----- খুব মজা না ! সব সময় তোমার সব কাজ আমাকেই কেন করে দিতে হবে ? তুমি তো কখনও আমার কোন কাজ করে দাও না !

এতক্ষন ঠাকুমা একভাবে নাতবৌ কে দেখে যাচ্ছিল ।এবার এক খিলি পান মুখে দিয়ে , ---- " তোমার কাজ দাদুভাই কেন করে দেবে ? স্ত্রী দের কর্তব্য স্বামী দের কাজ করে দেওয়া ।দেখনা তোমার শাশুড়ি কে ? তোমার মা কে দেখনি , তোমার বাবার কাজ হাতে হাতে করে দিতে?" 

----- ওগুলো তোমাদের যুগের নিয়ম।ওসব নিয়ম এখন চলে না । তোমার কি আনতে হবে সেটা বল ।জর্দা ফুরিয়ে গেছে, তাই না?

---- হাঁ , তাতো ফুরিয়েছে । কিন্তু তুমি আনবে ? থাক, দাদুভাই নিয়ে আসবে ক্ষন ।

---- তোমার দাদুভাই ! একটু হেসে, বেশ তাই হোক । দেখি কেমন মনে করে নিয়ে আসে ।মা, আমরা আসছি ।

রমলা তাড়াতাড়ি রান্না ঘর থেকে বেড়িয়ে এসে, দিব্য তোকে মাসকাবারীর লিস্ট টা দিয়ে দেব , দোকানে দিয়ে যাবি ?

----- তুমিও যেমন মা , ওকে দিলে সেটা কবে দোকানে পৌঁছাবে তার ঠিক আছে ? লিস্ট টা আমি নিয়ে নিয়েছি।

ইতিমধ্যে শোভন ও অফিস যাবার জন্য তৈরি হয়ে এসে যায়। তিন জন একসাথে " আমরা আসছি " বলে বেড়িয়ে যায় । রমলা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দুই হাত কপালে ঠেকিয়ে " দূগ্গা দূগ্গা" করে যতক্ষণ দেখা যায়, দাঁড়িয়ে থাকে । তারপর দরজা বন্ধ করে ঘরের ভেতর আসতেই দাদুর প্রশ্ন , " বৌমা , দিদিভাই কে আনতে যাবার কি ঠিক হ'ল?"

---- দিয়া তো এখন আসতে পারবে না বাবা ।

---- কেন ? এখন ই তো আসার কথা ছিল। প্রথম বাচ্চা , সে তো বাপের বাড়িতে ই হয়।

----- হাঁ , কিন্তু ডাক্তার দিয়াকে বেড রেস্ট বলেছে ।তাই ও আসতে পারছে না। এবার ঠাকুমা প্রায় তেড়েফুঁড়ে উঠলেন। " এই হয়েছে আজকালকার ডাক্তার দের ন্যাকামো। আমাদের সময়, আমরা বাচ্চা হবার আগে পর্যন্ত দুনিয়ার কাজ কর্ম করেছি ।আর এখন , পোয়াতি হতে না হতেই ডাক্তার বেডরেস্ট বলে দেয় । বুঝিনা বাপু আজকালকার কি যে সব চিকিৎসার ছিরি !"

---- না মা , দিয়ার অনেক কমপ্লিকেশন আছে , তাই ডাক্তার বেড রেস্ট বলেছে ।

------ ও তো একাই থাকে ।জামাই অফিস চলে গেলে ওকে দেখার তো কেউ নেই ।তাই ওর তো এখানে এসে থাকাই ভালো ছিল ।

------ কিন্তু বাবা , এখন তো ওকে এতটা জার্নি করতে দিচ্ছে না।

----- তাহলে ওর বেড রেস্ট টা হবে কি করে ? বলে ঠাকুমা প্রায় ধমকেই উঠলেন।

----- এখন ওর শাশুড়ি এসেছেন । ডেলিভারির সময় আমি যাব । ততদিন ওর শাশুড়ি ওর কাছে থাকবেন।

----- তুমি যাবে ? তাহলে আমাদের সংসার চলবে কি করে ?

------ কেন মা , সীমা তো থাকবে।

----- সীমা ! ও দেখবে সংসার ! ও তো ঘরেই থাকে না । এবার দাদু মুখ খুললেন ।" চাকরী করে কি কেউ সংসার করে না ? আজকাল সব মেয়েরাই চাকরী করে সংসার করে ।ও আমাদের মহারানী ও ঠিক পারবে ।

------ হুঁ , কি যে পারবে জানা আছে । আচ্ছা বৌমা , নাতবৌ এর বাচ্চা কাচ্চা কিছু হবেনা নাকি ? আচমকা এমন একটা প্রশ্নে রমলা বেশ হকচকিয়ে গেল।অবাক হয়ে শাশুড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। ঠাকুমা বলেই চলল , " দিয়া দিদিভাই এর বিয়ে হয়েছে বছর দুয়েক ।সে মা হতে চলল। আর নাত বৌ তো বিয়ে হয়ে এবাড়িতে এসেছে তা প্রায় সাড়ে তিন বছর হতে চলল। তুমি বরং ওকে ডাক্তার দেখাও " ।

---- মা , এটা ওদের নিজস্ব ব্যাপার। এ ব্যাপারে আমাদের কথা বলাটা ঠিক হবেনা। আর তাছাড়া এত তাড়াহুড়ো করারই বা কি আছে ?

----- তাড়াহুড়ো ! তিন বছর পর , এখনও সময় হয়নি বলতে চাও ? না কি আমি বলছি তাই তুমি বলবে না ?

----- মা - - -

----- থাক , বুঝেছি । তোমায় চাকরী করতে দিইনি বলে , তুমি তোমার চাকরী করা বৌমা কে সব সময় সাপোর্ট করে আমার উপর শোধ নিতে চাও ।

----- বৌমা কিছু পুড়ছে মনে হচ্ছে , বলে দাদু নাক টানে।

---- কিন্তু আমি তো রান্না ঘরে গ্যাস অফ করে এসেছি বাবা ।

------ গ্যাস অফ করে এসেছ বুঝি ? ও ও ও তাহলে বোধহয় এ ঘরেই কিছু পুড়ছে।

দাদুর ব্যঙ্গ বুঝতে পেরে ঠাকুমা রেগে যায় । "তুমি সব সময় আমায় ব্যঙ্গ করবে না তো।" 

---- তুমি ও একটু বুঝতে চেষ্টা কর । তুমি দাদুভাই কে এত ভালোবাসো অথচ ও যাকে ভালোবাসে তুমি তাকে সহ্য করতে পারনা। এটা কি তোমার দাদুভাই এর ভালো লাগছে ? একসময় দেখবে যে তোমার দাদুভাই এর মন থেকে তুমি দূরে সরে গেছ।

---- মা , সীমা অফিস করলেও ঘরের কাজকর্ম ও করে।

---- তুমি আর ওর হয়ে কথা বোলোনা বৌমা । ঘরের কোন কাজ টা করে শুনি ? একটা ছুটির দিনে রান্না ঘরেও তো যেতে দেখিনা

---- রান্না ছাড়া কি সংসারে আর কোন কাজ নেই মা ? বাবার বা আপনার এতটুকু শরীর খারাপ হলে আপনার ছেলে বা নাতির আগে ওই তো খেয়াল করে ডাক্তার ডাকা , ওসুধ আনা - - - সব নিজেই করে । সংসারে কখন কোন জিনিসটা দরকার , ওর নজর এড়ায় না । ইলেক্ট্রিকের বিল , বাড়ির ট্যাক্স ভরা , এগুলো তো আপনার ছেলে বা নাতির কাজ ? সেটাও সময়মতো সীমা ই মনে করে ভরে । বাড়ির রেশন , মাসকাবারি মাল , কোন কিছুই তো আপনার ছেলে বা নাতি কখনো জিজ্ঞাসা পর্যন্ত করেনা আনতে হবে কিনা । সেসব দায়িত্ব তো ও নিজেই পালন করে ।

---- তুমি শুধু শুধুই মহারানীর উপর রাগ কর গিন্নি। রান্না করে না বটে , কিন্তু আমাদের নজরে পড়েনা এমন কত সংসারের প্রয়োজনীয় কাজ ও চুপচাপ করে চলেছে , দেখ তো।

---- বুঝেছি বুঝেছি , ও মেয়ে তোমাদের জাদু করেছে ।

---- দাদু একগাল হেসে , " তুমি কি ফল খেয়ে বসে আছ বলো তো ! যে তোমাকে এখনো পর্যন্ত জাদু করতে পারলো না ? "

দাদু র কথা শুনে সবাই হেসে ওঠে। রমলা জিজ্ঞাসা করে , " মা ,এখন আর একবার চা খাবেন ? বানাবো ?

---- হাঁ , তোমাদের দুজনের বক্তৃতায় আমার মাথাটা ভারী হয়ে গেছে। একটু চা হলে ভালোই হয়।


এই ভাবেই সময় এগিয়ে চলে। সেদিন ছিল ঠাকুমার জন্মদিন। রাত্রে খাওয়াদাওয়া সারা হলে দিব্য ঠাকুমা কে জিজ্ঞাসা করে , " কি ঠাকুমা , জন্মদিনের খাওয়া ঠিক ঠাক ছিল তো ? তোমার পছন্দ হয়েছে?

---- হাঁ , খুব ভালো ছিল। পায়েসটা আজ তোর মা দারুন বানিয়েছিল ।

---- ওটা আমি বানাই নি মা , আজ পায়েস সীমা বানিয়েছে ।

---- সীমা ! ও আবার এত সব বানাতে শিখলো কবে?

--- পায়েসটা সীমা বরাবরই ভালো বানায় মা।


  ইতিমধ্যে সীমা দাদুর ওসুধ আর ঠাকুমার জন্য পান নিয়ে এসে --- দাদু এই নাও তোমার ওসুধ। -- বলে দাদুর হাতে ওসুধ আর জলের গ্লাস ধরিয়ে দেয়। দাদু ওসুধ টা হাতে নিয়ে একভাবে সীমার দিকে তাকিয়ে থাকে।

--- কি হোল ওসুধ টা খাও 

--- আজ এত ভালো মন্দ খাওয়ার পর এই ওসুধটা না খেলেই নয়?আজ একটা দিন নাহয় ওসুধ নাই খেলাম।

---- কোন কথা না বলে চুপচাপ ওসুধটা খেয়ে নাও।

সীমার কাছে পার পাবেনা জানাই ছিল।তাই দাদু "অগত্যা " বলে ওসুধটা খেয়ে জলের গ্লাস সীমার হাতে ফেরত দেয়। এবার সীমা ঠাকুমা কে পান দিয়ে ---- দিব্য, সামনের মাসে বাবা- মা'র বিবাহবার্ষিকী টা এবার বাইরে কোথাও গিয়ে মানালে কেমন হয়? 

-- তুমি পারোও বৌমা, একটা অনুষ্ঠান শেষ হতে না হতেই আর একটার চিন্তা শুরু? --- হাসতে হাসতে শোভন বলল।

উত্তরে সীমা বলল, অনেক দিন তোমরা কোথাও বাইরে যাওনি। মা ' র তো কোথাও বেরুন ই হয়না। তাই ভাবছিলাম ---

এই বেড়াতে যাওয়ার কথার মাঝে ঠাকুমা হঠাৎ ,--- নাত বৌ , এই জর্দ্দা টা কি নতুন? 

--- হ্যাঁ ঠাকুমা, কেন ভালো না?

--- না, ভালো ই । কোন দোকান থেকে এনেছ? 

দাদু অমনি ফুটকাটে -- কেন তুমি যাবে সেই দোকানে জর্দ্দা কিনতে?

সীমা হাসতে হাসতে ঠাকুমার কাছে এগিয়ে গিয়ে জর্দ্দার কৌটোটা ঠাকুমার হাতে দিয়ে, --- এই নাও ।এটা তোমার জন্মদিনের উপহার।

হ্যাঁ, ভালো কথা, দাদু-ঠাকুমার তো পিসির কাছে যাবার আছে । দিব্য তুমি কিন্তু টিকিট টা এখন ই কেটে রেখ, তবে মা - বাবার বিবাহবার্ষিকী র পরে যে কোন তারিখে।

শোভন বলে , আমাদের বিবাহবার্ষিকী র অনেক দেরি, দিব্য তুই বরন্ঞ্চ আগামী মাসের টিকিট করে তোর পিসিকে জানিয়ে দে যে টিকিট হয়ে গেছে। ও অনেক দিন ধরেই অস্হির হয়ে আছে বাবা - মা ওর কাছে কবে যাবে জানার জন্য।

এমন সময় দিব্যর ফোনে একটা ফোন আসে ।দিব্য কথা বলতে বলতে একটু দূরে চলে যায়। কিন্তু কথার কিছু আভাষ এই ঘর থেকে পাওয়া যায়।সকলেই বুঝতে পারে কোথা থেকে ফোন এসেছে।দিব্য কথা শেষে ফোন বন্ধ করে ঘরে এলে দাদু জিজ্ঞাসা করে, কার ফোন ছিল?নাত জামাই এর?

শোভন ---- কি বলল, সব ভালো তো? হঠাৎ এত রাতে ফোন করল?

রমলা অস্হির হয়ে --- দিয়া ঠিক আছে তো? 

--- বলছি , বলছি । দিয়া ঠিক আছে। কিন্তু একটা প্রবলেম হয়েছে। রজতের বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় মাসিমা মানে রজতের মা কে এখন ই ফেরত চলে যেতে হবে।তাই রজত বলছিল মাকে যদি আমরা এখন ই পাঠিয়ে দিতে পারি তাহলে খুব ভালো হয়।

শোভন জানতে চায়, রজতের বাবার কি হয়েছে ? 

--- অত বিস্তারিত কথা হয়নি , শুধু মা'র এই মুহূর্তে ওখানে যাওয়া সম্ভব কিনা---

শোভন রেগে যায়। বলে, --- কোন কান্ডজ্ঞান নেই । মানুষটার কি হয়েছে, কতটা অসুস্হ, বাড়িতে না হাসপাতালে , জিজ্ঞাসা করলে না? 

দাদু শোভনকে থামিয়ে দিয়ে বলে।শান্ত হও । ওগুলো তুমি কাল ফোন করে জেনে নিও।এখন বরং তোমাদের ওখানে যাবার কি করবে সেটা ভাবো।

সীমা সাথে সাথে ফোন নিয়ে বসে যায়, বলে --- আমি দেখছি ।

শোভন দিব্যকে বলে , তুমি কিন্তু বাবা-মা র তোমার পিসির ওখানে যাবার ব্যবস্থা টা করে দিও।

দাদু বলে , সে হবে খন। আমাদের যাওয়াটা অত জরুরি নয়।

এর ই মধ্যে সীমা বলে কাল রাতে র রিজার্ভেশন পাওয়া যাচ্ছে। এরপর চারদিন সব ভর্তি, কোন রিজার্ভেশন নেই। তোমরা চারদিন বাদে যাবে না কি কালকের টিকিট ই করবো?

দাদুর মত অনুযায়ী পরের দিনেরই টিকিট করা হোল এবং তারপর সবাই শুতে চলে গেল।


শোভন রমলাকে দিয়ার কাছে রেখে দুদিন পরেই ফেরত চলে এসেছে। তারপর দাদু-ঠাকুমাও চলে গেছে পিসির বাড়ি।এখন সীমার সংসার। একা হাতে সংসারের যাবতীয় কাজ সেরে, অফিস, দোকান বাজার সব সামলাচ্ছে।

এমন ই একটা সকালে, সীমা যখন রান্না ঘরে রান্নায় ব্যস্ত , দিব্য নিচে এসেই ---কি ব্যাপার! আজ এখনও চা পেলাম না? আজকের চা টা কি ভাতের সাথে খাবো ?সীমা বেশ শান্ত হয়েই --- একদিন খেয়েই দেখ , কেমন লাগে । দিব্য অসন্ত্তুষ্ট হয়ে বলে "মানে "! সীমা হাতের কাজ সারতে সারতে বলে--- বাবার তো সকাল থেকে দুবার চা খাওয়া হয়ে গেল। তোমার ঘুম না ভাঙলে আমি কি করতে পারি? বলে, দিব্যকে এক কাপ চা দেয় ।

---আমি ঘুমাচ্ছিলাম তো কি হয়েছে?ওপরে গিয়ে আমায় ডেকে তুলে চা দিয়ে আসতে পারনি? রান্না ঘরের কাজ করতে করতে,সীমা

----সকালে আমার অতো সময় হয় না।

----- কি এমন কাজ করো যে কথায় কথায় বলো 'সময় হয় না?'

---- কি করি , সেটা যদি চোখ থাকতেও না দেখতে পাও তো কি করবো বল?

দিব্য চা খেতে খেতে কাগজ পড়ছিল ।ডোর বেল বাজতে সীমা রান্না ঘর থেকে বলে ---

দেখনা কে এসেছে।

----আমি পেপার পড়ছি। তুমি দেখ।

-----আমি মাছ কাটছি, দুটো হাত ই আটকা।প্লিজ দেখনা।

দিব্য বিরক্ত হয়ে উঠে গিয়ে দরজা খোলে ,

----- পেপারের টাকা নিতে এসেছে।

----- টেবিলের উপর রাখা আছে দিয়ে দাও ।

দিব্য খুব বিরক্তি সহকারে পেপারের টাকা টা দিয়ে আবার কাগজ নিয়ে বসে ।এমন সময়, 

----- কলে জল নেই , পাম্পটা চালিয়ে দেবে?

---- আমি পেপার পড়ছি , পারবোনা। নিজে গিয়ে চালিয়ে এস।

সীমা বিরক্ত হয়, ----কোন একটা কাজে সাহায্য চাইলে পাওয়া যায় না---বলতে বলতে রান্না ঘর থেকে বেড়িয়ে গিয়ে পাম্প চালিয়ে আবার রান্না ঘরে চলে যায়।

পেপার পড়তে পড়তে দিব্য ---- ঠাকুমা ঠিকই বলে, তোমার দ্বারা সংসারের কোন কাজ ই হবে না।মা তো সব কাজ একা হাতেই করে। তোমার সব কাজে এত সাহায্য চাই কেন? 

---- মা সারাদিন ঘরে থেকেই সব কাজ করে। আমাকে সময়ের মধ্যে কাজ সেরে অফিস যেতে হবে।

----- অফিস যেতে হবে তো যাও। বলে পেপারটা ছুঁড়ে ফেলে ওপরে চলে যায়।

সীমা রান্না বসিয়ে বাইরের ঘরে এসে পেপারটা গুছিয়ে রাখে। সোফার চাদর , টেবিল পরিস্কার করে।এমন সময় দিব্য নীচে এসে বেশ রাগের সাথে --- আমার একটা সার্ট প্যান্ট ও প্রেস করা নেই। আমি কি পড়ে অফিস যাবো?

আজকের মতো একটা সার্ট প্যান্ট প্রেস করে নাও। আমি একদম সময় পাইনি। রবিবার সবগুলো প্রেস করে রাখবো।

----তোমার সময় হয়না তো দোকানে তো প্রেস করতে দিতে পারো!( আওয়াজ উঠতে থাকে )

---- সেটা তো তুমিও করতে পারো। তোমার অফিস যাবার পথেই তো পরে দোকানটা।

---- এইসব কাজগুলো এখন আমায় করতে হবে ? সংসারের কোন দায়-দায়িত্ব ই ঠিক করে পালন করতে পারো না?

----- সংসার টা কি আমার একার? আর কোন দায়িত্ব টা আমি পালন করি না?

---- দুধ নেওয়া, পাম্প চালানো, খাবার জল ভরা, পেপার ওলাকে পয়সা দেওয়া , জামা-কাপড় প্রেস করা , এগুলো আমার কাজ?

-----ইলেক্ট্রিকের বিল ভরা, বাড়ির ট্যাক্স ভরা, বাজার করা ,দাদু-ঠাকুমার ওসুধ আনা, এগুলো ও তো তোমার কাজ নয়, তাই না?

--- না, এগুলো ও আজকাল মেয়েরাই করে ।

----তাই বুঝি? তাহলে সংসারে ছেলেদের কাজ কি ? শুধু খাওয়া, আড্ডা মারা আর হুকুম করা , তাই তো?

----সীমা বড় বেশি বলছ না কি?

এবার ধীরে ধীরে পরিস্থিতি বদলে ঝগড়া চরমে উঠতে থাকে।

---শুনতে খারাপ লাগছে , তাই না? অফিস তুমি ও কর, আমিও করি। সারাদিন পর তুমি অফিস থেকে ফিরলে তোমার মুখের সামনে জল, চা পেয়ে যাও । তুমি আয়েস করে বসে চা খেতে খেতে টি ভি দেখ।আর আমি ! অফিস থেকে ফিরেই রান্না ঘরে ঢুকে তোমার জন্য চা বানাতে হয়।এক গ্লাস জল ও তো কখনো হাতে করে কেউ দেবার নেই।তারপর রান্না সেরে তোমার পরের দিনের অফিসে পড়ে যাবার জামা-কাপড় প্রেস করে রাখতে হবে। তোমার খাওয়া হয়ে গেলে সেইএ বাসনগুলো নিয়ে রান্নাঘরের বেসিনে রাখতে হবে।

---অনেক ফালতু বকবক করেছ, এবার থামবে?

-----কেন সত্যি কথাগুলো শুনতে খারাপ লাগছে?

---- ফালতু কথা বন্ধ করে আমার একটা সার্ট প্যান্ট প্রেস করে দাও। অফিস যেতে হবে।

---পারবো না। নিজে করে নাও ।

---- মানে !

----- মানে , আমার এখন সময় নেই। আমাকেও অফিস যেতে হবে।

--- আর আমার অফিস যাবার নেই? আমি কি পড়ে অফিস যাবো? একটাও জামা-কাপড় প্রেস করে রাখোনি।

---- এটাতো কাল রাতেই ভাবা উচিত ছিল।এখন হয় নিজে প্রেস করে নাও নাহলে প্রেস ছাড়া জামা পড়েই অফিস যাও। এখন প্রেস করত বসলে আমার অফিসের দেরি হয়ে যাবে।

---- সংসার সামলে যদি অফিস করতে না পারো তাহলে চাকরি ছেড়ে দাও।

এবার সীমার ধ্যৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে যায়। সে রুখে দাঁড়ায়।

----- কি বললে , চাকরি ছেড়ে দেব !

---- হ্যাঁ, চাকরি করে যখন সংসার সামলাতে পারছ না, তখন চাকরি ছেড়ে দাও।

--- এত খরচা করে পড়াশোনা শিখেছি কি শুধু হেঁসেল ঠেলবার আর বসে বসে তোমার হুকুম তামিল করার জন্য? সংসারে আমার যতটুকু করার আমি তার সবটাই করি। সংসারের কোন দায়িত্বটা তুমি পালন কর?

---ঠাকুমা ঠিকই বলে, আজকালকার মেয়েরা চাকরি করে ধরাকে সরা জ্ঞান করে।

----ঠাকুমা পুরোনো দিনের মানুষ। আজকের সময়ের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেন না। তাঁর কোন বিরূপ মন্তব্যে আমি কিছু মনে করি না। কিন্তু তোমার চিন্তা ধারা টা কোন যুগের !

---- কোন্ যুগের মানে ? আমি কি এ বাড়ির চাকর? তুমি আমায় হুকুম করবে জল ভরে দিতে , পাম্প চালাতে , এখন বলছ জামা-কাপড় প্রেস করে নিতে !

---ঘরের ছোট খাটো একটা দুটো কাজে সাহায্য করলে বাড়ির চাকর হয়ে যায় না। আর জামা-কাপড় প্রেস করার মতো নিজের কাজ নিজের ই করে নেওয়া উচিত।এতে কেউ ছোট হয়ে যায়না, এটা কোন অসম্মানের কাজ নয়। তোমার মার উচিত ছিল ছেলেবেলা থেকেই এইসব নিজের কাজ নিজেকে করতে শেখানো।

 সীমার কথা শেষ হতে দেরি দিব্য সীমার হাত ধরে এক টান দেয়, সীমা গিয়ে পড়ে টেবিলের উপর, সীমার মাথায় চোট লাগে ।সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ না করে দিব্য চিৎকার করে ওঠে  --- এতবড় স্পর্দ্ধা তোমার ! তুমি আমার মা তুলে কথা বল?

সীমা ধীরে উঠে দাঁড়ায়, তীক্ষ দৃষ্টি তে দিব্যর দিকে তাকায়। দিব্যর রাগ তখনো তুঙ্গে।সে কিছু বলতে যাচ্ছিল, সীমা হাতের ইশারায় তাকে থামিয়ে দিয়ে ওপরের ঘরে চলে যায়।


একটু পরে সীমা একটা স্যুটকেশ আর পার্স নিয়ে নীচে নেবে আসলে দিব্য বুঝতে পারে সীমা ঘর ছেড়ে চলে যাচ্ছে।দিব্য সীমাকে অনুরোধ করে নয়, জোর ফলিয়ে আটকাতে গেলে সীমা বলে --- যে স্বামী স্ত্রী কে মর্যাদা দিতে জানে না তার সাথে ঘর করা যায়না।


শোভন বেশ কিছুক্ষণ ধরে এদের ঝগড়া আড়াল থেকে দেখছিল এবার সে সীমার উদ্দ্যেশ্যে গম্ভীর আওয়াজে ---"দাঁড়াও " বলে সীমার কাছে এগিয়ে গিয়ে সীমার হাত থেকে স্যুটকেশটা নিয়ে দিব্যর হাতে দিয়ে --- এটা ওপরে রেখে এস '। দিব্য মন্ত্র মুগ্ধের মত স্যুটকেশটা নিয়ে ওপরে চলে গেলে শোভন সীমার মাথায় হাত রেখে, স্নেহের সাথে তাকে বলে --- কোথায় যাচ্ছ? আর কেনই বা যাচ্ছ? সব সংসারেই স্বামী-স্ত্রীতে ঝগড়া হয়।তাই বলে কি ঘর ছেড়ে চলে যেতে হয়?এটা তোমার সংসার।এই সংসারে তোমার দিদি শাশুড়ি আর শাশুড়ির যতটা অধিকার, ঠিক ততটাই তোমার ও অধিকার এই সংসারে। সামান্য একটা ভুল বোঝাবুঝির জন্য, তুমি তোমার সংসার, তোমার অধিকার সব ছেড়ে দিয়ে চলে যাবে? কেন ?

সীমা কিছু বলতে যাচ্ছিল,শোভন তাকে বলার সুযোগ না দিয়ে আদর করে নিয়ে এসে সোফায় বসায়। বলে, --- দেখ মা, সংসার আর বাস্তব দুটোই বড় কঠিন।যুগ আর সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে নিজের অভ্যাস আর চিন্তা ধারাকে বদলানো খুব একটা সহজ কাজ নয়। আজ তোমার শাশুড়ি খুব কষ্ট করে নিজের চিন্তা ধারাকে সময়ের সাথে মানিয়ে নিয়ে, তোমার প্রতি তোমার দিদি শাশুড়ির রাগ, অসন্তোষের হাত থেকে সর্বদাই তোমাকে রক্ষা করছে এবং সংসারটাকে আগলে রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু একসময় , যখন সে তার ছেলেকে মানুষ করেছে,তখন তা র পুরনো অভিজ্ঞতা ,--- যেভাবে তার মা কে দেখেছে তার ভাইকে মানুষ করতে --সেই পুরানো দিনের পুত্রস্নেহে, তার সমস্ত কাজ হাতে হাতে করে দিয়েই সে তার ছেলেকে বড় করেছে এবং আজকের যুগের অনুপযুক্ত করে তুলেছে। নিজের কাজ নিজে করে নেওয়া উচিত এবং সেটা যে অসম্মানের নয়, সেই মূল্যবান শিক্ষাটা দিতে ভুলে গিয়েছিল। তুমি তো তোমার শাশুড়ি কে খুব শ্রদ্ধা কর, ভালোবাস, সেই ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা দিয়ে তার এই ভুলটাকে তুমি ক্ষমা করে দিতে পার না?

সীমা অবাক বিস্ময়ে শোভনের দিকে তাকায়,

শোভন আবার বলে, ---- তুমি আজকের যুগের মেয়ে ।একটা সময় আসবে যখন তুমি পুরোনো যুগের হয়ে যাবে।তখন দেখবে সময়ের ব্যবধানে এমন কিছু পরিবর্তন আসবে যেগুলো মেনে নিতে তোমার ও কষ্ট হব। কিন্তু সংসারে শান্তি বজায় রাখতে তোমায় তখন সেই পরিবর্তন কে মেনে নিতে হবে।

সীমা কোন কথা বলেনা, শোভনের দিকে তাকিয়ে তার কথা শোনে।

--- দেখ মা, শোভন আবার বলতে শুরু করে, কোন কিছু ভাঙতে বা নষ্ট করতে বেশি সময় লাগেনা। কিন্তু কিছু গড়তে বা গড়া জিনিষকে সুন্দর করে ধরে রাখতে ধৈর্য্য, প্রচেষ্টা আর সময়ের প্রয়োজন।

সীমা চোখ নামিয়ে নেয়। শোভনের কথাগুলো উপলব্ধি করার চেষ্টা করে।

---- আমি জানি তোমার সেই ধৈর্য্য আছে, আর তুমি পারবে। সব রাগ, অভিমান ভুলে তুমি দিব্যকে তোমার মনের মতো করে,এই সময়ের উপযুক্ত করে তৈরি করে নাও। অধিকার কেউ দেয় না মা, কেড়ে নিতে হয়।এই সংসার এখন তোমার, এখানে তোমার সম্পূর্ণ অধিকার আছে।

সীমা চোখ তুলে শোভনের মুখের দিকে তাকায়।

---- আমি আশীর্বাদ করছি , তুমি সফল হবে। বলে শোভন নিজের ঘরে চলে যেতে গিয়ে দেখে দিব্য দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে। দিব্য কে ভেতরে যাবার ইশারা করে শোভন নিজের ঘরে চলে যায়।

দিব্য ধীরে ধীরে সীমার কাছে এসে, পিছন থেকে তার কাঁধে একটা হাত রাখে।সীমা উঠে দাঁড়ায়।দিব্য তাকে নিজের দিকে টেনে নিয়ে, ---- " সব ভুলে নতুন করে শুরু করা যায় না ? " সীমা দিব্যর বুকে মুখ গুঁজে কেঁদে নিজে হাল্কা হয়।



















Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract